অদ্ভুতুড়ে পর্ব ২

#অদ্ভুতুড়ে
পর্ব-২
আমাদের বাড়িটা সাভারের হেমায়েতপুর। যদিও এই বাড়িতে আমরা এসেছি বছর দু’য়েক হয়েছে। কিন্তু এই দু’বছরের মধ্যে এরকম কোনো সমস্যা এর আগে বাড়িতে হয় নি।
হঠাৎ এমন হওয়ায় মা, বাবা দুজনেই খুব বিচলিত হলেন। রুবা আপুকে নিয়ে শুরু হলো কানাকানি। রুবা আপুর বাবা খুব চটে গেলেন। দোষ চাপালেন আমার মায়ের উপর। মা’য়ের অসচেতনতার জন্য রুবা আপু এমন করেছে। এসব ঘটনায় মা আরও ভেঙে পড়েন। সংসারের সব কাজ কর্ম কাজের লোকের কাছে রেখে মা শুধু জায়নামাজে বসে থাকেন।
আমাকে দেখলে হু হু করে কেঁদে ওঠেন।
এলাকায় রুবা আপুর নামে নানান মানুষ নানান কথা বলেন। কিন্তু রুবা আপুর অনাগত সন্তানের কথা কেউ জানেন না। সেটা শুধু জানি আমি। কিন্তু আমি কাউকে বলতেও পারছি না। আমি বললে সবাই জানতে চাইবে আমি কী করে জানলাম। তাই আমার কাজ হলো সবার আচরণ লক্ষ্য করা। রুবা আপু মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু ব্যাপার আমার চোখে পড়লো। তার মধ্যে আমার ভাইয়ার আচরণ টা একদম চোখে লাগার মতো। যেমন যে রাতে রুবা আপু মারা গেল সে’রাতে ভাইয়া বেশ স্বাভাবিক ছিলেন। আমি যখন অশরীরি কন্ঠস্বর শুনে কাঁপতে কাঁপতে রুবা আপুর ঘরে গেলাম তখন ভাইয়াও এলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ফাহিম?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, কেন যেন মনে হচ্ছে রুবা আপুর খুব বিপদ।
ভাইয়া এরপর রুবা আপুর ঘরে ধাক্কা দিলেন। এর আগে দরজা ভাঙা হয়েছিল বলে ছিটকিনি ছিলো না। একটু জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। রুবা আপু তখন ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। আমি দেখে আর্তচিৎকার করলেও ভাইয়া নিজেকে সামলে নিলেন। আমাকে বললেন, তুই তো আগে থেকেই জানতি রুবা মরে গেছে! তবুও কেন ভেঙে পড়ছিস?
ওই সময় এই কথা নিয়ে ভাবার মতো মানসিক পরিস্থিতি আমার ছিলো না। তবে যেদিন রুবা আপুর বাবা বাড়ি এসে থানা পুলিশের ভয় দেখালেন সেদিন ভাইয়া বিড়বিড় করে বলল, বাটপার! ধুরন্ধর! টাকা পেয়ে সব ভুলে যাবে।
ঘটনাও ঘটলো তাই। রুবা আপুর বাবা আমার বাবার থেকে এক লাখ টাকা নিলেন।
এই ঘটনার পর আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে গেলাম। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করায় সে হাই তুলে বলল, তোর কী সন্দেহ? তোর মানবী আমাকে এসে সব জানিয়ে গেছে?
আমি বললাম, নাহলে তুমি জানলে কী করে?

-বাতাসে জেনেছি।

-বাতাসে কী করে জানলে?

-যেভাবে তুই জানলি।

আমার খুব রাগ হলো। আমি কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করলাম। ভাইয়া শান্ত গলায় বলল, এটা একটা কমন সেন্সের ব্যাপার।

আমি বললাম, কিভাবে?

-দেখ এই যে তুই একটা গল্প বানালি যে তোকে কেউ একজন কানে কানে সব খবর বলে যায় এটা যে আজগুবি গল্প সেটা যেমন সবাই জানে তেমনি এটাও জানে যে রুবা একই রকম ঘটনা আবারও ঘটাবে।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অবিশ্বাস্য গলায় বললাম, আমি আজগুবি গল্প বানিয়েছি?

ভাই হো হো করে হেসে উঠে বলল, তা নয়তো কী? সত্যিই কেউ এসে তোর কাছে সব বলে যায় কখন কী হবে?

