অনেক সাধনার পরে পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৩৩]

ঘড়ির ঘন্টার সরু কাটা রাত আটটায় ঠেকেছে। বাহিরের পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছিমছাম গুমোট বাধা রাত্রী। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ডাকে কোলাহলপূর্ণ চারপাশ। জ্যোৎস্নার আলো পরেছে ধরনীতে। কিন্তু সেই আলো জুলফিকারের বারান্দায় পরেনি। কারণ চাঁদের ঠিক বিপরীত পাশেই তার বারান্দা। প্রাকৃতিক আলো না থাকলেও সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে বারান্দা আলোকিত। ইজি চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছেন জুলফিকার। হাতে রোজকার নিয়মের মতো পত্রিকা। কড়া লিকারের মশলাদার রঙ চা বানিয়ে দিয়ে গেছেন আমেনা। জুলফিকার চায়ের কাপে ছোট চুমুক বসাচ্ছেন। আবার মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। চুপিচুপি পায়ে জুলফিকারের বারান্দায় পা রাখলো শেফালী। দরজায় মাথা উঁকি দিয়ে বললো, ‘আব্বু?’

পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন জুলফিকার। আদরের ছোট মেয়েকে দেখে প্রছন্ন হাসলেন। শেফালী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বারান্দায় এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জুলফিকার, ‘চা খাবে?’

ছোট করে উত্তর দিলো শেফালী, ‘না।’ বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাহিরের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকালো শেফালী। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে বলে উঠলো, ‘তুমি আমাদের দুইজন কে অনেক ভালোবাসো তাই না আব্বু?’

হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন জুলফিকার। হেসে বলে উঠলেন, ‘অবশ্যই। কোনো সন্দেহ আছে নাকি?’

মৃদু শব্দ করে হাসলো শেফালী। বাবার দিকে ঘুরে রেলিং’এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বললো, ‘কোনো সন্দেহ নেই। ছোট থেকেই দেখে আসছি। তুমি আমাদের দুজনকে খুব বেশি ভালোবাসো। এতোটা ভালো হয়তো অন্য কোনো বাবা তাদের মেয়েকে বাসে না।’

হাতের পত্রিকা ভাজ করতে করতে বললেন জুলফিকার, ‘না। এটা তোমার ভুল ধারনা। প্রত্যেক বাবাই তার সন্তানকে বেশি ভালোবাসে। সন্তানকে ভালোবাসার কোনো মাপকাঠি নেই।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো শেফালী। বুকে দুই হাত গুঁজে বলে উঠলো, ‘বাবা-মা নিজের সন্তানদের অনেক ভালোবাসে। তাদের জন্য সব কিছু করতে পারে। সন্তানের ভালোলাগা, খারাপ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ, সুখ-দুঃখ সবই খেয়াল রাখে। আমি তো বলবো আমাদের দুই বোনের বেলায় তুমি খেয়াল রেখেছো। আম্মু তো বলতো ‘বেশি করো না। মেয়ে দুটো বিগড়ে যাবে’ কিন্তু তুমি বলতে ‘আমার মেয়েরা এমন হবে না’। আম্মুর থেকে বেশি তুমি আদর করেছো। আমাদের দুজনের পছন্দ অপছন্দের দিকটা তুমি খেয়াল রেখেছো। আগেও যেমন আমাদের মতের গুরুত্ব দিয়েছিলে এখনো তাই করবে। জোড় খাটাবে না তুমি। এটাই আমার বিশ্বাস।’

ভ্রুঁ ডুট বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো উঁচু করে শেফালীর দিকে তাকালেন জুলফিকার। শব্দ করে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন। পত্রিকা টা কাচের টি-টেবিলের উপর রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো সোজাসুজি বলে ফেলো তো।’

হাল্কা গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করলো শেফালী। দ্রুত পায়ে বাবার পাশের চেয়ারে বসলো। চেয়ারটা একটু দূরে থাকায় টেনে বাবার পাশাপাশি এনে একটু ঝুকে সিরিয়াস হয়ে বলতে লাগলো, ‘ছোট হওয়ার শত্বেও এইসব বলা ঠিক কিনা জানি না। তবুও বলছি। অংকুর ভাইয়া বুবুকে অনেক ভালোবাসে আব্বু। প্রথম দিন থেকেই খেয়াল করেছি আমি। বুবুকে ভাইয়া অনেক ভালো রাখবে। জানো? বুবুর যখন মন খারাপ থাকে কিংবা ভাইয়ার উপর রেগে থাকে। তখন ভাইয়া বুবুর রাগ ভাঙ্গাতে কি কি না করে। রাতের বেলায় তো বাসার নিচে পর্যন্ত চলে আসে। কতো ভাবে বুবুকে হাসায়। তুমি কখনো শব্দ করে হাসতে দেখেছো বুবুকে? কিন্তু অংকুর ভাইয়ার কারণে বুবু হাসে। সাজগোছ করে। যেখানে তারা দুইজন একে অপরের মাঝে নিজেদের শান্তি খোঁজে পায় সেখানে আমরা বাধা দিবো কেন বলো তো?’

