অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -৪০+৪১

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪০

অনিতা জানালার পাশে বসে আছে। তার অবাধ্য নেত্র জোড়া অশ্রু ধারায় পরিপূর্ণ। মুছে ফেলার চেষ্টা করছে না। আশ্রমের সব ছেলে মেয়েরা তার মুখের দিকে চাতক পাখির নিমিত্তে তাকিয়ে আছে। পরের কথাগুলো শুনবে বলে। অনিতা বললেন না। নিজের পাপের কথাগুলো বাচ্চাদের কাছে কিভাবে বলবে। সকলের অগোচরে মুছে নিল অশ্রুটুকু। অতি সাধারণ স্বরে বললেন,

-” কালকে তোমাদের স্কুল আছে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। কালকে আবার বাকিটা বলবো।”

বাচ্চারা কিছুতেই যাবে না। অনিতাও চুপ করে রইলাম। অনেক কষ্টে রাজি করালেন সকলকে। সকলে শুয়ে পড়লেন। অনিতা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ছোট ঘরে গিয়ে বসলো। আলো জ্বালিয়ে দিলো। এখন তার কাছে আলো আঁধার দুটোই সমান। দিন রাতের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। ডান পাশে তাকালো। অরিশ আর তরীর হাসৌজ্জ্বল দুই মুখ। অরিশ তরীর চুল টেনে ধরেছে। তরী পেঁচা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে‌। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। হাত বুলিয়ে নিলেন ছবিতে। ধুলো জমে গেছে ফ্লেমে। গাঁদা ফুলের মালা টা শুকিয়ে গেছে। অনিতা খুলে রাখলেন। পাঁচ বছর ধরে এই ছবিটা বুকে আগলে রেখেছেন। তার প্রিয় বলতে কেউ নেই। তার ভুলের জন্য অরিশ তরী কেবল স্মৃতি। মরে গেছে তারা। শুধু অরিশ তরী মেরে যায়নি, একটা ফুটফুটে ছোট বাচ্চা, তাদের বাবা মায়ের সাথে চলে গেছে। “তুর”! ছোট নাম অথচ হৃদয় স্পর্শ করে ফেলেছে। অপূর্ব আরশি এখন অচেনা, অজানা কোনো দেশে থাকে। তার বাবা ছায়ার মতো ঢাল হয়ে আছে। তার মা। অরিশের দিদাও মরে গেছে। অঘটন টা ঘটার পরে পুরো বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেছিলো। অরিশের বাবা কথা বলা বন্ধ করে দেয় সকলের সাথে। অনিতার মা দিন দশের পর মৃগী রোগের কারণে আগুনে পুড়ে মারা যায়। যখন তিনি জ্ঞানশক্তি হারিয়েছে, তখন নিস্তেজ হয়ে কিচেনে পড়ে যায়। তার শাড়ির আঁচলের এক প্রান্ত আগুনে ছিল। শাড়ির আগুন লেগে মারা যায় সে। তার কিছুদিন পর সকল সম্পত্তি তার নামে লিখে দেয়। সাথে চিঠি লিখে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তার স্বামী মোতাহার হোসেন। তার মেয়ের কাছে আছে।

অনিমা সবকিছু দান করে অপূর্বের প্রতিষ্ঠা করা এতিম খানায় থাকছে। নিজের সন্তানদের হারিয়ে তাদের যত্নে নিজের জীবন অতিবাহিত করছে। আর মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছে।
_________
অপূর্ব সবে বাড়িতে ফিরেছে। বৃষ্টির ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। শীতকাল হলেও বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিজের রুমে গেল। সেখানেও আরশি নেই। মেয়েটা কোথায় গেছে। আশে পাশে আছে ভেবে জামা কাপড় সমেত ওয়াশরুমে গেল। মিনিট বিশেক পর বেরিয়ে এলো। বেলকেনিতে ভেজা জামা কাপড় গুলো মেলে দিলো। আরশি আরশি বলে বেশ কয়েকবার ডাকল। সারা পেল না। বিনিময়ে আয়া এলো। আরশির দায়িত্বের জন্য আয়ান রাখা হয়েছে। মাথা নিচু করে বলল,

-” স্যার ম্যাম বাইরে গেছিলো। কবরের কাছে। এখনো আসে নি, আমি তাকে নিয়ে আসতে গেছিলাম। সে আমাকে ধমকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

আরশির ইদানিং কি হচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না।অপূর্ব ঘরে এসে ছাতা নিলো। ভেজা রাস্তা দিয়ে সচেতনতা অবলম্বন করে সেদিকে এগিয়ে গেল। আরশি কবরের পাশে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। আট মাসের ভারী পেট টা দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব আতংকে উঠলো। কতোক্ষণ ভিজেছে তার হিসেব নেই। তার শরীরের চামড়া সাদা হয়ে গেছে। যেখানে একটু ঠান্ডা লাগলেই ক্ষতি। সেখানে বৃষ্টিতে কিভাবে। অপূর্ব ছাতা আরশির মাথায় ধরলো। আরশির পাশে বসে বলল,
-” আরু, কি করছো তুমি? তুমি জানো না, বেবীর ক্ষতি হবে? তাহলে..

