অনুভূতি
পর্ব ৬
মিশু মনি
.
৮.
মিশু চোখ মুছতেও ভূলে গেছে। তাক লেগে হা করে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে।
এবারে বলল, “কাঁদার মত কিছু ঘটেছে কি?”
– “সরি। আসলে সাধারণত এমনটা তো হয়না।”
মেঘালয় মুখ টিপে হেসে বলল,”আমি একটু অসাধারণ তো তাই আরকি। নাও খাও এবারে।”
মেঘালয়ের তাড়া দেখে মিশু একটু একটু করে খেতে আরম্ভ করলো। ওর এখন বেশ ভয় ভয় লাগছে।মেঘালয় কেমন রহস্যময় ভাবে হাসি দিচ্ছে। এই হাসিতে কিছু লুকিয়ে নেই তো? বড়লোকের ছেলেদের কত কত পরিকল্পনা থাকে! কিন্তু মেঘালয় তো সেরকম নয়। তবুও ওর হাসি দেখে ভয় হচ্ছে মিশুর। এভাবে হাসছে কেন ছেলেটা?
মেঘালয় মিশুর কান্না দেখে হাসছে। আর ওর চাহনী টাই কেমন রহস্যজনক! মিশু অযথাই ভূল বুঝছে ওকে। কিন্তু সে কথা কে বোঝাবে মিশুকে? মিশু তো ভয়েই অস্থির হয়ে বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয়ের বাঁকা ঠোঁটের দিকে।
মেঘালয় বললো, “ম্যাম কি কিছু ভাবছেন?”
– “আমি মনের কথা চেপে রাখতে পারিনা।একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো?”
– “না, বলো।”
– “আসলে বলছি যে, আপনি এরকম একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিলেন আবার আমাকে নিয়ে ট্যুরে যেতে চাইছেন। আমার না খুব ভয় করছে। আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তো?”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর টাইপ অবস্থা। মিশুর জন্য এতকিছু করার পরও সে ভাবছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা? আসলে মেয়েরা বোধহয় এমনই। ওরা সবকিছু ছেড়ে দিতে পারে কিন্তু সন্দেহ ছেড়ে দিতে পারেনা।সন্দেহ এদের রক্তের সাথে মিশে আছে।
মিশু বললো, “আপনি কি রাগ করলেন?”
– “না,আমি বড্ড আনন্দ পাচ্ছি। এভাবে কৃতিত্ব দিলে কি রাগ করা যায়?”
– “না মানে আমি এভাবে বলতে চাইনি। মাথায় হুট করে আসলো তাই। সরি।”
– “গভীর রাতে একা পেয়েও যে আপনাকে সম্মানের সহিত ফার্মেসি তে নিয়ে গেলো, বাপের ঘুম ভাঙিয়ে বিকাশে টাকা নিয়ে ওষুধ নিয়ে দিলো, আবার বাসায় পৌছে দিলো, সে এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করে আপনাকে নিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করবে? আজব!”
মিশু খুব লজ্জা পেয়ে গেলো মেঘালয়ের কথা শুনে। সত্যিই তো! এত কিছুর পরও কেন যে মিশু সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়লো নিজেও বুঝতে পারছে না।
মিশু বললো, “আমি দুঃখিত। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে এসব ভেবে বলিনি কথাটা। আমি না একটু এরকম ই।”
মিশুর অসহায় মুখ দেখে হাসি পেলো মেঘালয়ের। হেসে বলল,”ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আমাদের সাথে ট্যুরে যেতে হবেনা। আমিই একটু বেশী বেশী বলে ফেলেছি বোধহয়। অফিসের ঠিকানা দিচ্ছি,চাইলে চাকরীতে জয়েন করতে পারো। আমার বাবার নিশ্চয় ই কোনো উদ্দেশ্য নেই।”
মিশু বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো মেঘালয়ের কথা শুনে। মাথা নিচু করে ফেলল। ওর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আসলে একটু বেশিই ইমোশনাল এই মেয়েটা। কথায় কথায় কান্না আসে ওর। কেউ কঠিন করে কিছু বললেই চোখে পানি এসে যায়।
মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটাকে নিয়ে দারুণ মুশকিলে পড়া গেলো তো। কিছু বললেও সে সহ্য করেনা, আবার না বললেও পারা যায়না কিছুতেই। মাথাটা ঝাঁকিয়ে মেঘালয়, উঠে এসে মিশুর পাশে বসতে বসতে বলল,”আচ্ছা ঠিকাছে বাচ্চা মেয়েটা। মন খারাপ করোনা কেমন? তুমি যা চাইবে, তাই হবে। এবার খেয়ে নাও।”
মিশু চুপচাপ খেতে আরম্ভ করে দিলো। টুকটুক করে খাবার মুখে দিতে দিতে বারবার আড়চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছিলো। ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। একটু রহস্যময় হলেও খুব উদার মনের। পর্বতারোহী রা বুঝি এমন ই হয়!
মেঘালয় উঠেই গিয়ে ফোনে কথা বলে আসলো। মিশুর খাওয়া ততক্ষণে হয়ে গেছে। মেঘালয় এসে সামনে বসলো। মিশু খেয়েদেয়ে চুপচাপ চেয়ে আছে মেঝের দিকে।
মেঘালয় আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। মিশুও পিছুপিছু এলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। মেঘালয় যেদিকে যাচ্ছে,মিশুও পিছুপিছু যাচ্ছে ওর। একটা চেম্বারে নিয়ে এসে মেঘালয় মিশুকে বসতে বসলো। এটা যে ডাক্তারের চেম্বার সেটা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলোনা মিশুর। কিন্তু অসুখ টা আবার কার? মেঘালয় কি অসুস্থ?
একটু পরে মিশুর বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন ডাক্তার এসে ওকেই নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। তাহলে এই হচ্ছে আসল ব্যাপার! সামান্য শরীর খারাপের কথা শুনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে। অদ্ভুত মানুষ একটা!
ডাক্তার জানালেন অনেক আগে থেকেই মিশুর শরীরে জ্বর বইছে। শরীর অনেক দূর্বল আর অপুষ্টিতে ভুগছে। একটু পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে, আর কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। ওষুধ গুলো ফার্মেসি থেকে কিনে নিয়ে মেঘালয় মিশুর হাতে দিয়ে বললো, “এইগুলা নিয়ম করে খাবেন ম্যাডাম। অসুস্থ শরীরে অফিসে কাজ করবেন কি করে?”
মিশুর মুখে কোনো কথা নেই। ও বিস্ময়ের ঘোরে শুধু বারকয়েক বিড়বিড় করলো। মেঘালয় এগিয়ে এসে রাস্তায় সিএনজি দাড় করালো। তারপর মিশুকে তাতে উঠতে বললো। মিশু অবাক করা চোখে ওর দিকে চেয়ে থেকে গাড়িতে চেপে বসলো। মেঘালয় ওর পাশেই বসে পড়লো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বোনের শরীর কেমন এখন?”
-“মোটামুটি সুস্থ। ওষুধ খেলেই ও ঠিক হয়ে যায়।”
– “ওহ আচ্ছা। তুমিও ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে যাবা।”
– “আচ্ছা। এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
– “আমরা নেভারল্যান্ডে যাচ্ছি।”
মিশু ফিক করে হেসে ফেললো, “সিএনজি তে করে নেদারল্যান্ড? বাহ! আজকালকার সিএনজি বুঝি ফ্লাইং করে?”
মিশুর হাসি দেখে মেঘালয় ও হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, “নেদারল্যান্ড নয় মিশু, নেভারল্যান্ড।”
মিশু ভ্রু কুঁচকে বললো, “নেভারল্যান্ড! সেটা আবার কোথায়? ”
মেঘালয় মুখ টিপে হাসলো। হা করে চেয়ে থাকা মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে ও বললো, “নেভার ল্যান্ড মিরপুরে অবস্থিত ম্যাম।”
-“জীবনেও নাম শুনিনি আমি। কি আছে সেখানে? প্লেন উড়াউড়ি করে নাকি?”
– “আজব প্রশ্ন! প্লেন উড়াউড়ি কেন করবে? সেখানে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি না বললা খুব বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে?”
মিশু লজ্জা পেয়ে গেলো খুব। লাজুক স্বরে বলল, “ও আচ্ছা। সেখানে কি কি আছে? পার্ক?”
