অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -০১+২

— “মামুনি! ও মামুনি, কোথায় তুমি? তোমার ছেলে আজকে সবার সামনে আমার গালটাকে মেরে খাল বানিয়ে দিয়েছে। কি বলবে না তুমি?”

হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বললাম আমি। তদানীং আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেন মহাশয়। পেছন থেকে বেনুণী টেনে ধরলেন। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলাম এবার। পুনরায় মামুনি বলে চিৎকার করে উঠলাম। মামুনি খুন্তি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কিচেন থেকে। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগে অরিশ ভাইয়া দূরত্ব বজায় রেখে সরে দাঁড়ালেন আমার থেকে। ভদ্র ছেলের মতো দুহাত সামনে রেখে ঠিকঠাক হলেন। মামুনি অরিশ ভাইয়াকে এতো শান্তশিষ্ট দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। কেন জানি ভাইয়ার এমন ভাবাবেগ সহ্য হলো না আমার। আজ নয় কোনো কালেই সহ্য হয়না। মুখের ভঙ্গিমা বদল করে, ছলছল নয়নে বললাম..

— “মামুনি, দেখ এই গালটায় দুটো চড় মেরেছে‌। লাল হয়ে গেছে। এখন তোমার কাছে বিচার দিয়েছি তাই আবার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলেছে। তোমার বিশ্বাস না হলে ভাইয়ার হাত দেখো।”

মামুনি অরিশ ভাইয়ার দিকে রুদ্ধ চোখে তাকালেন। খুন্তি তুলে বললেন..

— “অরিশ এই বয়সে কি মার খেতে চাস? কেন বারবার মেয়েটার পেছনে লাগিস বল তো?”

মামুনির কথায় এবার কান্না পেয়ে গেল আমার। বরাবারই কেউ আমার হয়েছে কথা বললে এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। এগিয়ে গিয়ে মামুনিকে জড়িয়ে ধরলাম। হাউ মাউ করে নাকে কান্না শুরু করে দিলাম। আমার এই কান্না নতুন কিছু নয়, সবাই বেশ পরিচিত। বিরাগী হয়ে মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন..– “তুমি আমার মা, না-কি তরীর?”

ধপাধপ পায়ে হেঁটে উপর থেকে মামা নেমে এলেন। এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, কিছু একটা হয়েছে। দূর থেকে আমাদের পর্যবেক্ষন করে এগিয়ে এলেন তিনি। অরিশ ভাইয়ার কাঁধে চপল মেরে বলল..

— “মাইয়া মানুষ মানেই ছিঁচকাদুনে। কিছু হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়‌। তোর মায়ের কাছে থাকতে থাকতে তরীরও একই অবস্থা হয়েছে।”

এতেই যেন অতিশয় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মামুনি। খুন্তি তুলে বললেন..

— “ভাইয়া মানুষ মানে কি? বেশ তো ছিঁচকাদুনে মাইয়া মানুষের রান্না খেতে হবেনা, রান্না করে খাও..

বলেই খুন্তি হাতে নিয়ে তেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। মামা টলমলে নয়নে অবলোকন করলো। ইমোশনাল হয়ে কি থেকে কি বলে দিয়েছে হিসেব নেই তার। এখন পড়লেন মহা মুশকিলে। যেমন ধপাধপ পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, তেমন ধপাধপ পায়ে হেঁটে প্রস্থান করলেন। বাকি পড়ে রইলাম আমি আর অরিশ ভাইয়া। তাকে ভেংচি কেটে যেই-না উপরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম অমনি কান টেনে আটকে দাঁড়ালেন। চিৎকার করতে চাইলে মুখ চেপে ধরলেন। হুমকি দিয়ে বললেন..– মুখ থেকে আরেকটা স্বর বের হলে, এখানে সব ফাঁস করে দিবো? তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র নিয়ে আমার রুমে আয়!

তার হুমকি শুনে ফিচেল হাসলাম আমি। তিনিও বত্রিশ পাটি মেলে দিলেন। আমার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে চলে গেলেন তিনি, রেখে গেলেন এক আকাশ সমপরিমাণ দূশ্চিন্তা।
ফ্লাসব্যাক___

আমি তরী। বাবা মা নেই বললেই চলে। আমার জন্মের সময় রক্তশূন্যতায় পৃথিবীর ছেড়েছেন তিনি। বাবা থেকেও নেই। ছোট বেলা থেকে মামা মামুনির কাছে মানুষ হয়েছি। আছে একটা বড় ভাই। তার নাম তারুণ্য। মায়ের মৃত্যুর পূর্বে ঠিক করে রেখেছিলেন, তরী তারুণ্য। তিনি হার্ট সার্জন। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন শেষবার তার মুখ দেখেছিলাম। এখন অবশ্য মনে নেই। তবে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু চাইবা মাত্র হাজির।

