অদ্ভুত মুগ্ধতা – ২
পর্ব ২
মিশু মনি
.
মিশু ওর হ্যান্ডব্যাগ টা নুহাশ পল্লীতেই ফেলে এসেছে।বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো অনেক্ষণ,তারপর সেটা আর নেয়া হয়নি।আর পায়ের জুতো জোড়াও খুলে রেখে দৌড় দিয়েছিলো বলে সে দুটোর কথাও আর মনে ছিলোনা।অনেকটা পথ আসার পর মনে হয়েছিলো জুতার কথা।কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
মৈত্রী জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো মিশু?
– আমার ব্যাগটা ফেলে এসেছি নুহাশে।ব্যাগে মোবাইল ছিলো।একটু ফোন দিয়ে ওনাদের কাউকে বলবে ওটা রেখে দিতে?
মৈত্রী হেসে বললো,এতটাও আত্মভোলা কেউ হয়?
– তুমি হাসছো? আমার মোবাইল টা আছে ঐ ব্যাগে।
– হুম।থাক না, আরেকটা মোবাইল কিনে দিবো।
মিশু একটু রেগে বলল,এমন করছো কেন? ফোন দাও ওনাকে।ব্যাগে আরো দরকারি কিছু জিনিস পত্র ছিলো।
– স্নো,পাউডার, লিপস্টিক?
– ফাজলামো করছো তুমি?
মৈত্রী হাসতে হাসতে বললো,টেনশন করোনা।তোমার ব্যাগ আমি গাড়িতে তুলে রেখেছিলাম।ওটা গাড়িতে আছে দেখো গিয়ে।
মিশু এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।সত্যিই ও বড্ড মনভোলা।এই মৈত্রী নামের ছেলেটা না থাকলে কি যে হতো ওর! আজকাল মিশুর কিছুই মনে থাকেনা।মৈত্রী টাই সব মনে করিয়ে দেয়।
খাওয়া শেষ করে মিশু হাত ধুয়ে এসে বসলো।মৈত্রীও খাওয়া শেষ করে ইয়া বড় ঢেকুর তুললো।তারপর মিশুর দিকে তাকালো।কিন্তু তাকানো মাত্রই বুকের ভিতরে একটা ধাক্কা লাগলো এসে।মিশুকে ভেজা চুলে এতটাই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে যে,চোখ ফেরানো দায়! বুকের ভিতর টা কেমন যেন চিনচিন করছে।হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে হঠাৎ করেই।শাড়ি পড়ে মিশুর সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।মেয়েটা এত মায়ায় জড়িয়ে ফেলে যে,বুকের ভিতর টা কেমন যেন করে।
এমন সময় ম্যানেজার সাহেব একটা ট্রেতে করে দুই মগ কফি নিয়ে এসে বলল,এগুলো খান।আর কিছু লাগলেই আমাকে ফোন দিবেন।
– থ্যাংকস নাজমুল ভাই।আপনি শুধু গাড়ি থেকে মিশুর ব্যাগটা নিয়ে এসে দিন পারলে।আর কিছু লাগবে না।কফির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
নাজমুল ভাই হাসিমুখে চলে গেলেন।মিশু কফির মগটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।এখান থেকে খুব সুন্দর বৃষ্টি উপভোগ করা যায়।রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।কত স্নিগ্ধ আর মোহময় বৃষ্টি! একটা শীতল অনুভূতি হচ্ছে হৃদয়ে।মিশুর দেখাদেখি মৈত্রীও বারান্দায় এসে ওর পাশে বসে পড়লো।তারপর কফি মগে চুমুক দিতে দিতে বললো,খুব সুন্দর ওয়েদার তাইনা?
