অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -৩৬+৩৭

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥 (রহস্য উন্মোচন: শেষ)
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬

-” আমার চোখের সামনে আমার আভা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে।‌ ঝলসানো ভয়ংকর ছিলো সেই মুখ।
আভার সতী’ত্ব কেড়ে নিয়ে ছুরির আঘাতে শিরা কেটে ফেলেছিলো। ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো।‌ অতঃপর বাসে আগুন দিয়েছিলো। আগুন সেই দিন আভাকে স্পর্শ করলেও আমাকে করতে পারি নি। কা’পুরুষের মত পালিয়ে এসেছি। ছেড়ে এসেছি তাকে। আভা আমাকে কসম দিয়ে বাধ্য করেছিলো। তারপরের দিন খবরের কাগজে সেই পুড়ে যাওয়া বাসের খন্ডিত অংশ দেখেছিলাম। শুধু আভা পুড়ে যাইনি। আমার আর আভার বেঁচে থাকার প্রতিটা স্বপ্ন পুড়ে গেছিলো।”

তারুণ্য দূর্বল হাসলো। তার চোখের অশ্রু টলমল করছে। যা আমার চোখ থেকে এড়ালো না। আমি ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাইয়ার শীতল গাল স্পর্শ করলেই তার নেত্র জোড়া গ্ৰথণ হয়ে এলো। পরমুহূর্তেই চোখের কার্নিশ গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। ভাইয়াকে দেখে আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-” আরে পাগলী তুই কাঁদছিস কেন? এতো কাঁদলে বাকিগুলো শুনবি কিভাবে?”

আমি অবাক চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তাকে দেখে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না, তবুও আমার জন্য সবকিছু বলছে।

-” আভার মৃত্যুর পর আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, ওর খুনি, ধ’র্ষ’ক’দের শাস্তি দেওয়া। ওর খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বদলে যাই আমি‌। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি গ্যাং স্টার অপূর্ব হয়ে উঠি। আর কোনো ভালোবাসার মানুষদের বিচ্ছেদ হয়ে দেই নি।
এই অপূর্ব নামটা আভা দিয়েছিল। আমাকে দেখার পরে না-কি আভার মুখ থেকে প্রথমে অপূর্ব শব্দ টা উচ্চারণ হয়েছিল।
যেই পাঁচার কারীদের কবলে তুই পড়েছিলি। তারাই আমার আভাকে মেরেছিলো। ঐ গ্ৰুপের সবাইকে আমি বিদেশেই মেরে ফেলেছি। যেই দুইজন বাকি ছিলো তাদেরও শেষ করেছি।
বাকি রইল, তোর কাছে কেন নিজের পরিচয় গোপন রেখেছি? আমি চাইনি আমার শক্রুরা তোর কথা জেনে যাক! তোর ক্ষতি করুক। তাই বাধ্য হয়ে ছিলাম।”

আরো কিছু বলতে চেয়েছিল তারুণ্য। তার আগেই তার দৃষ্টি গেল দরজার দিকে। সেখানে আরশি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়া অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে‌। গম্ভীর তার মুখ। তারুণ্য দৃষ্টি লুকালো। আরশি তার বাড়িতে গিয়েছিল। আজকে ফেরার কথা ছিল না। বলেছিল কাল সকালে আসবে। তাই সে আজকে তরীকে সবটা জানাতে চেয়েছিল।

তারুণ্য ঠোঁট উঁচু করে কিছু বলতে চাইলে আরশি শুনলো না। তার পূর্বেই উল্টো পথ দিয়ে হাঁটা ধরলো। চুপচুপ ছাদে দিয়ে দাঁড়ালো। আকাশ তখন মেঘের ভারে কষ্টগুলো ধামাচাপা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। সে আরশির কষ্টের সাথে কাতর হয়ে উঠেছে। আরশি ছাদের এক কোনায় বসে আছে প্রানহীন জীবন্ত পুতুলের ন্যায়। স্তব্ধ তার চোখের চাওনি। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। তারুণ্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন সেদিকে। জুতো বিহীন সমান পা জোড়া নিয়ে আরশির দিকে এগিয়ে গেল। বসলো তার পাশে। আদুরে গলায় ডাকলো তাকে,

-” আলু! আলু! এই পুঁচকু আলু?”

