#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২১
#তাশরিন_মোহেরা
মুখরের মা ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আমি করুণভাবে চেয়ে আছি এক দুঃখে জর্জরিত জননীর দিকে। এক ছেলে তার বিছানায় আহত হয়ে পড়ে আছে আর অপরজন পাড়ি জমিয়েছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। দুই সন্তানের কষ্ট মহিলাটি কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। না জানি তার উপর কি যাচ্ছে!
কিছুক্ষণ পর মুখরের মায়ের জন্য এক কাপ কফি এনে তার কাছে এগিয়ে দিলাম। তিনি কান্না থামিয়েছেন, তবে তার ভেঙে পড়াটা দৃশ্যমান। সেই ভেঙে যাওয়া চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। অতি শুষ্ক এক হাসি হেসে তিনি আমার হাত ধরে তার পাশে বসালেন। তার পাণ্ডুর মুখখানা দেখে আমার বুকের ভেতরেও ঝড় বইছে! আমি চুপচাপ বসে আছি। তিনি আমার হাতের উপর হাত রেখেই বললেন,
‘তুমি নিশ্চয়ই মুগ্ধের ম্যাম, তিথিয়া তাই না?’
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘জ্বি!’
তিনি আমার হাতখানা বুলিয়ে বললেন,
‘তোমার সাথে ঠিকমতো পরিচয়টাও হলো না, মা! কিছু মনে কোরো না। তবে আমার ছেলে দুইটা সবসময় তোমার কথা বলে।’
আমি খানিক অবাক হলাম। মুগ্ধ আমার ব্যাপারে বলে তা মানা যায়, কিন্তু মুখর আমায় নিয়ে তার মা’কে বলে তা কেন যেন বিশ্বাস হলো না।
তিনি আবারো বললেন,
‘আমার ছেলে দুটো আজ কেমন মৃত্যুর সাথে লড়ছে, দেখেছো? আমার বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি আমার দায়িত্ব পালনে বিফল, মা!’
তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমার চোখ বেয়েও অবারিত পানি ঝরছে। বাধভাঙ্গা এ পানিদের থামানো দায়। তাও চোখ জোড়া মুছে বললাম,
‘আপনি মোটেও বিফল নন। বরং একজন সাহসী মা। দুই ছেলেকে একা হাতে সামলেছেন সাত বছর, স্বামী ছাড়া। আপনি কিছুতেই বিফল হতে পারেন না, আন্টি।’
আমায় কথায় আন্টি বোধহয় কিছুটা দমলেন। তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন,
‘আমার বড় ছেলে মুখর অনেক কষ্ট সহ্য করেছে, মা। আমি জানি তার হৃদয় এতোদিনে পাথরে পরিণত হয়েছে! এতো কষ্টের মাঝে এখন মুগ্ধের এই অবস্থা দেখে ছেলেটা নিজেকে কি করে সামলাবে? বলো তো!’
কথা বলতে গিয়েও মানুষটার গলা কাঁপছে। সাথে ঠোঁট ভেঙে কান্না পাচ্ছে আমারও। আমি জানি মুখর অনেক কষ্ট মনে দেবেছিল। কিন্তু কখনো তার কষ্ট দেখার সুযোগ কিংবা সাহস কোনটিই আমার হয়নি। আমি বললাম,
‘মানুষটার জীবনে নিশ্চয়ই অনেক কিছু হয়ে গেছে, তাই না?’
তিনিও মাথা দুলালেন। ওড়না দিয়ে চোখ জোড়া বারবার মুছছেন। কিন্তু কিছুতেই চোখের পানিগুলো শুকোচ্ছে না। ওড়নার অর্ধাংশই ভিজে গেছে আন্টির।
মুগ্ধের এমন আচমকা গুলি লাগা, মুখর সাহেবের কোথাও চলে যাওয়া এসব কিছুই আমাকে একটা দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বারংবার। সেদিনের অজানা নাম্বার থেকে আসা মেসেজটি। যাতে সে ব্যক্তি বলেছিলো মুখর সাহেবই তার বাবাকে মেরছেন। কিন্তু মুখরের ভেতরকার কিছুই আমার জানা নেই বলে তাকে অযথা সন্দেহ করাটাও উচিৎ না। তবে মুখরের অতীত জানার একটা আগ্রহ আমার প্রথম থেকেই কাজ করেছিলো। তাই আন্টিকে পেয়ে সেই কৌতুহলটা আর আটকে রাখতে পারলাম না। তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
‘কিছুদিন আগে, মুখর সাহেবের ফোনে একটা মেসেজ এসেছিলো। সেখানে লিখা ছিলো, মুখর সাহেব তার বাবাকে মেরেছেন। আর এর জন্য তার জটিল এক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কথাটা কতটুকু সত্য, আন্টি?’