আমি অবাক চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া হাসি থামিয়ে বলল, শোন ফাহিম গ্যাস লিকের ঘটনা টা তুই প্রথম যখন বলেছিস তখনই আমার সন্দেহ হয়েছে। আমাদের বাড়িতে মোমেনা বুয়া যে আছে তার কাজ হচ্ছে ভুলে যাওয়া রোগ। সেদিন ও গ্যাস বন্ধ করতে ভুলে গেল। আর তুই হয়তো কোনো একটা কাজে নিচে গিয়েছিস তখন গন্ধ পেয়ে ঘরে চলে এসে গল্পটা বানালি। তারপর বলি দক্ষিণ পাড়ায় আগুন লাগার কথাটা। দক্ষিণ পাড়ায় আগুন লাগার ব্যাপার টা তুই জানলি তোর ঘরের বারান্দায় গিয়ে। বারান্দা থেকে স্পষ্ট আগুনের লালচে রঙ দেখা গেছে। আর রইলো রুবার কথা।
হতে পারে সেদিন রাতে তুই রুবার ঘরে কোনো একটা কাজে গেলি। রুবা দরজা খুলছে না দেখে তুই ভেবে নিলি রুবার বিপদ। আর রুবার ইনসমনিয়া আছে সেটা সবাই ই জানে। রুবা দরজা খুলছে না দেখে সবাই ই কিন্তু ভেবেছে ভিতরে কিছু একটা ঘটেছে।

আর রুবার মৃত্যু? সেটা তো সবাই ই জানে যে রুবা আবারও সুইসাইড করবে। ওর পেটে বাচ্চা ছিলো। বাচ্চাটা মরে গেছে। আর যে ছেলেটার সাথে প্রেম ছিলো সে বিয়ে করবে না তাই ও মরেছে।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ভাইয়া এ কথা যে শুধু আমাকে বলেছে তা নয়। বাকী সবাইকেও এই কথা বলেছে। বাবা সব শুনে আমাকে খুব বকাবকি করলেন। মা’ও অনেক কিছু শুনিয়ে গেলেন। ভাইয়া আরও বললেন, এসব আমি করেছি সবার এটেনশন পাওয়ার জন্য।

আমি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। দিন দিন ডিপ্রেশনে অসুস্থ হতে লাগলাম। ইউনিভার্সিটি তে যাওয়া বন্ধ করলাম। একদিন ইরাও দেখা করতে এসে মা’য়ের কাছ থেকে সব শুনে আমাকে বলল, ভালো একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে।

দিনে দিনে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। রুবা আপুকেও ভুলে গেলাম একসময়। আর ওই কন্ঠস্বর আর শুনতেও পেলাম না।
আমার ওইরকম অবস্থা দেখে ভাইয়া একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে গেলেন। এবারের সাইক্রিয়াটিস্ট ভদ্রলোক কে আমার খুব পছন্দ হলো। ভদ্রলোক আমার সব কথা শুনলেন। শুনে বললেন, আপনার সাথে যেটা হয়েছে সেটার মধ্যে না আছে কোনো রহস্য, আর না আছে কোনো ভৌতিক ব্যাপার। এটা হলো সিক্সথ সেন্স। মস্তিষ্কে যখন চাপ কম থাকে তখন অনেক সময় মানুষের সিক্সথ সেন্স প্রবল হয়। যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন কিংবা দীর্ঘদিন করেন তাদের সাথে এই ধরনের ব্যাপার অহরহ ঘটে। আপনি যাদের বিপদের কথা বললেন, এরা প্রত্যকেই আপনার কাছের মানুষ। অবচেতন মন এদের কথা ভেবেছিল বলেই আপনার সিক্সথ সেন্স বলছিল এদের বিপদ। যেমন ধরুন লুনা মেয়েটার মা, বাবা বাড়িতে নেই সেটা আপনি কোনোভাবে জানতেন। তাই যখন আগুনের ব্যাপার টা চোখে পড়ে তখন আপনার অবচেতন মন জানান দেয় যে লুনার বিপদ।
রুবার ব্যাপার টা’ও তেমন। রুবার বিষন্নতা আপনার অবচেতন মনে প্রভাব ফেলে তাই আপনি মাঝরাতে রুবার ঘরে যান।