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,হুম।বড্ড রোমান্টিক।
মিশুর কথায় মুচকি হাসলো মৈত্রী।কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো।এত সুন্দর বৃষ্টি যেন অনেক দিন দেখা হয়নি।অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে,মৃদুমন্দ বাতাস ও বইছে।সে হাওয়া যতটা শীতল,তারচেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর।শিহরণ বইয়ে দেয় মনে।এমন বৃষ্টি আর মেঘময় আকাশ দেখলে কেমন যেন মায়া মায়া লাগে।কারো কথা খুব বেশি মনে পড়ে যায়।বুকের ভিতর কোথায় যেন শূন্যতা অনুভূত হতে থাকে।কিন্তু এই শূন্যতা কিসের সেটা বোঝা যায়না।অনেক সময় সবকিছু থাকার পরও এই শূন্য শূন্য অনুভূতিটা মনে বাজতে থাকে।এইতো মিশু পাশেই বসে আছে,তবুও কেমন যেন করছে বুকের ভিতর টা!
মিশু নিস্তব্ধতা ভেঙে বললো,কেমন লাগছে তোমার?
মৈত্রি জবাব দিলো, খুব মায়া কাজ করছে মিশু।কিন্তু কিসের জন্য মায়া সেটা বুঝতে পারছি না।সবকিছুই ভালো লাগছে,আবার একটা মন খারাপ ভাবও কাজ করছে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিশু অবাক হয়ে বললো,আমার ও তো।শুধু মনে হচ্ছে,কি যেন নাই।কিছু একটা জিনিস খুব করে মিস করছি।কিন্তু জিনিস টা যে কি,বুঝার উপায় নেই।
– হয়ত বৃষ্টির বৈশিষ্ট্যই এটা। কিছু নতুন অনুভূতির জন্ম দেয়।যে অনুভূতি গুলোর উৎস টাও আমরা বুঝতে পারিনা।
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,হুম।এটা ঠিক বলেছো।”বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” বইটা পড়েছো?
মৈত্রী মাথা নেড়ে বললো,না গো।পড়া হয়নি।
– পড়ে দেখো।তুমি বোধহয় সবসময় ডাক্তারি বই পড়াশোনা করো তাইনা?
– হ্যা,মাঝেমাঝে শার্লক হোমস পড়ি।
মিশু বাইরে তাকিয়ে আছে।এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও বিদ্যুৎ আছে।বাংলোর বারান্দার সামনে থেকে ছোট একটা রাস্তা চলে গিয়েছে কিছুদূর।তারপর সেখানে একটা বড় রাস্তার সাথে মিলেছে। সেই রাস্তাটা চলে গিয়েছে একদম গেট পর্যন্ত।রাস্তার দুপাশে নারকোল গাছের সাড়ি।একদিকে বাগান,একদিকে পুকুর।আর বাংলোর এদিকে যতই এগোনো যায়,দুপাশে সুন্দর ফুলের বাগান চোখে পড়ে।বাংলো পেড়িয়ে ওদিকে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে,দু একটা খাঁচায় খরগোশ,কাঠবিড়ালি আর কুকুর ও পোষা হয়।এরিয়া টা নেহাত ছোট নয়।এখানে বাংলোর বারান্দায় বসে সামনের মাঝারী সাইজের একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে,বাগানের একদিক চোখে পড়ছে।মাঠের ঘাসের উপর খুব সুন্দর রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে,বাগানের ফুলগাছ গুলোর উপরেও বৃষ্টির ফোটা পড়ে সেগুলো দুলে দুলে উঠছে।কাছেই কোথাও একটা সুগন্ধি ফুলের গাছ আছে মনেহচ্ছে।সুন্দর সুবাস নাকে এসে লাগছে!
মৈত্রীর মুখে এখানকার সৌন্দর্যের কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেলো মিশু।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ঘাসের বৃষ্টি স্নানের দিকে।ওরও ইচ্ছে করছে আবারো গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে।কিন্তু এখন বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগচগে,ভিজলে জ্বর এসে যাবে।তাছাড়া শাড়িটা ভিজিয়ে ফেললে আর জামা পাবে কোথায়? মিশু বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেটাকে দমন করে ফেললো।
মৈত্রী বললো,মিশু তোমার কফি শেষ হয়নি?
