অদ্ভুতুড়ে শেষ পর্ব

#অদ্ভুতুড়ে
শেষ পর্ব

আমার অবস্থা পাগল পাগল হলো। এসব আমি কী আবিষ্কার করলাম! ভাইয়া আর রুবা আপু! ছিঃ! আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। টেনশন আর অস্থিরতায় অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
আমার মনে হলো এই রহস্য উদঘাটন না করতে পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমার রহস্য উদঘাটনে অনু আমার পাশে থাকবে না। আমাকে রহস্য পর্যন্ত নিজে থেকেই পৌছুতে হবে।

অসুস্থ বলে ভাইয়া আমার খোঁজ নিতে এলো। ভাইয়াকে দেখেই আমার চোখ মুখ শক্ত হতে শুরু করলো। মুখে থুতু জমতে শুরু করলো। ভাইয়া আমার গায়ে হাত রেখে বলল,
-কী রে এখন কেমন আছিস?

আমি চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলাম। ভাইয়া বুঝলো আমার কিছু একটা হয়েছে। বলল,

-তোর কী হয়েছে বল তো? মুড অফ?

আমি সেকথার জবাব দিলাম না। ভাইয়া আবারও বলল, দেশ ছেড়ে যাবি বলে কী মন খারাপ?

আমি নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আর্তচিৎকার করে বললাম, কোথাও যাচ্ছি না আমি। কোথাও না। তোমার সব কুকীর্তি ফাঁস করে তারপর যাব।

ভাইয়া ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, আমার সব কুকীর্তি মানে?

-হ্যাঁ। আমি সব জানি।

ভাইয়াও রেগে গেল এবার। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেল। রাগী গলায় বলল,

-আমি কী এমন কু’কাজ করেছি যে তুই সেটা জেনে গেছিস।

-আমি সব জানি সব।

-কী জানিস তুই?

-তোমার আর রুবা আপুর ব্যাপারে।

ভাইয়া থমকে গেলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে একটু পর আবারও বলল,
-কী জানিস বল?

-তোমরা সবাইকে ধোকা দিয়েছ। একই বাড়িতে থেকে দু’জন সবার আড়ালে প্রেম করেছ। এমনকি রুবা আপুর বাচ্চাটাও যে তোমার সেটাও আমি জানি।

ভাইয়া ফোস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও নিজের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানলাম তোর থেকে।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভাইয়ার একটু আগের রক্তশূন্য মুখে যেন কৌতুক খেলা করছে।

আমি রাগী রাগী ভাব গলায় এনে বলতে চেষ্টা করলাম যে, আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে লাভ নেই।

-কেন তোর কাছে প্রমাণ আছে?

আমি চুপসে গেলাম। সত্যিই তো আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। যা বলছি সব তো অনুমানের উপর ভিত্তি করে।
আমি শুকনো ঢোক গিললাম মাথা নিচু করে।
ভাইয়া হো হো করে উচ্চস্বরে কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বলল, আগে সব কিছু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখ। বুদ্ধিমান হলে নিজেই উত্তর বের করতে পারবি।

ভাইয়ার অপমানে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন মরে যাই। তবুও কেন জানি ভাইয়াকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

আজ অনুকে না ডাকতেই অনু চলে এলো। এসে বলল,
-তোমার ভাইয়া ঠিক ই বলেছে।

-কী ঠিক বলেছে?

-সবকিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখো। সব উত্তর পেয়ে যাবে।

আমার খুব রাগ হলো। বললাম,
-তুমি কেন আমার সাথে এমন হেয়ালি করছ।

-কারণ আমি চাইছি সত্যিটা তুমি নিজে উন্মোচন করো।

-কিসের সত্যি?

অনু বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলো। আমি মাথার চুল দু’হাতে টানতে টানতে বললাম, তুমি কেন পরিস্কার করে সব টা বলছ না।

-আচ্ছা তোমাকে আরেকটা ক্লু দেই তাহলে। রুবা আত্মহত্যা করেছিল তোমার ভয়ে।
আরেকটা কথা জেনে রাখো ফাহিম তোমাদের বাড়িতে সবচেয়ে ভালোমানুষ হলো তোমার ভাই।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। অনু এসব কী বলছে! আমার ভয়ে রুবা আপু কেন আত্মহত্যা করতে যাবে! তবে কী রুবা আপু আমার ভবিষ্যৎ জানতে পারার ঘটনায় ভীত ছিলো। কিন্তু কেন!

হঠাৎই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল এক অজানা আতঙ্কে। রুবা আপুর ভয় পাওয়ার কারণ টা আমি বুঝতে পারলাম। রুবা আপুর বাচ্চার বাবা আমার পরিচিত কেউ ছিলো বলেই কী সে ভয় পেয়েছিলো!

—————————————————

ভাইয়াকে পরদিন দুপুর বেলা একা পাওয়া গেল। ভাইয়া আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও আমি ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম। ভাইয়াকে বললাম, ভাইয়া লাশ দুটো কোথায় আছে?

ভাইয়া সামান্য চমকানোর ভান করে বললেন, কীসের লাশ!

আমি ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-বাবা এই বাড়িতে যখন একা থেকেছেন তখন দুটো খুন করেছে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে অনু। সে আমাকে বলেছে তার লাশ উদ্ধার করার জন্য।

ভাইয়া যেন একটুও অবাক হলেন না। চুপ করে রইলেন। বললেন,

-একটু ভালো করে খেয়াল করতো ফাহিম। তাহলেই বুঝতে পারবি।

রাগে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। সবাই কেন আমার সাথে এমন হেয়ালি করছে। আমি কিছু বলতে যাব তখনই ভাইয়া বলল,
-আমি নিরুপায় ফাহিম। আমি সব জানি কিন্তু বলতে পারব না।

-কেন?

ভাইয়া আমার চোখের দিকে তাকালো। চোখ মুখে এক অব্যক্ত যন্ত্রনার ছাপ। ভাইয়া বললেন,

-মা’য়ের মাথা ছুয়ে কসম খেয়েছি তাই।

আমি রীতিমতো বজ্রাহত হলাম। তার মানে মা’ও জানে। আমাকে দেখে ভাইয়া বুঝে গেলেন যে আমার মনে কী চলছে। সে আমার হাত ধরে বলল,
-ফাহিম আমাদের বাড়ির সবচেয়ে সহজ সরল মানুষ টি তুই। তুই অনেক কিছুই বুঝিস না। কিন্তু আমিও নিরুপায় তাই তোকে বোঝাতে পারি না। তবে সেই লাশ দুটো এই বাড়ির আশেপাশেই আছে। একটু খেয়াল করে খুঁজলেই পেয়ে যাবি তোর উত্তর।

সারাটাদিন আমি এক ঘোরের মধ্যে কাটালাম। আমাদের বাড়ির সব রহস্য বাকীরা জানে। শুধু আমি ই জানিনা।

আমাদের বাড়িটা উত্তরপাড়ার শেষ দিকের বাড়ি। এই বাড়ির পর আর কোনো বাড়ি নেই। অনেকটা দূরে বাড়ি বানানোর কারণ হিসেবে বাবা বলেছিলেন যে তার নিরিবিলি পছন্দ। বাড়ির আশেপাশে অনেক ফলের গাছ লাগিয়েছেন বাবা। লিচু, কাঠাল, আম, লেবু, লটকন সব ধরনের গাছ ই লাগিয়েছে। তিনটা দিন আমি শুধু বাড়ির আশেপাশের সবকিছু দেখতে লাগলাম কোথাও না কোথাও সেই খটকা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে লেবু গাছ তলায় এসে বসলাম। বাড়িটার দিকে তাকালাম। তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে বড়জোর হাত, পা আর কিছু হার গোড় ভেঙে যাবে তাহলে অনু কীভাবে মারা গেল। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা লাগতে শুরু করছে আবারও। কেমন যেন ক্লান্তও লাগছে। আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনার কারনেই বোধহয় ব্রেন ক্লান্ত হয়ে যায়। আমি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার দিকে। মায়ের ডাকাডাকির কারনে। মা রাগারাগি করলেন এখানে এসে ঘুমানোর জন্য। আমি কোনো জবাব দিলাম না। কেন যেন কথা বলতেও ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো। ঘরে এসে বারান্দায় বসে রইলাম। হঠাত বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টিতে আমার লেবু চা খেতে ইচ্ছে করলো। আমি নিচে নেমে গেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন,

-কোথায় যাচ্ছিস এই ঝড় বাদলের মধ্যে?

-লেবুপাতা আনতে যাচ্ছি মা। চা খেতে ইচ্ছে করছে।

মা বিরক্ত গলায় বলল, ঘরে লেবু আছে। চা বানিয়ে দিচ্ছি।

আমি আর গেলাম না। চায়ের জন্য অপেক্ষা করলাম। হঠাৎ ই মাথায় এলো রুবা আপু কখনো গাছের লেবু খেত না। এমনকি ভাইয়াকেও খেতে দেখিনি।

আমি মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া কোথায়?

-বউ নিয়ে কোথায় যেন গেল।

-মা ভাইয়া কী লেবু খায়?

মা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, কেন বল তো?

আমি অস্থির গলায় বললাম, তুমি বলো না?

-বাজার থেকে আনলে খায়। গাছের টা খায় না।

আমার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলো। আমি হড়বড় করে বমি করতে শুরু করলাম,

আমার জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে। বাবা হুংকার দিয়ে বললেন, বাড়িতে আর রাখবেন ই না। বাড়িতে থাকলে আমি দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব।
আমি বুঝলাম যে আমার সময় কম।
আমি অনুকে ডাকলাম। অনু আজ একবার ডাকতেই চলে এলো।
আমি অনুকে জিজ্ঞেস করলাম,

-এখন আমি কী করব অনু?

-তোমার বিবেচনায় কী বলে?

-আমি পুলিশ কে জানাবো সব।

-আচ্ছা।

-অনু তুমি কী আমাকে সব টা খুলে বলবে?

-আমি ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আরাফাত নামের এক ছেলের সাথে। যে কী না তোমার বাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। কথা ছিলো বাড়ি থেকে আমি বেশী করে টাকা , পয়সা আর গয়না নিয়ে আসব। কিন্তু সেসব কোনো কিছুই আনতে পারিনি। কয়েকটা জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই আনিনি। আরাফাতের হাতেও বাসা ভাড়া করার মতো টাকা নেই। তারপর তোমার বাবার শরনাপন্ন হলেন। তোমার বাবা এই বাড়িতে থাকতে বললেন। আমরা এখানে এসে নিচতলার এক রুমে সংসার পাতলাম। মাস খানেক পর তোমার বাবা বাড়িতে আসলেন। আরাফাত কে কি একটা কাজে পাঠিয়ে সে বসে রইলেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্যহীন কথা বার্তা, আর চাহনী কোনটাই ভালো লাগলো না। একসময় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। সে বলল, আরাফাত আজ রাতে ফিরতে পারবে না। আর উনিও যেতে পারছেন না। উনি এখানেই থাকবেন। আমি ভয় পেয়ে উপরের একটা ঘরে চলে এলাম। কারণ নিচে আমরা যে ঘরে থাকতাম সে ঘরের ছিটকিনি নষ্ট ছিলো। ঘরে এসে দরজা লাগানোর পর তোমার বাবা দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। এক সময় মনে হলো দরজা ভেঙে ফেলে উনি আসতে পারে। তাই আমি দৌড়ে ছাদের দিকে গেলাম। বৃষ্টি কেবল তখন একটু থেমেছে। আমি জানতাম যে ওখান থেকে লাফিয়ে পড়লে আমি মারা যাব না। আমি ছাদ থেকে লাফ দিলাম।

অনু এইটুকু বলে থেমে রইলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-তারপর?