জুলফিকার মেয়ের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বিস্মিত তিনি এইসব কথা শুনে। বাবার এমন রিয়েকশন দেখে ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো শেফালী। কানের পিছনে চুল গুঁজে সোজা হয়ে বসলো। সামনে তাকিয়ে থেকে আবারো বলতে লাগলো, ‘বুবুর ওয়েট একটু বেশি। তার জন্য মানুষের কাছে কম কথা শুনেনি। দাদী পর্যন্ত কতো কথা শুনিয়েছে। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ রিজেক্ট করেছে। অথচ অংকুর ভাইয়াকে দেখো। বুবুর ফিগার নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। বুবু উপেক্ষা করার পরেও সেই প্রথম দিন থেকেই বুবুকে ভালোবাসে ভাইয়া। বুবুকে সে স্প্রেশাল ভাবে। মন থেকেই ভালোবাসে। বুবুকে যাকে ভালোবাসে তার কাছেই তো বিয়ে দেওয়া উচিত তাই না? ধরো, এখন যদি অন্য কোথায় বুবুর বিয়ে দাও। আর সেই ছেলের প্রয়োজন শেষে যদি বুবুকে ছুঁড়ে ফেলে। তাহলে?’

বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো শেফালী। জুলফিকার এখনো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো শেফালী। জুলফিকারের ডান হাত ধরে অনুনয় স্বরে বললো, ‘আব্বু? ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। আমাদের কি উচিত তাদের আলাদা করা? দুইটা মন ভেঙ্গে দেওয়া? জেদ চেপে বসে আছো কেন বলো তো? ইগো বাদ দিয়ে ওদের দুজনকে এক করে দিলে হয়না? বুবুও খুশি হবে। বলো?’

পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে মেয়ের দিকে তাকালেন জুলফিকার। প্রশান্তি লাগলো মনে। স্মিতি প্রাপ্তির হাসি দিয়ে শেফালীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কে বলেছে শেফালী ছোট? এ-তো দেখছি বিয়ে দেবার সময় হয়ে গেছে।’

‘উফফু আব্বু। তোমাকে বলেছি না আমি এখন বিয়ে করবো না। আগে মার্চেংডাইজিং’এ ভর্তি হবো। নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার হবো। তারপর আরেক ফ্যাশন ডিজাইনার দেখে বিয়ে করে নিবো। হিহি।’

বলেই জুলফিকার কে জড়িয়ে ধরলো শেফালী। জুলফিকার হেসে উঠলেন মেয়ের কথায়। মাথায় হাত বুলিয়ে আগলে নিলেন মেয়েকে। তখুনি সেখানে আগমন ঘটলো আমেনার। বারান্দায় এসে বাপ-ব্যাটির আহ্লাদ দেখেই সন্তুষ্টির হাসি দিলেন একটা। টেবিল থেকে খালি চায়ের কাপ ও পত্রিকা হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘বাবা-মেয়ের আহ্লাদ শেষ হয়েছে? তাহলে দুজন খেতে আসেন। খাবার তৈরি।’
.

টেবিলের সম্মুখে বসে আছেন জুলফিকার। চেহারায় তার খুশির ঝিলিক। শেফালীর বলা প্রত্যেকটা কথায় তার মাঝে আনন্দ আনিয়ে দিয়েছে। ছোট মেয়েটা এতো বড় হলো কবে? কিছুদিন আগেও তো ঝুনঝুনির জন্য সে কি কান্নাকাটি করতো। সেই মেয়ে এতোটাই বড় হয়েছে যে কিনা তার বাবাকে বুঝাচ্ছে? মনে মনে প্রফুল্লিত। মেয়েদের তিনি ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। কোনো প্রকার খারাপ পন্থা অবলম্বন করে না। মেয়ে দুটো এখনো তার ভয়ে ভীতিগ্রস্ত।

শেফালীর মনটাও আজ ফুরফুরে। খুশি মনে হেলেদুলে আপন মনে খাবার খাচ্ছে। তবে ভালো নেই মিতালী। অস্বস্তিতে প্রায় শেষ হয়ে যাবার পথে। বাবার সামনে বসে খাবার খেতে অস্বস্তি লাগছে তার। চোখে চোখ রাখার মাঝে রয়েছে ভীষণ দ্বিধা। আড় চোখে একবার বাবার দিকে তাকালো। এর থেকে লজ্জা আর কি হতে পারে? গতকাল রাতে অংকুরের সাথে ফোনালাপ করার সময় বড় মেয়ে হয়ে বাবার সামনে ধরা পরেছে। এই লজ্জা থেকে বাঁচার জন্যই প্রেমে জড়াতে চায়নি সে। আর দেখো কপাল। ঠিক তাই হলো। ধরা পরলো বাবার সামনে। তাও আবার অংকুরকে নিয়েই। কোনো রকমে ভয়, জড়তা, অস্বস্তি নিয়েই রাতের খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালো মিতালী । বিদায় দিয়ে দ্রুত পায়ের কদম ফেলে রুমে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে যেন সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তখুনি কল আসলো অংকুরের। অশান্ত মনে ফুটে উঠলো আমোদিত হাসি।
.