সাইক্রিয়াটিস্ট এর কথা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো অপশন আমার হাতে নেই। আমার কাছে কোনো প্রমান ও নেই। তাই চুপচাপ মেনে নিলাম।

আমি এরপর একা একা থাকতে শুরু করলাম। বাড়ির লোকের সাথে কথা বলাও কমিয়ে দিলাম। কথা যা বলার তা একটু রুবা আপুর সাথেই বলতাম। কিন্তু রুবা আপুও নেই তাই সবসময় মন খারাপ লাগে।
তাই কিছুদিন পর থেকে ইউনিভার্সিটি তে যেতে শুরু করলাম। ইউনিভার্সিটি তে এই ব্যাপার টা ইরা ছাড়া আর কেউ জানতো না। ইরা ও আর কাউকে বলে নি তাই আমার জন্য সুবিধা হলো। নাহলে বন্ধুদের উপহাসে ইউনিভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ করতে হতো।
আস্তে আস্তে ডিপ্রেশন কাটিয়ে আমি স্বাভাবিক হলাম। নিয়মিত ক্লাস, এক্সাম এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে লাগলাম। বাড়ির পরিবেশ আবারও স্বাভাবিক। মোমেনা বুয়াকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার বদলে আনা হয়েছে অল্প বয়সী এক মেয়ে হেনাকে। হেনা কাজ করতে গিয়ে এটা, ওটা ভেঙে ফেলে, রান্নায় ঝাল, মরিচ বেশী দেয়। সেটা নিয়ে মা হেনার সাথে খিটখিট করে। তারপর আবারও হেনাকে কাজ শেখাতে লেগে পড়ে। ভাইয়া তার প্রেমিকার সাথে রাত জেগে কথা বলে আর দিনের বেলা ঘুমায়। বিকেলে বাবার কারখানায় একবার সৌজন্য রক্ষায় যায়। আর বাবা বরাবরের মতো ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ঘরে থাকলে এটা ওটা খাওয়ার জন্য ফরমায়েশ দেন আর টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখেন। মোট কথা রুবা আপুকে সবাই খুব দ্রুতই ভুলে গেল। সবাই ই যাপিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু ভুলতে পারলাম না শুধু আমি। খাওয়ার টেবিলে রুবা আপুর চেয়ার টা দেখলে আমার বুকের ভেতর টা হাহাকার করে ওঠে। নাকে,মুখে খাবার গুজে দ্রুত প্রস্থান করার চেষ্টা করি।

——— ——— ———
সেমিস্টার ফাইনাল শেষে বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলো ঘুরতে যাওয়ার। আমিও রাজি হলাম। কারন বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্তত নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা তো পাওয়া যাবে। ভাইয়াও বললেন, হ্যাঁ যা। দেখ এবার একটা প্রেম করতে পারিস কী না! তাহলে রাতে আর কেউ ফিসফিস করে কথা বলবে না।
আমি ভাইয়ার কথার উত্তরে কিছু বললাম না। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। একটু তন্দ্রাভাব আসতেই আবারও সেই কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আবারও সেই অদ্ভুত গা ছমছমে অনুভূতি। এবারের কন্ঠস্বর আরও বেশী আস্তে। ফিসফিস করে বলা, ফাহিম যেও না। ফাহিম যেও না।।
ভয়ে আমি কাঁপতে শুরু করলাম। কিন্তু চিৎকার করলাম না। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি?
কন্ঠস্বর থেমে গেল। একটু পর টেনে টেনে বলল, ফা হি ম তো মা র বি প দ।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি বলুন?
কন্ঠস্বর থেমে যায়। আর কোনো কথা আসে না। আমি আরও চল্লিশ মিনিট বসে রইলাম কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না।

পরদিন আমরা গাবতলি থেকে সাতক্ষীরার বাসে উঠলাম। নাইট কোচের বাস স্ট্যান্ড থেকে রাত এগারো টায় ছাড়লো। বাসে হৈ হট্টগোল করে সবাই যখন একটু ঘুমে আচ্ছন্ন হলো তখনই বাস টা তীব্র ঝাকুনি দিয়ে পড়ে গেল।

প্রচন্ড মাথা ব্যথায় আমি মা’গো বলে চিৎকার করলাম। আধো অচেতন অবস্থায় টের পেলাম একটা কোমল হাত আমাকে টেনে বের করছে।

এরপর আর কিছু মনে রইলো না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here