এই নামে ছোট বেলায় তারুণ্য তাকে ডাকতো। কিন্তু আজ সে অপূর্ব, অপূর্ব আহসান। তার ঝারু ভাইয়া নেই। চোখ বুজে অশ্রু কণা বিসর্জন দিলো। অধরে অধরে চেপে নিজেকে সংযত করে বলে,

-” অপূর্ব ভাইয়া, আপনি ভেতরে যান! আমাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিন। প্লীজ!”

অপূর্ব নামটা বুকে এসে তীরের ন্যায় বিধল। নিজেকে কেমন অপরাধী, অপরাধী লাগছে তার। আজ আরশির কাঁধে দিতে গিয়েও দিতে ব্যর্থ হলো সে। নিজেদের মাঝখানে অদৃশ্য দেয়ালের আবাস পেল। মৃদু স্বরে বলল,
-” ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আয়। জ্বর আসবে।”
তারুণ্য চাতক পাখির নিমিত্তে অপেক্ষা করলো আরশির কথন শ্রবণ করার জন্য। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পানির মাঝে ছোপ ছোপ শব্দ করে প্রস্থান করলো সে।
.
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে। আরশি ছাদ থেকে ভেতরে এলো না। ভোর পেরিয়ে সকাল ছাড়িয়ে গেল। তবুও তার দেখা পাওয়া গেল না। বিরাগী হয়ে নিজেই আরশির খোঁজে নেমে পড়ি। ছাদে এসে কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। বৃষ্টি থেমে গেলেও পানির ধারায় পুরো ছাদ ভেজা। তবে আরশি যেখানে বসে ছিলো, সেই জায়গাটা শুকনো রয়েছে।
চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। হয়তো বৃষ্টির কারণে আরশি ওখানে আছে। কিন্তু আমার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে সেখানেও তার দেখা পাওয়া গেল না। হাঁফ ছাড়ল আমি। নিচে গিয়ে ভাইয়াদের সব জানালাম। পুরো বাড়ি, বাগান, সুইমিং পুল খুঁজেও মেলেনি তার আভাস। দাড়োয়ান চাচার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ভোরের দিকে আরশি চলে গেছে। দাড়োয়ান চাচা জিজ্ঞেস করেছিলো। তাকেও কিছু বলেনি। স্থির দৃষ্টিতে চলে গেছিলো।

অরিশ ভাইয়া উপায়হীন হয়ে বাড়িতে ফোন করলো। বেশ কয়েকবার করার পরেও কেউ রিসিভ করেনি। প্রায় মিনিট বিশেক পর ওপাশ থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই অরিশ ভাইয়া বিচলিত হয়ে পড়লো। মামা ওপাশ থেকে বলছে, -“আরশি বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে এসেছে। এসেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। আমরা মনে করেছি, জামা কাপড় ছেড়ে নিবে। কিন্তু সে ভিজেই বসে ছিলো। তোর মা একটু আগে ডাকতে গিয়ে দরজা বন্ধ পেয়েছে। ডাকার পরেও দরজা খোলে নি। দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি। তাও পারছি না। ওবাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিলাম। আরু একই পোশাকে ভেতরে শুয়ে আছে। কি হয়েছে ওর? কে জানে?”

আরশি এমন কথা শুনে অরিশ ভাইয়া আর তারুণ্য ভাইয়া বেরিয়ে গেলেন। তাদের পিছুপিছু আমি গেলাম। এটাই ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। মামনির ভালোবাসার মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম পেছনে কাটিয়ে আসা দিনগুলো।
.
অবশেষে দরজা ভাঙা হলো। আরশির গায়ে ধুম জ্বর।তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভেজার ফলে হাত- পা, চোখ- মুখ সাদা হয়ে গেছে। ভেজা জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে। জামা কাপড় পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মামুনি কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। দিদার গাল ভর্তি করে পান চিবুচ্ছে।
আরশির মাথায় পানি দিচ্ছে অরিশ ভাইয়া। মামুনি কাঁদছে। আমি হাত পায়ের তালুতে ঘষছি। তারুণ্য ভাইয়া ডাক্তার আনতে গেছে।

ডাক্তার দেখে মেডিসিন দিয়ে গেছে। ইনজেকশন পুশ করে রাখা হয়েছে। ডাক্তার চলে যাওয়া পর আমরা বেরিয়ে আসতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ কেউ হাত টেনে ধরলেন। মামুনিকে দেখে মাথা নিচু করে রইলাম। হয়তো আজও কিছু বলবে, মারবে। তেমন কিছু করলেন না। হুট করেই আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

-” রেগে আছিস মামুনির উপর। একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করলি না, কেমন আছি? এতো রাগ কেন তোর? আমি তোর বড়। একটা চড়ও কি তোকে মারতে পারি না! সেই অধিকারও কি আমার নেই? তাই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি!”

