অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -০২

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_০২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ। পৃথিবী অন্ধকার করা একটুকরো কালো মেঘ সকাল থেকেই আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ঝট করেই থেমে যাচ্ছে। সকাল থেকেই মেঘ মেঘ খেলায় এবার মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। ভীষণ বিরক্ত হলো তরী।
তার ভালো নাম দিলারা জাহান তরী। সবাই তরী ডাকলেও বাবা তটিনী নামে ডাকেন। তটিনী অর্থ নদী। জন্মের একমাস পর বাবার মনে হলো গভীর নদীর মতো এই মেয়েটির নাম তটিনী হওয়া উচিত। সেই ছোট্ট তরীর টলমল চোখে তিনি একটি বিশাল নদী দেখতে পেতেন। নদী ভালোবাসা মানুষটি সব বাদ দিয়ে তটিনী নামেই মেয়েকে ডাকা শুরু করলেন।
তরীর মনটা খারাপ হয়ে গেল এমন ঝুমঝুমি বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টি তার অপছন্দ, তেমনটা নয়। তবে এমন বৃষ্টির দিনে বাইরে বের হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ তার কাছে। বৃষ্টি হচ্ছে হোক! সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে বৃষ্টি উপভোগ করবে অথবা কাঁথা মুড়ি দিয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে। বাইরে কেন যেতে হবে?
বাধ্য হয়েই আজ বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের ধরতে গেলে সারাবছরই ল্যাব নিয়ে দৌঁড়ঝাপের উপর থাকতে হয়। তার উপর সে এখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী।
ল্যাব না থাকলে কেউ মে*রে ধরেও এমন বিরূপ আবহাওয়ার মাঝে তাকে ক্যাম্পাসে পাঠাতে পারতোনা। বাস এসে থামলো স্টপেজ এ। কিন্তু বৃষ্টি থামার নাম নেই। মাথায় ছাতা ধরে দৌঁড়ে কোনভাবে একটা দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো কোন সিএনজি পাওয়া যায় কি-না!
কিন্তু ভাগ্য সহায় না হলে যা হয়। রাস্তায় দু-একটি সিএনজি দেখা গেলেও দেখে মনে হচ্ছে লোকজনে ভর্তি। স্টপেজ থেকে তার বাসা বেশি দূর নয়। হেঁটে গেলে দশমিনিট এর পথ। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ের মুখে পড়ে হেঁটে ফিরতে পারছেনা। উপরের অংশ রক্ষা পেলেও কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ ভিজে বি*শ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বাজারের উপর প্রায় সবগুলো দোকানপাটই খোলা। কে কিভাবে তাকিয়ে থাকবে কে জানে? এসব ভেবেই আর এগোনোর ইচ্ছে হলোনা। দোকানি চাচা খসখসে গলায় বললেন,
-“বৃষ্টির ছাঁটে ভিজা যাইবেন আম্মা। ভেতরে আইসা বসেন।”

তরী কৃতজ্ঞতা সূচক মৃদু হাসলো।
-“আমি এখানেই ঠিক আছি চাচা।”

ভেতরে গেলোনা সে। বাইরে দাঁড়িয়েই সিএনজি খোঁজ চালিয়ে গেল। একটা সিএনজি এদিকে আসছে দেখে হাঁপ ছাড়লো। ঠিক তার সামনে বরাবর থামলো। সিএনজির ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কোথায় যাবেন?”