আরশি তাচ্ছিল্যের হাসলো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি গেল। বলতে লাগলো,
-” আর বেবী। ও তো আগের বারের মতো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমার পুড়া ভাগ্য দেখো। তোমার বোন। তোমার বোন আমার সন্তানকে কেড়ে নিচ্ছে। কেন কেড়ে নিচ্ছে? আমার মা ওদের বাঁচতে দেয়নি তাই।”

অপূর্ব জবাবে কি বলা উচিত ভুলে গেছে। ছাতাটা সার্ভেন্টের হাতে দিলো। আরশির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চোখে পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-” আমার খুকি যে, আরুকে অনেক ভালোবাসত। সে কিভাবে তার আরুর ক্ষতি করবে?”

আরশি অপূর্বের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলল,

-” তাহলে আমার মায়ের কুকর্মের অভিশাপ আমার উপরে পড়েছে।”

এই নিয়ে পাঁচ বার কনসেভ করেছে আরশি। পাঁচ ছয় মাস পরেই মিসক্যারেজ হয়েছে। আরশি ধারণা, তার মায়ের কাজের ফল সে ভোগ করছে। গ্ৰামের বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের কথা বিশ্বাস করে। তাই মৃত অরিশ আর প্রেগন্যান্ট তরীর কবরের কাছে এসেছে। অপূর্ব বিরাগী হয়ে গেল। হুট করেই আরশিকে কোলে তুলে নিলো। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়াতে আরশির ওজন স্বাভাবিক নেই। দেহের ওজন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কপালের মাঝের রগটা ফুলে উঠেছে। অপূর্ব ছোট ছোট পা ফেলে অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করল। পেছন পেছন আয়া মেয়েটা ছাতা ধরে রাখল‌।

আরশিকে বেডের উপর বসিয়ে দিয়েছে। পড়নের ঢিলেঢালা ফ্রক টা লেপ্টে আছে শরীরে। অপূর্বও ভিজে গেছে অনেকটা। এক টান দিয়ে গাঁ থেকে টি শার্ট টা খুলে এক কোণে রেখে দিলো। কাবার্ড থেকে লাল রঙের একটা ফ্রক বের করে বেডের উপর রাখল। আয়া মেয়েটাকে পড়িয়ে দিতে বলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে হাত ধরল আরশি। অনুরোধ করে,-” তুমি পড়িয়ে দাও না?”
অপূর্ব জবার দেয় না। আরশি আঙুল ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,-” কি হয়েছে কথা বলবে না?”
এবারও জবার দেয় না অপূর্ব। আরশি ব্যাথা কাতর কন্ঠে বলে,
-” আমার কথার কোনো মূল্যে নেই তোমার কাছে?”

-” আমার কথার কোনো মূল্য কি আদোও তোমার কাছে আছে? আরশি! নেই। দুটো মৃত মানুষের কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কি সব সমাধান হয়ে যাবে। তাহলে আমি রোজ গিয়ে আমার খুকিকে চাইতাম। আমার খুকির খুকি কে চাইতাম। তার বাবাকে চাইতাম।
এইসব করে তুমি আমার সন্তানের কাল ডেকে আনছো? মিসক্যারেজ হলে আরে আগেই হতো, অলরেডি আট মাস চলছে।”

আরশির নিজের কাজে অনুতপ্ত হলো। হাঁচি কাশিতে মুখ ভেঙ্গে আসছে। অপূর্ব বেরিয়ে গেল। ডাক্তার কে কল করে জানাতে হবে ব্যাপার টা।
নিচে এসে দেখা পেল মামার অর্থাৎ আরশির বাবা মোতাহার হোসেন। অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” কি হয়েছে আরশির?”
-” মামা, কি করবো এই মেয়েকে নিয়ে আমি। আমার একটাও কথা শুনছে..