আমি আমার পূর্বের হারিয়ে যাওয়া মামুনিকে দেখতে পেলাম। শব্দহীন স্বরে আওড়ালাম,

-” মা-মু-নি!

মামুন মাথার অগ্ৰভাগে অধর ছুয়ে দিলেন।‌ হাত দুটি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

-” আমি তোর সাথে এতো কিছু করলাম আর তুই কিছু বললি না। তুই না চলে গেছিলি বলেই হয়তো আমি বুঝতে পেরেছি, দোষটা আমার ছিলো। আরু, অরি আমার সাথে কথা বলেনি। মা বলে ডাকে নি। কখন বাড়িতে এসেছে, কখন বেরিয়েছে। কিছু বলেনি। আমি কিছু বলতে গেলে, মাথা নাড়িয়ে হু, হা করেছে।”

ফট করে অরিশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার ফেকাসে মুখের আড়ালেও মিষ্টি হাসি লুকিয়ে আছে। মাথা দিয়ে সায় দিলেন। আমিও হাসলাম মৃদু।
এই দিনটাই কাল হয়ে উঠলো একদিন। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো চারটে জীবন। ধোঁয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো বেঁচে থাকা।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৭

বর্ষার মেঘমালা। চারদিকে বৃষ্টির ধাঁচে সবকিছুই স্পষ্ট। গাড়ির গ্লাসে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। তারুণ্য তা মুছে নিজের গন্তব্যে ছুটেছে। তার চোখের পর্দা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ভারী ভারী ঠেকছে। মাঝে মাঝে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম দূর করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। তার পাশে বসে আছে অরিশ ভাইয়া। তিনি কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে আছেন। হাতে তার ললিপপ। ললিপপে অধর জোড়া কমলা হয়ে গেছে। এই নিয়ে আট টা ললিপপ খেয়েছে। আজ আমরা ফুফুর বাড়িতে যাচ্ছি। টুরে যাওয়ার পূর্বে ফুফুজান এসে দাওয়াত করে গেছিলো। রাফি ভাইয়ার বিয়ে। আমরা সেই উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। এতো দিনের ঝামেলার মাঝে ভাইয়ার বিয়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মামুনি ভালো হয়ে গেছে। আমাকে আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তারুণ্য ভাইয়া আমার কথায় মাস্তানি ছেড়ে দিয়েছে। এখন আমরা একসাথে মামুনিদের সাথে থাকি। দিদাও কেমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। হঠাৎ করে সেদিন থেকে হুট করেই জীবনের রং ফিরে এলো। তবে আরশি স্বাভাবিক হয়নি। তারুণ্য ভাইয়ার সাথে কথা বলেনি। সর্বদা তাকে এড়িয়ে চলেছে।

হুট করে ব্রেক করাতে ভাবনার ছেদ ঘটল আমার। বেশ খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়লাম। তারুণ্য ভাইয়া চোখ ঢলছে। বোতলের ছিপি খুলে হাতে পানি নিল। গ্লাস খুলে পরপর কয়েকটা ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করে রাখল। পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিতে চাইলে বাঁধ সাধল অরিশ ভাইয়া। বললেন,

-” যা! অপু তুই পেছনে যা। এই অবস্থায় ড্রাইভ করা ঠিক নয়!”

-” আমি তোর বড় অরি। তাই আমাকে জ্ঞান দিস না। কতো চালিয়েছি..