তরী বাসার ঠিকানা বলল।
-“উঠে বসেন।” বলার পরপরই তরী সিএনজিতে উঠে পড়লো। ঠিকঠাক হয়ে বসে পাশে চোখ পড়তেই বিষম খেলো সে। এই লোকটির মুখোমুখি হতে চায়না সে। তবুও বারবার উনার সম্মুখীন হয়। মাহমুদের সরল দৃষ্টি সিএনজির সামনে গ্লাস ভেদ করে রাস্তায় গিয়ে ঠেকলো। আজ আর তরীর দিকে তাকিয়ে নেই। তবুও তরী কুঁকড়ে যাচ্ছে। মাহমুদ যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। তরী আরেকটু দূরত্ব সৃষ্টি করে সিএনজির কোণের সাথে লেগে বসলো। সিএনজির পর্দা ভালোভাবে টে*নে না বসায় বাইরের বৃষ্টির ছাঁট এসে তরীর সাথে সাথে মাহমুদকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাত বাড়ালো মাহমুদ। তরী কোলে থাকা ব্যাগ আঁকড়ে আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো। তার চোখে রাজ্যের ভ*য়। তার ভ*য়*কে দূরে ঠে*লে পর্দা ঠিক করে সোজা হয়ে বসলো মাহমুদ। সামনে তাকিয়েও সে তরীর অস্বস্তি বেশ বুঝতে পারছে। এই প্রথম সে কথা বললো মেয়েটির সাথে। গলা পরিষ্কার করে চিরাচরিত শান্ত স্বরে বলল,
-“আপনার কি প্রবলেম হচ্ছে? আমি সামনে চলে যাবো?”

চমকে উঠে পাশে তাকালো তরী। মাহমুদের নির্মল দৃষ্টি তার দিকেই জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে। একমাসের যাত্রায় তাদের মাঝে একদিনও কথা হয়নি। হুট করে লোকটির মুখে তার উদ্দেশ্য প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রতিভ হলো। বলল,
-“জি?”

-“আপনার বসতে সমস্যা হচ্ছে কি? আমি কি সামনে গিয়ে বসবো?”

তিনজনের জায়গায় তারা দুজন বসেছে। সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তার অস্বস্তি হচ্ছে বললে মানুষটি কী ভাববে? তা ভেবেই তরী হড়বড় করে বলে ফেললো,
-“না না সমস্যা হবে কেন? আপনি সামনে যাবেন না। এখানেই বসুন।”

মাহমুদ আরেকবার তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। তরী নিজেকে নিজে ভীষণ বকছে। তাড়াহুড়োয় সে এমনভাবে কেন বলতে গেল? মনে হচ্ছিল সে চায় লোকটি তার পাশে বসে থাকুক।
এখন বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। শীতল আবহাওয়ার মাঝেও তার গরম লাগছে। আজকের দিনটাই খা*রা*প। নয়তো তার সাথে সকাল থেকেই কেন অপছন্দের ঘটনাগুলো ঘটতে যাবে?

সিএনজি এসে থামলো বাসার সামনে। তরী ভাড়া বের করতে ব্যস্ত, অনেকক্ষণ ধরেই ভাংতি টাকার খোঁজ করে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতার শেষ নেই। এই বুঝি আরেকটি বিব্রতকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো সে।
হাতড়ে ভাংতি টাকা না পেয়ে পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো। ড্রাইভার জানালেন ভাংতি নেই। বিপাকে পড়লো তরী।
পাশ থেকেই গম্ভীর স্বর শোনা গেল,
-“কিছু মনে না করলে আমি কি আপনার ভাড়া দিয়ে দিতে পারি?”

মুহুর্তেই মাথা তুলে তাকালো তরী। ততক্ষণে মাহমুদ দুজনের ভাড়া মিটিয়ে দিলো। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। তার এখানে কী বলা উচিত? পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই মাহমুদ বলে গেল,
-“ভিজে যাচ্ছেন আপনি। মাথায় ঠিক করে ছাতা ধরুন।”

সংবিৎ ফিরে পেতেই নিজের কাজে আবারও লজ্জায় পেল তরী।

★★★

বৃষ্টির দিনে বাঙালিরা খিচুড়িটা একটু বেশিই পছন্দ করে। সন্ধ্যার পরপরই চুলায় খিচুড়ি বসালো তরী। মা সবটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“আজ তুই রান্না কর।”
পাশেই পাঁচ বছর বয়সি ছোটবোন অরু বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে,
-“খিচুড়ি কখন হবে?”

সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মিঠুর কাছে গেল। তার সাথে রামি বসে আছে। পড়ার ব্যাপারেই দুজন কথা বলছে।
খিচুড়ি হতেই ডাক পড়লো সবার। বাবাও বাসায় আছেন। হাত ধুয়ে সবাই বসে পড়লো গরম গরম খিচুড়ি খেতে। সাথে আমের আচার।
সবার শেষে খাওয়া শেষ হলো রামির। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে তরীর ওড়না টে*নে ধরলো। প্রেমিক পুরুষের মতো সুর পাল্টে বলল,
-“খাওয়া শেষে ওড়নায় হাত মোছার জন্য হলেও মিষ্টি একটা সিনিয়র আপু চাই।”

রামির মাথায় চা*টি দিয়ে তটিনী বলল,
-“বয়সের তুলনায় বড্ড বেশি পেকে যাচ্ছো না তুমি? দ্বিগুণ বয়সী আপুর সাথে ফাজলামো করো?”

রামি বিরক্ত হলো। বলল,
-“আমায় তুমি করে ডাকবেনা তো, আপু! মিঠুকে যেমন তুই করে ডাকো, আমাকেও তেমন করেই ডেকো। তুই সম্বোধন আপন আপন লাগে৷
আর তোমার সাথে ফাজলামো করবোনা তো কার সাথে করবো?”
রামির কন্ঠে তীব্র অধিকারবোধ।

মিষ্টি করে হাসলো তরী। আদুরে স্বরে বলল,
-“আচ্ছ তুই করেই ডাকবো। এখন আন্টিকে গিয়ে খিচুড়ি দিয়ে আয়। ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

মুখ কুঁচকে নিলো রামি। এখন ঘরে গেলেই ভাইয়ার কাছে পড়ার জন্য একচোট বকা খেতে হবে। অনাগ্রহ প্রকাশ করে বলল,
-“আমার মিঠুর সাথে পড়ার ব্যাপারে অনেক কথা আছে। তুমি দিয়ে এসো।”

-“দিয়ে আয় না।”

-“প্লিজ আপু তুমি যাও!”

-“মিঠু গিয়ে দিয়ে আয়।”

মিঠুর কাছ থেকে জবাব এলো,
-“পারবোনা।”

মা সবার তামাশা দেখছেন। মিঠুকে বকাবকি করে শেষে তরীকেই যেতে বললেন। যেতে পারবেনা বললে মা অনেক প্রশ্ন করবেন। অগত্যা তরীকেই যেতে হলো। সংকোচ নিয়ে দরজায় বেল দিল।
ক্ষীণ সময় পর দরজা খুলে গেলো। আরও একবার অপ্রস্তুত হলো তটিনী। ভেবেছিল আন্টি দরজা খুলবে। কিন্তু দরজা খুলেছে মাহমুদ।
তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদুস্বরে বলল,
-“ভেতরে আসুন।”

তটিনী হাতের বাটি বাড়িয়ে দিল। ইতস্তত করে বলল,
-“এটা রাখুন। মা পাঠিয়েছে।”

মাহমুদ হাত থেকে বাটি নিলো। ভেতর থেকে মা প্রশ্ন করলেন,
-“কে এসেছে, মাহমুদ?”

খানিকক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,
“বাড়ির মালিক।”

আয়েশা সুলতানা এগিয়ে এসে তরীকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত টে*নে ভেতরে নিয়ে এলেন। অনুযোগের স্বরে বললেন,
-“তুমি দেখছি এখন একদমই আমাদের ফ্ল্যাটে আসতে চাওনা। আন্টি কি তোমায় খুব বিরক্ত করি?”