অরিশ ভাইয়া আমার মামাতো ভাই। ইভেন্ট আমাদের ভার্সিটির প্রোফেসর। দ্বিতীয় ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে বসে আছি আমি। আমার সন্নিকটে বন্ধুমহল। নুডুলস খাচ্ছি বসে বসে। আমার খাওয়ার মাঝেই চোখজোড়া আটকে গেল অদূরে অরিশ ভাইয়ার দিকে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতের একটা ডাইরী। রোদ্দুরের মাঝে শার্টটা এক প্রকার লেপ্টে আছে শরীরে। ললাটে বিন্দু বিন্দু জল কণা। ফর্সা মুখটা রোদে লালচে আঁকার ধারণ করেছে। তবুও রোদের মাঝখানে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বরাবরই ভার্সিটিতে থাকাকালীন ভাইয়ার হাতে ডাইরীটা থাকে। এই ডাইরীটায় ক্লাসের সবকিছু নোট করে রাখেন আর বাড়িতে এনে আমার উপরে ঢেলে দেয়। মানে সবগুলো মুখস্থ করায়।
আমাদের ভার্সিটির আরেক-ম্যাম নিশি। ভাইয়ার সাথে কথা বলছেন। কথা বলাটা সামান্য পরিমাণে থাকলেও চলতো, কিন্তু মেয়েটা গায়ে হাত দিচ্ছি। ভাইয়াকে ম্যামের সাথে দেখে মাথা রক্ত উঠে গেল আমার। আমার সামনের টেবিলে একটা পিচ্চি বেলুন ফুলাচ্ছে। দুষ্টু বুদ্ধি এলো মাথায়। দুটো বেলুন ফুলিয়ে নিলাম। কামিজ ভেদ করে পেটের উপর রেখে ওরনা দিয়ে ঢেকে নিলাম। এবার আমাকে দেখতে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা লাগছে। ক্যান্টিনের সবাই আমার দিকে সন্দিহান নয়নে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে গেলাম ভাইয়ার দিকে। দুইজন আমাকে দেখে নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কদাচিৎ ফাঁক হয়ে আছে ভাইয়ার মুখ। আমি হাত জড়িয়ে ধরলাম অরিশ ভাইয়ার। ইনোসেন্স ফেইস করে বললাম..

— “বাবুটা তখন থেকে চকলেট খেতে চাইছে আর তুমি এখানে এসে দাড়িয়ে আছো জানেমান। আমরা কিন্তু তোমার সাথে কথাই বলবো না।”

ভাইয়া এবার অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ঠোঁট চেপে শব্দহীন হাসলাম আমি। ভাইয়ার ব্যবহৃত চশমাটা খুলে নিজের চোখে পড়ে নিলাম। আঢ় চোখে তার দিকে অবলোকন করলাম। এতোক্ষণ পড়ে মুখ খুলে বললেন..

— “অরিশ, এই বাচ্চা মেয়েটা কে?”

আপনাআপনি কোটর থেকে বেরিয়ে এলো আমার আমার চোক্ষুজোড়া। বাচ্চার মা সাজতে এসে শেষে কি-না বাচ্চা হয়ে গেলাম। ইচ্ছে তার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলি। জেদ ধরে অরিশ ভাইয়াকে দেখিয়ে বললাম..

— “এইযে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখছো? তার বাচ্চার মা..

আর কিছু বলার আগেই সেই পিচ্চি ছেলেটা চলে এলো আমাদের মাঝে। আমার পেটের দিকে ইশারা করে বলল..

— “এই মেয়েটা আমার বেলুন নিয়েছে ভাইয়া।”

ছেলেটা এগিয়ে এসে বেলুন নেওয়ার চেষ্টা চালালো। হলো তার বিপরীত। বেলুনটা ফুটে গেল। সাথে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। অরিশ ভাইয়া তেড়ে তাকালেন আমার দিকে। নিশি নামক মেয়েটা তো ইতিমধ্যে হা হা করে হেঁসে উঠেছে। ছেলেটাকে থামাতে মৃদু শব্দে চপল মারলেন আমার গালে। এতেই কাজ হয়ে গেল।

_______________
লাইভ কনভারসেশন চলছে। দেখায় মন দিয়েছে আরশি। নয়ন জোড়া নিবন্ধ টিভির মাঝে। পৃথিবীর সব ধ্যান ভাবনা টিভির ছেলেটিকে নিয়ে। রুমে প্রবেশ করলাম আমি। আরশিকে এভাবে টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালাম। অপূর্ব আহসান-কে নিয়ে কি পেয়েছে মেয়েটা বোঝার চেষ্টা চালালাম। এই কনভারসেশন দেখবে বলে আজকে ভার্সিটিতে যায় নি। শুধু সে নয় অনেকেই অনুপস্থিত ছিল। আমার জল্পনা কল্পনার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো আরশি। অধর ছুয়ে দিলো টিভির গ্লাসের উপর। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত অপূর্বের জায়গায় অন্য একটা মোটা সোটা কালো লোক ছিলো। নাক ছিঁচকালাম আমি। বললাম..

— “ছিঃ ছিঃ। শেষে কিনা চাচাকে

আরশি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে আমার সামনে এসে বসলেন। মুখ কালো করে বলল..

— “এই অপূর্বের একটা ছবিও কোথাও পেলাম না। এতো দিন অপূর্ব মনে করে যে ছেলেটার সাথে কথা বলেছি, সেটা এখন জেলের আলু পরোটা খাচ্ছে। একটু পর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এই ভিডিওটাও ডিলেট করে দিবে।
একবার এই ছেলেটাকে হাতের মুঠোয় পাই, বিয়ে না করে ছাড়বো না। ছাড়বো না মানে ছাড়বো না।”

শেষে কথাটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে সে। অতঃপর বেডের উপর উঠে সাউন্ড সিস্টেম চালু করে শুরু হয়ে গেল তার নাচ।

এদিকে টেনশনে পড়ে গেলাম আমি। একটু পরে আমাকে না পেয়ে মহাশয় নিজে এসে হাজির হবে। আমার ভাবতে দেরী ওমা তার আস্তে দেরী হলো না। সাউন্ড সিস্টেম টা অফ করে সামনাসামনি দাঁড়ালেন আমার। আমাকে তার রুমে যেতে বললেন।
— “তাড়াতাড়ি রুমে আয়। খবরদার আমাকে যেন আসতে না-হয়।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড় লাগালাম তার রুমের দিকে। ভেতরে ভয়ে ভয়ে কম্পিত হচ্ছি বারবার। খবরদার শব্দটি সচরাচর ব্যবহার করেন না। একবার ব্যবহার করলে, তার অন্যথা হয় না#অনুভূতির_অন্তরালে❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২

সেই কখন থেকে কান ধরে উঠবস করে যাচ্ছি। অরিশ ভাইয়া গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে উঠবস থামিয়ে দিবো, তার কোনো উপায় নেই। অরিশ ভাইয়ার ডান হাতে স্টিলের স্কেল। যদি এখানেও ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ হতো ঠিক আছে। না, তেমন কিছু হলো না। পকেট থেকে নিজের মুঠোফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে দিলো। আমি সিউর, এই ভিডিও দিয়ে পরেরবার আমাকে ব্লাকমেইল করবে। আমি কিছুতেই এমন হতে দিবো না। তট জলদি কান ছেড়ে পা নামিয়ে উল্টো ঘুরে সর্বশক্তি দিয়ে দিলাম দৌড়। এতে হয়তো ভাইয়ার সহ্য হয়নি‌। হাতের মাঝে বন্দী স্কেলটা ছুঁয়ে মারল আমার পায়ের পাতা বরাবর। সাথে সাথে পায়ের টাকনুতে লেগে থেমে গেল চরণ। আঘাতপ্রাপ্ত হলো চরণ। পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম নিচে। ব্যাথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আমার। ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার দিকে তাকাতেই ক্ষোভে পূর্ণ হয়ে এলো শরীর। সামান্য একটুর জন্য আমাকে এভাবে আঘাত করতে পারল।

অরিশ ভাইয়া উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে এগিয়ে এলো দুকদম। মাটি থেকে স্কেল-টা তুলে নিলো। এক হাঁটু গেড়ে ভাঁজ করে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল..

— “পালাতে চেয়েছিলি না, পালা এবার। যা পালিয়ে যা। আমার কথার অবাধ্য হলে এর চেয়ে ভয়ংকর ফলাফল হয়। এবারের মতো এইটুকু, পরের বার আরো..

সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। ব্যাথায় আমার অবস্থা শোচনীয় আর তিনি ভাষণ দিচ্ছে। একবার যাই এখানে থেকে আর আসবো না। অম্বুতে পূর্ণ হলো আঁখি জোড়া। তার অগোচরে মুছে নিলাম। মাটিতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম। সক্ষম হলো না। পায়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম। পড়ে গেলাম নিচে।

আমার অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসলেন তিনি। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন। নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে গলা জড়িয়ে ধরলাম তার। একদম কাছাকাছি মিশে গেলাম আমি। আরো একবার ক্রাশ খেলাম তার সৌন্দর্যে। আমি যখন তার ভাবনার বিভোর তৎক্ষণাৎ তিনি ফেলে দিলো বেডের উপরে। কোমড়ে ব্যাথা পেলাম খানিকটা। সূচালো চোখে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। তিনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলল..

— “আই নো দ্যাট, আমি দেখতে সুন্দর। তাই বলে এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। শুধু শুধু নজর লেগে যাবে। এখন নজর ফোঁটা পড়তে পারব না।”

ভেংচি কাটলাম আমি। অরিশ ভাইয়া কাবার্ড খুলে মলম নিয়ে এলো। মলমটা স্বযত্নে পায়ে লাগিয়ে দিলেন। শেষে ওয়ান টাইম লাগিয়ে দুগালে চাপ দিলো। হাত সরালো না। গালে হাত রেখেই বললেন..

— “এভাবে গাল ফুলিয়ে রাখতে নেই পিচ্চি, তোকে দেখতে ভয়ংকর লাগে। তিন আঙ্গুলের বাচ্চাদের এতো ভয়ংকর হতে নেই।”

এতেই যেন আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলাম। ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম..

— “একদম আমাকে তিন আঙ্গুলের পিচ্চি কিংবা বাচ্চা বলবেন না। আমি মোটেও তিন আঙ্গুল নই। তাছাড়া আমি গাল ফুলাবো, নাক ফুলাবো যা ইচ্ছে তাই ফুলাবো। তাকে আপনার কি?”

এতে তার কপাল যে কুঁচকে গেছে বেশ বুঝতে পারছি। যেই আপনি ডাকার জন্য আমাকে শাস্তি দিলো, সেই আপনি ডেকে ফেললাম। তবে এটাই আমার বৈশিষ্ট্য। কারো সাথে রাগ করলে তাকে আপনি বলে সম্বোধন করি। আমি মনে করি, তুমি আর তুই বলে সম্মোধন মানুষকে প্রিয় করে তোলে। আপনি সম্মোধন পর পর লাগে।

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল তখন, যখন অরিশ ভাইয়া আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। তেলের বোতলটা হাতে এগিয়ে দিয়ে দিয়ে বলল..

— “এখন তো আর কান ধরে উঠবস করতে পারবি না। তারচেয়ে বরং বসে বসে তোর ছোট হাতে আমার মাথায় তেল দিয়ে, হাত বুলিয়ে দে..! এটা তোর শাস্তি।”

অতঃপর তিনি নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। এটা নতুন কিছু নয়, মাঝে মাঝে তিনি আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর আমি তার চুলগুলো সানন্দে টেনে দেই। তার ধারণা আমার এই ছোট হাতজোড়া তার মাথায় রাখতে, তিনি সকল ক্লান্তি থেকে অবসর পায়। কিন্তু আমার হাত মোটেও ছোট না।
আমিও কথা বাড়ালাম না। হাতে তেল নিয়ে প্রতিটি চুলের ভাঁজে লাগিয়ে দিতে লাগলাম। এই কাজটা করতে বরাবরই আমার খুব ভালো লাগে।

ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে গভীরতম হচ্ছে। নিদ্রায় নয়নজোড়া মেলে রাখা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার জন্য। ততক্ষণে হয়তো ভাইয়া গভীর তন্দ্রায় মগ্ন হয়ে গেছেন। মাথাটা হেলিয়ে দিলাম বেডের কিনারায়। হাই তুলে লোচন যুগল বন্ধ করে নিলাম। হাতজোড়া তখনও নির্বিকার ভাবে অরিশের চুলে বন্দী। হাতজোড়া খসে পড়লো নিচে। কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম, জানা নেই।

_______________
ভোরের প্রথম সোনালী আলো
স্বপ্ন নতুন জাগিয়ে গেলো,
শিশির ভেজা ঘাসের পাতায়,
তোমার হাতের আলতো ছোয়ায়,
ফুটলো সকাল কাটলো রাত,
তাই মিস্টি মুখে জানাই তোমায়
“সুপ্রভাত”

সূর্যের উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাইরের উষ্ণ হাওয়া জানালা ভেদ করে ঘরে উঁকি দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করতে করতে ৯টার কাঁটা ছাড়িয়ে। মধ্য রাতে ঘুমানোর ফলে এখনো ঘুম গভীর। হঠাৎ মুখের উপর পানি পড়াতে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। সামনেই অরিশ ভাইয়া ফাঁকা গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে বাকি নেই, গ্লাসের বাকি পানিটুকু আমার দেহে। মুখ কুঁচকে বললাম..