– “নদী, নৌকা, রেস্টুরেন্ট আর সবুজে ঘেরা একটু প্রকৃতি। মজার ব্যাপার কি জানো? প্লেনের উড়াউড়ি না থাকলেও সেখানে ময়ূরপঙ্খী আছে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো,”ঢাকার ভিতরে এমন প্লেস আছে! আমিতো জানতাম না। ময়ূরপঙ্খি আছে! উফফ তাড়াতাড়ি চলুন না প্লিজ।”
– “সিএনজি কি আমি চালাচ্ছি?”
মিশু আবারো লজ্জা পেয়ে গেলো। মুচকি হাসলো এবার ও। মেঘালয়ের খুব আনন্দ হচ্ছে। মেয়েটির এই আনন্দিত মুখটাই দেখার জন্য ওকে সীতাকুণ্ড ট্যুরের প্লানটা জানিয়েছিলো। সামান্য কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনলেই মেয়েটি বড্ড আনন্দিত হয়ে ওঠে। পাগলী একটা! এই ফুটফুটে মেয়েটাকে কি ওইরকম বন্দি দশায় মানায়? এ জন্যই বড্ড মন কেমন করছিলো মেঘালয়ের।
মেঘালয় বলল,”ওটা মূলত একটা রেস্টুরেন্ট। তবে শ্যুটিং স্পট। পরিবেশ টা অনেক সুন্দর করেছে। আর রেস্টুরেন্ট এ চাইনিজ,থাই থেকে শুরু করে দেশী খাবার দাবার ও পাওয়া যায়।”
মিশু অবাক হয়ে বলল,”আপনি যে বললেন ময়ূরপঙ্খী? রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে নৌকা চলে?”
মেঘালয় এবারে হো হো করে হেসে উঠলো। আচ্ছা পাগলি মেয়ে তো। রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে নৌকা কখনো চলে নাকি? বরং অনেক সময় নৌকার উপরেই রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠে। কিন্তু নেভার ল্যান্ড তো কয়েক একর জমির উপরে তৈরী। রেস্টুরেন্ট একদিকে আছে। এটা বুঝতেও কষ্ট হচ্ছে ওর?
মেঘালয়ের উত্তর শুনে মিশু লজ্জা পেয়ে বলল,”আমি একটু এমন ই। কিচ্ছু বুঝিনা। তবে একবার বললে আর ভূলিনা।”
মেঘালয় হাসল। এই বাচ্চা স্বভাব টাই দেখার অপেক্ষায় ছিলো ও এতদিন! মেয়েটি বড্ড মায়াবী, শুধু মায়ায় জড়িয়ে ফেলে!
মিশু সিএনজির ভিতর থেকেই বাইরে টা দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। মেঘালয় বললো,”তোমার কি সবকিছু দেখতে খুব ভালো লাগে?”
– “হ্যা লাগে। খুউউব লাগে। কিন্তু দেখার সুযোগ পাইনা তো। সারাক্ষণ অফিসে বন্দি থাকতে হয়। আর এখন এই দেখুন সিএনজি থেকে কিচ্ছু দেখা যায় না।”
মিশুর ছেলেমানুষি কণ্ঠ শুনে আবারো হাসি পেলো মেঘালয়ের। ও মনে মনে ভাবলো, এখন থেকে বাইক নিয়ে বের হতে হবে। তাহলে ঘুরাঘুরি করে খুব আনন্দ পাবে মেয়েটা।
মিশুর পরিবারের অবস্থা শুনতে শুনতে অনেক দূর চলে এলো ওরা। মেঘালয় সিএনজি থেকে নেমে রিক্সা নিলো। এবার মিশুর মুখটা উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। রিক্সা থেকে সবকিছু বেশ সুন্দর দেখা যায়! একদম বাচ্চাদের মত লাফিয়ে উঠছে আনন্দে।
নেভারল্যান্ডে ঢোকার আগেই মিশুর খুশি আর দেখে কে? রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে ও। রাস্তাগুলো এত সুন্দর কেন! নদীও দেখা যাচ্ছে। মিশু আনন্দে লাফাচ্ছে।
চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখানোর পর মিশুকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট এ এসে বসলো মেঘালয়। খাবারের মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার করতে বলল মিশুকে। মিশু কি অর্ডার করলো নিজেও জানেনা। খাবার চলে আসতেই হা করে চেয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। এই খাবার জীবনেও দেখেনি ও। কিভাবে খেতে হয় তাও জানেনা। মেঘালয় কাঠি ও কাটা চামচ দিয়ে ওকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে খাবার টা খেতে হবে।
মিশু মেঘালয়ের দেখাদেখি খাবার খাচ্ছে। এখন একটু একটু খেতে পারছে। কিন্তু খাবারের স্বাদ বেশী সুন্দর না,শুধু নামেই সুন্দর। এজন্যই বিদেশী খাবার গুলো ভালো লাগেনা ওর। খাবার খেতে খেতে রেস্টুরেন্ট এর পরিবেশ উপভোগ করছিলো মিশু। বেশ উন্নত আর সুন্দর, সাজানো গোছানো পরিবেশ। চারদিক টা অনেক সুন্দর বলতে হবে। মেঘালয় দারুণ একটা সারপ্রাইজ দিলো আজ ওকে।
কিন্তু ময়ূরপঙ্খী তে ওঠা হলোনা। অল্প ক’জন যাত্রী নিয়ে ময়ূরপঙ্খী যাত্রা করেনা। যাত্রী পূর্ণ হলে তবেই নৌকা ছাড়ে। মিশুর খুব মন খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে। মেঘালয় ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আরেকদিন নিয়ে আসবো এখানে।
অনেকবার বলার পর একটু মন ভালো হলো মিশুর। পুরোটা বিকেল জায়গাটায় ঘুরাঘুরি করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো ওরা। এর মধ্যে টুকটাক কথা হয়েছে দুজনাতে সেটা শুধুমাত্র পড়াশুনা, ছেলেবেলা এসব নিয়েই। লোকাল বাসে করে রওনা দিলো ওরা। মিশু জানালার পাশে বসে বাইরে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে রোজ মিশুকে এভাবে বাইরে ঘুরতে নিয়ে বের হতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?
৯.
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইয়ারফোনে গান শুনছিলো মিশু। পুরনো দিনের কিছু গান। শুনতে শুনতে একটা গল্পের বই পড়ছিলো। একটা গান শেষ হওয়ার পর আরেকটা গান আসতেই বেশ চমকালো মিশু! গানটা পুরনো দিনের হলেও তার সুর এত মধুর আর মায়ায় জড়ানো! কিছুক্ষণ পড়া বন্ধ করে গান শুনতে লাগলো। শিল্পী গান গাইতে আরম্ভ করার পর একদম চোখে জল এসে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। এত মায়া দিয়ে গান গাইছে সে! কণ্ঠে যেন জাদু আছে। কিন্তু কে এই শিল্পী? ওনার গান তো আগে কখনো শোনা হয়নি। এত ভালো গান গায়, অথচ তার গান আগে শোনা হয়নি!
মিশু অবাক হয়ে প্লে লিস্টে ঢুকলো। গানের ডিটেইলস দেখে ভিরমি খেয়ে গেলো একবার। শিল্পীর নাম দেখে কয়েক মুহুর্ত চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো, “Meghaloy Ahmed”
এলবামের ছবিতেও মেঘালয়ের ছবি দেয়া। প্রথম টায় স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিলো মিশুর। এই ছবির ছেলেটার সাথে তো আজকেই সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে ও। তার গান প্লে লিস্টে বাজছে আবার এত মধুর কণ্ঠ! সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যেন! এটা কিভাবে সম্ভব? মেঘালয় কি গান গায়? এটা তো মিশু জানতো না।
আজ কিছু গান ডাউনলোড করেছে মিশু। এ গানটাও আজকেই ডাউনলোড করা। কিন্তু মিশু তখন জানতো না মেঘালয়ের গাওয়া গানও আছে এতে! আর মেঘালয় তো আরোহী হিসেবেই পরিচিত, সে আবার গান গায় কবে থেকে?
তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে ঢুকে গেলো মিশু। মেঘালয়ের নাম দিয়ে সার্চ দিয়ে ওর পেইজে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর দেখতে পেলো সত্যিই মেঘালয় মাঝেমাঝে গান গায়। রেডিও তে গাওয়া গান এটা! রেডিও তে গেয়ে রেকর্ডিং করে আপলোড দিয়ে দিয়েছে। দেখার পর অজান্তেই কেঁদে ফেললো মিশু।
বেশ কিছুক্ষণ অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। ছেলেটা পর্বতারোহী, মাঝেমাঝে গানও গায়। মোটামুটি জনপ্রিয় একজন মানুষ। অথচ এত আপনজন দের মত মিশেছেন যেন মিশু ওনার বন্ধু! রোজ রোজ মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা, রাতে ওষুধ কিনে দেয়া, বিকাশে টাকা নেয়া, বাইকে তোলা, আবার আজ ডাক্তার দেখানো, স্টার কাবাবে খাওয়াদাওয়া, নেভারল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়া সবকিছু স্বপ্নের মত মনেহচ্ছে। এসব শুধুমাত্র স্বপ্নেই সম্ভব। বাস্তবেও সম্ভব সেটা ভাবাই যায়না!
মিশু বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে হেডফোনে মেঘালয়ের গানটা ফুল ভলিউম দিয়ে বারবার শুনতে লাগলো। কেন যে কাঁদছে সেটা ও নিজেও জানেনা। গানে মেঘালয়ের মায়াবী সুরের টান শুনে আরো কান্না বেড়ে যাচ্ছে মিশুর।
চলবে..
অনুভূতি
পর্ব ৭
মিশু মনি
.
১০.
গভীর রাত।
রেলস্টেশনের ওভারব্রিজ দিয়ে হাঁটছে মেঘালয়। মাঝেমাঝেই এই কাজগুলো করে ও। হুটহাট করে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, তারপর যেদিকে ইচ্ছে হয় হাঁটা শুরু করে। রাতের পরিবেশ বড্ড বেশি রোমাঞ্চিত করে মেঘালয়কে। রাতের মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। রাতে সবকিছুই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ধরা দেয়।
ওভারব্রিজ এর উপরে অনেক লোকজন শুয়ে আছে, কিছু বাচ্চা একেবারে খালি গায়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এদের দেখলেই মনটা কেমন যেন করে উঠে। কত অসহায় এরা! মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে এগিয়ে গিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দিতে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়,সে রাতে খেয়েছে কিনা? এরা দুবেলা ঠিকমত খেতেও পারেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে মেঘালয় ওভারব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ টা দেখছে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর দিকে একটা মেয়ে বসে আছে। মাথায় ওড়না দেয়া। পিছন দিকটা দেখে কেমন চেনাচেনা লাগছে। এরকম ওড়না কারো দেখেছিলো ও। কিন্তু এই মাঝরাতে সে স্টেশনে বসে থাকবে কেন? ভেবেই পেলো না মেঘালয়।
কৌতুহলে ভরা চোখ নিয়ে ধীরেধীরে নেমে এলো নীচে। সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর কাছাকাছি এসেই বুঝতে পারলো এটা আর কেউ নয়, এটা সেই বাচ্চা স্বভাবের মিশু নামের মেয়েটা। মেঘালয় বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। পিছনে মেঘলয় এসে দাঁড়িয়েছে মিশু সেটা খেয়াল করেনি। মেয়েটা সামনে ই চেয়ে আছে আর গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে।
মেঘালয় এগিয়ে এসে সিঁড়িতে মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু এক পলক ওর দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেঘালয়ের চোখেও বিস্ময়! এত রাতে এই মেয়েটা রেলস্টেশনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, কত রকমের বিপদ ঘটতেও পারে। কিন্তু সে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। ভাবতেই অবাক লাগে!
মিশু বললো, “আপনি খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারেন।”
– “সেটা আমিও জানি। এত রাতে তুমি এখানে কেন?”
– “এত রাত আর কোথায় হলো? সবেমাত্র রাত সাড়ে এগারো টা।”
– “এটা কি সন্ধ্যাবেলা মনেহচ্ছে? তুমি এখানে কেন?”
– “আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওদেরকেই ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলাম।”
– “সেকি! তোমার আম্মুও অসুস্থ! কি হয়েছে ওনার?”
– “কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর আম্মুর জণ্ডিসের দিকেও যাচ্ছিলো। তাই গ্রামে যেতে চাচ্ছিলো।”
– “চলে গেছেন ওনারা?”
– “হ্যা, ওদেরকে বিদায় দিয়ে আমি এখানে বসে আছি। আমার আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।”
– “তোমার মায়ের সাথে আর কে আছেন?”
– “ছোটবোন।”
– “আচ্ছা বেশ।”
মেঘলয়ের চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়েছে। মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মুখ দিব্যি হাসিহাসি। মেঘালয় জিজ্ঞাস করলো, “তোমার খারাপ লাগছে না?”
– “একটু লেগেছিলো। মানিয়ে নিয়েছি।”
– “কি বলে মানিয়ে নাও নিজেকে?”
– “এইযে স্টেশনে কত কত লোক এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে, বাচ্চাদের গায়ে জামাও নেই। কি করুণ চেহারা ওদের, ঠিকমত খেতেও পারেনা। আমি শুধু নিজের দিকে তাকাই আর ভাবি, ওদের চেয়ে আমিতো কত্ত ভালো আছি। তাহলে কেন সামান্য কিছু দুঃখে মন খারাপ করে বসে থাকবো”
মেঘালয় মিশুর এই উক্তিতে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। ছোট্ট একটা মেয়ে, অথচ কত গভীর চিন্তা ভাবনা! এরকম কেন এই মেয়েটা! সত্যিই অদ্ভুত!
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথাও যাচ্ছেন?”
– “না, আমি মাঝেমাঝে এরকম বাইরে বের হয়ে হাঁটি। রাত আমাকে মোহিত করে তার সৌন্দর্য দিয়ে।”
– “আমার ও রাত প্রিয় অনেক। রাত কত স্তব্ধ, কত নির্জন, কত রহস্যময় তাইনা?”
– “হুম। এ জন্যই রাতকে আমার ও এত বেশি ভালো লাগে। এনিওয়ে মিশু, মুখটা খুব শুকনা শুকনা লাগছে। বসো, চা নিয়ে আসি।”
মেঘালয় উঠে গিয়ে দুকাপ চা নিয়ে এসে আবারো মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু মুগ্ধ হচ্ছে এটা ভেবেই যে, এরকম বড় একজন মানুষ এত অনায়াসে, এত নিঃসংকোচে কিভাবে মিশতে পারেন! বড্ড মুগ্ধ হতে ইচ্ছে করে।
মেঘালয় চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। মিশু চা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মেঘালয় বললো, “কি ভাবছো মিশু?”
মিশু রেললাইনের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। যাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। কেউ কেউ নামছে, কেউ উঠছে। কত সুন্দর একটা দৃশ্য! মিশুর ও খুব ইচ্ছে করছে একবার ট্রেনে উঠে লম্বা একটা জার্নি দিতে। কিন্তু সকালেই অফিস আছে, আবারো সকাল দশটা থেকে রাত দশটা অব্দি ডিউটি। জীবন টাকে নিজের মত করে উপভোগ করার কোনো সুযোগ ই যে নেই।
মেঘালয় জানতে চাইলো কি হয়েছে? মিশু জবাব দিলো, “আমার খুব ট্রেন জার্নি করতে ইচ্ছে করছে।”
– “কোথাও ঘুরে আসো ট্রেনে করে।”
– “কিন্তু আমার লাইফটা তো ব্যস্ততায় ঢাকা। ঢাকা শহরের ব্যস্ততায় ঢাকা হলে কি অবস্থা হয় জানেন ই তো। সকালে ডিউটি আছে।”
– “আমি তো তোমাকে একটা অফিসের এড্রেস দিয়েছি। সেখানে চাকরী কনফার্ম। তুমি শুধু গিয়ে ইন্টার্ভিউ দিয়ে, এপোয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে আসবে।”
মিশু একবার তাকালো মেঘালয়ের দিকে। এটার কথা ওর মনেই ছিলোনা। বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর চোখ। চোখের মণি ঝিকমিক করে উঠলো।
মিশু বলল, “আজ তো বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। আমি তাহলে আজই ট্রেনে করে কোথাও ঘুরে আসি।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আচ্ছা যাও। হুটহাট করে কোথাও যাওয়ার মজাই আলাদা।”
মিশু এক চুমুকে সবটুকু চা শেষ করে দ্রুত উঠে পড়লো। তারপর এগিয়ে গেলো ট্রেনের দিকে। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়েছে। মিশু একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “যাই ঘুরে আসি। ট্রেন যেখানে যাবে, সেখানেই যাবো।”
মেঘালয় হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। মিশু ছুটে গিয়ে টেনে উঠে পড়লো। ব্যাপার টা চমকানোর মতই ছিলো। এত রাতে একা একটা মেয়ে স্টেশনে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে আছে, আবার ইচ্ছে হতেই ছুটে গিয়ে ট্রেনে উঠলো। এমন মেয়েও এ পৃথিবীতে আছে! ভারী অদ্ভুত!