-“ছিঃ! ছিঃ! আন্টি, বিরক্ত করবেন কেন? আসলে ইদানীং পড়াশোনার চাপ একটু বেশি যাচ্ছে। সেজন্যই আসা কমিয়ে দিয়েছি।”
সত্যটা আলগোছে লুকিয়ে গেল তরী। কঠিন সত্য তো এটাই যে, সে মাহমুদের সামনে আবার কোন বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে যায় এই ভ*য়ে*ই আসতে চায় না।

-“আজ আমার সাথে গল্প করে তবেই যাবে।”

নিঃশব্দে হেসে ফেললো তরী। বলল,
-“ঠিক আছে।”

-“বাটিতে কী এনেছো?”

-“খিচুড়ি। বৃষ্টি হচ্ছে, সবাই খেতে চাচ্ছিল। তাই রান্না করে ফেললাম।”

আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি রান্না করেছো? আর কী কী পারো?”

-“প্রায় রান্নাই পারি। মায়ের কাছ থেকে শিখেছি।”

বাটি থেকে কিছু খিচুড়ি আলাদা প্লেটে নিয়ে মাহমুদকে খেতে দিলেন আয়েশা সুলতানা। সেটা নিয়ে কোনরূপ বাক্যব্যয় ছাড়াই হাত ধুয়ে খেতে বসলো মাহমুদ। কানে মা আর তরী মেয়েটার টুকটাক আলাপ ভেসে আসছে। কারো সাথে পরিচিত না হয়েও তাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছে মাহমুদের। কেননা বাসায় আসলেই মা সবাইকে নিয়ে গল্প জুড়ে দেন। সে মন দিয়ে শোনে। স্বামী হা*রা এই নারীটিকে সময় পেলেই সে মুগ্ধ হয়ে দেখে। মাকে সে হাসিখুশি দেখতে চায়। মা নামক এই নারীটি কষ্ট পেলে তার বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালা করে।

তরী আড়চোখে একটু পরপর মাহমুদের খাওয়া দেখছে। তার রান্না ঘরের মানুষ ছাড়া বাইরের কেউ কখনো ট্রাই করেনি। আজই প্রথম আন্টির জন্য নিয়ে এসেছিল। লোকটি কোন ফিডব্যাক দেবেন কি? দিলেও কেমন দেবেন? পজিটিভ না-কি নেগেটিভ?
পরক্ষণেই তরী ভাবলো সে এতসব ভাবছে কেন?

অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে এবার উঠে পড়লো তরী। আয়েশা সুলতানাকে বিদায় জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। ড্রয়িংরুমে বসেই কাজ করছিল মাহমুদ। মা খেতে বসেছেন। তাই সে দরজা লাগাতে গেল। দরজা পর্যন্ত এসেই মাহমুদের কথায় থেমে গেল তরী।
মাহমুদ শান্ত চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
-“খিচুড়িটা বেশ ভালো ছিল।”

কারো প্রসংশা করতে সে কখনো কার্পণ্য করেনা। তাই সরাসরিই তরীর রান্নার প্রসংশা করলো। তরী কী বলবে ভেবে পেলো না। এই একটা জায়গায় এসেই সে শব্দ হারিয়ে ফেলে। পরিস্থিতি হয়তো এমন হতোনা। যদি না সেদিন মাহমুদ এসে পড়তো। হুট করেই কোন বিব্রতকর ঘটনা ঘটে গেলে তটিনীর জড়তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। এখনও ঠিক তেমনটাই হচ্ছে।
প্রসংশা পেয়ে ধন্যবাদ দেবে কি দেবে না ভেবে উসখুস করছিল সে।
অনেকটা সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো মাহমুদ। মোটা মোটা পুরুষালি স্বরে শুধালো,
-“এতটা অশান্ত কেন হচ্ছেন, তরী? আপনি কি সেদিনের ঘটনার জন্য বিব্রত?”

#চলবে………

(এখন থেকে তরী নাম চলবে। মাঝেমাঝে সংলাপের স্বার্থে তটিনী আসতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here