রাত প্রায় ১২:৪৫.
নিস্থব্ধ চারপাশ। গোমট বাধানো পরিবেশ। এই সময় বাহিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নাবিলাস করা সম্ভব না। অন্য কারোর তো জানা নেই। তবে শেফালীর জন্য তো জীবনেও সম্ভব না । সে কখনোই একা বারান্দায় যাবে না। অন্যান্য দিন এই সময় ঘুমিয়ে বিভোর থাকতো। কিন্তু আজ কেন জানি ঘুম আসছে না চোখে। তাই হেডসাইডে হেলান দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে জাফর ইকবাল স্যারের ‘ ফিনিক্স ‘ বইটি পড়ছে। হঠাৎ-ই মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটলো মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো রাকিব কল করেছে। বিরক্ত হলো কিছুটা। বাবার সাথে কথা বলার পরেই রাকিবকে কল দিয়েছিলো কয়েকবার। কিন্তু রিসিভ করেনি। আর এখন মাঝরাতে আসছে কল দিতে। তাই রাগি গলায় রিসিভ করার পরপরই বললো, ‘এতো গুলা কল দিলাম তখন ধরেন নি। এখন কল দিতে এসেছেন কেন?’

‘টেনিস খেলছিলাম ফ্রেন্ডদের সাথে। স্যরি। যাইহোক, তোমার বাবার সাথে কথা বলেছো?’

শেফালী বইয়ের ভিতরে বুকমার্ক দিয়ে বইটি বন্ধ করে পাশে রাখে দিলো। তারপর হেডসাইডে হেলান দিয়ে কন্ঠ করম করে বললো, ‘হ্যাঁ বলেছি তো।’

চিন্তিত হলো রাকিব। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘আঙ্কেল কি বলেছে? উনার মতামত কি? মানে রাগারাগি করেছে?’

রাকিবের অস্থির প্রশ্ন শুনে চুপচাপ হয়ে গেলো শেফালী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো। একটু ভাব নেওয়া দরকার। এতো তাড়াতাড়ি বলে দিলে রিলেক্স হয়ে যাবে। তাই একটু টেনশন দিয়েই রিলেক্স করানো যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। এখনো নিশ্চুপ রইলো সে। অপরপ্রান্তে রাকিব পরলো দ্বিগুণ বিপাকে। চিন্তিত হলো সে। হচ্ছে টা কি? মেয়েটা কিছু বলছে না কেন? তাহলে কি আঙ্কেল মানে নি? অস্থিরতা নিজের মাঝে দমাতে পারলো না। আবারো বলে উঠলো, ‘ শেফালী? চুপ হয়ে গেলে কেন? আঙ্কেল কি মেনে নিয়েছে? রাগারাগি করেছে নাকি? আরেহ্ বলো না ইয়ার টেনশন হচ্ছে।

কপালে এবার বিরক্তির ভাজ পরলো শেফালী। এতো আদিক্ষেতা পছন্দ হলো না তার। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো, ‘আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন বলুন তো? এমন একটা ভাব যেন বিয়েটাই আপনার।’

শেফালীর কথা শুনে গম্ভীর হলো রাকিব। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেলে আড়ষ্টতার সঙ্গে বলে উঠলো, ‘অংকুর আমার ভাই। চাচাতো ভাই হলেও আপন ভাইয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। চিন্তা আমার তাকে নিয়ে। তার খুশি নিয়ে। ভাইয়ের খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ।’

বিমুগ্ধ হলো শেফালী। ভালো লাগলো দুই ভাইয়ের ভালোবাসার বন্ধন দেখে। আনমনে মুচকি হেসে ফেললো। অতঃপর সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললো। আপাতত তার কাজ শেষ। বাকি কাজটা এবার রাকিবের সামলানোর পালা।
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৩৪]

আজ বৃহঃস্পতিবার। ঘড়ির কাটা বিকেল চারটার ঘরে নিবদ্ধ। টিপটিপ শব্দ তুলে সেকেন্ডের কাটা অনবরত ঘুড়ে চলছে। টিভি থেকে বাজনারত কোলাহলের ধ্বনি ভেসে আসছে। তার সামনেই সুপ্তি বেগম অধীক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। অর্ধ পাকা চুল গুলো স্বযত্নে খোঁপা করে বাধা। মাঝে দুই একটা পাকা সাদা চুল ভাস্যমান। এক হাতে তার চিড়া ভাজার বাটি। রাকিব চুপিচুপি পায়ে এসে সুপ্তি বেগমের পাশে বসলো। তার দিকে তাকালেন না সুপ্তি। দৃষ্টি টিভির দিকে রেখেই চিড়া ভাজার বাটি এগিয়ে দিলো রাকিবের দিকে। রাকিব ভ্রুঁ কুঁচকে বাটির দিকে তাকালো। চিড়া ভাজা! এটা তার প্রিয় শুকনো খাবার না। আবার অপছন্দের তালিকায়ও না। তাহলে কি বলা যায়? সুবিধে পার্টি টাইপের পছন্দ। ইচ্ছে হলে পরিস্থিতি বুঝে খাবে নাহলে না। তবে এখন চুপচাপ বাটি থেকে হাতে গুণা কয়েকটা চিড়া নিলো। মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে টিভির দিকে তাকালো। বেশকিছু সময় টিভির কাহিনী দেখে বলে উঠলো, ‘চাচি? কাল রাতে না এটা দেখলেন?’