মুখরের মা আবারো শব্দ করে কাঁদলেন। আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে বললেন,
‘তুমি কি এ কথা বিশ্বাস করলে, মা? বলো? আমার ছেলে কি তার বাবাকে মারতে পারে?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘এ কথা আমি একদমই বিশ্বাস করি না। শুধু সত্যতা যাচাই করছি।’
তিনি আমায় বললেন,
‘শোনো তবে। হ্যাঁ আমার ছেলের হাতেই তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
কথাটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই থমকালাম আমি। কথাটা ঠিক শুনেছি তো? এই রহস্য উদঘাটনের জন্যই আজ থেকে পাড়ি জমালাম বহু বছর আগে। ঠিক মুখরের জন্মের সময়।
আমেনা হাসনাত আর হাসিবুল্লাহ্ শিকদারের একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে হয়েছে। চারপাশ মুখরিত করে তার আগমন। বাবার জীবনেও স্বচ্ছলতা ফিরে এলো মুহুর্তেই। একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেল। আকিকাতে নাম রাখলেন মুখর শিকদার। বাবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসায় বেশ কাটছিলো তিনজনের ছোট পরিবারটি।
মুখর যখন পাঁচ বছরে পা দেয় ঠিক ততোদিনে কোম্পানির হেড এরশাদ মুত্তাকীর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবের। তার দুই বছরের ছোট মেয়ে রূপন্তীকে নিয়ে এরশাদ সাহেব প্রায় সময়ই এ বাড়িতে আসতেন।
এমন করে মুখর আর রূপন্তীর বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। কিন্তু এ সখ্যতা দিনের পর দিন যেন বিরক্তির কারণ হলো। মুখর যখন একটু বুঝতে শিখলো সে রূপন্তীর কাছ থেকে দূরে দূরেই থাকতে চাইতো বেশি। এর কারণটা মুখরের বাবা-মায়েরও চোখ এড়ালো না। রূপন্তী সারাটাক্ষণ মুখরের পিছু পিছু ঘুরতো। সকাল থেকে রাত অবধি মুখরকেই পাশে চাইতো বেশি। তার বাবাকেও একপ্রকার ভুলতে বসেছিলো সে।
রূপন্তী যখন কৈশোরে পদার্পণ করলো মুখরের জন্য তার পাগলামো আরও বেড়ে গেল। মুখরকে সামনে দেখতে না পেলে সে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যেতো। কিছু খেতো না, কারও সাথে কথা বলতো না, জিনিসপত্র ভাঙচুর এসব তার নিত্যদিনের আচরণ ছিলো। এরশাদ সাহেব মেয়ের উপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে মেয়ের অবস্থার জন্য খুব কষ্টও হলো তার। মুখরের বয়স যখন ১৭ হলো, মুগ্ধ জন্ম নিলো। এদিকে মুগ্ধের আগমনে মুখর রূপন্তী থেকে আরও দূরে সরে গেল। রূপন্তী এতে মানসিক ভাবে ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়লো। এজন্যই এরশাদ সাহেব কিছু না দেখে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবকে মুখর আর রূপন্তীর বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। হাসিবুল্লাহ্ ছেলের অমতে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না বলে এরশাদ সাহেবকে সরাসরি না করে দেন।
কোম্পানির হেড হয়ে একজন সামান্য কর্মচারীর হাতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এরশাদ সাহেব ফুঁসে উঠেন। মুখরেকে হাত করার উদ্দেশ্যে বাবা-মেয়ে মিলে এক গভীর ষড়যন্ত্র করেন।
এক রাতে হাসিবুল্লাহ্ সাহেবকে এরশাদ সাহেব তার বাড়িতে ডেকে পাঠান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ম’দ পান করিয়ে মাতাল করে তোলেন। মাতাল অবস্থায় রাস্তা ধরে বাড়ি আসার জন্য বেরিয়ে পড়েন হাসিবুল্লাহ্ সাহেব।
হাসিবুল্লাহ্ আসতে দেরি করায় আমেনা বেশ অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সে মুহুর্তেই মুখরের ফোনে কল আসে রূপন্তীর। সে মুখরকে বলে,
‘তোমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে, মুখর। জলদি আমাদের বাসায় এসো!’
