#অদ্ভুতুড়ে
পর্ব- ৩
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বাবা মা দুজনেই মাথার পাশে বসে কাঁদছেন। আর ভাইয়া আমার পায়ের কাছে দাঁড়ানো। আমাকে চোখ খুলতে দেখে ভাইয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ওই তো ফাহিমের জ্ঞান ফিরেছে। বাবা, মা আমার জ্ঞান ফিরেছে বলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে এখানে কে এনেছে?
কেউ বলতে পারলো না কে এনেছে। এম্বুলেন্সে করে অন্য রোগীদের সাথে নিয়ে আসা হয়েছিল। অথচ আমার স্পষ্ট মনে পরে কেউ একজন আমায় টেনে বের করেছিল। আমি কাউকে এ ব্যাপারে বললাম না। বন্ধুদের খবর নিতে গিয়ে জানলাম ইরার পা ভেঙে গেছে, আর মাথাও ফেটে গেছে অনেকখানি। বাকীরাও আমার মতো অবস্থা। আল্লাহর রহমতে কেউ মারা যায় নি। তবে বুলবুল নামে আমাদের যে বন্ধুটা ছিলো ওর নাকি মাথা, চোখে কাচ ঢুকে গেছে। ভয়াবহ অবস্থা!
সপ্তাহ দু’য়েক হসপিটালে থেকে আমি বাড়ি আসলাম। মা একটু সময়ের জন্যেও কাছছাড়া হয় না। আর আমি সুযোগ খুঁজে বেড়াই রাতে একা থাকার। অনেক কষ্টের পর একা থাকার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাবার হঠাৎই ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় সেদিন আর রাতে মা থাকলেন না। আমি সে’রাতে অনেকক্ষন জেগে রইলাম কিন্তু সেই অশরীরী কন্ঠস্বরের হদিস পেলাম না।
শরীরের ক্ষত পুরোপুরি সেড়ে ওঠেনি বলে মা ঘর থেকে বের হতে দেন না একদম ই। সারাদিন ঘরে শুয়ে, টিভি দেখে সময় যেন আর কাটতেই চায় না। হঠাৎ একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে লুনা দেখতে আসলো। লুনাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব একটা পছন্দ করি না। কারণ লুনা স্বভাবে বেশ কঠিন আর নিষ্ঠুর। লুনা আমাকে দেখে হেসে বলল, শুনলাম তুমি নাকি আজকাল ভুত দেখো? আর ভুত নাকি এসে সব ভবিষ্যৎ বলে যায়?
আমি দাঁতে দাঁত চেপে লুনাকে সহ্য করলাম। নেহাৎ বাড়ি পর্যন্ত এসেছে বলে চুপ করে থাকলাম।
লুনা আরও কিছুক্ষণ ঠেস দিয়ে কথা বলে যাওয়ার আগে বলল, যাই আমার আবার কম্পিউটার কোচিং আছে। আর তোমার ভুত কে আমার হয়ে থ্যাংকস বলে দিও।
আমি মনে মনে লুনাকে অশ্রাব্য গালি দিলাম। ভাগ্যিস মনের কথা লুনা শুনতে পেল না!
লুনা চলে যেতেই আবারও সেই অশরীরী কন্ঠস্বর! তবে এবার অনেক টাই স্পষ্ট। আমাকে বলল, ফাহিম লুনা একটা বাজে মেয়ে। ও এখন কম্পিউটার ক্লাসে যাচ্ছে না।
আমি এবার আগের থেকেও বেশী ভয় পেলাম। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম দ্রুত। রাগী গলায় বললাম,
-আপনি যদি আমার সামনে না আসেন তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো। আমার ওষুধের কৌটোয় কিন্তু কিন্তু ঘুমের ওষুধ আছে।
কিছুসময় পিনপতন নীরবতা। তারপর রিনরিনে হাসির শব্দ পেলাম বারান্দা থেকে। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে এগিয়ে আমার ঘরের দিকে আসছে। এমনভাবে আসলো যেন মনে হলো পাশের ঘর থেকে এসেছে।
আমি ভয় পেলাম খুব। হাত, পা কাঁপছে অনবরত। মেয়েটা আমার সামনে এসে সহজ সাবলীলভাবে বলল,
-এতো বিশ্রী গালি কোথা থেকে শিখলে ফাহিম?
আমার গলা শুকিয়ে গেছে। মুখে থু থু জমছে। ফুল স্পিডে ফ্যান চলা স্বত্তেও সমানে ঘামতে শুরু করলাম।
অস্ফুটস্বরে মাকে বার দু’য়েক ডাকলাম। মনে পড়লো মা নতুন কাজের মেয়েটাকে নিয়ে সামনের বাজারে গেছেন।
——————————————
ভয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখি মেয়েটা সামনের চেয়ারে বসে আছে। আমি উঠে বসে জগ থেকে পানি খেলাম। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনি কে?
-আমি অনু
আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী ভুত?
মেয়েটা নির্বিকার গলায় বলল, হ্যাঁ। আমি দুই বছর আগে মারা গেছি।
আমি বিশ্বাস করলাম না। বললাম,
-আপনি মিথ্যে বলছেন। সাইন্স বলে ভুত বলে কিছু নেই।
-তোমার বিজ্ঞান তো আল্লাহ কেও বিশ্বাস করে না। তাদের ভাষ্যমতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে বিগব্যাং থেকে। তুমি কী বিশ্বাস করো সেটা?
আমার শুকনো ঢোক গিললাম। বললাম, আপনি আমার কাছে কী চান?
-আমার কিছুই চাওয়ার নেই।
-তাহলে আমার আশেপাশে কেন থাকেন?
মেয়েটা মৃদু হাসলো। আবারও সেই ফিসফিস কন্ঠস্বরে বলল, তোমাকে বাঁচানোর জন্য।
-কিন্তু কেন?
-ভালো লাগে তাই।
আমি এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মেয়েটা হঠাৎই বলল, আজ গেলাম।
আমি স্থির চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল,
-ফাহিম শোনো, লুনা মেয়েটা বাজে মেয়ে। রোজ কম্পিউটার ক্লাসের নাম করে ওর ছোটবোনের টিচারের বাসায় যায়। তুমি ওই মেয়েটাকে পছন্দ করো বলে তোমাকে সাবধান করলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম। লুনার প্রতি আমার দূর্বলতা আছে সেটা সত্যি আর লুনা আমাকে পাত্তা দেয় না বলে ওর আর উপর রাগ ও আছে।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনার নাম কী?
-অনু।
-আমার এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকী যে!
আবারও আসবো। কোনোরকম পাগলামী কোরো না। সামনে তোমার ভাইয়ের বিয়ে।
এইটুকু বলে হঠাৎই যেন গায়েব হয়ে গেল। মেয়েটা যেতেই ভাইয়া ঘরে ঢুকে বলল, কার সাথে কথা বলছিলি ফাহিম?
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
-কী হলো কার সাথে কথা বলছিলি?
-ভাইয়া তুমি কী ওই আপুটাকে বিয়ে করছ? যার সাথে রোজ রাতে কথা বলো?
ভাইয়ার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, তোকে কে বলেছে এসব?
আমি ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললাম, বিয়েতে কী খাসির রেজালা হবে?
ভাইয়ার বিয়ের খবর মা বাবার কান অব্দি নিয়ে গেলাম বিয়ের দুদিন পর। বাবা, মা দুজনেই মেনে নিলো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যপার হলো ভাইয়া বিয়ে করেছে এক রিকশাওয়ালার মেয়েকে। মেয়ের বাড়ি মোহাম্মদপুর। মকবুল হোসেন কলেজে অনার্স পড়ছে। মেয়ের বাবা রিকশা চালায় আর মা চায়ের দোকানে কাজ করে। মা প্রায় মূর্ছা গেলেন বউ দেখে। বাবাও আহত হলেন কিন্তু তবুও দুজনে মেনে নিলো।
এই প্রথম বাড়ির পরিবেশে আমার বেশ মজা লাগতে শুরু করলো। আমি মনে মনে চাইলাম রাতে অনু আসুক। অনুর কাছে অনেক কিছু জানার আছে।
রাতে সত্যিই অনু এলো। এসে বলল,
-তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি ফাহিম। ওয়েল ডান মাই ডিয়ার।
আমি গলার শ্লেষ্মা পরিস্কার করে বললাম, আপনার কাছে একটা ব্যাপার জানার ছিলো।
-আমি জানি তুমি কী জানতে চাও!
-কীভাবে জানেন?
-কার মনে কী আছে আমি সব জানি।
কেন যেন হঠাৎ ই আমার ভয় কেটে গেল। আমি বললাম,
-আচ্ছা বলুন তো আমাদের বাড়ির মানুষগুলোর মনে কী চলছে।
-তোমার মা এখন আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের কথার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। মনে মনে দুইবার তোমার ভাইয়ের বউকে খা*কী বলে গালি দিয়েছেন। তোমার বাবা ভাবছেন তার বিজনেস নিয়ে। কিছুদিন আগে আশুলিয়ায় একটা জমি কিনেছেন সেটা নিয়েও ঝামেলায় আছেন। আর তোমার ভাবী মনে মনে বিরক্ত হচ্ছেন তোমার ভাইয়ের উপর। কেন বিরক্ত হচ্ছেন সেটাও বলবো।
-না।
লজ্জায় আমার দু’কান লাল হয়ে গেল। আজ ভাইয়ার বাসর রাত।
-শেষ হয় নি। তোমাদের কাজের মেয়েটা বেশ ধুরন্ধর। কাল সে তোমার মানিব্যাগ থেকে সাতচল্লিশ টাকা চুরি করেছে। আজ রাতে তার প্ল্যান হলো তোমার ফোন চুরি করে তোমার ভাবীর মাথায় দোষ চাপাবে।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, কী সাংঘাতিক!
-হ্যাঁ। এই মেয়েটা প্ল্যান করেছে তোমাকে বিয়ে করবে।
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, কী?
-হ্যাঁ। অনেকদিন থেকে প্ল্যান ছিলো রাতে তোমার ঘরে এসে জামা কাপড় খুলে তোমার পাশে শুয়ে থাকবে। তারপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা অংকের টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে।
কিন্তু তোমার ভাই বস্তিতে বিয়ে করায় তার প্ল্যান বদলে গেছে।
আমি খুক খুক করে দুবার কাশলাম।
-আর কিছু জানতে চাও?
আমি কী বলবো খুঁজে পেলাম না। কিন্তু চাইছিলাম মেয়েটা অনেকক্ষন থাকুক। আমি বললাম, আমার মনে কী চলছে বলুন তো?
-গত তিনদিন ধরে তোমার মনে শুধু দুটো শব্দই ঘুরছে।
অনু!!
আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম।
চলবে…..