সুপ্তি বেগম টিভির দিকেই তাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘সবটা দেখতে পারি নাই। শেষে মাইয়াটা কি বললো সেটাই তো বুঝতে পারি নাই। এখন মনোযোগ দিয়া দেখবো।’

কিছুটা বিরক্ত হলো রাকিব। নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠলো, ‘ টিভিতে কি লাগাইয়া রাখেন সারাদিন? সারাদিন খালি এক ঝগড়া আর ঝগড়া। একজন আরেক জনের সংসারে আগুন লাগাতে ব্যস্ত। এক মহিলার জামাইয়ের পিছে দশ মহিলা পরে থাকে। এইগুলা বাদে টিভিতে আর কিছু নাই? খেলা, খবর দেখেন কাজে দিবে।’

সুপ্তি প্রথমের ন্যায় টিভির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর খেলা তুই-ই দেখ গিয়া।’

আর সহ্য হলো না রাকিবের। বাসায় যখনই থাকে তখুনি এই ভারতী বাংলার কাহিনী টিভিতে চলতে থাকে। দুই মাস আগেও দেখেছিলো এক মহিলার বিয়ে কাহিনী চলছে। সেই কাহিনী এখনো আগের মতোই চলছে। এই গুলাও মানুষ দেখে? কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি মাখিয়ে বললো, ‘চাচি রাখেন তো এইগুলা। ছাদে আসেন। আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর। ছাদে ভাল্লাগবে। আসেন এখুনি।’

‘তুই যা না বাবা। এই নাটকটা শেষ হলেই আমি আসবো।’

কথা বললো না রাকিব। তার চাচিজানকে কিভাবে ছাদে নেওয়া যায় তা খুব ভালো করেই জানা আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে দাঁড়িয়ে শার্ট টেনে হাতা ঠিক করতে করতে বলে উঠলো, ‘ঠিক আছে। আপনি আপনার নাটক নিয়েই পরে থাকেন। ওই দিকে ছাদের গাছ গুলো ভাড়াটিয়ারা নষ্ট করে ফেলুক। তাতে আমার কি? গাছ গুলো তো আর আমার না।’

বলেই দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। চোখ কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কি বললো রাকিব? চকচকিয়ে দরজার দিকে তাকালে রাকিবের চলে যাওয়া দেখলো। রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো। তার গাছ নষ্ট করা? তাও আবার তারই বাসায় থেকে? এতো সাহস? হাতে থাকা চিড়া ভাজির বাটিটা সামনের কাচের টি-টেবিলের উপর ধপাস করে রাখলো। রিমোট হাত নিয়ে টিভি বন্ধ করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। নাটকে নায়িকাকে তার শাশুড়ি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাই এমনিতেই মন ভালো নেই। তার উপর আবার গাছ ছিঁড়ার খবর। রাগ চাপলো শরিরে। দ্রুত পায়ের কদম ফেলে ছাদে আসলো। পুরো ছাদ একদম খালি। শুধু ছাদের দ্বারপ্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অংকুর ও রাকিব। ছেলেদের থেকে চোখ সরিয়ে বাগানের দিকে তাকালো। এগিয়ে এসে পুরো বাগান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বাগান তো ঠিকই আছে। কোথাও কোনো গাছের ডালপালা পরে নেই। তাহলে ছেলেটা মিথ্যে বললো কেন? ভ্রুঁ কুঁচকে রাকিবের দিকে তাকালেন সুপ্তি। দূর থেকে রাকিব বুঝেও না বুঝার ভান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। অংকুর তো ভুলেও মায়ের দিকে একবারো তাকায় নি। সুপ্তি বেগম রাকিবের মিথ্যে বলা বুঝে ফেললেন। কিঞ্চিৎ বিরক্ত ও রাগও হলেন। শাড়ির আঁচল পেছন থেকে সামনে কোমড়ে গুঁজলেন। এগিয়ে এসে রাকিবের কানে মুচড়ে ধরে বললেন, ‘ফাজিল ছেলে। এই তোর শ’য়’তা’নী? মিথ্যে বললি কেন? দিন দিন ছোট হইতাছোস?’

অংকুর রেলিং’এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সুপ্তিকে রাকিবের কান ধরতে দেখে পকেটে দুই হাত গুঁজে তাকালো দুজনের দিকে। তাদের দুইজনের ঝগড়া দেখে সে প্রতিবারই উপভোগ করে। আজও তাই করছে। তবে উপরে গম্ভীর ভাব। কারণ আপাতত সে মায়ের উপর ক্ষিপ্ত।

সুপ্তি বেগম কান মুচড়ে ধরায় ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো রাকিব। মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো, ‘আহ্, চাচি ব্যাথা পাচ্ছি। ছাড়েন প্লিজ।’

ছেড়ে দিলেন সুপ্তি। কোমড়ে এক হাত রেখে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলেন কেবল। রাকিব কপাল কুঁচকে মুখ কালো করে বলল, ‘আমার কান কি আপনার বাপের সম্পত্তি? যখন পারেন এসেই হা’ম’লা করেন।’

‘তোকে পেটে ধরি নাই তো কি হইছে? তুই আমার-ই সন্তান। শ’য়’তানী করবি তো কান বরাবর খাবি। বে’য়াদব ছেলে।’

রাকিব কান ঢলতে ঢলতে আড় চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমি কোনো শ’য়’তানী করি নাই। একদম খাটি নিখুঁত ভদ্র পোলা।’

সুপ্তি কপাট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘তাইলে একটু আগে কে বললো আমার গাছ নষ্ট করে ফেলছে? বল?’