মুখর আর দাঁড়ালো না। এরশাদ সাহেবের উপহার দেওয়া গাড়িটায় চড়েই রওনা হয় সে। কিন্তু হায়! অর্ধেক যেতেই গাড়িটার ব্রেকফেইল হয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখর বেশ ঘাবড়ে যায়। এমন সময় রাস্তায় গাড়িটার সামনে এসে পড়েন হাসিবুল্লাহ্! হাসিবুল্লাহ্কে গুরুতর আহত করার পর গাড়িটা পাশেই এক গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে মুখরও বেশ গুরুতর আহত হয়। সে যাত্রায় মুখর বেঁচে গেলেও বেঁচে ফিরতে পারেননি হাসিবুল্লাহ্। তার মৃত্যুর অনলে গত সাত বছর ধরে জ্বলছে ছেলে মুখর। বাবার শোকে বেশ কয়েক বছর পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো সে। কথা বলা অনেকাংশেই কমে গিয়েছে, তার চোখ দুটোও যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে ক্রমেই। ছেলের হাতে বাবার এক্সিডেন্ট হওয়ায় এই শহরে আর থাকতে পারেননি আমেনা। চারপাশের মানুষের কানাঘুঁষা তিনি আর নিতে পারেননি। এ অন্ধকার শহরের মায়া ত্যাগ করে চলে যান বাবার বাড়ি। মনের মধ্যে রেখে যান এক পাহাড়সম দুঃখ। তিনি জানেন তার স্বামীর আসল খুনি সেই এরশাদ। কিন্তু টাকার জোরে কেউ তার বিচার করবে না। টাকার কাছে আইন হার মানবে বারংবার। তাই মিছে ঝামেলা না করে তিনি পিছু হটে যান সহজেই। কিন্তু এতো বছর পর আপদটা পিছু ছাড়লো না দেখে আমেনার মাঝে আবারো জমা হয়েছে একরাশ ভয়।
সাত বছরের এমন করুণ কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম চেয়ারে। মুখরের কথাটা এবার বোধহম্য হলো। এরশাদ সাহেবকে সে একটা বিষাক্ত সাপের সাথে তুলনা করেছে। সেই সাপ যে কিনা তার বিষ ছড়িয়ে সবটাই গিলে নিচ্ছে।
পরক্ষণেই মনে পড়লো প্রথমদিনের দেখা মুখরের সেই বুকের নিচের দাগটি। এই ক্ষতটা নির্ঘাত তার এক্সিডেন্টার জন্যই হয়েছিলো। বুকে হাত দিয়ে অনুভব করলাম কি ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে এখানটায়। সে যন্ত্রণা ভোগ করে মুখরের উদ্দেশ্যে বললাম,
‘কিভাবে এতো কষ্ট, এতো রাগ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছেন, মুখর সাহেব?’
.
আজ তিনদিন হলো মুগ্ধ হাসপাতালে আছে। আর কিছু সময় পরই মুগ্ধকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। মুগ্ধের জ্ঞান ফিরেছে একদিন হলো। অবস্থা স্বাভাবিক থাকায় ডাক্তার বলেছেন তাকে দুইদিন পর রিলিজ দেওয়া যেতে পারে।
ছোট ছেলেটা জ্ঞান ফেরার পর তার মমতাময়ী মা’কে দেখেই তার বুকে ঝাপটে পড়ে। সে অতিশয় ভীত ছিল! আর যাই হোক, এইটুকু বয়সে সে গুলির মতো ভয়ানক কিছুর মুখোমুখি হয়েছে! সৃষ্টিকর্তাকে হাজারবার শুকরিয়া জানিয়েছি এই বিপদ থেকে ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। আমি পাশে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মুগ্ধকে। জড়িয়ে ধরেই বুঝলাম সে কাঁপছে, ভীষণ ভাবে! আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে পরম আদরে বললাম,
‘কিচ্ছু হয়নি, বাবা। তুমি একদম ঠিক আছো, দেখো!’
আরও খানিক্ষণ জড়িয়ে রাখার পর সে বলে উঠলো,
‘আম্মু, ভাইয়া কোথায়?’
আন্টির ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো। তিনি মনে মনে এই প্রশ্নের আশায়ই ছিলেন। তবে তার কাছে বোধহয় কোনো উত্তর নেই। আমার দিকে করুণভাবে চেয়ে আছেন তিনি।
কি বলবে মুগ্ধকে? তার ভাইয়া তো আজ তিনদিন হলো লাপাত্তা। আন্টি থেকে জানলাম সে নাকি ঐ এরশাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে গেছে। কিন্তু অতো বড় একজন মানুষের কাছে মুখর কিছুই না! চাইলেই লোকটা নিমিষে গায়েব করে দিতে পারে মুখরকে। হঠাৎ আঁতকে উঠলাম। ছেলেটা জেনেশুনে আগুনে পা দিতে গেছে! পরক্ষণেই তার উপর আবার ভীষণ রাগ হলো! রূপন্তী মেয়েটা তার সাথে এতোকিছু করেছে তারপরও কেন রূপন্তীকে ছেড়ে দিলো না সে? মেয়েটা তাকে শুধু কষ্টই তো দিয়েছে! রূপন্তীকে সামনে পেলে আমি বোধহয় রোস্ট বানিয়ে আস্ত চিবিয়ে খাবো তাকে!
(চলবে)
(পর্ব বড় দিয়েছি, কেউ অভিযোগ করবেন না দয়া করে!)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২২
#তাশরিন_মোহেরা
আজ প্রায় একমাস হতে চললো মুখরের কোনো হদিস নেই। এলাকার আনাচে কানাচে খোঁজা হয়ে গেছে, কিন্তু তার দেখা কোথাও মিললো না। মিলবেই বা কি করে! যারা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাদের খুঁজে পাওয়াটাও অনিশ্চিত!
একবুক হতাশা নিয়ে দরজা খুলে মুগ্ধের বাসায় প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই দেখলাম আন্টি পড়ার রুমটা গুছিয়ে রাখছেন। আমাকে আসতে দেখেই মলিন মুখটায় হালকা হাসি টেনে বললেন,
‘এসেছো মা! বসো, আমি মুগ্ধকে ডেকে দিচ্ছি।’
আমি চুপচাপ বসলাম। মুগ্ধ এ কদিন যাবৎ স্কুলে যায়নি। তার পায়ের ক্ষতটা সেরেছে তবে আন্টি তাকে বাইরে বের হতে দিতে নারাজ। তিনি এখনো বেশ ভয়ে আছেন। আমাকেও কিছুদিন ছুটি দিয়েছিলেন তবে মুগ্ধের জন্য তা আর হলো না। সে আমার কাছে পড়ার অনুরোধ করলো মা’কে। তাই আবারো আগের মতো তাকে পড়াতে আসছি।
পড়ার রুমের ঠিক সামনেই আগে মুখরকে দেখতাম আমি। মুগ্ধকে পড়ানোর ফাঁকে উঁকি মেরে দেখতাম সে তার রুমটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে। কিন্তু এখন সেই রুমটায় মুখর নেই। আন্টি থাকছেন সেখানটায় মুগ্ধকে নিয়ে।
কিছু সময় পর মুগ্ধ এসে বসলো। আজ তাকে অতিরিক্ত শান্ত দেখাচ্ছে। চুপচাপ বসে আছে। গত একমাসে সে প্রতিদিন তার ভাইয়ার জন্য কেঁদেছে। পড়তে বসে কেঁদেছে, স্কুলে গিয়ে কেঁদেছে, খেলতে গিয়ে কেঁদেছে। আমি এলেই সে দৌঁড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলতো,
‘ম্যাম, ভাইয়া আজও আসেনি!’