মিশু ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। টিকেট কাটা হয়নি,কাজেই সিট পাওয়ার প্রশ্নও আসেনা। গাড়িতে প্রচণ্ড রকমের ভিড়। সকলেই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য যে যার সিটে বসে পড়লেই গাড়িটা ফাঁকাফাঁকা লাগবে। মিশু চুপচাপ একটা সিটের উপরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মেঘালয়কে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছেনা।
গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে চলতে আরম্ভ করে দিয়েছে। মিশু দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলো মেঘালয় ও ছুটে এসে গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়লো। মিশু এগিয়ে এসে বিস্ময়ের ঘোরেই বললো,”এভাবে ছুটে এলেন যে! আপনার ও বুঝি ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে?”
– “হুম, হঠাৎ ই ইচ্ছে করে বসলো। আর আমার কিছু ইচ্ছে হলে আমি সেটা করেই ফেলি।”
মিশু হেসে বললো, “আমিও খানিকটা এরকম পাগলী পাগলী। যখন যা ইচ্ছে হয়,কিছু না ভেবেই করে ফেলি। জানেন, একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটে যাচ্ছিলাম। সাথে ছিলো আমার চারজন বন্ধু। রাস্তার পাশেই রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু আমরা যেখানে আছি,সেখান থেকে গিয়ে ট্রেনে উঠতে চাইলে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট দৌড়াতে হবে। তবুও সম্ভব কিনা সন্দেহ। তো, আমার এক বন্ধু আমাকে বললো, “ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিবে। এখন ছুটে গিয়ে উঠা সম্ভব?” আমি উত্তরে বললাম, “হ্যা সম্ভব।” এরপর দু একটা কথায় রীতিমত ওরা আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালো। আমি আর কিছুই না ভেবে ছুটা আরম্ভ করে দিলাম। উসাইন বোল্টের মত গতিতে দৌড়েছি বোধহয় কারণ আমি দ্রুতই স্টেশনে পৌছে গেলাম।কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে সেটা চলতেও আরম্ভ করেছে। আমি অনেক দ্রুত দৌড়াচ্ছিলাম। লোকজন শুধু চেঁচাচ্ছিল আমাকে দেখে। কেউ কেউ বলছিল,এই মেয়ে ট্রেনে উঠতে পারবে না। পড়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি সব কথাবার্তা। ট্রেনে খুব জোড়েই ছেড়ে দিয়েছে। আমি চলন্ত ট্রেনে গিয়ে উঠে পড়লাম। কি যে থ্রিলিং ছিলো ব্যাপার টা!”
কথা শেষ করতে করতেই মিশু রীতিমত হাঁফাচ্ছিলো। মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। মনেমনে ভাবছে, “আমার মতই পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটা। এমন রিস্কি কাজও কেউ করে!”
মিশু হাসছে আর বারবার মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেঘালয় বললো, “কোথায় যাবে এখন?”
– “ট্রেন যতদূর নিয়ে যাবে।”
– “আচ্ছা বেশ। আজ বোধহয় খুব টাকা পয়সা নিয়ে বেড়িয়েছো?
মিশু মুখ বাঁকা করে হেসে বললো, “না। মানে আজ বেতন পেয়েছি তো।”
– “আচ্ছা। আজ তোমার অফিসে আমি যেতেও পারিনি, ক্লাস শেষে ফ্রেন্ডরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আজ কিছু কেনাকাটা করা হয়নি। সে যাই হোক, এখন চলো বসে পড়ি।”
– “টিকেট তো কাটিনি। কোথায় বসবো?”
মেঘালয় আশেপাশে তাকিয়ে একটা সিট দেখিয়ে দিয়ে বললো, “আপাতত এখানে বসো। এরপর দেখি কি করা যায়।”
মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে সিটে গিয়ে বসলো। এই লোকটা সত্যিই একটু অন্যরকম! যাক, ট্রেন জার্নিটাও তবে বেশ অন্যরকম হবে!
চলবে..