দাঁত কেলিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো রাকিব। তার হাসি দেখে সুপ্তি দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেন। অতঃপর নিজেও হেসে ফেললেন। ঠোঁটে হাসি রেখেই অংকুরের দিকে তাকালেন। অংকুর তাদেরই দিকে তাকিয়ে স্মিতি হাসছিলো। সুপ্তি তাকাতেই চোখে চোখ পরলো। হকচকিয়ে গেলো অংকুর। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রাকিবকে বলল, ‘আমি মাঠে যাচ্ছি। তোর হাসা শেষ হলে আসিস।’

দ্রুত পায়ের কদম ফেলে চলে গেলো অংকুর। অংকুর চলে যাওয়ার কারণে সুপ্তি বেগমের মুখের হাসি মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো। অসহায়ত্ব আসলো তার চেহারায়। রাকিব ঠোঁটে ঠোঁট টিপে সুপ্তি বেগমের অগোচরে হাসলো। বুকে হাত গুঁজে ঘাড় ঘুরিয়ে বড় মাঠের দিকে তাকালো। সুপ্তি বেগম কাদুকাদু গলায় বললেন, ‘দেখলি? দেখলি ছেলেটা এখনো আমার উপর রেগে আছে। সেদিনের পর থেকে কিভাবে আমাকে এড়িয়ে চলে।’

রাকিব ত্যাঁছড়া করে প্রতিত্তুর করলো, ‘করবে না কেন? যা কাহিনী করছেন আপনি।’

মুখ কালো করে ফেললেন সুপ্তি। ঠোঁট উলটে ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাকিব এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে আসলো। এমন একটা সময়েরই অপেক্ষায় ছিলো সে। আপাতত বুঝানোর পালা। ফুঁশ করে একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, ‘চাচি? একটা সত্যি কথা বলেন তো। মিতালীকে আপনার পছন্দ হয়নি?’

জড়তাহীন চোখে রাকিবের দিকে তাকালেন সুপ্তি। সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘পছন্দ হবে না কেন আশ্চর্য। মেয়েটা অনেক মিষ্টি। চেহারায় মায়া মায়া ভাব আছে। চোখ দুটো টানা টানা। সব থেকে বেশি ভালো লাগছে লম্বা চুল গুলো। আজকালকার মেয়েরা অনেক শ’য়’তা’ন। রঙ দিয়া চুল লাল বানায় রাখে। মেয়েটার চুল কালো আবার লম্বা। যদিও একটু মোটা। ওইটা কিছু না। এমনিতেও বিয়ের পর মেয়েরা মোটা হয়। বাচ্চা হলে তো আরো।..’

এতো বর্ননা শুনে অল্প শব্দে বিরক্তিতে মুখ তা ‘চাহ্’ জাতীয় উচ্চারণ করলো রাকিব। সবসময় এক কথায় উত্তর আসে না তার চাচির কাছ থেকে। সব প্রশ্নের উত্তর একদম ব্যাখ্যা সহ দিয়ে দেন। মাঝে মাঝে ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। এখন কিঞ্চিৎ বিরক্ত লাগলেও একটু বেশি ভালো লাগলো। কারণ মিতালীর সম্পর্কে সুপ্তির পজিটিভ ধারণার কারণে। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বললো, ‘আপনার কি মনে হয়না অংকুর আর মিতালীর ব্যাপারটা নিয়ে বুঝাপড়া করা দরকার?’

উষ্ঠধয় চেঁপে ধরে আলতো করে মাথা দুলালেন সুপ্তি। চিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে রাকিবের পাশে দাঁড়িয়ে রেলিং’এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। অসহায় হয়ে মলিন কন্ঠে বললেন, ‘মেয়েটা সত্যি অনেক মিষ্টি। আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তখন আমি খারাপ ভাবে, মেয়েটাকে অপমান করতে কিছু বলিনি। সম্পূর্ণ ভুল বুঝাবুঝি। যা হবার হয়েই গেছে। এখন কি করবো?’

রাকিব তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে কেমন হয়?’

‘কিন্তু তোর কাকা তো বাসায় নেই। উনাকে ছাড়া কিভাবে কি করবো?’

কাকার কথা শুনেই বিরক্ত আসলো রাকিবের মাঝে। অপ্রসন্ন চোখেমুখে বলে উঠলো, ‘আরেহ্ ধুরু! কাকা কবে কোন কাজে এসেছে শুনি? নামে মাত্র বাড়ির কর্তা। পুরাটাই অকেজো।’

‘বড়দের এভাবে বলে না রাকিব।’

‘তো কি করবো? কাকার উপর আমার অনেক রাগ। উনি নিজে যা ভাবে তাই করে। একবারও আমাদের দুইজনের মতামত জানতে চায় না। কি দরকার আছে কুমিল্লায় থেকে রাইস মেল দেখার? রাইস মেল ফ্যাক্টরি থেকে লাভ হচ্ছে বাকি লস এটা দেখার জন্য ওইখানে লোক আছে। তারা তো হিসেব দিচ্ছেই। তাহলে কাকার কুমিল্লা একা থাকার কোনো মানে আছে? ফ্যাক্টরি গোল্লায় যাক। আমি আর অংকুর দুইজনই জব করি। হুদাই ওইটা নিয়া এতো প্যারা নেওয়ার দরকার নাই। মেজাজ খারাপ হয়।’