আর আমি নির্বাক হয়ে তার দুঃখের সঙ্গী হতাম। আন্টিও ভেতরের রুম হতে থেমে থেমে কাঁদতেন।
তবে আজ তার ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি যা প্রশ্ন করছি তার বাইরে একটা কথাও সে বলছে না। ভাইয়ার কথাও আজ জিজ্ঞেস করছে না! তার এমন শান্ত আচরণ দেখে অদ্ভুত লাগলো। পড়ানো শেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি ব্যাপার, মুগ্ধ? আজ সকালবেলা উঠেই কাঁদলে না যে?’
সে আগের মতোই বেশ শান্ত হয়ে বললো,
‘আমি আর কাঁদবো না, ম্যাম!’
আমি অবাক হলাম। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন, বাবা?’
‘আমাকে ভাইয়া বলেছে!’
আমি এবার তার কথায় চমকে উঠলাম। মুখর বলেছে মানে? সে কি ফিরে এসেছে? সে ফিরে এলে মুগ্ধ আমায় বলেনি কেন? আর কেনই বা তার মুখখানা মলিন হয়ে আছে?
আমি মুগ্ধকে বললাম,
‘ভাইয়া বলেছে মানে? মুখর সাহেব ফিরে এসেছেন?’
সে দু’দিকে মাথা দুলালো। তার মানে মুখর এখনো ফেরেনি। আমার মনে যে ক্ষীণ আশাটুকুর সঞ্চার হয়েছিলো তা তক্ষুণি নিভে গেল। মুগ্ধ আবারো বললো,
‘ভাইয়া আমার স্বপ্নে এসেছিলো। আমাকে বলেছে, বড় ছেলেরা কাঁদে না। তাই আমাকেও নিষেধ করেছে আর না কাঁদতে। তাই আমি ভেবেছি আর কাঁদবো না কখনো!’
ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো তার। বহুকষ্টে কান্না থামাচ্ছে সে। মুগ্ধের পেছনে ঠোঁটে হাত চেপে আন্টিও নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছেন। আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন হতে চাইলো যেন।
‘কোথায় গেলেন আপনি, মুখর সাহেব? এতোগুলো মানুষগুলোকে কষ্টে ফেলে কোথায় গেলেন আপনি?’
আমার ছিন্ন মনটা ভেতর থেকে ডেকে উঠলো। মুখরের উপর ঘটা করে আবারো রাগ উঠলো, চরম রাগ! যেন সামনে পেলেই শার্টের কলার চেপে ধরবো! কিন্তু তা হওয়ার নয়। আর কবে মুখরের দেখা মিলবে কেউ জানে না। সে যে আদৌও বেঁচে আছে তা নিয়েও সন্দেহ আছে সবার। নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে ছেলেটা প্রতিপক্ষের সাথে লড়তে গিয়েছে। জিতে গেলে তো কবেই ফিরতো, তাই না? কিন্তু আজ তো পাক্কা একমাস হতে চললো! এখনো তার বাঁচার আশা করাটা যে বড্ড বোকামি হয়ে যাবে।
.
দীর্ঘ এক ব্যস্ত দিন পার করে বাসায় পৌঁছালাম। এসে জিরোবারও ফুরসত নেই। রান্নাঘরে ঢুকে আব্বার জন্য সহ দু’কাপ চা বসিয়ে দিলাম চুলোয়। চা বানাতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো এক সকালে আমি মুগ্ধ আর মুখরের জন্য কেক বানিয়ে এনেছিলাম আমার জন্মদিন উপলক্ষে। সেদিন মুখর আমাকে বলেছিলো,
‘চলুন, মিস.তিথিয়া! আপনাকে আমার স্পেশাল চা খাওয়াই!’
আমিও খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,
‘ঠিক আছে, মুখর সাহেব!’
সেদিন দেখলাম মুখর সাহেব সম্পূর্ণ উল্টো পদ্ধতিতে চা বানাচ্ছেন। আমি সচরাচর নিজের জন্য চা বানাতে গেলে প্রথমেই একটা লিকার তৈরি করে তাতে পরিমাণমতো তরল দুধ ঢেলে দেই। চা হয়ে গেলে এক কাপে চিনি নিয়ে চা’টা তাতে ঢেলে দেই। কিন্তু মুখর প্রথমেই একটা কড়া লিকার তৈরি করে তা আলাদা করে রাখলেন। একটা কাপে তরল দুধ নিয়ে তাতে আধা চামচ চিনি আর দু’চামচ পাউডারের দুধ দিলেন। কড়া লিকারটা ছাকনি দিয়ে ঐ দুধ-চিনির মিশ্রণটাতে ঢেলে দিলেন। গরম গরম চা’টুকু থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ পেলাম আমি। চায়ে চুমুক দিতেই মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছি। এরপর আমিও কয়েকবার বাসায় এমন করে চা বানানোর চেষ্টা চালিয়েছি। মুখরের মতো অতুলনীয় না হলেও ভালো হয়েছে!