তারুণ্য ভাইয়ার কথা থামিয়ে দিয়ে অরিশ ভাইয়া। বললেন,-” তখন তোর পরিবার ছিলো না, বোন ছিলো না। এখন আছে। তাই ওদের নিয়ে কোনো রিক্স তুই নিবি না।”
তারুণ্য আর কিছু বললো। অরিশের জায়গায় বসতে চাইলে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা জারি করলো অরিশ। তার এক কথা, তারুণ্য ভাইয়া পেছনে বসবে। তাই তার কথা মতো তারুণ্য ভাইয়া পেছনে বসলো আর আমাকে বসতে হলো ফন্ট সিটে। অরিশ ভাইয়ার মুখে তখন দুষ্টু হাসি। একবার আমার দিকে চেয়ে ড্রাইভ করতে মন দিলো। গাড়ির আয়না আমার দিকে ঘুড়িয়ে দিলেন। ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমি চোখ মারতেই ফট করে চাইলেন আমার সমীপে। আমার হাত টেনে নিজের বাহুতে নিয়ে নিলেন। নিজের সাথে দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে রাখলেন। ড্রাইভ করতে করতে বললেন,-” ঘুমিয়ে পড় ডিঙিরানী। নাহলে এই বর্ষায় তোকে ডিঙির মতো চালিয়ে চালিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যাবো।”
.
আরশি সিটের একদম কোণ ঘেঁষে বসে আছে। দুজনের মাঝখানে রাজ্যের ব্যবধান। এতোক্ষণ তরীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। তারুণ্য আরশির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বলল,

-” আরু, তুই চাইলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারিস।”

আরশি নাক ফুলিয়ে চাইলো তারুণ্যের দিকে। তার গলা আরশি ছাড়া কেউ শুনে নি। আরশি দ্বিগুণ তেজ নিয়ে ধীরে ধীরে টেনে টেনে বলল,
-” কোন পরপুরুষ কিংবা পর নারীর প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে আরু ঘুমায় না। তাদের থেকে মেপে মেপে একশত হাত দূরে দূরে থাকে‌।”

তারুণ্য আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আঁটকে গেছে এমন ভাব করলো। কিছুদিন আগে তার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলো। এক ঘরে থেকেছিলো, তখন কি নিজের পুরুষ ছিল। মাথা চুলকে ইনোসেন্স ফেইস করে বলল,
-” আ’ম সিউর। আমাদের মাঝে দুই ফুট ডিস্টেন্ড নেই। এক ফুট দূরত্ব আছে কিনা সন্দেহ।”

আরশি তেজ নিয়ে তাকাতেই তারুণ্য অন্যদিকে ফিরে গেল। কাঁচ টানা জানালার ভেতর থেকে প্রকৃতি দেখার জন্য উঁকি ঝুঁকি দিলো সে। সিটে পুরোপুরি গাঁ হেলিয়ে দিলো। দুহাত বুকে গুজে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। ধীরে ধীরে পাতা ভারী হয়ে রাজ্যের ঘুমেরা এসে ধরা দিলো তার গ্ৰথণ করা চোখে। পাড়ি জমালো ঘুমের রঙিন দেশে।
.
প্রত্যুর্ষের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ষন শেষে অন্তরিক্ষে দেখা মিললো রবির। সেই আলোর এক চিলতে রোদ এসে পড়লো আরশির মুখশ্রীর উপর। আরশি নড়ে চড়ে উঠলো। হালকা হয়ে গেছে তার নিদ্রা। ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই দৃষ্টি গোচর হলো কারো ফর্সা চিবুক। উঠতেই চাইলেই আঘাত প্রাপ্ত হলো মস্তিস্ক। পুনরায় নেতিয়ে গেল সে। বুকের ভেতরে সেই অনুভূতি কড়া নেড়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখার জন্য এক নজর চাইলো। দৃষ্টি গোচর হলো সেই অতি পরিচিত মুখ। অজান্তেই তার মুখে হাসির দেখা মিললো। তারুণ্য ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-” তো ম্যাম! ঘুম ভাঙল। তখন তো দিব্যি বলেছিলেন, কোনো পরপুরুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমান না। রাতে তো দিব্যি ঘুমিয়েছেন। বলি, রাতে কি পরপুরুষ প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেছে?”

আরশি আমতা আমতা করে ঢোক গিলে। কোনো রকম বলে,-” মোটেও না! আমি আপনার কাছে যাইনি। বরং আপনি জেতার জন্য আমাকে আপনার বুকে টেনে নিয়েছিলেন।”

-” ধরা পরার পর সবারই একই কথা।”

আরশি কথা বাড়ালো না। সে জানে, ঘুমের সময় তার হুঁশ থাকে না। কি করে জানা নেই। তাছাড়া কালকে রাতে অসুস্থ ছিলো। আরশি লম্বা একটা হাই তুলে আশে পাশে চাইলো। কাউকে গাড়িতে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে গেল কোথায় তারা। চোখ ঢলতে ঢলতে বলে,
-” বাকিরা কোথায় গেছে?”