সুপ্তি বেগম রাকিবের বাহুতে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগলেন, ‘থাক বাবা। রাগ করিস না। কি করবি বল। রাইস মেলটা তারা দুই ভাই মিলে দিয়েছে। পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে তো তাই এখনো ছাড়তে পারে না।’

‘কাকাকে কষ্ট করে বলে দিয়েন যেন কাল ঢাকা চলে আসে। আর পরশু আপনারা মিতালীদের বাসায় যাবেন। আমি এখন যাই অংকুরের কাছে। সন্ধ্যার পর আসবো।’

কিছুটা বিরক্তিসহিত কথাটা বলেই শার্টের দুই হাতা গুটাতে গুটাতে ছাদ থেকে নেমে গেলো। সুপ্তি বেগম আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রেলিং’এ হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষটাকে নিয়ে সে নিজেও কিছুটা ক্ষুব্ধ। দুই ছেলে যেহেতু চায়না উনি কুমিল্লা একা থেকে রাইস মেল ফ্যাক্টরি সামলাক। তাহলে তাই হোক। যেন শুধু শুধু ছেলে দুটোর বিরুদ্ধে গিয়ে সেখানে একা পরে আছে? অংকুর কুমিল্লায় তার এক আত্মীয়কে রাইস মেল দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলো।কিন্তু অংকুরের বাবা যেন এখানে থেকে হাসফাস করতে লাগলেন। ব্যবসা লাভ হচ্ছে না, তারা টাকা মে’রে দিচ্ছে, লস হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি অহেতুক চিন্তা করে নিজেই কয়েকমাসের জন্য সেখানে চলে যান। এই নিয়ে ছেলে দুটোর গুরুতর আপত্তি। কিন্তু কে শুনে কার কথা?
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৩৫]

সন্ধ্যায় আজান পরেছে অনেক সময় আগে। বড় মাঠের পাশে থাকা বিশালাকৃতির মসজিদে নামাজ পরে বাসায় ফিরেছে অংকুর ও রাকিব। বাসায় এসে অংকুর কলিংবেল বাজালে সুপ্তি বেগম হাসি মুখে দরজা খুললেন। প্রতিদিনের মতো আজও দুই গ্লাসে ঠান্ডা পানি এনে রাকিব আর অংকুরের হাতে দিলেন। অংকুর নিশ্চুপ থেকে প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেয়ে নিলো। রাকিব তৃপ্তি সহকারে পানি টুকু খেয়ে গ্লাসটা টি-টেবিলের উপর রেখে সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসলো। ভাব-খানা এমন যেন কত ক্লান্ত সে। স্মিতি হাসলো অংকুর। তারপর শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো । তখুনি সুপ্তি পিছন থেকে চটজলদি বলে উঠলো, ‘তোর বাবা কাল আসবে।’

হেলান দেওয়া অবস্থা পরিবর্তন করে হুড়হুড় করে সোজা হয়ে বসলো রাকিব। চোখ দুটো তার কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো চাচির দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে চাচি এতো সহজে রাজি হলেন? তাও আবার একদম কাকাকেও ম্যানেজ করে ফেলেছে। বাহ্ চাচি বাহ্। আপনি দেখছি একদফা এগিয়ে। মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলো রাকিব।

মায়ের কথা শুনে তাৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরলো অংকুর। হাতা গুটানো হাতটা থেমে গেলো আপনা আপনি। ঘাড় বাঁকা করে পিছনে মায়ের দিকে তাকালো। ভ্রুঁ যুগল কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বললো, ‘কাল আসবে তো পরশু-ই চলে যাবে। এটা আহামরি কিছু না।’

তখুনি রাকিব বসা থেকে একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো। চাচির দুই বাহু ধরে অস্থির কন্ঠে মহা খুশি হয়ে বলে উঠলো, ‘সত্যি চাচিজান? আপনি কাকাকে সব বলেছেন? সিরিয়াসলি? ওএমজি! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

তারপর অংকুরের দিকে তাকিয়ে অভিনন্দন জানাল, ‘কনগ্রেচুলেশন ব্রাদার। ছক্কা লেগে গেছে তোমার।’

কিছুই বুঝলো অংকুর। ভ্রুঁ দুটো তার আরো কুঁচকে এলো। প্রশ্নাতীতভাবে তাকালো রাকিবের দিকে। কাহিনী কি জানার ও বুঝার প্রয়াস করলো। তার এমন চাহনী দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো রাকিব। এগিয়ে এসে অংকুরের বাহুতে স্বজোড়ে চাপড় বসিয়ে বললো, ‘ইয়ার, পরশু মিতালীকে দেখতে যাবো। সেই জন্য-ই তো কাকা কাল ঢাকা আসবে।’

অংকুরের চোখ দুটো ভারি অবাক হলো। বিস্মিত চোখেমুখে মায়ের দিকে তাকালো একবার। সুপ্তি বেগম ঠোঁটে মিষ্টি হাসি রেখে মাথা দুলিয়ে ইশারায় ‘ হ্যাঁ ‘ বুঝালেন। আবারো বিস্মিত হলো অংকুর। একের পর এক বিস্মিত হবার কারণে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে প্রায়। হেসে উঠলো রাকিব। এগিয়ে এসে অংকুরকে জড়িয়ে ধরে আবারো অভিন্দন জানালো। খুশি হলো অংকুর। মায়ের দিকে প্রশান্তি ও সন্তুষ্টির হাসি দিলো একটা। এতোদিনে যেন সুপ্তি বেগমের কলিজা ঠান্ডা হয়েছে। এই হাসি টা দেখার জন্যই কতো কিছু করেছে সে। আগে যদি জানতো মেয়েটাকে ঘরে আনলে ছেলের মুখের হাসি আরো দ্বিগুণ চৌড়া হবে; তাহলে আরো আগেই তা করতেন তিনি। আপাতত অংকুর ও রাকিবকে পাশাপাশি খুশি দেখে নিজেও খুশি হলেন। প্রশান্তি পেলেন মনে।
.

বাসার অন্যদের তুলনায় মিতালীর রুমের বারান্দা একটু বড়। রেলিং’এর সাথে গ্লিল সংযুক্ত নেই। জুলফিকারের বারান্দায় গ্লিল আছে। মিতালীর বারান্দার স্টাইলটাও একটু ভিন্ন। তাই শেফালী বেশিরভাগ সময় এই বারান্দায় সময় কাটায়। আজও এখানে। দুই বোন বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বালিশে শুয়ে আছে। শেফালীর শুয়ার স্টাইলটা আলাদা। বারান্দায় শুয়ে আছে ঠিকই কিন্তু পা দুটো রেলিং’এ উঠিয়ে রেখেছে। দুই বোন প্রায় সময় একান্তে সময় কাটায়। একে অপরের সাথে মনের কথা শেয়ার করে। শেফালী তার কলেজ, পড়াশোনা ও এক্সামের প্রিপারেশন সম্পর্কে সকল প্ল্যান জানাচ্ছে। মিতালীও সাবলীল ভাবে বুঝাচ্ছে কিভাবে কি করলে আরো ভালো করবে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে যখন মজার আড্ডাখানা জমলো। তখন শেফালী কথার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে বসলো, ‘জিমির সাথে তোমার প্রথম কোথায় দেখা হয়েছে বুবু? আর প্রথম পরিচয় টা কেমন ছিল?’

দূর আকাশের দিকে তাকালো মিতালী। লাজুক মিশ্রিত মিষ্টি একটা হাসি দিলো। মধুর কন্ঠে বলল, ‘বড় মাঠের পাশে। ঝগড়ার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে আমাদের।’

চকচকিয়ে উঠে বসলো শেফালী। মুখ হা করে চেহারায় বিস্ময় ফুটিয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের কাপলের স্বাদ মিষ্টি। অংকুর ভাইয়া বেশ রোমান্টিক। তাহলে ঝগড়া হলো কিভাবে? এটা তো কোনো ভাবেই সম্ভব না।’

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো মিতালী। শুয়া থেকে উঠে বসে শেফালীকে নিচু আওয়াজে ধমকে উঠলো, ‘এতো বেশি পাকনামি করিস কেন?’

শেফালী আহ্লাদজনক ভাবে এগিয়ে মিতালীর গা ঘেঁষে বসলো। ঠোঁট উলটে বলে উঠলো, ‘বলো না বুবু ঝগড়া কেন হয়েছিল?’

ত্যাঁছড়া চোখে শেফালীর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো মিতালী। মনে করলো প্রথম দিনের কথা। মনে পরলো অংকুরের সেই প্রথম রাগি চেহারার কথা। তীক্ষ্ণ চোখ, কপাল কুঁচকানো, এলোমেলো চুল, ঘামার্ত নীল টি-শার্ট, হাতে ক্রিকেট বল। এতো কিছুর পরে আজ সেই মানুষটাকে সুদর্শন লাগছে তার কাছে। অংকুরের প্রতি মুগ্ধ হয়ে আলতোভাবে হাসলো মিতালী। অতঃপর আস্তে আস্তে প্রথম দিনের ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে উচ্চ হাসিতে মেতে উঠলো শেফালী। হাসিতে দাঁত চোখমুখ খিঁচে বলল, ‘পরিবেশ দূষণকারী কন্যা? সিরিয়াসলি বুবু?’

মিতালী নিজেও শব্দহীন ভাবে হেসে উঠলো। তার মনে এক অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করছে। কেন জানি অংকুরকে নিয়ে যতো ভাবছে ততোই মুগ্ধতা কাজ করছে মনে। তবে এই মুগ্ধতার নামকরণ কি হবে? ‘ ভালোবাসা! ‘

হঠাৎ-ই শেফালীর মোবাইলে কড়া ধ্বনিতে রিংটোন বেজে উঠলো। এতো রাতে কল আসায় হকচকিয়ে গেলো শেফালী। তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো রাকিব কল দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলো সে মিতালীকে পাশে দেখে। মিতালী তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে কল দিয়েছে?’

