অনুভব
৭ম পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর
অর্ণবের গলা জড়িয়ে ওর বুকের সাথে লেগে আছে একটা মেয়ে, মেহুলের মনে হচ্ছে মেয়েটাকে ও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে। অর্ণব কেনই বা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার পারমিশন দিয়েছে? আচ্ছা অর্ণব কি তাহলে ওকে ভালইবাসে না? কিন্তু ভাল না বাসলে একটু আগে যেটা হল সেটা কি ছিল? মাত্র তিন সেকেন্ডের জন্য মেহুলের মনে হতে লাগল হাজার বছর পার হয়ে গেছে ওর, চোখের পানি যেন বাঁধ ভাঙ্গা শুরু করল। টপটপ করে চোখের পানি গুলো চিবুক ছুঁয়ে বুকের উপরে পড়া শুরু হল। সহসা একটু পরেই লাল হয়ে যাওয়া দু চোখ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিল। ধীরে ধীরে ওর মনে পড়লো অর্ণবের ক্লজিটের মধ্যে যে ছবিটা ও পেয়েছিল, এই মেয়ে আর সেই ছবিটা তো একই। তাহলে অর্ণব এই মেয়েটাকেই ভালোবাসতো? যদি এমনটাই হয় তাহলে ওকে বিয়ে করল কেন? তাহলে ও কি এই দুজনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না ও কারো মাঝে আসবে না। যে যেমন করে ভালো থাকতে চায় সে তেমন করেই ভালো থাকুক। হঠাৎ আকাশের দিকে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ও….
অর্ণব সবে বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে ফোন বের করেছে কল দেবে বাসায়, হঠাৎ এমন সময় ওর মনে হল ঘাড়ের কাছে কার যেন কোমল স্পর্শ। অর্ণবের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো, ও জানে এটা মেহুলেরই হাত। হাতটা ধরে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখের পাতা যেন স্থির হয়ে রইল ওর। হাসোজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঝিলমিল। অর্ণবের যেন বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না, কি করে সম্ভব ঝিলমিলের এখানে আসা, স্বপ্ন দেখছে না তো ও? জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন এর মতন। সামনে ঘুরে এসে ঝিলমিল সহজ ভঙ্গিতেই অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরলো।
___ ” আমাকে ছাড়া ভালো নেই জানি, তারপরও প্রশ্ন করছি কেমন আছো।”
ঝিলমিল এবার আরো কাছে এগিয়ে এলো অর্ণবের। এতক্ষন বিস্ময়ের ঘোরে থাকার পরে অর্ণবের হঠাৎ প্রচুর রাগ হতে লাগল, বিশেষ করে ঝিলমিলের উপরে। ওকে হাত দিয়ে এক প্রকার ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
___ ” তোমার সাহস কি করে হয় আমার পিছু পিছু এখানে আসার। হাউ ডেয়ার ইউ?”
___ ” ভালবাসি তাই এসেছি, সকালে ফোন দিয়েছিলাম তখন বর্ডার পার হচ্ছিলাম। আচ্ছা কেমন তুমি বলো তো, এত দিন পরে এসেছি আমি তুমি এমন করছো কেন বলো তো! ”
আধো স্বরে বলল ঝিলমিল। অর্ণব ততক্ষনে রাগে নিজের সংবরন খুঁইয়েছে,
___ ” আমি তোমাকে ঘৃণা করি ঝিলমিল ঘৃণা। তোমার নাম মনে আসলে আমার এখন মুখ ভরে থুতু আসে বুঝলে…”
___” প্লীজ অর্ণব আমাকে আর একটা বার সুযোগ দেও প্লীজ। ”
___ ” একদিন এভাবেই কেঁদেছিলাম আমি, কিন্তু তুমি ফিরে আসো নি ঝিলমিল। আজকে তোমার কাঁদার পালা। আর হ্যাঁ আমার কাছে তোমার জায়গাটা ছিল সেটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ”
___ ” এমন করে বলো না, সহ্য করতে পারতেছি না।আমাকে ক্ষমা করে দেও প্লীজ। ”
অর্ণবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ঝিলমিল। অর্ণব আবারও দূরে সরে যেয়ে বলল,
___ ” আমি অন্যকাউকে ভালবাসি ঝিলমিল। আর হ্যাঁ আমার কাছে যদি দুটো অপশন থাকে মৃত্যু অথবা তুমি তাহলে আমি মৃত্যুকেই বেঁছে নেবো।”
এতক্ষনে ওদের চারপাশে অনেক লোকে জমাট বেঁধেছে৷ অর্ণবের হঠাৎ খেয়াল এলো মেহুল কোথায়, ঝিলমিলের এই ঝামেলায় পড়ে মেহুলের কথা তো খেয়ালই ছিল না অর্ণবের। ভিড় ঠেলে ও চলল মেহুলের খোঁজে। ঝিলমিল এবার শক্ত সিমেন্টের মেঝে বসেই পড়লো৷ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, আজ যা কিছু হয়েছে তার গাছ ও নিজের হাতে অনেক আগেই বুনেছিল। এবার সূর্য যেন ধীরে ধীরে ঢলে লাগল পশ্চিমে। ঝিলমিল উঠে দাঁড়িয়ে কোলাহল ছেড়ে এগিয়ে যেতে লাগল পাহাড়ের সোজা খাঁড়া ঢালের দিকে।