-” যেখানে আসার জন্য এতোপথ অতিক্রম করেছি, সেখানে।” তারুণ্যের তেড়া উত্তর।

-” মানে!” না বোঝার স্বরে।

-” তুই তো ঘুম কাতুরের মতো ঘুমিয়ে ছিলি। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা না করে চলে গেছে। আমি গাড়ি পার্ক করে বসে আছি তোর ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়।”

আরশির অস্বস্তি হলো। কি হতো একদিন না ঘুমালে। “চলো” বলে নামতে নিলে হাত টেনে ধরলো তারুণ্য। নিচ থেকে সিল্কের ওরনা তুললো। দরজা খুলে বাইরে ঝেড়ে দিয়ে আরশির কাঁধে তুলে দিল। আরশির মুখে লজ্জার্ত রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। একহাত দিয়ে ওরনা পেঁচিয়ে নিচের দিকে চেয়ে রইল। তারুণ্য আরশির অস্বস্তি অনুভব করতে পারলো। অগোচরে শব্দ করে হাসলো সে। বাঁকা হেসে বলল,
-” এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি? আমি যাচ্ছি। তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি পাহারা দে.

বলেই হাঁটা দিলো তারুণ্য। আরশি দৌড়ে এসে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,-” একটু আস্তে হাঁটুন না।” তারুণ্য হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো। তবুও হাত ধরলো আরশি। ছোট ছোট পা ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। এখনো অনেকটাই পথ বাকি। একেই মাটির রাস্তা তার উপরে উপরে বৃষ্টি হয়ে কাঁদাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। গাড়ি কাঁদায় মাখো মাখো হয়ে যাবে। তাই আর গাড়ি সামনে এগুলো না।
_______

কাঁদার ভেতরে লাফালাফি করছি আমি। অরিশ ভাইয়া দূরে দাঁড়িয়ে এটা ওটা বলে চলেছে আর সামনের দিকে হাঁটছে। আমাকে না দেখে পেছনে চাইলো সে। কয়েকপা এগিয়ে এসে দিলো রাম ধমক। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
-” তরী! কি হচ্ছে এইসব? চল! আমাদের যেতে হবে। অনেকটা পথ পরে আছে।”

লাফাতে লাফাতে বললাম,
-” ঐ গাছের ডালে কদম ফুল আছে। যদি এনে দিতে পারো, তবেই যাবো। ডান!”

-” তরী, আগে বাড়িতে চল। পরে সময় করে কদম এনে দিবো।”

-” তাহলে পরে সময় করে আমিও বাড়িতে যাবো। তুমি বরং এখানে এসে লাফাও। দেখো, অনেক ভালো লাগবে!”

অরিশ ভাইয়া এগিয়ে এলেন কাঁদার মাঝে। আমার হাত ধরে টানতে লাগলেন। একটু অসাবধানতায় ধপাস করে কাঁদার ভেতরে দুইজনে। আমি নিচে তিনি উপরে। কাঁদায় মাখো মাখো দুইজনে। চোখাচোখি হলো বেশ কিয়ৎক্ষণ। তিনি উঠে বসলেন। আমিও তার পাশে বসে বললাম,
-” দেখেছ তুমি? ছোটদের কথা না শুনলে কি হয়! তাই বড়দের কথার মাঝে ছোটদের দু একটা কথা শুনলে দোষের কিছু হয় না। বরং কিছু না কিছু শেখা যায়।”

ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন,-“সত্যি!” আমিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
হুট করে মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন আমায়। দৃঢ় বাঁধনে আবৃত করে নিলেন। নড়াচড়ার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। কাঁদা সমেত পা নিয়ে ধীরে ধীরে সাবধানতা অবলম্বন করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। ত্রুব্ধ কন্ঠে বললেন,

-” ছোটদের কথা না শুনলে কি কি হয় দেখলাম। এবার বড়দের কথা না শুনলে কি কি হয় সেটাই দেখার বাকি আছে। নাউ স্টার্ট..

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here