অদ্ভুত মুগ্ধতা-২ পর্ব ৩

অদ্ভুত মুগ্ধতা-২
পর্ব ৩
মিশু মনি
.
খুব সাজগোজ করে বেড়িয়েছে মুগ্ধতা।কিন্তু রাস্তায় পা দিতেই একেবারে গোবরে পা পিছলে ধপাস!
আশেপাশের লোকজন হো হো করে হেসে উঠলো ওর পড়ে যাওয়া দেখে।মুগ্ধতা খুবই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।ওর উঠে দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছে না।সবাই এভাবে একটা মেয়ের পড়ে যাওয়া দেখে হাসছে! শুধু হাসলেও কথা ছিলো,সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।কি লজ্জার ব্যাপার!
এমন সময় কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর হাতটা ধরলো।তারপর টেনে তুললো রাস্তা থেকে।ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছে মুগ্ধতা! যেখানে রাস্তার সব লোকজন ওকে দেখে হাসছে,সেখানে এই লোকটা উঠতে সাহায্য করলো! তার মুখে কোনো হাসিও নেই,আর বিদ্রুপ করার চিহ্ন মাত্রও নেই!
মুগ্ধতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে।ছেলেটি এবারে হেসে বলল,একটু দেখে চলবেন না?
তারপর আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খোজার চেষ্টা করে বললো,ধেৎ এখানে কোনো টিউবওয়েল,পুকুর ও নেই।কোথায় পা ধোবেন বলুন তো?আচ্ছা আপনি আমার গাড়িতে উঠে বসুন।কোথায় যাবেন বলুন,আমি নামিয়ে দিচ্ছি।
মুগ্ধতার এখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না।কি সুন্দর দেখতে ছেলেটা! কত সুন্দর করে কথা বলছে! এত ভালো মনের মানুষ ও আজকাল আছে? কোন মানুষ টা এভাবে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ায়? ছেলেটা একবার মুগ্ধতার দিকে তাকাচ্ছেও না।
সে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,উঠুন।
রাস্তায় লোকজন এখনো ভিড় করে দেখছে।মুগ্ধতা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে বসলো।
ছেলেটি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,বলুন কোথায় যাবেন?
মুগ্ধতা বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে।ও মুগ্ধ গলায় বললো,আপনাকে কষ্ট করে অত দূর যেতে হবেনা।
– আহা, কোথায় যাবেন বলুন তো?
– আমি যাবো মনিরামপুর।এখান থেকে বেশ দূরে।
– সমস্যা নেই।আমি সেখানেই যাচ্ছি।
মুগ্ধতা মাথা নেড়ে বললো,তাহলে ঠিক আছে।
ছেলেটি বেশ হাসিখুশি,উচ্ছল।মুগ্ধতার বারবার ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে।ছেলেটি বলল,নাম কি আপনার?
– মুগ্ধতা।
ছেলেটি হেসে বলল, বাহ! মুগ্ধ হওয়ার মত নাম।আমি মর্ম,কাজী মর্ম।বাসা ঢাকার মোহাম্মদপুর।এখানে একটা কাজে এসেছি।
মুগ্ধতা অবাক হয়ে বললো,ঢাকা থেকে এতদূর এসেছেন! আপনি কি কাজ করেন?
মর্ম একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললো,একটা ফিল্মের শুট হচ্ছে যশোরে।মনিরামপুর
ে একজন ভাইয়ের বাসা,সেখানে যাচ্ছি।
মুগ্ধতা এবার আরো খানিক টা অবাক হলো।বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল,আপনি কি “স্বপ্নচূড়া” ফিল্মের ডিরেক্টর কাজী মর্ম?
মর্ম মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,জি।
এবারে মুগ্ধতার বিস্ময় চরম সীমায় পৌছে গেলো! এত বড় একজন ডিরেক্টর ওর হাত ধরে টেনে তুলে গাড়িতে করে পৌছে দিতে চাচ্ছে! আর এত সহজে একটা মেয়ের সাথে মিশে গেলো। মুগ্ধতা ভেবেছিলো যারা অনেক উপরের শ্রেণির লোক,তারা হয়ত তত বেশি অহংকারী।কিন্তু আজ সেই ধারণা ভূল প্রমাণিত হলো।মানুষ যত উপরে ওঠে, তার আচরণ তত স্বাভাবিক আর সহজ হতে থাকে।
মর্ম বলল,কি হলো? অমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
– আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।
মর্ম মুচকি হাসলো।আজকাল অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়না।ওকে মাথায় তুলে রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু মর্ম’র এই জিনিস টা ভালো লাগেনা।পরিচালক কিংবা আর্টিস্ট বলে কেন ওকে আলাদা করে সম্মান দিতে হবে? সবার সাথে অনায়াসে মিশে জীবন কে উপভোগ করাই তো আনন্দের।অনেকে কেন যে সাধারণ মানুষ আর শিল্পী দের আলাদা করে ফেলে বুঝা মুশকিল।শিল্পী রাও তো মানুষ, ওরাও তো সাধারণ। হয়ত সাধারণ হয়েও একটু অসাধারণ কর্ম করে ফেলেছে,তাই বলে অত আধিখ্যেতার কি আছে? অনায়াসে কেন মেশা যায়না ওদের সাথে?
মুগ্ধতা আর কোনো কথা বলছে না।মর্ম’র একটা মাত্র শর্টফিল্ম দেখেই ওর খুব ভালো লেগেছিল।সেই ফিল্মটা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম হয়েছে।এত সুন্দর করে কেউ গল্পকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারে সেটা ও কল্পনাও করেনি।খুবই ভালো লেগেছিলো বলে পরিচালকের নাম ওর মনে আছে।সেই বিখ্যাত মানুষ টা আজ ওর পাশে! বিশ্বাস ই হচ্ছেনা!
মর্ম বললো,কি করেন আপনি?
– পড়াশুনো করি।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন


– বাহ! খুবই ভালো।আপনার মুখটা অমন ছোট্ট একটু হয়ে গেলো কেন?
মুগ্ধতা লজ্জা পেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।মর্ম’র একজন বড় ভক্ত হয়ে গেলো ও।এইটুকু সময়েই মর্ম’র চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছে ওকে।মর্ম যদি ফিল্ম মেকার নাও হতো,তবুও এই ভালোলাগা কাজ করতো।
মর্ম জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি ছবি আঁকেন?
মুগ্ধতা অবাক হয়ে গেলো প্রশ্ন শুনে।উনি কিভাবে বুঝলো ও ছবি আঁকে? লাজুক স্বরে জবাব দিলো, হ্যা একটু আধটু আঁকি।
– হুম,একটু আধটু আর কি কি করা হয়?
– আর কিচ্ছু পারিনা।
মুগ্ধতা বাইরে তাকিয়ে আছে।ওর খুবই লজ্জা লাগছে আজ!

গান শেষ করে মৈত্রী পিছন ফিরে দেখলো ম্যানেজার ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।ও বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো, কখন এলেন ভাই?
– একটু আগে।আপনার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি মৈত্রী ভাই।এত সুন্দর গান জানেন আপনি!
মৈত্রী হেসে বললো,ডাক্তারের কি গান জানা যাবেনা?
– তা বলিনি।অনেক ভালো লাগলো শুনে।
– আসলে আমি অনেক গান শুনি।কিন্তু কখনো গাওয়া হয়না।নিজেই গুনগুন করে গান গাই মাঝেমাঝে।
মিশু মুখ বাঁকিয়ে বলল,এত সুন্দর গান জানো আর বলছো গাওয়া হয়না? আমি অতকিছু বুঝিনা।মাঝেমাঝে আমাকে গান শোনাতে হবে বলে রাখলাম।
ম্যানেজার সাহেব হেসে খাবারের প্লেট টা ঘরে রেখে আসলো।তারপর বলল,ভাইয়া গরম গরম খিচুড়ি এনেছি,খেয়ে নিন।
মিশু লাফিয়ে উঠে বলল,এই বৃষ্টিতে খিচুরি না হলে কি চলে? থ্যাংকস নাজমুল ভাই,থ্যাংকস।
নাজমুল ভাই হেসে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পর আবারো এলেন হাতে একটা ছোট্ট গামলা নিয়ে।কাধে মিশুর ভ্যানিটিব্যাগ ঝুলছে।মিশু নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো সবকিছু ঠিকঠাক মত আছে কিনা।তারপর আবারো নাজমুল ভাইকে ধন্যবাদ জানালো।
খাওয়াদাওয়ার পর নাজমুল ভাই থালাবাসন নিয়ে চলে গেল।মৈত্রী আবারো এসে বারান্দায় বসলো।মিশুর দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো।বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে,হাওয়া ও বইছে অনেক।বাইরে বেশিক্ষণ থাকাও যাবেনা।কিন্তু ঘরে গিয়ে বসে বসে কি করার আছে? শুধু গল্প? কিন্তু আজ কোনো এক অজানা কারণে গল্প করতে ইচ্ছে করছে না।তাহলে পাশের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়।কিন্তু আজ ঘুমাতেও ইচ্ছে করছে না।তবে কি ইচ্ছে করছে? মনটা কি যে চাইছে,সেটাও বোঝা যাচ্ছেনা।
মিশু দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।মৈত্রী ওকে জিজ্ঞেস করলো,আচ্ছা মিশু বলোতো মানুষ বড় হয় কখন?
– কি রকম বড়?
– একটাই প্রশ্ন।এটার উত্তর তুমি যেভাবে পারো দাও।
মিশু একটু ভেবে বললো,বড় হওয়া বলতে আমি দুটো জিনিস বুঝি।একটা হচ্ছে,মানসিক পরিপক্বতা আরেকটা হচ্ছে সম্মানের যোগ্য হওয়া।
– হুম,দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আর পার্থক্য কি জানো?
– কি?
