বন্ধ দরজা পর্ব ২৬

বন্ধ দরজা
পর্ব- ২৬
লেখা-মিম
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। পাশাপাশি শুয়ে আছে তানভীর সুহায়লা। সুহায়লা ফেইসবুক চালাচ্ছে আর তানভীর কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সুহায়লার ভাই বোনদের খুব কাছ থেকে দেখেছে আজ ও। সাথে ইমরানকেও। কত্ত মিল ওদের মাঝে। ওদের দেখে মনে হয়েছে তানভীর সেখানে থেকেও নেই। ওদের মতো তানভীর না। ওরা সবাই কতটা গল্প আর হাসাহাসিতে মেতে ছিলো। আর সে নিজে? ওদের মতো করে মিশতে চাচ্ছিলো খুব। কিন্তু পারেনি। নিজের মধ্যে জড়তা কাজ করছিলো। ও কখনো সেভাবে কারো সাথে মিশেনি। এত বড় ফ্যামিলি তানভীরের ছিলো না। বাবা, মা আর সে। মাত্র তিনজনের ঘর। একটাসময় অনেক বন্ধু ছিলো। অনেক হৈ হুল্লোর করতো। এরপর একদিন মা চলে গেলো। ধীরে ধীরে বন্ধুদের কাছ থেকেও সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। চার পাঁচটা বন্ধু বাদে বাকি সবাই ওর খারাপ সময়ে ওকে নিয়ে রঙ তামাশা করেছে। এমন বন্ধু দিয়ে কি করবে ও যারা ওর এতটা দুঃসময়ে খোঁচা মেরে কথা বলতে এতটুকু ছাড় দেয়নি। যাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো ওদের সাথে এরপর কখনো সেভাবে মেতে উঠেনি তানভীর। এজন্যই হয়তোবা আজ জড়তা কাজ করছিলো ওর মাঝে। চোখ বন্ধ রেখেই সুহায়লাকে তানভীর বললো,
-” তোমাদের ভাই বোনদের মধ্যে খুব মিল তাই না?”
-” হুম।”
-” ইমরানের সাথেও কত ভালো সম্পর্ক তোমাদের। ছেলেটা তোমাদের মতই। খুব ভালো মানুষ ও। প্যাঁচগোচ ছাড়া।”
-” হুম।”
-” তোমরা একসাথে থাকলে খুব মজা করো তাই না?”
-” হুম।”
তানভীর খেয়ালকরলো সুহায়লা কখন থেকে হুম হুম করছে। কথায় মনোযোগ নেই ওর। কি করছে ও? চোখ মেলে দেখে সুহায়লা ফোন গুতাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। খানিকটা চটে গেলো তানভীর। সুহায়লা ওকে ইমপরটেন্স দিচ্ছে না। তার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো তানভীর। সুহায়লা বেশ অবকক হয়েছে তানভীরের এমন কান্ডে। তানভীর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সুহায়লার দিকে।
-” এমনভাবে তাকিয়ে আছো মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলবা আমাকে। সমস্যা কি?”
-” তোমার সমস্যা কি সেটা বলো?”
– ” আমার আবার কি সমস্যা হবে?”
-” তোমার হাতে ফোন দিয়েছি তারমানে এই না যে তুমি আমাকে ফেলে ফোন নিয়ে পড়ে থাকবে। আমাকে এভাবে ইগনোর করার মানে কি?”
-” ইগনোর কোথায় করলাম?”
-” তুমি আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছি আর তুমি হুম হুম বলছো ফোন গুতাচ্ছো। কেনো? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না?”
-“তুমিও তো চোখ বন্ধ করে কথা জিজ্ঞেস করছিলে।”
-” একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না আমার সাথে। তর্ক আমার পছন্দ না।”
-” তর্ক করলাম কোথায়?”
-” ইশশ! ন্যাকা! তর্ক করলাম কোথায়! তর্ক করছো না তো কি করছো?”
” ঠিকাছে করলাম না।”
কথাটা বলেই সুহায়লা অন্যপাশে ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। তানভীরের আরো রাগ উঠছে। প্রচন্ড রকমে ইগনোর করছে তাকে সুহায়লা। সুহায়লার কাঁধে টেনে এপাশে ফিরালো তানভীর।
-” খুব দাম বেড়ে গেছে না? তানভীর পিছন পিছন ঘুরছে তাই বেশি উড়ে গেছো? ডানা একদম কেটে দিবো। বুঝেছো?”
সুহায়লা কোন উত্তর দিচ্ছে না। খুব শান্ত চোখে ওকে দেখছে। তার কাছে তানভীরের এমন হুটহাট খারাপ ব্যবহার পানি ভাতের মতো। খুব বেশি অভ্যস্ত এই ব্যবহারের সাথে সে।
-” কথা বলো না কেনো? মুখ নেই তোমার? আমার সাথে কথা বলতে মন চায় না? তামাম দুনিয়ার মানুষের সাথে তো ভালোই হাসি তামাশা করতে পারো। আমার সাথে করতে কি সমস্যা? বুড়ো হয়ে গেছি? বুড়ো লোককে কি ভালো লাগে না?”