এতক্ষনে সম্বিৎ ফিরে পেলো মিশু।কফির মগের দিকে চেয়ে দেখে কফি নেই।অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।ও এতক্ষণ খালি মগেই চুমুক দিচ্ছিল।মৈত্রীর কথায় লজ্জা পেয়ে বলল,খেয়াল ছিলনা।কিছু নিয়ে ভাবার সময় আমার অন্যদিকে হুশ থাকেনা।
মৈত্রী হেসে বলল,দিনদিন বড্ড আত্মভোলা আর আনমনা হয়ে যাচ্ছো তুমি।
– হুম,হয়ত বা।
– আচ্ছা মিশু,তুমি প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলে কবে?
প্রশ্ন শুনে মিশু একটু নড়েচড়ে বসলো।এমন বিষয়ে আড্ডা দিলে মন ভালো হয়ে যায়।মিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।হাসিমুখে বললো,আমি তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি।
মৈত্রী অবাক হয়ে বললো,ক্লাস থ্রি! অদ্ভুত ব্যাপার!
মিশু বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,হুম।ছেলেটা আমাদের ক্লাসেই পড়তো।আমি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম।ভর্তির পর থেকেই ওই ছেলেটা আমার দিকে সবসময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।আমি প্রচণ্ড রেগে যেতাম।কিন্তু রাগটা হজম করে ফেলতাম।এভাবে চলতে চলতে একদিন ওই ছেলেটার একটা বন্ধু এসে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলো। তারপর বলল,আমার বন্ধুটা তোকে খুব পছন্দ করে।ওর সাথে প্রেম করবি? তখন তো প্রেমের মানে বুঝতাম না।কিন্তু প্রেম বলতেই ধারণা ছিলো যত সব নোংরামি,ওটা খারাপ জিনিস।বড়রা প্রেম করলে স্বাভাবিক ব্যাপার, আমরা যথেষ্ট হেল্প করতাম।কিন্তু ছোটরা প্রেম করছে শুনলেই তাকে সবাই খারাপ বলতাম, তার সাথে মিশতাম না।
মৈত্রী হেসে বলল,সত্যিই তাই।আমাদের সময়েও এই জিনিস টার প্রচলন ছিলো।বড় ভাইয়া আপুরা প্রেম করলে সেটা ভালো জিনিস, তাদেরকে কতরকম হেল্প করতাম আমরা।কিন্তু কোনো ছোট ছেলেমেয়ে প্রেম করছে শুনলেই সবাই মিলে সারা এলাকায় সব বন্ধু বান্ধবীদের বলতাম অমুক প্রেম করছে,ও খারাপ হয়ে গেছে।আমাদের দলে আর ওকে নেয়া যাবেনা।ওর সাথে আর কেউ কথা বলবে না।হা হা হা..
মৈত্রী হাসছে,মিশুরও হাসি পেলো ছোটবেলার কথা ভেবে।কত মজাই না হতো তখন!
মিশু বললো,জানো একবার কি হয়েছিলো?
– না বললে জানবো কিভাবে?
মিশু হেসে বললো,তখন আমি ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। বাসার সামনে বাগানে ছোট ছোট বাচ্চারা মিলে খেলা করছিলাম।একটা পাগল কোথ থেকে এসে যেন হাজির।আমাদের পাশে বসে খেলা দেখছিল আমাদের।পাগল টা সবকিছু বুঝত কিন্তু বোবা ছিলো।কথা বলতে পারতো না।তো হঠাৎ সেই পাগল টা আমাকে ইশারায় কিছু একটা বলল।আমি বুঝতে পারলাম না।এভাবে অনেকবার কিছু একটা বুঝালো কিন্তু আমি তবুও বুঝতে পারিনি।আমার বন্ধুরাও কেউ বুঝিনি।তারপর পাগলটা ইশারায় বোঝালো আমি হাতের লেখা বুঝি কিনা? আমি হ্যা বলামাত্রই সে মাটিতে একটা কথা লিখে দেখালো।সেই লেখা দেখে আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া! আমার কাজিনরা উপুড় হয়ে চোখ বড়বড় করে সেই লেখাটা দেখতে লাগল।পাগলটা লিখেছিলো, I love you.