– মানুষ মানসিক পরিপক্বতা অর্জন করে ফেললেও সবাই সম্মানের যোগ্য হয়না।কিন্তু যারা সম্মানের যোগ্য,তাদের মানসিক পরিপক্বতা এসে গেছে।
মিশু অবাক হয়ে বলল,আমার মধ্যে একটা ও আসেনি এখনো। না মানসিক পরিপক্বতা, না সম্মানের যোগ্যতা।
– দুটোই তোমাকে অর্জন করতে হবে।
– কি করতে হবে আমায়?
মৈত্রী বললো,নিজের প্রতিভাকে আবিষ্কার করো,জানার চেষ্টা করো তোমার মাঝে কি কি গুণ আছে।তারপর সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করে ফেলো। দেখবে, আর কিছু ভাবতে হবেনা।একবার নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে,পরে আপনা আপনি অনেক কিছু মাথায় এসে যাবে।
মিশু একটু ভেবে বলল,আমার তো সেরকম কোনো প্রতিভা নেই।আমি কিচ্ছু পারিনা।
– এখনি বলতে হবেনা,তুমি চিন্তা ভাবনা করে বুঝার চেষ্টা করো কোন কাজটা করতে তোমার ভালোলাগে।যেটা করতে মনটা আনন্দ পাবে,ভাব্বে সেটাতেই তোমার প্রতিভা আছে।
মিশু আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চিন্তা করতে লাগলো।মৈত্রী বাইরের ঝুম বৃষ্টি দেখছে।অনেক্ষণ চিন্তা করার পর মিশু বলল,আমার শুধু ঘুরতেই ভালো লাগে।ঘুরাঘুরি, ঘুরাঘুরি আর ঘুরাঘুরি।
– এটা তো তোমার প্যাশন।তোমার নিজের ঠিক কিছু করার প্রতিভা আছে কিনা ভাবো তো দেখি।
মিশু আবারো চিন্তায় পড়ে গেলো।আসলেই কি ওর কোনো প্রতিভা আছে? ওর চিন্তিত মুখ দেখে মৈত্রী বলল,থাক এখন ভাবতে হবেনা।পরে ভেবে দেখো কেমন?
– আমার কোনো প্রতিভা নেই।
– আচ্ছা, তাহলে নেই।
মিশু হেসে বললো,তুমি তো বলেছো আমায় দার্শনিক হতে হবে।
বলেই মুখ টিপে হাসলো।মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে ও বাইরে চেয়ে আছে।খুবই মায়াবী দেখাচ্ছে ওর মুখটা।ছেলেদের চেহারা বুঝি কখনো এত মায়াবী হয়? মায়াবী হয় তো মেয়েরা,ছেলেরা কি হয় তাহলে? মধুর বাপ?
মিশু খিলখিল করে হেসে উঠলো।মৈত্রী ওর দিকে তাকিয়ে বলল,হাসছো কেন মেয়ে?
– তোমাকে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে।মধুর বাপের মত।
– মধুর বাপ আবার কে?
– জানিনা,যে দেখতে খুব মায়াবী একদম মাধুরীময় চেহারা তাকে মধুর বাপ বলে।
মৈত্রী হেসে ফেললো ওর কথায়।হাসতে হাসতে মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো।চোখাচোখি হতেই মিশুর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।অচেনা এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো মনটা।
মৈত্রী দেখলো মিশুর চোখে অসম্ভব মায়া! এভাবে চেয়ে থাকা বিপদজনক! ও জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে মিশু?
– আমার না কেমন কেমন লাগছে।
মৈত্রী হেসে বললো,কেমন কেমন লাগছে শুনি?
– খুব কেমন কেমন,বুঝতে পারছি না।
আবারো হাসি পেলো মৈত্রীর।কি হয়েছে মিশুর আজ?
বলল,এটা আবার কেমন কথা? তোমার কেমন লাগছে তুমি জানোনা?
– উহু,কেমন কেমন ফিল হচ্ছে।
মৈত্রী মুখ টিপে হেসে একটু কাছে এগিয়ে এসে বললো,কেমন কেমন?
– আমার মনেহয় কিছু একটা হয়ে গেছে।
– কি হয়ে গেছে টুকটুকি?
মিশু চোখ নামিয়ে নিয়ে দুহাত কচলাতে লাগলো। মৈত্রীর বেশ মজা লাগছে ওর এমন মুখভঙ্গি দেখে।ও আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,কি হয়ে গেছে বলবে না?
মিশুর মুখ শুকিয়ে গেছে।এত জোরে হৃদস্পন্দন হচ্ছে যেন বৃষ্টির শব্দ না থাকলে মৈত্রী সে শব্দ শুনতে পেতো।ও মাথা নিচু করেই হাত কচলাতে লাগলো।
মৈত্রী একটু এগিয়ে এসে মিশুর গালে একটা টোকা দিলো।
মিশু চমকে উঠে বলল,আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বলেই এক দৌড় দিয়ে রুমে চলে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।মৈত্রী শব্দ করে হেসে উঠলো।এতদিনে বুঝতে পেরেছে ও আমাকে ভালোবাসে? পাগলী একটা মেয়ে!
ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি।বারবার অজান্তেই হেসে উঠছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।আজকের রাতটা বড় সুন্দর! কি যে ভালো লাগছে।মিশু আজ প্রথমবার ভালোবাসি বলেছে!
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here