— “অরিশ ভাইয়া তুমি আমার রুমে কি করছ?”

— “কানের নিচে চড় পড়লে ঠিক মনে পড়বে। আমি তোর রুমে নয়, তুই আমার বাড়িতে, আমার রুমের, আমার বেডের উপর আরাম করে ঘুমিয়ে আছিস! বুঝলি?

অপমান বোধ হলো আমার। থাকবোই না এই বাড়িতে। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। কিছুদূর গিয়ে মনে পড়লো আমার চুলগুলো খোলা। ফিরে এলাম চুলের কাঁটা নিতে। যতবার আমি অরিশ ভাইয়ার রুমে ভুলে ঘুমিয়ে গেছি, তখনবার কাঁটা হারিয়ে গেছে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু উঁকি দিলাম। অরিশ ভাইয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ না করেই বললাম..

— “ভাইয়া তুমি আবার আমার কাঁটা নিয়েছ? তুমি জানো না, আমার ভাইয়া বাড়িতে নেই। সে না থাকলে কে আমাকে কাঁটা কিনে দিবে?”

হেয়ার ব্রাশ-টা জায়গা মতো রেখে আমার দিকে কয়েকপা এগিয়ে এলেন তিনি। মাথাটা নিচু করে বলল..

— “আমি তো মেয়ে মানুষ, এতোবড় চুল সামলাতে তোর ব্যবহার করা কাঁটা, নিজের চুলের ব্যবহার করি। নে তাহলে খুলে নে.., ডাফার!”

শেষের কথা ধমকের সুরে বলল তিনি। মৃদু কেঁপে উঠলো আমার শরীর। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উল্টো ঘুরে নিজের রুমে চলে এলাম।
.
.
সবাই ইতিমধ্যে নাস্তার টেবিলে বসে পড়েছে। আমিও চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। মামনি দুটো পরোটা সাজিয়ে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। চোখের ইশারায় খেতে বলল। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে বড় বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আরশির পায়ের নিউ কালেকশন পায়েল-টা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। ভাইয়াকে বলতে চেয়েও পারি না, তাই ইতোহস্ত নিয়ে বললাম..

— “মামা, আমাকে কিছু টাকা দিবে। আসলে..

কথা শেষ করতে পারলাম না, তার আগেই শোনা গেল তৃতীয় ব্যাক্তির কন্ঠস্বর..

— “দে, দে ওকে তোর সব টাকা দিয়ে দে! অলক্ষী, অপয়া মেয়েটাকে সব দিয়ে দে। না দিলেও সমস্যা নেই। কিছুদিন পরে তোর সব কিছু খেয়ে ফেলবে‌। যেমনটা ওর মাকে খেয়েছে।”

রুটির টুকরো টা মুখে দেওয়ার মতো শক্তিটুকু অবকাশ নেই শরীরে। হাত থেকে খসে পড়লো নিচে। সাথে যোগ দিলো অশ্রু ধারা। গড়িয়ে পড়ার আগেই ক্লান্ত হাতে মুছে নিলাম। আমি কি সত্যিই অপয়া, অলক্ষী। নিজের মাকে শেষ করেছি। আমি তো আমার মাকে নিজের চোখেই দেখেনি, তাহলে কিভাবে খেয়ে ফেলেছি। এখানে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আমার। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উপরে যাওয়ার পথে তাদের কথা কানে এলো আমার। মামা বলছেন..

— “কিসব বলছো তুমি? কষ্ট পাবে তো! মেয়েটার মা নেই, বাবা থেকেও নেই। বড় ভাই বাড়িতে নেই।”

দিদা তার কথা থেকে নড়লেন না। আরো দুটো পরোটা ছেলের প্লেটে দিয়ে বললেন..

— “ঠিকই তো বলেছি! ওর জন্য ওর মা মরেছে। বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের অশান্তিতে..

ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এলো কন্ঠস্বর। তাদের কথা আর কানে এলো না। বেলকেনিতে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। সব পাখিদের দিন শেষে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে, কিন্তু আমার সেই জায়গা-টা নেই।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অনুভুতির_অন্তরালে❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here