সুহায়লার এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। উঠে বসে সেও বেশ চড়া গলায় তানভীরকে বলতে লাগলো,
-” কার সাথে হাসি তামাশা করেছি আমি? আর যদি করেও থাকি তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? তোমার সাথে তো জীবনে কম করার চেষ্টা করিনি। তোমারই হাসি তামাশা করতে মজা লাগে না। যতবারই করতে গিয়েছি ততবারই তো বলেছো আমি নির্লজ্জের মতো তোমার গায়ে পড়ে কথা বলতে আসি। এখন তুমি যে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসো সেটা কি? এটা কি নির্লজ্জতা না? আর কথায় কথায় বুড়া বুড়া করো কেনো? আজ পর্যন্ত শুনেছো তোমাকে আমি এ কথা বলেছি? বরং উঠতে বসতে তুমি আমাকে বলেছো আমি পিচ্চি, তোমার সাথে আমার যায় না। ২৭-২৮ বছরের মেয়ে তোমার জন্য পারফেক্ট ছিলো। কি যেনো মেয়েটার নাম? তোমার ক্লাইন্টের মেয়ে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে প্রিয়া। প্রায়ই ঐ মেয়ের সাথে আমাকে তুলনা করতে। ওর বয়সী বউ নাকি তোমার প্রয়োজন ছিলো। ওর মতো স্মার্ট, রিচ ফ্যামিলির মেয়ে তোমার দরকার ছিলো। তোমার স্ট্যাটাসের সাথে যায়। সেই হিসেব করতে গেলে আমার বয়স স্ট্যাটাস সব নিয়ে তুমি আমাকে ছোট করেছো।আমি তো কখনো অভিযোগ করিনি। আর আমি তো কখনো বলিনি তুমি বুড়া এটা সেটা। তাহলে বারবার এক কথা কেনো বলো? কি শুনতে চাও তুমি? আমার মুখ থেকে শুনতে চাও যে তুমি বুড়ো। হ্যাঁ তুমি বুড়ো। তুমি একটা বুড়ো ইবলিশ। ভালো সাজার যতই নাটক করো না কেনো তুমি জীবনেও ভালো হবা না। তুমি ইবলিশ ছিলা আজীবন তাই থাকবা। আসলে কি জানো? আসিফ আমার জন্য একদম পারফেক্ট একটা ছেলে ছিলো। যথেষ্ট ইয়াং ও। তোমার মতো বুড়ো না। আমার পাশে ওর মতো ছেলেকেই মানায়। তোমার মতো বুড়োকে না। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে আমি ওকেই বিয়ে করবো। ”
কথাটা বলেই সুহায়লা পা বাড়িয়েছে অন্য রুমে যাবার জন্য। তানভীরের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। বিছানা ছেড়ে নেমে এসে সুহায়লা পথ আগলে ওর গলা চেপে ধরলো তানভীর।
-” কি বললি তুই? আবার বল।”
সে এতটাই জোরে চেপে ধরেছে যে কথা গলা থেকে বেরোনো থাক দূরের কথা, নিঃশ্বাসটাই সুহায়লা ঠিকমতো নিতে পারছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেছে এমন মনে হচ্ছে। শত চেষ্টায়ও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না সুহায়লা। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসছে।
-” কি রে? এখন মুখ থেকে কথা আসে না? আসিফের কাছে যাবি? খুব শখ হচ্ছে যাওয়ার তাই না? তুই তো ছোটলোকের বাচ্চা। তুই ঐ তনুর মতই একটা ছোটলোকের বাচ্চা। তোর মত ছোটলোক এই ঘরে থাকার কোনো দরকার নেই। তুই থাকা মানে ঘর নোংরা হওয়া। এক্ষুনি ঘর থেকে বের হ তুই।”
কথাটা বলেই সুহায়লাকে সজোরে ধাক্কা মারলো তানভীর। ড্রেসিং টেবিলের কর্নারে কপাল যেয়ে ঠেকলো। গতকাল এক্সিডেন্টে যে জায়গাটায় ব্যাথা পেয়েছিলো ঠিক সেখানেই ব্যাথা পেয়েছে সে। কপাল ফেটে ফের রক্ত বেরোচ্ছে। মাথাটা প্রচন্ড রকমে ঘুরিয়ে উঠলো তার। চোখের সামনে ধীরে ধীরে সমস্ত কিছু অস্পষ্ট হয়ে উঠছে ওর। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে। তানভীরের সামনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগলো তানভীরের ঘটনা কি ঘটেছে সেটা বুঝতে। সুহায়লার কপাল রক্ত ঝড়তে দেখে তানভীরের এতক্ষনে হুঁশ হলো মেয়েটা অসুস্থ ছিলো। গতকালই কপালে তিনটা সেলাই পড়েছে। আজ এক্স্যাক্টলি সেখানেই আবার ব্যাথা দিয়েছে সে। কি করলো এটা? ও তো এমনিতেই অসুস্থ ছিলো। এখন যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে? মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে তানভীরের। গুটি গুটি পায়ে সুহায়লার পাশে ফ্লোরে যেয়ে বসলো সে। সুহায়লার গালে আলতো করে ধাক্কা দিচ্ছে তানভীর।
-” এই তাকাও।”
-“………”
-” কি বলছি? তাকাচ্ছো না কেনো?”