-তোমার বাবা ক্ষোভে কিংবা জেদে আমাকে মাটি চাপা দিলো বাড়ির কেয়ারটেকার কে ডেকে। এরপর আরাফাত কেও মেরে ফেলে ঝামেলা এড়ানোর জন্য। একই ভাবে ওকেও মাটিচাপা দিয়ে রাখে।

আমি দু’হাতে মুখ ডেকে কেঁদে ফেললাম। অনু বলল,

-সত্য কখনো চাপা থাকে না ফাহিম। তোমার ভাইয়া ব্যাপার টা জেনে গিয়ে খুব ঝামেলা করেছিল। এতে তার বিপদ বাড়তে পারে ভেবে তোমার মা তাকে চুপ করে দেয়।

-আর রুবা আপুর ব্যাপার টা?

-রুবার বাচ্চাটাও ছিলো তোমার বাবার। রুবার ফ্যামিলিগত প্রবলেমের সময় তোমার বাবা কৌশলে সম্পর্ক স্থাপন করেন এরপর ব্ল্যাকমেইল করে। তুমি পর পর দুটো ঘটনা জেনে যাওয়ায় রুবা ভয় পেয়েছিল যে কোনোদিন হয়তো তুমি ওর ব্যাপার টা’ও জেনে যাবে। তাই ও ভয় পেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়।

আর তোমার ভাইয়া সারারাত ফোনে কথা বলতো এই কারণে কারণ সে জানতো যে রুবা এই ধরনের কাজ করতে পারে।

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। অনু আবারও বলল,

-সেদিন গ্যাস লিক করার কাজ টা’ও রুবা করেছে ফাহিম। সে ডিপ্রেসড ছিলো। তাই সে চাইছিলো নিজে মরার সাথে সাথে সবাইকে মেরে ফেলতে।

আমি মূর্তির মতো বসে সব টা শুনতে লাগলাম।

-আমি এই ব্যাপার টায় তোমাকে ব্যবহার করেছি কারণ তোমার ভাইয়ার হাত পা বাধা ছিলো। তাই তোমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য আগাম বিপদসংকেত দিতাম তোমাকে। আর লুনার ব্যাপারে তোমার বাবার কোনো হাত ছিলো না। তবুও পুরোনো ঘটনা তুলে আনার জন্য ওই বাড়িটি ব্যবহার করেছিলাম।

-আর লুনার মৃত্যু?

-তাতে আমার হাত নেই ফাহিম।

পরিশিষ্টঃ বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি তার সামনে ছিলাম না। আমি তখন নিজের ঘরে বসে ছিলাম। ভাইয়া এসে বলল, ফাহিম তুই কী সত্যিই দেশ ছেড়ে যাবি?

-হ্যাঁ। প্লিজ আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।

আমি দেশ ছেড়েছিলাম অনেক বছর আগে। তারপর আর ফেরা হয় নি। বাবা ক্ষমতার জোরে ছাড়া পেয়েছিল বছর দু’য়েক পরেই। সে কারনেও আমি আর যাই নি। মা মারা গেছেন। ভাইয়া বলেছিল এবারও আসবি না?
আমি বলেছিলাম না।

এরপর অনেক দিন পরের কথা। আমি তখন ভার্জিনিয়া শহরের দুটো রেস্টুরেন্টের মালিক। এক সন্ধ্যায় বাঙালী এক মেয়ে এলো সোনালী রঙা শাড়ী পরে। নিজের দেশের লোক বলেই এগিয়ে গেলাম পরিচিত হতে। কিন্তু কাছ থেকে মেয়েটাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে রইলাম। এটা তো অনু। মেয়েটা আমাকে দেখে হেসে বলল, হাই আমি অনন্যা অনু। আপনিও বুঝি বাঙালী!!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here