পুরোনো এই স্মৃতিতে ডুব দিয়েই মনটা আরও চূর্ণবিচূর্ণ হলো। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা পড়ার আগেই নাক টেনে তা থামিয়ে ফেললাম। চা’টা বানিয়ে আব্বার সামনে এক কাপ রাখলাম। কিন্তু তিনি তাতে চুমুক দিতেই থু মেরে সবটা ফেলে দিলেন। বললেন,
‘এসব কি বানিয়েছিস, তিথি? চায়ের বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছিস এতে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘কই আব্বা! আমি তো চিনিই দিয়েছিলাম।’
নিজে চুমুক দিয়ে বুঝলাম আব্বা আসলে ঠিকই ধরেছে। আমি চিনির বদলে একগাদা লবণ দিয়ে ফেলেছি। আব্বাকে বললাম,
‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আরেক কাপ বানিয়ে আনছি!’
আব্বা আমাকে পিছু ডাকলেন। ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। আমিও গুটিশুটি মেরে বসলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘তোর কি হয়েছে বল তো! সারাক্ষণ মুখটা মলিন হয়ে থাকে। চোখের নিচেও কালি জমেছে।’
আমি নিচে তাকিয়ে বললাম,
‘পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপ বেড়েছে, আব্বা। তাই এমন লাগছে দেখতে!’
‘আমাকে বোকা বানাতে যাস না। পড়ার যত চাপই হোক তোর চোখের নিচে কখনো কালি পড়েনা। কেননা তোর রাত জেগে পড়ার অভ্যাস নেই। কোনো সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলতে পারিস, মা!’
ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করলাম,
‘আব্বা, আমি আপনাকে কেমনে বলি একটা ছেলে আমায় এমন অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে?’
আব্বা আমাকে আবারো বললেন,
‘আমি জানি আমার পাগলামো তুই পছন্দ করিস না। তাই কখনো কিছু খুলেও বলিসনি আমায়। নিজের মধ্যে রেখেই সবসময় ফাইট করে গেছিস। কিন্তু আমারো যে আমার মেয়ের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। আমিও যে চাই তুই এসে আমাকে এটা ওটা বলিস।’
আমার মনটা আরো ছোট হয়ে গেল। আব্বা নিজের দুর্নাম করছে ঠিক, তবে আমার মনে হচ্ছে আমিই বোধহয় আব্বার মনের মতো একটা মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। আব্বার অপছন্দের সবকিছুতেই আমি জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। তন্মধ্যে সবচে’ বড় অপছন্দের ব্যাপার হলো আমি ভালোবেসেছি। মুখর নামের নিখোঁজ এক পথিকের কাছে মন দিয়ে এসেছি নিজের। যা ফেরত দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভাবনার মাঝে আব্বা বললেন,
‘মানুষ অনেক সময়ই মনের দ্বন্দ্বে পড়ে পথ হারিয়ে বসে। বুঝে উঠতে পারে না তার ঠিক কি করা উচিৎ! তুই যদি এমন দ্বন্দ্বে পড়ে থাকিস তবে অবশ্যই আমায় বলবি! আমি তোকে সাহায্য করতে না পারি অন্তত আমাকে বলে তোর মনটা হালকা হবে।’
আমার বুকটা দুরুদুরু করছে। আব্বাকে কি সবটা খুলে বলবো? কিন্তু এতে করে আব্বা যদি আমাকে মায়ের মতো বন্দী করে রাখে? কিন্তু এতো কিছু বলার পরও কি তিনি আমার উপর রুষ্ট হবেন? শেষমেশ কিছু না ভেবেই আব্বাকে বলে ফেললাম,
‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’
(চলবে)