মিশুর কথা শুনে মৈত্রী হো হো করে হেসে উঠলো। বেশ মজার কথা তো! হাসি থামাতে পারছে না কিছুতেই।মিশুও হাসছে।মৈত্রী বলল,তারপর তোমরা কি করলে?
– আমরা সবাই মিলে ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাড়িয়ে দিয়েছি।সবাই গালিও দিয়েছি অনেক।সবাই ভাবতাম খারাপ লোক ওটা।
মৈত্রী হাসি থামিয়ে বলল,সেই জন্যই মিশু তুমিও পাগল হয়ে গেছো। হা হা হা..
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বলল,আমি মোটেও পাগল নই।
– তুমি তো পাগল নও,তুমি পাগলী।
বলেই আবারো হাসতে শুরু করলো।মিশু উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলো।দুহাত পেতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগলো মৈত্রীর গায়ে।মৈত্রি বাধ্য হয়ে উঠে এগিয়ে আসলো মিশুর কাছে।মিশুর একদম কাছে এসে ও থমকে দাঁড়াল।খোলা হাওয়ায় মিশুর চুল উড়ছে,শাড়ির আঁচল উড়ছে,মিশু খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বৃষ্টির পানি ধরার চেষ্টা করছে।এতবেশি সুন্দর লাগছে ওকে,যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।সামনের ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে এসে মুখে পড়তেই মৈত্রী অজান্তেই হাত দিয়ে মিশুর চুলগুলো সরিয়ে দিলো।মৈত্রীর আঙুলের স্পর্শ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো মিশু।দুজনেরই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হঠাৎ করে।এরকম অনুভূতি এই প্রথম বার হলো মিশুর।গল্প,সিনেমায় এই ঘটনা অহরহ ঘটে,কতবার সিরিয়ালে এরকম দৃশ্য দেখেছে ও।কিন্তু আজ প্রথম বুঝতে পারলো এই অনুভূতি কতটা তীব্র আর কতটা ভালোলাগার!
মৈত্রী একটু সরে দাঁড়ালো।তারপর লাজুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বৃষ্টির দিকে।আজ আকাশের বাধ ভেঙেছে,মেঘের সাথে আড়ি করে অঝোর ধারায় কাঁদছে।কিন্তু সে কান্না যতটা করুণ, ততটা তীব্র আর সুন্দর।এমন সুন্দর আবহাওয়া,পাশে মিষ্টি মিশু।সময়টা এখানে থেমে গেলে কি এমন ক্ষতি হয়? এমন ভালোলাগার মুহুর্ত থমকে যেতে পারেনা? সময় কেন এত দ্রুত চলে যায়?
মিশু অনেক্ষণ চুপ থেকে বললো,একটা গান শুনাবা?
মৈত্রী একটু চমকে মিশুর দিকে তাকালো।তারপর নিঃসংকোচে গেয়ে উঠল,
এই মেঘলা দিনে একলা,
ঘরে থাকে না তো মন…
কাছে যাবো,কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ…
মৈত্রী খুব সুন্দর করে গানটা গেয়ে যাচ্ছে।মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছে ওর গান! এত সুন্দর করে মৈত্রী গান গাইতে পারে,এটা কখনো ভাবেনি ও।ভোকাল,সুর,কণ্ঠের ওঠানামা সবকিছু এত সুন্দর হচ্ছে যে মুগ্ধ হতেই হলো।সত্যিই মৈত্রীর কণ্ঠের তুলনাই হয়না! এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে রিমঝিম ধারায়,মৃদু হাওয়া,সাথে ফুলের সুগন্ধ! মিশু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে আকাশের দিকে! এই সময় টা এখানেই থেমে যাক না।বড় ভালো লাগছে!
চলবে..