কারো চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো অপূর্বের কানে। সবকিছু ফেলে দৌড়ে চলে এলো উপরে। আরশি মেঝেতে পড়ে আছে। পেটে হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করছে। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আয়া মেয়েটি আরশিকে ডাকছে। অপূর্ব ধরলো আরশিকে। ডাক দিলো তাকে, আরশি কষ্টে কাতর হয়ে গেছে। তার পেটের মাঝে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব নিজেকে সামলে বলল,
-” আরুর কি হয়েছে? এমন করছে কেন?”

-” ম্যাম আমার কথা না শুনে আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলো। তখন পা পিছলে..

অপূর্ব আরশিকে কোলে তুলে নিলো। ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে থামলো। আরশিকে পেছনের সিটে তার বাবার কাছে রেখে সে ড্রাইভ করতে লাগলো।
.
.
ডাক্তার ইমিডিয়েট ভেলিভারি করতে বলেছে। আরশি বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে। অপূর্ব ঘাবড়ে গেছে। তাকে মোতাহার হোসেন সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে তার। অপূর্ণ মনে হচ্ছে। আরশিকে তৈরি করে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে নেওয়া হবে। আরশি অপূর্বের হাতটা ধরে দূর্বল স্বরে বলল,

-” আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি কিন্তু অরিশ ভাইয়ার মতো করবে না। আমাদের পুঁচকু টাকে মানুষ করবে। আমি আমার ভাই ভাবীর আর তুরের কাছে ভালো থাকবো। আর আমরা দুজনেই চলে গেলে, তুমি ভেঙ্গে পড়বে না। নতুন একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবে।”

অপূর্ব নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আরশি গালে চড় বসিয়ে দিল। আরশির থেকে দূরে গিয়ে নার্সদের উদ্দেশ্য করে বলল,

-” ওকে এখান থেকে নিয়ে যান।”
আরশিকে ভেতরে নিয়ে গেল। অপূর্বের চোখে জল। ডাক্তার হয়ে ভয় পাচ্ছে। নিজের বোনটাকে আগলে রাখতে পারে নি। এবার অন্যের বোনটাকে সে আগলে রাখবে। টুলের উপর বসে পড়লো। হারিয়ে গেল ধোঁয়াশায় পূর্ণ স্মৃতির পাতায়।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১

গ্ৰামে থেকে আসার পর চার মাস পেরিয়ে গেছে। অরিশ এখন বিদেশে থাকে। দুমাস হয়েছে গেছে। তার চোখের সমস্যা তীব্র হয়েছে। আগে চশমা ছাড়া যথেষ্ট দেখতে পেত কিন্তু হঠাৎ করেই চশমা পরেও দেখতে পাচ্ছিল না। মাথা সারাদিন ধরে থাকত। তাই চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়। তাও দুই মাস। ডাক্তার তাকে বিদেশে যেতে বলে চিকিৎসা করাতে। তাই অরিশ মাস দুই হয়েছে বিদেশে গেছে, তার সাথে অপূর্বও গেছে।
তরী শুয়ে আছে। চারদিকে আয়ানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইদানিং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বমি বমি পাচ্ছে। কিছু খেলে ঘন্টা খানেক পেটে থাকছে না। সারাদিন মাথা ঘুড়ায়। গাঁ গুলিয়ে উঠে। তলপেটে আগের চেয়ে ভারী ও বড় হয়ে গেছে। তরী পেটের উপর হাত রেখে বসে আছে।

আরশি হুরমুড়িয়ে ফোন নিয়ে ঢুকল ঘরে। সবে ঘুমের মতো পড়েছে তরী। তার ভেতরেই এমন আরশির প্রকট কন্ঠস্বর শুনে লাফিয়ে উঠলো। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,-” কি হয়েছে আরু? চেচাচ্ছিস কেন?”

আরশি তাকালো একবার। নিভু নিভু কন্ঠে বলল,-” ভা, ভাইয়া ফোন করেছে। তোকে নাকি দুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।”

তরী একপলক চাইলো।
-” পরে কথা বলবো নে!”

আরশি চমকালো। হঠাৎ মেয়েটার কি এমন হয়েছে? দুপুরে খেয়ে ছিলো তো? খাবার টেবিলের উপর রাখা। -” তরী, তুই এখনো খাইনি কেন?”

ফোনের ওপাশে থেকে অরিশের কাতর কন্ঠস্বর ভেসে এলো,-” তরী তুই খাস নি।”
দুইজনেই ফোনের দিকে চাইলো। আরশি ফোন কেটে দিলো। খাবার নিয়ে মেখে জোর পূর্বক তরীর মুখে দিয়ে দিলো। আরশি মুখে হাত দিলো। দৌড়ে গেল ওয়াশরুমে। বেসিনের উপর মুখ রাখতেই বমি করে ভাসিয়ে দিলো। আরশি ছুটে এলো। তরীকে এই অবস্থায় দেখে ছুটে গেল মায়ের ঘরের দিকে। অসহায় হয়ে গেল। তরী ট্যাপ ছেড়ে কুলি করে বেরিয়ে এলো।

বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। অনিতাকে নিয়ে এসেছে আরশি। অনিতা তরীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিক্ষা করলেন। তরীর সমস্যা গুলো জানলেন। অনিতা কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,-” তুই কি প্রেগন্যান্ট তরী?”
তরী চুপ করে রইলো। নির্বাক সে। তার হাত টা আপনাআপনি পেটের কাছে চলে গেল। চোখ থেকে আনন্দ মিশ্রিত পানি গড়িয়ে পড়লো। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,-” তুর!”

আরশি নাচছিল। তুর শুনে ভ্রু নাচালো। অভিমানী সুরে বলল,” তুই নাম ঠিক করে ফেললি?”

তরী তখনও নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অরিশ ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে করছে, ভাইয়া তোমার পিচ্চি আরো একটা পিচ্চির জন্ম দিতে চলেছে। তুমি এবার কাকে সামলাবে?”

অনিতা অরিশকে জানাতে বারণ করলেন। ডাক্তারের রিপোর্ট দেখে আগে সিউর হতে বললো। পরের দিনই ডাক্তারের কাছে গেলেন। তরী চাতক পাখির নিমিত্তে অপেক্ষা করে রইলো রিপোর্টের প্রতিক্ষায়। ডাক্তার কিছু বলেনি, গম্ভীর মুখে কয়েকটা রিপোর্ট করাতে বলেছেন শুধু।

.
অরিশের দিদা ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখলেন না। অনিমার কান ভাঙালেন। তরীকে কিডন্যাপ করার পরে অনেকদিন বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। মেয়েটাকে প’তি’তা হিসেবে উপস্থাপন করলেন অনিতার কাছে। বোঝাতে চাইলেন, এটা অরিশের সন্তান নয়।
.
পরের দিন রিপোর্টের আশায় বসে ছিলো তরী। অনিতা এলেন। তার মুখ ছিলো গম্ভীর। আরশি ছিলো সাথে। অসহায় কন্ঠে বলতে শুরু করলেন,
-” তোর টিউমার হয়েছে মা। ওভারিতে। ডাক্তার বলেছেন এটা বলের আকার। চার মাসে অনেকটা গভীর হয়ে গেছে। কোষ একত্রিত হয়ে টেরাটোমা টিউমার হয়েছে। ধারণা করেছেন, টিউমারের মধ্যে ক্যান্সার রয়েছে।
টিউমার দু’ধরনের হয়। এক ধরনের টিউমার শুধু এক জায়গাতে বৃদ্ধি পেয়ে এক জায়গাতেই বসে থাকে। এদের বলে বিনাইন টিউমার। এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়। আরেক প্রকার টিউমারের ভেতর থাকা অস্বাভাবিক কোষগুলো রক্ত কিংবা লিম্ফ্ নামক কিছু রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে শরীরের অন্য কোনো অংশে গিয়ে জমা হয়ে সেই অংশের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, নতুন কোনো টিউমার তৈরি করে সেখানে, তখন তাদের বলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। এ ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকে অন্যভাবে বলে ক্যান্সারাস টিউমার। কাজের সুবিধায় সংক্ষেপে ক্যান্সার বলে। তোর শরীরে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার।”

তরীর সব আশা ভরসা কাঁচের মতো ভেঙ্গে গেল। দূর্বল হাসলো। সে বেঁচে থাকবে তো। শত বছর বাঁচার ইচ্ছেটা পূর্ণতা পাবে তো। আরশি বলল,

-” মা! আমরা তরীর পেট কেটে বের করে ফেলতে পারি।”

-” একবার রক্ত পরিক্ষা করলে ভালো হতো।”

তরী চুপটি করে বসে রইল। অনিতা আরশিকে বাইরে যেতে বললেন। রিপোর্ট পেপারের নিচ থেকে একটা পেপার বের করে তরীর সামনে রাখলেন। অস্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-” তরী। আমার অরিকে মুক্তি দিবি।”

তরী মাথা তুলে পেপারের দিকে চেয়ে চমকে উঠলো। তার মামুনি ডিভোর্স পেপার নিয়ে হাজির হয়েছে। চোখজোড়া তার ঝাঁপসা। হাত বুলিয়ে দিল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-” মামুনি এটা কিভাবে সম্ভব? আমি তোর অনুমতি না নিয়ে.. । তাছাড়া আমি তাকে ছাড়তে পারি না। আমি যে তাকে দেনমোহর হিসাবে বিয়ে করেছি।”

-” তুই চাস না, অরিশ ভালো থাকুক। আমি তোর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করে দিবো। তুই সুস্থ হলে আবার আমার ছেলের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। প্লীজ..। তুই সুস্থ হয়ে গেলে তোকে আমি আবার আমার ছেলে বউ করে নিয়ে আসবো।”

অনিতা তরীর পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তরী ভাবল,” তার মামুনি আগের মতো নেই। বেঁচে থাকলে হয়তো আবার অরিশের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে হবে। আর যদি রক্তে হিমোগ্লোবিনে ছড়িয়ে ব্লাড ক্যান্সার হয়। তখন না হয়, তার অগোচরেই পৃথিবী ত্যাগ করলো। তার জন্য ঘৃণা বরাদ্দ করে নাহয় চলে গেল।

ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিলো। অনিতা চলে গেল। তরী উঠানের শিমুল গাছের তলে গিয়ে বসলো। তার চোখের বাঁধ মানছে না। রাত পেরিয়ে গেল। ভোর হয়ে এলো। ভোর পেরিয়ে দুপুর হয়ে এলো। তরী উঠে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করল। ভেতরটা সাজানো- গোছানো। কয়েকটা মেয়ে বসে আছে। তার মাঝে আরশির বসে আছে। একদম নিশ্চুপ সে। দুই হাত মেহেদীর রঙে রাঙানো।

তরী যেতেই টেনে নিয়ে মেহেদী পড়াতে লাগলো। তরীর কান্না মিশ্রিত ফোলা ফোলা চোখে সবকিছু দেখে আধো আধো কন্ঠে বলল,
-” মেহেদী পড়াচ্ছেন কেন?”

-” তোর যে বিয়ে!” অনিতা এসে বললেন।

-” বিয়ে! আমার! মানে!” অবাক হয়ে তরী।

-” শুধু তোর না। আরশি আর তোর দুজনের। নিভ্রান তোকে বিয়ে করতে রাজি আছে আর স্যামি, সামিরার ভাইয়ের সাথে আরশির।”

তরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। তার বিয়ে অথচ সে জানে না। অনিতার সামনে দাঁড় বলল,-” কি বলছো তুমি মামুনি? আমি যে তোমার ছেলের বউ। হ্যাঁ আমাদের আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হয়নি। তাতে কি?”

-” তুই তো নিজেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিস।”

-” কিন্তু অরিশ ভাইয়া তো সাইন করেনি। কার্যকর হতেও সময় আছে। তাছাড়া আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অরিশ ভাইয়ারই থাকবো।”

-” তুই কি ভেবেছিস তরী। তোমার মতো একজন প’তি’তা’কে আমার ছেলের বউ বানাবো? কতো ছেলে তোকে ভোগ করেছে তার হিসেব নেই।
এখন অরিশ তোকে ভালোবাসে, তাই তোকে মেনে নিয়েছে। যখন আরেকটু বয়স হবে তখন তোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দুই বার ভাববে না। ”

তরী জ্ঞানহীন চেয়ে রইল। মেয়েরা জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। পুতুলের ন্যায় বিয়ের কনের সাজে সজ্জিত করলো। তরীর কোনো রুপ বাঁধা দিলো না। তার মনের ভেতরে অনেক কথা ঘুরছে। সত্যিই কি সে তার অরিশ ভাইয়ার যোগ্য নেই।
যখন কিডন্যাপ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছে, কোনো উত্তর মেলে নি। তাহলে কি সবটা আড়াল করে রাখা হয়েছে। অনিতার কথাগুলোই সত্যি। কাবার্ডে যত্নে রাখা হসপিটাল থেকে দেওয়া গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিল। এক লাইনে বারবার খুঁজতে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য গুপ্তধন লুকিয়ে আছে। অবশেষে খুঁজে পেল। হাত থেকে রিপোর্ট টা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তরী বসে পড়লো। চোখে পানিতে ভিজে গেল সাজ।

সে আর তার অরিশের যোগ্য নেই। কিন্তু তার শরীরে সর্বশেষ চিহ্ন টা ছিল অরিশের। সে অরিশকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ের ভারী সাজ নিয়ে জানালার কাছে গেল। ওরনা বেঁধে নিল গ্ৰিল বিহীন রেলিং এ। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল। ছুটে চলল অদূরে। থাকবে না এই পৃথিবীতে।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here