আড় চোখে তাকালো শেফালী। কিছুটা আমতা আমতা করে বলল, ‘ওই তো…কলেজের এক ফ্রেন্ড…’

বেশি কিছু বলার আগেই মিতালীর মোবাইল বেজে উঠলো। পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিলে দেখতে পেলো অংকুরের কল এসেছে। পালানোর সুযোগ পেলো শেফালী । কিছুটা টিটকারি করে বলে উঠলো, ‘বাহ্ বাহ্ জিমির কথা উঠতেই জিমির কল। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখুক। নাও নাও প্রেম করো। আমি তোমাদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি না হই। টাটা।’

বলেই চটজলদি উঠে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো শেফালী। মোবাইল হাতে নিয়ে স্মিতি হাসলো মিতালী। কল রিসিভ করে কানে দিলে অংকুরের মুগ্ধকর কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো।

‘ভালো আছেন ম্যাডাম?’

আবারো অংকুরের মুখে ‘ ম্যাডাম ‘ ডাকের সম্মোধন। লজ্জাভূতি হলো মিতালী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মুচকি হাসলো। গাল দুটো লাল হয়ে এলো তার। কথা বলতে লাগলো সেই মানুষটির সাথে যাকে সে ধীরে ধীরে তার মনে জায়গা দিয়েছে। যাকে সে ভালোবাসে।
.

রুমে এসে দরজা লাগাতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো শেফালী। বুকে হাত গুঁজে কয়েকবার স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো। কোনো রকমে যদি বুবু বুঝে যেত জিমির ভাই রাকিব কল দিয়েছে তাহলে কি ভাবতো? যদি জিজ্ঞেস করতো কেন কল দিলো এতো রাতে? তাহলেই বা সে কি উত্তর দিতো? এই লোকটা এতো বেহায়া কেন? বিরক্ত করার জন্য কি শুধু আমাকেই পাই? দাঁতে দাঁত পিষে মোবাইলের দিকে তাকালো শেফালী। কল রিসিভ করে ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি আপনার? এতো রাতে আমাকে কল দেওয়ার মানে কি?’

হাস্যউজ্জ্বল চেহারায় উল্লাসিত হয়ে কিছু বলার আগেই শেফালীর ঝাঁঝাল কণ্ঠস্বর শুনে থমথমে খেলো রাকিব। ভড়াট কন্ঠে বলল, ‘আশ্চর্য সবসময় এভাবে খ্যাঁকখ্যাঁক করো কেন তুমি?’

রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে উঠলো শেফালী। কোমরে এক হাত রেখে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘কিছুদিন আগে গ্যাঁজগ্যাঁজ বলেছিলেন। আজকে খ্যাঁকখ্যাঁক বলছেন।’

‘বলছি বেশ করেছি। আরো বলবো। নতুন নতুন কিছু বলবো। প্যানপ্যান, ভ্যানভ্যান, ক্যানক্যান, দ্যানদ্যান।’

শেফালী কিড়মিড় করে বলল, ‘উফফ থামবেন আপনি?’

রাকিবের ত্যাঁছড়া প্রতিত্তুর, ‘আমার মুখ, আমার ইচ্ছা। যতো খুশি বললো। তুমি বলার কে?’

বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করে ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো শেফালী। নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে বলল, ‘ফালতু কথার ঝুড়ি ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে বলেন কি জন্য কল দিয়েছেন।’

রাকিব প্রফুল্লিত কন্ঠে সবটা ঘটনা খুলে বললো। বিস্ময়ের কারণে শেফালীর ঠোঁট দুটোর মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক তৈরি হলো। বিশ্বাস হলো না তার। রাকিব আবারো বুঝাল। খুশি হলো শেফালী। খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো সে।
.

একদিন পার হলো। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত দিনটি চলে আসলো। দিনটি হচ্ছে রবিবার। সময় বিকেল কারেক্ট চারটা। কোনো এক কারণে আজকের বিকেলে সকলে উপস্থিত। জুলফিকার ও জুলেখা পাশাপাশি সোফায় বসে চা খাচ্ছে। শেফালী তাদের পাশেই বসে টিভিতে নিউজ লাগিয়ে দেখছে। মূলত জুলফিকারের কথায় বাধ্য হয়ে নিউজ দেখছে। যদি জুলফিকার না থাকতো তাহলে ওয়েব সিরিজ লাগাতো সে। আমেনা রান্না ঘরে কিছু কাজ সামলাচ্ছে। তখুনি কানে বাজলো কলিংবেলের আওয়াজ। ‘আমি দেখছি’ বলে উঠে দাঁড়াল শেফালী। দরজার কাছে এসে নিজের কুঁকড়ানো চুল গুলো ঠিক করে দরজা খুললো। দরজার অপর পাশের ব্যক্তিদের দেখে মুহূর্তেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো । বিস্মিত হয়ে মুখ হা করে ফেললো। অস্ফুটিত কন্ঠে জুলফিকার কে ডেকে উঠলো, ‘আব্বু?’

শেফালীর ডাক শুনে জুলফিকার ও জুলেখা দরজায় দিকে তাকালো। আগন্তুক ব্যক্তিদের দেখে বিস্মিত হলো দুজন। দাঁড়িয়ে পরলো তাৎক্ষনাৎ। জুলফিকার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা?’

চলমান…
চলমান..
চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here