-” …………”
-” সুহা…… এই সুহা…… চোখ মেলে তাকাও।”
-” ……..”
-” দেখো আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি। প্লিজ তাকাও আমার দিকে।।”
সুহায়লাকে নড়াচড়া করতে না দেখে তানভীরের মনে হচ্ছে তার বউ বোধহয় মরে গেছে। পুরো শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে ওর। কি করবে না করবে খুঁজে পাচ্ছে না। খাটের উপর থেকে ফোনটা কোনোমতে হাতে নিয়ে ফাহিমকে ফোন করলো তানভীর। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো ফাহিম।
-” কি রে এতরাতে ফোন করেছিস কেনো? কোনো সমস্যা?”
-” সু….. সুহায়লা…..”
-” কি হয়েছে ওর? অসুস্থ হয়ে গেছে আবার?”
-” আমি…. আমি বোধহয় ওকে মেরে ফেলেছি।”
-” কি বলছিস পাগল ছাগলের মতো?”
-” তুই আয়….. আয় না প্লিজ। একটু দেখে যা না ও বেঁচে আছে কিনা?”
-” তানভীর তুই কি ড্রিংক করেছিস?”
-” না, সুহায়লাকে বোধহয় আমি মেরে ফেলেছি। এখন কি হবে? ওকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? এক কাজ করি আমিও মরে যাই?”
-” তানভীর তুই কিচ্ছু করবি না। যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক। আমি আসছি।”
ফোনটা কেটেই পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো ফাহিম। বের হওয়ার সময় নিশাত কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। কোনো উত্তর দেয়নি ফাহিম। উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না সে। রাস্তা ফাঁকা ছিলো তাই পৌঁছুতে মাত্র সাত মিনিট লেগেছে। সমানে কলিংবেল চেপে যাচ্ছে ফাহিম। নয়ন ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে কিছুক্ষন বাদে গেইট খুলে দিলো। দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে তানভীরের রুমে আসলো ফাহিম। এসে দেখে সুহায়লাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে সুহায়লার কপাল চেপে ধরে রেখেছে তানভীর। দুচোখ বেে পানি ঝড়ছে ওর। একদম নিঃশব্দে । ফাহিমের চোখ কপালে উঠে গেছে এত রক্ত দেখে।
-” কি রে ? এমন হলো কিভাবে?”
তানভীর কোনো কথা বলছে না। এক নজরে সুহায়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তানভীরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে ফাহিম জিজ্ঞেস করলো
– তানভীর, কি হেয়েছে ওর? কি করেছিস তুই ওর সাথে?”
-” ওকে গলা চেপেধরেছিলাম। এরপর ধাক্কা দিয়েছি। আচ্ছা ও কি মরে গেছে?”
এই মূহূর্তে তানভীরকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে ফাহিমের। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। অলরেডি অনেক ব্লিডিং হয়ে গেছে। ওকে হসপিটাল নিতে হবে। পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো ওর বন্ধু আসাদকে। হসপিটালে আসতে বলছে ওকে। সুহায়লার ট্রিটমেন্টআসাদকে দিয়ে করাবে ফাহিম। যদিও আসাদ ঘন্টাখানেক আগেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে । কিন্তু সে ফাহিমের কথায় আবার আসতে রাজি হয়েছে।
-” তানভীর, সুহায়লাকে এক্ষুনি হসপিটাল নিতে হবে। আর নয়তো সত্যিই মরে যাবে। উঠ। ওকে কোলে নে। নিচে নাম জলদি। আমি যেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি।”
ফাহিের কথায় খানিকটা সাহস পাচ্ছে তানভীর। সুহায়লাকে কোলে তুলে নিচে নেমে এলো তানভীর গাড়ির পিছনের সিটে সুহায়লাকে নিয়ে বসেছে তানভীর। এখনও শক্ত করে বুকে ধরে রেখেছে তানভীর। গায়ের হালকা আকাশি রঙা গেন্জিটা লাল রক্তে ভিজে যাচ্ছে। আর তানভীরের চোখের পানিতে সুহায়লার গাল ভিজছে।
(চলবে)

.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here