মেহুল হোটেলের রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে রুমে এসেই ব্যাগ গুছিয়ে নিল। বেশি কাপড় বের করতে হয় নি তাই গোছাতে বেশি সময় নিল না। পাসপোর্টটা পার্সে ডুকিয়েই হোটেলের দেওয়া নোটপ্যাড আর কলম হাতে নিল। কি যে লেখবে খুঁজে পেতে বেশ কিচ্ছুক্ষন সময় নিল, তারপর একটানা লেখে কলমের ক্যাপটা লাগিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিল। টিটেবিলের উপরে চিঠিটা রেখে রাতেই বেরিয়ে গেল মেহুল। র্যাংপো পার হয়ে গাড়ি যখন সিকিম এসে পৌঁছালো তখন মাঝ রাত, একা একটা মেয়ে এত রাতে বেশ অসুবিধাতেই পড়ল। কিন্তু ড্রাইভার একটা পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে মেহুলের দিকে ফিরে বলল,
___ ” বেহেনজী আপ ইধার ইস রাতকে লিয়ে রুখিয়ে, ইয়ে আচ্ছা হোটেল হ্যায়””
এ মূহুর্তে মেহুলের খুব মায়া হতে লাগল ড্রাইভারের জন্য, পান খেয়ে লালা হয়ে যাওয়া দাঁত গুলো মেলে নিষ্পাপ এক হাসি খেলে আছে লোকটার মুখে,
___ ” শুকরিয়া ভাইজান”
ভাড়া মিটিয়ে ট্রলিটা টেনে নিয়ে নেমে গেল মেহুল। ড্রাইভার অবাক চোখে তাকিয়ে রইল কাঁন্না আটকে রেখে নাক মুখ লাল করে ফেলা মেয়েটার দিকে। হোটেলে রুম নিয়ে মেহুল রুমে যেয়েই কাপড় ছেড়েই চলল শাওয়ার রুমের দিকে। শাওয়ারের সাথে সাথে চোখের পানির ঝর্ণাটাকেও যেন কে ছেড়ে দিল। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো মেহুল, অর্ণবকে খুব করে ভালোবেসে ফেলেছিল ও, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন যে হবে সেটা তো ভাবতেই পারে নি কখনও।
অর্ণব ভীড় ঠেলে মেহুলকে খুঁজতে বেরিয়েই গনেশ টকের সেই দোকানটাতে এলো যেখানে ও মেহুলকে রেখে গিয়েছিল। এদিক ওদিক তাকিয়েও মেহুলকে খুঁজে পেলো না ও। তারপর দোকানীকে আধ ভাঙ্গা হিন্দিতে মেহুলের সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই তারা বলল জানে না। আতিপাতি করে এদিক সেদিক খুজতে খুজতে হঠাৎ ওর মনে হলো গাড়ির কাছে যায় নি তো আবার। তারপর ও ছুটলো পার্কিংয়ের দিকে, যেয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলো না আছে মেহুল না আছে ওদের আনা গাড়িটা। তখন অর্ণবের মনে হল মেহুল চলে যায় নি তো হোটেলে। আচ্ছা ও কি ঝিলমিল আর ওকে এমন ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখে ফেলেছে। মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন উওর কোন কিছু যেন খুঁজে পাচ্ছে না অর্ণব এখন সব প্রশ্নের উওর মেহুলের কাছে। হাতের ফোনটার দিকে নজর পড়তেই ও কল করল মেহুলের কাছে। ওপাশে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না৷ তাড়াতাড়ি করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ও ফিরে এলো হোটেলে। নিচতালা থেকে তিনতালায় যে কি করে এসে পৌঁছেছিল ও সেটা ও নিজেও জানেনা। যেন ভূতে তাড়া করা মানুষের মতন এসেছিল ও। এসে দেখে মেহুলও নেই রুমে ওর ব্যাগটাও নেই। মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল অর্ণব হঠাৎ ওর চোখ পড়ল একটা কাগজ গ্লাসের নিচে চাপা দেওয়া। হাতে কাগজটা নিয়ে খুলতেই চোখে পড়ল মেহুলের গোটা গোটা হাতের লেখা,
প্রিয়…….
প্রিয়র পরে খালি রেখেছি তাতে হয়ত অবাক হবেন,কিন্তু কি বলে যে সম্মোধন করব বুঝতে পারছি না তাই খালি রেখে দিয়েছি। আসলে আমি প্যাঁচ মার্কা কথা বলতে পারি না তাই সোজা বাংলাতেই বলছি, আমি চাই না কারো সুখের অন্তরা হতে৷ আপনি আপনার ভালবাসার মানুষের সাথে ভালো থাকুন এটুকুই আমার চাওয়া। আমি কাবাবের হাড্ডি হতে একদম চাই না। আর হ্যাঁ ভাল থাকবেন। বাই দ্যা ওয়ে খুব মিস করব কিন্তু আপনাকে।
ইতি
এখানেও না হয় খালি থাকুক।
অর্ণব খুব শক্ত ধাঁচের মানুষ সহজে কখনও কাঁদে না, কিন্তু কেন জানি না আজ ওর চোখ বিদ্রোহ করেছে ওর মনকে সাথে নিয়ে।বারবার পানি জমছে চোখের কোনায়।এই পাগলী মেয়েটাকে যে খুব করে ভালোবেসেছিল ও। এই তিনচার দিনে এতটা কাছে চলে এসেছিল ও যে মনে হয় অর্ণবের জন্যই মেহুলকে বানিয়েছে উপরওয়ালা। একটু শান্ত হয়েই অর্ণব দ্রুত ওর ব্যাগ গোছালো। মেহুলকে আটকাতেই হবে, না হলে এই ভুল বোঝাবুঝিতে মেহুল সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যাবে৷ সারারাত সারাদিন জার্ণি করে অর্ণব মেহুলদের বাড়ি পৌছালো প্রায় সন্ধ্যায়। মেহুলের বাবা মসজিদে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে সবে বেরিয়েছে…….
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর