#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★পিটপিট করে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছে খুশি। মাথাটা প্রচন্ড ভার লাগছে ওর। এক হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ খুলে তাকালো ও। চোখের সামনে সবকিছু অপরিচিত লাগছে ওর কাছে। বিস্মিত চোখে চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ও কোথায় আছে। এখানে চারপাশে বাঁশের দেয়াল। মাথার ওপরে ছনের ছাউনি। এসব কি? আমি কোথায় আছি? আর এখানে কিভাবে এলাম? খুশির হঠাৎ মনে পড়লো তখনকার কথা। আৎকে উঠলো খুশি। তারমানে কি কেউ ওকে কিডন্যাপ করে এনেছে?
খুশির ভাবনার মাঝেই হঠাৎ প্রহর হাতে করে একটা ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকে বাঁকা হেসে বললো।
–আরে বাহ্ মহারাণীর ঘুম ভেঙেছে তাহলে? বাপরে তুমি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। ওই সামান্য ক্লোরোফোমে কেউ এতক্ষণ বেহুশ থাকে নাকি? সারাটা রাত ঘুমিয়ে থাকলে।
খুশি যেন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো।
–তারমানে কি তুমি আমাকে বেহুঁশ করে এখানে এনেছ?
প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বললো।
–ওমা তো আর কারোর সাহস আছে নাকি আমার দুষ্টুপরিকে কিডন্যাপ করার? এতবড় বাপের বেটা এখনো পয়দা হয়নাই বুঝেছ? আর বেহুঁশ করার কি আছে? তোমার কোন হুঁশ থাকলে না বেহুঁশ করবো। আরে হুঁশ থাকলে কি আর এসব আবালের মতো কাজকাম করতে? আর না আজ আমাকে এসব করতে হতো।
খুশি কোনরকমে নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বললো।
–এসব কি করেছ তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
প্রহর ট্রে টা সামনের টেবিলে রেখে। ছুরি দিয়ে ফল কাটতে কাটতে বললো।
–সেতো কবে।তুমি এতদিনে বুঝলে? আরে আমার মাথাতো সেদিনই রিটায়ার্ড হয়ে গেছে, যেদিন থেকে তুমি আমার লাইফে এসেছ। আরে কোন ব্রেইন ওয়ালা সুস্থ সবল ব্যাক্তি কি তোমার প্রেমে পড়বে নাকি?
খুশি এবার তেতে উঠে বললো।
–এক মিনিট! কি বলতে চাইছ তুমি? তুমি কি বলতে চাইছ কোন সুস্থ সবল ব্যাক্তি আমাকে ভালোবাসবে না? তারমানে কি আমি পাগল?
–দেখ তুমি নিজেই নিজেকে পাগল বলছ? এখন আবার আমার দোষ দিওনা।
–এই এই একদম কথার জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে না। আমি মোটেও পাগল না বুঝেছ?
–এটা কি তুমি আমাকে বুঝাতে চাইছ? না নিজেকে? এন্ড এনিওয়ে সব পাগলরাই বলে আমি পাগল না।
খুশি এবার আরও খেপে গিয়ে বললো।
–আমি মোটেও পাগল না। পাগল তুমি বুঝেছ? তুমি তুমি তুমি..
প্রহর খুশির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বাঁকা হেসে বললো।
–হ্যাঁ পাগল তো আমি নিশ্চয়। তোমার প্রেমে পাগল। আর শুধু পাগল না। দিওয়ানা, উন্মাদ পাগল।
কথা বলতে বলতে প্রহর খুশির একেবারে কাছে চলে এলো। প্রহরের কথাবার্তা আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। কিছুটা সেই পূর্বের খুশির মতো। খুশির বিস্ময় যেন কাটছেই না। প্রহর খুশির কপালের পড়ে থাকা চুলটা আঙুলের সাহায্যে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে ভাবপ্রবন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–আর এই পাগলের ট্রিটমেন্ট একমাত্র তোমার কাছেই আছে। পারলে ট্রিটমেন্ট করো। নাহলে এই পাগলের সাথে নিজেও পাগল হয়ে যাও। দুজনে মিলে একটা পাগলের সংসার গড়ে তুলবো কেমন?
প্রহরের এমন খাপছাড়া কথাবার্তায় খুশি হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছে। খুশির খেয়াল হলো এসব চক্করে ও আসল বিষয় টাই ভুলে গেছে। প্রহর ওকে কথার জালে ফাঁসিয়ে আসল ব্যাপার থেকে পথভ্রষ্ট করছে। খুশির সেটা বোধগম্য হতেই খুশি প্রহরের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে শক্ত গলায় বললো।
–দেখ কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেনা। আমাকে এখানে কেন এনেছ? কি করতে চাইছ তুমি? দেখ এসব বন্ধ করো। এসব করে কোন লাভ হবে না।
প্রহর খুশির হাত টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মোহময় চোখে তাকিয়ে বললো।
–লাভ হবে কি হবেনা এটা নাহয় আমার ওপরই ছেড়ে দাও।
–দেখ তুমি কিন্তু ভুল করছো। এসব কিন্তু অন্যায়।
–আমিতো তোমাকে আগেই বলেছি। তোমাকে ফিরে পেতে যদি আমাকে দুর্ধর্ষ অপরাধীও হত হয় হবো। আমার মঞ্জিল শুধু তুই। আমি কোন মহান প্রেমের ইতিহাস গড়তে চাইনা। আমি শুধু তোর সাথে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচতে চাই। স্বার্থপর আমি, অনেক স্বার্থপর। তোর জন্য আমি চরম স্বার্থপর। তোমার সাথে থেকে আমিও একটু ফিল্মি হয়ে গেছি। তাই একটা ফিল্মি ডায়লগ বলছি শোনো।
“” মে তুম হে ভুল যাউ ইয়ে হো নেহি সাকতা
(আমি তোমাকে ভুলে যাবো এটা হতে পারে না)
অর তুম মুঝে ভুল যাও ইয়ে মে হোনে নেহি দুঙ্গা
(আর তুমি আমাকে ভুলে যাও এটা আমি হতে দিবোনা)
প্রহরের হৃদয় নিংড়ানো আবেগী কথায় খুশি সম্মোহিত হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রইলো প্রহরের চক্ষু পানে। প্রহর দুষ্টু হেসে বললো।
–কি দেখছ? আজ কি একটু বেশিই এট্রাক্টিভ লাগছে আমাকে?
খুশির কানের কাছে ঝুঁকে বললো।
–ডু ইউ ওয়ান্ট টু ইট মি? ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান সার্ভ ইউ।
খুশির চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। এ কোন প্রহরকে দেখছে ও? এটা প্রহর হতেই পারে না। প্রহরকে ভুতে টুতে ধরলো নাতো? নিজের বিস্ময় সামলে নিয়ে খুশি প্রহরের বুকে ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে সরিয়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–কিসব ফালতু কথা বলছ? আর তুমি চাইলেই কি সব হবে নাকি? আমি এখুনি চলে যাবো এখান থেকে। দেখি কিভাবে আটকাও আমাকে?
কথাটা বলে খুশি ধুপধাপ পা ফেলে রুমের বাইরে চলে গেল। প্রহর পেছন থেকে বাঁকা হেসে বললো।
–যাও চেষ্টা করে দেখ পারো নাকি।
খুশি বাইরে এসে চারপাশে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেল। কারণ এমনিতে এই কটেজের চারিদিকে বাঁশের বেড়া দ্বারা আটকানো।আর বেড়ার বাইরে সামনে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। আশেপাশে কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। খুশি হতভম্ব হয়ে গেল। এটা ও কোথায় চলে এসেছে? এখন এখান থেকে কিভাবে যাবে?
পেছন থেকে প্রহর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে এসে বললো।
–এটা প্রহরের মায়াজাল বেবি। এখান থেকে বের হওয়া এতো সহজ না।
খুশি প্রহরের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো। –এটা কোন জায়গা? কোথায় নিয়ে এসেছ তুমি আমাকে?
–এটা প্রহরের গড়া প্রাসাদ শুধুমাত্র আমার খুশি রাণীর জন্য। কাল একদিনের ভেতর আমি এটা বানিয়েছি। তুমি চাইলেও এখান থেকে যেতে পারবে না। কারণ এটা সেন্টমার্টিন দ্বিপের এমন একটি স্থান যেখানে মানুষের কোন নাম গন্ধ নেই। শুধু নির্জন পরিবেশে তুমি আর আমি। কত্তো রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার না?
–কেন করছ এসব পাগলামি? এতে কিছুই হাসিল হবে না। কেন নিজের জীবন টা আমার পেছনে বর্বাদ করছ? প্লিজ আমাকে রিসোর্টে ফিরিয়ে দিয়ে আস।
–বর্বাদ তো অনেক আগেই হয়ে গেছি তোমাতে। তাই যে করেই হোক তোমাকে তো আমার চাই। আর এখান থেকে তুমি ততক্ষণ ছাড়া পাবে না যতক্ষণ না তুমি মেনে নিচ্ছ যে তুমি এখনও আমাকেই ভালোবাস।
–এটা কখনোই হবে না। তুমি যত যাই করো তাতে লাভ হবে না। শুধু হিতে বিপরীতই হবে। তুমি কি ভেবেছ আমাকে এখানে আটকে রাখলে সব ঠিক হয়ে যাবে? এটা তোমার ভুল ধারণা। আর আমি তোমাকে সেটা প্রমাণ করেই ছাড়বো।
–লেটস সি দেন। হু উইল বি উইন। তোমার মিথ্যে অভিনয় জিতে,নাকি আমার সত্যি ভালোবাসা? এখন থেকে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই তোমার চোখের সামনে শুধু আমাকেই দেখতে পাবে। দেখি কতক্ষণ নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারো। ইট উইল বি ফান।
প্রহর খুশির কাঁধের ওপর ঝুঁকে দুষ্টু সুরে বললো
–বায়দা ওয়ে তোমাকে পিংক ড্রেসে কিন্তু মারাত্মক কিউট লাগছে। দিল বাত্যমিজ হয়ে যাচ্ছে।
খুশি চোখ বড়বড় করে প্রহরের দিকে তাকাতেই প্রহর চোখ টিপ মেরে দিল। খুশি বেচারির মুখ গোল আলুর মতো হা হয়ে গেল। হাতের ধাক্কায় প্রহরকে সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে লাগলেই প্রহর পেছন থেকে খুশির হাত ধরে ফেললো। খুশি প্রহরের দিকে ফিরে তাকালে প্রহর মুচকি হেসে গান ধরলো।
♬ জানাম দেখলো মিটগায়ি দূরিয়া
♬ মে ইঁহা হু ইঁহা, হু ইঁহা,হু ইঁহা
♬ কেইসি সারহাদে, কেইসি মাজবুরিয়া
♬ মে ইঁহা হু ইঁহা, হু ইঁহা, হু ইঁহা
(খুশি প্রহরের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একটা ব্রেঞ্চে গিয়ে বসলো। প্রহরও ওর পাশে গিয়ে বসে খুশির কাঁধ জড়িয়ে খুশিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে,হাতের মধ্যমা আঙুল খুশির কপাল থেকে স্লাইড করে নিচে আনতে আনতে গাইলো)
♬ তুম ছুপা সাকোগি মে ও রাজ হু
♬ তুম ভুলা সাকোগি ও আন্দাজ হু
♬ গুঁঞ্জতা হু যো দিলমে তো হেয়রা হো কিউ
♬ মে তুমহারি হি দিল কি তো আওয়াজ হু
♬ শুন সাকো তো শুনো ধারকানো কি জুবা
♬ মে ইঁহা হু ইঁহা, হু ইঁহা, হু ইঁহা
(সংক্ষিপ্ত)
__
তিশাকে নিয়ে বিচে এসেছে ফাহিম। বেড়ানোর উদ্দেশ্যে না। তিশাকে দিয়ে খাটানোর উদ্দেশ্যে। বেচারিকে পার্সোনাল সেক্রেটারি কম আয়া বানিয়ে দিয়েছে ফাহিম।তিশা এক হাতে পাইপ লাগানো ডাব আর আরেক হাতে টাওয়াল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে দুঃখে শরীর রি রি করলেও কিছু করতে পারছে না সে। এই বদমাশ টা যে চরম ফাঁসা ফাঁসিয়ে দিয়েছে ওকে। তবে আমার নামও তিশা। একেতো আমি মজা দেখিয়েই ছাড়বো। আজকে তো একে পাবলিকের রাম ধোলাই খাইয়ে ছাড়বো। বেটা বুঝবে কার সাথে লাগতে এসেছিল। মনে মনে প্ল্যান করে সয়তানি হাসি দিল তিশা।
কিছুক্ষণ পর ফাহিম সমুদ্রের পানি থেকে উঠে এলো। তিশার কাছে এসে এক হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আরেক হাত থেকে ডাব টা নিয়ে পাইপের সাহায্যে ডাবের পানি সেবন করতে লাগলো। তিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–দেখুন এখন কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আপনি যা বলেছেন আমি করেছি। এখন প্লিজ এসব বন্ধ করুন। আরে আপনার পিছে পিছে আয়া হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমি আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে কোন আড্ডাই দিতে পারছিনা। তাই আমি আর এসব করতে পারবোনা। আমি চললাম।
কথাটা বলেই তিশা উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই ফাহিম তিশার হাত ধরে ফেললো। বাঁকা হাসলো তিশা। এটাই তো ও চাচ্ছিলো। এখন হবে মজা। ফাহিম মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিশা হঠাৎ উচ্চস্বরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে লাগলো।
–বাঁচাও বাঁচাও, কেউ আছ প্লিজ আমাকে বাঁচাও। এই সয়তান টা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
তিশার এই ক্রিয়াকার্যে ফাহিম টাস্কি খেয়ে গেল। মেয়েটার মাথার তার ছিড়ে গেল নাকি সেই চিন্তা করছে। তিশার ড্রামায় কয়েকজন ছেলে ওদের কাছে এগিয়ে এলো। ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি হয়েছে এখানে?
তিশা মেলোড্রামা করে বললো।
–দেখুন না ভাইয়া এই বদমাশ টা আমার সাথে ইভটিজিং করছে। আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে প্লিজ বাঁচান না আমাকে।
তিশার ড্রামায় ভ্রু কুঁচকে এলো ফাহিমের। বুঝতে পারছে কি করতে চাইছে ও। ছেলেগুলো ফাহিমের দিকে এগিয়ে এসে প্রখর চোখে তাকিয়ে বললো।
–ওই তোর সাহস তো কমনারে। আমাদের সামনেই মেয়েবাজি করছিস? হাত পা নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাস না নাকি? ভালো চাশতো এখুনি ওর হাত ছাড়। নাহলে কিন্তু তোর মায়ের বুক খালি হয়ে যাবে।
ফাহিম ভালো করেই বুঝতে পারছে এই ছেলেগুলো কোন ধরনের। তাই হঠাৎ মুখভঙ্গি বদলে নিয়ে ভীতু স্বরে বললো।
–আরে আরে ভাই আমার এতো সাহস কই আপনাদের সাথে লাগার। আমি তো ছোট্ট নান্না মুন্না বাচ্চা মানুষ। ভুল হয়ে গেছে ভাই আর কখনো হবে না।
ছেলেগুলো বিজয়ের গর্বিত হাসি দিয়ে বললো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে। আজ প্রথম বার বলে মাফ করে দিলাম। আর যেন এসব না দেখি। যা এখন এখান থেকে।
–জ্বি ভাই।
ফাহিম মাথা ঝুঁকিয়ে ওখান থেকে সরে গেল। তিশা মনে মনে বিশ্বজয়ের হাসি দিল। যাক শেষমেশ এই আপদ টা থেকে মুক্তি পেল।হুঁহ্ এসেছিল তিশার সাথে লাগতে। দিলাম ঘোল খাইয়ে। তিশা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললো।
–আপনাদের অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। এখন আসি আমি।
কথাটা বলে তিশা চলে যেতে নিলেই ছেলে গুলো ওকে ঘিরে ধরলো। তারপর সয়তানি হেঁসে বলে উঠলো।
–এতো জলদি কিসের সুন্দরী? ধন্যবাদ জ্ঞাপন টা আরও একটু ভালো করে দিলে নাহয় জমতো। এমন শুঁকনো শুঁকনো ধন্যবাদে কও হবে?
তিশার ভয়ে গলা শুঁকিয়ে এলো। ওতো আসমান থেকে পড়ে খেজুরে আটকে গেল। এক ঝামেলা থেকে বের হতে গিয়ে আরও বড় বিপদে পা ফেললো। এরাতো হিরো না ভিলেন। একজনের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেরাই ভোগ করতে চায়। এরচেয়ে তো ফাহিমের সাথেই ভালো ছিলো। কমছে কম ছেলেটা ওর দিকে কু নজরতো দিতো না। এখন কি করবে ও? বেশি পন্ডিতি দেখাতে গিয়ে ফেসে গেলি। তিশা আশেপাশে তাকিয়ে ফাহিমকে খোঁজার চেষ্টা করছে। এখন একমাত্র ওই ভরসা। কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ফাহিমকে। তিশার এবার ভয়ে আত্মা কাঁপছে। কি করবে এখন ও? কিভাবে বাঁচবে ওদের হাত থেকে? তিশা ভয়ে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। হঠাৎ ফাহিমের কন্ঠ শুনে ফট করে চোখ খুলে তাকালো তিশা। ফাহিম ওখানে এসে ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললো।
–সরি ভাই আপনাদের আবার ডিস্টার্ব করছি। আসলে আমার আংটি টা বোধহয় এখানেই কোথাও পড়েছে। তাই খুঁজতে এসেছি।
ছেলেগুলো মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল। ফাহিম আংটি খোঁজার বাহানায় তিশার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো।
–কি মজা হচ্ছে তো এখন? আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এরা কেমন লোক। তাই চুপচাপ চলে গিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারবেন বেশি চালাকি দেখাতে গেলে কি হয়। আমার সাথে ডাবল গেম খেলতে চাইছিলেন না? এখন দেখেন কেমন লাগে?
তিশা কাঁদো কাঁদো সুরে বললো।
–প্লিজ মাফ করে দিন আমাকে। অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে আমার। আপনি যা বলবেন তাই করবো। তবুও প্লিজ বাচাঁন আমাকে।
–এখন আর বলে কি লাভ? দেখেছ এরা কতজন আর আমরা মাত্র দুজন। এদের সাথে কিভাবে পারবো? আমি কি বাহুবালী নাকি? তাই এখন আর কোন উপায় নেই।
–প্লিজ এমন করে বলবেন না। আমি পায়ে পড়ছি। প্লিজ বাঁচান আমাকে।
–দেখ এখন শুধু একটাই উপায় আছে।
–কি??
ফাহিম তিশার হাত ধরে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–ভাগোওওওও….
বলতে না বলতেই দুজন ভোঁ দৌড় দিল। ছেলেগুলো প্রথমে হকচকিয়ে উঠে পড়ে তারাও দৌড়ালো ওদের পিছে। ওরা দুজন দৌড়াতে দৌড়াতে পর্যটকদের ভীরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। এত মানুষের ভীড়ে ছেলেগুলো আর খুঁজে না পেয়ে ওরা ফিরে গেল। ফাহিম তিশা দৌড়ে অনেক দূর চলে এলো। যখন দেখলো ছেলেগুলো আর পিছে নেই। তখন ওরা থামলো। হাঁটুতে দুই হাত ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো ওরা। কিছুক্ষণ পর ওরা দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে একসময় বালির ওপর শুয়ে পড়লো ওরা।
___
হাঁটুর মাঝে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে খুশি।চিন্তার বেড়াজাল তার মস্তিষ্ক জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। ও যতো সবটা গোছাতে চাইছে ততই যেন সবকিছু বালির মতো হাত থেকে গড়ে পড়ছে। প্রহরকে যতো দূরে সরাতে চাইছে ততই অসফল হচ্ছে। কোন ক্রিয়াকৌশল ওর ওপর প্রতিক্রিয়া ফলাচ্ছে না। এখন আবার এইখানে এনে আঁটকে রেখেছে। তাও ভালো সুযোগ বুঝে বিবিকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি যে,আমি ঠিক আছি আমার জন্য যেন চিন্তা না করে। নাহলে তো আমাকে না পেয়ে বাসার সবাই এতক্ষণে চিন্তায় পড়ে যেত। কিন্তু এখন পাগলকে কিভাবে বুঝাবো?
গট গট পায়ের শব্দে প্রহরের আসার আগমন বুঝতে পেরে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল খুশি। যতটা সম্ভব শুধু ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখাতে চায় প্রহরকে। প্রহর ট্রে হাতে রুমে ঢুকে প্রফুল্লচিত্তে বললো।
–টাডা… বান্দা আপনার সেবায় হাজির রাণী সাহেবা। দেখ তোমার হ্যান্ডসাম শেফ তোমার কি বানিয়েছে। গরমা গরম ক্রিসপি এন্ড স্পাইসি প্রন ফ্রাই। একেবারে সমুদ্র থেকে টাটকা ধরে এনে তোমার জন্য বানিয়েছি। তোমার তো প্রন অনেক পছন্দ না?
প্রন ফ্রাইয়ের কথা শুনে মুখে আধামন চলে আসলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার যথাযথ প্রয়াসে নিয়জিত আছে খুশি। উল্টো মুখি অবস্থায়ই বললো।
–খাবোনা আমি।
প্রহর খাবারের ট্রে টা বেডের রেখে বললো।
–আর ইউ শিওর?? দেখ আমার কিন্তু অনেক ক্ষুদা লেগেছে। জানি তোমারও লেগেছে। তাই ফটাফট খেয়ে নাও। নাহলে কিন্তু আমি সব সাবার করে ফেলবো।
বেডের ওপর ট্রে রাখায় প্রন ফ্রাইয়ের তীব্র সুস্বাদু ঘ্রাণ নাক দিয়ে ঢুকে সোজা পেটে গিয়ে আঘাত করছে। খুশির দৃঢ় সংকল্পের সাথে রীতিমতো ওয়ার্ল্ড ওয়ার শুরু করে দিয়েছে। অবাধ্য চোরা চোখ বারবার ওদিকেই যাচ্ছে। সকাল থেকেই না খেয়ে থাকায় ক্ষুদাও লেগেছে অনেক। তারওপর এমন সুস্বাদু খাবার সামনে এনে খুশিকে সাংঘাতিক ভাবে টর্চার করছে প্রহর। খুশির মনোভাব বুঝতে পেরে প্রহর আবার বলে উঠলো।
–দেখ আমি তিন গুনবো। এর ভেতর যদি তুমি না খাও তাহলে কিন্তু আমি খেয়ে নিবো। এন্ড আই মিন ইট।
প্রহর গোনা শুরু করলো।
–এক…………দুই………আড়াই…….পনে তিন…….. এন্ড নাউ ফাইনালি তি….
তিন পুরো করার আগেই খুশি ওর সংকল্প কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রেখে ঝট করে একটা চিংড়ি তুলে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। প্রহর মুখ লুকিয়ে হাসলো। খুশির নজর এড়ালো না। খুশি আত্মগর্বের সুরে বললো।
–দেখ হাসবে না একদম। আমি খাচ্ছি কারণ আমি সুস্থ থাকতে চাই। যাতে তোমাকে আমি ভুল প্রমান করতে পারি। তানা হলে আমি মোটেও খেতাম নাহ।
প্রহর হাসি চেপে ধরে বললো।
–ইয়া ইয়া অফকোর্স। আই ক্যান টোটালি আন্ডারস্ট্যান্ড।
খাওয়া শেষে প্রহর প্লেট বাসন আবার রেখে আসলো। বেডের ওপর এসে কোন পূর্ব বার্তা ছাড়াই অনায়াসে খুশির কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আচমকা কান্ডে খুশি একটু থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত গলায় বললো।
–এই এই কি করছ তুমি? ওঠ, ওঠ বলছি।
খুশির কথা কর্নপাত না করে খুশির হাতটা নিজের মাথায় রেখে বললো।
–মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাওনা। মাথাটা অনেক ব্যাথা করছে। তোমার হাতের পরশ মাখিয়ে দাও একটু প্লিজ।
এমন আবদার কিভাবে ফেলবে খুশি? মন যে বড্ড বেশি বেহায়া। পারলোনা মানা করতে। হাত উঠিয়ে চালান করে দিল প্রহরের মসৃণ কেশবনে। আবেশে আঁখি যুগল বুজে নিল প্রহর। চেহারায় প্রসন্নতার ছায়া এনে বললো।
–জানো মনে হচ্ছে এখানেই সারাটাজীবন থেকে যাই। তুমি আর আমি মিলে এই নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে আমাদের আলাদা এক পৃথিবী গড়ে তুলবো। যেখানে শুধু তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না। কত্তো সুন্দর হবে সবকিছু তাইনা বলো? তোমার কি মনে হয়?
–ইঁদুর।।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ইঁদুর?? ইঁদুর কোথাথেকে আসলো?
–আরে আসলো না, এসে গেছে। মেঝেতে ইঁদুর।
প্রহর ফট করে চোখ খুলে হড়বড়িয়ে বেডের মাথার উপর উঠে বসে বললো।
–ই ইঁদুর?? কোথায় ইঁদুর? কিভাবে এলো ইঁদুর?
প্রহরের প্রতিক্রিয়া দেখে খুশি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–প্রহর তুমি ইঁদুর কে ভয় পাও??
প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে আমতাআমতা করে বললো।
–হো হোয়াট রাবিশ? আমি আর ভয়? হাঁহ্, নো চাঞ্চ। আমিতো বরং তোমার জন্য চিন্তিত হচ্ছিলাম। তুমি ভয় পাওনি তো? দেখ তুমি ভয় পেও না। আমি আছিতো। আমার কাছে চলে আস। আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই।
প্রহরের এই অপক্ব দলিল খুশির সন্দেহকে আরও মজবুত করে দিলো। খুশি আচমকা ঘর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে বেচারির কোমড় বাঁকা হয়ে গেল। হাসির মাঝে বলতে লাগলো।
–লাইক সিরিয়াসলি প্রহর?? তুমি ইদুর ভয় পাও? আই মিন দ্যা গ্রেট প্রহর মেহরাব, যে কিনা এক হাতে দশ জনকে কুপোকাত করতে পারে। সে কিনা সামান্য ইঁদুর ভয় পায়? ও মাই গড। এটাতো ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাওয়া দরকার।
বলতে বলতে খুশি হেঁসে হেঁসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে প্রহরের রাগ হচ্ছে না। কেন হবে? আজ কতদিন পরে ওর দুষ্টুপরির মন খোলা হাসি দেখছে। যে হাসিটাই একসময় প্রহরের ভালো থাকার টনিক ছিল। আজ এতদিন পরে আবারও সেই টনিকের ডোজ পেল প্রহর। শরীর মন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। ওর খুশিকে এভাবে হাসিখুশিই দেখতে চায় ও। আর তার জন্য সব করতে রাজি ও। এখানে আসাটা নিশ্চয় ওর জন্য পজিটিভ কিছু এনে দিবে।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২২
#লেখিক-মেহরুমা নূর
★দুপুরের কড়া রোদের তীব্রতা খানিকটা কমে এসেছে। বিকালের শীতলতা নেমে আসছে। জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে উদাসীন হয়ে বসে আছে খুশি।মলিন চোখের দৃষ্টি সামনের সীমাহীন সমুদ্রের মাঝে।একসময় প্রহরের সাথে এমনই একটা জায়গায় আসার স্বপ্ন দেখতো সে। দুজনে মিলে প্রকৃতির নিবিড়তায় নিজেদের হারাবে। প্রেমের মোহময় আলোড়নে জড়াবে দুজন। ভালোবাসাময় এক ছোট্ট পৃথিবী গড়ে তুলবে। তবে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েও অসম্পূর্ণ,বেদনাময়। আমাদের সাথে এমনটা না হলে খুব কি ক্ষতি হতো? জীবনের আরও কিছু টা দিন প্রহরের বক্ষে কাটাতে পারলে কি এমন হতো? আমাদের প্রেমকাব্যের পরিণতি এতো নির্মম হবে জানলে, আমি কখনোই প্রহরকে ভালোবাসার কথা বলতাম না। কখনও ওর মনে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করতাম না। কিন্তু এখন কি করবো? ওর মনে জায়গা তো করেছি। এখন সেটা মেটাবো কিভাবে?খুশির দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কিভাবে কি করবে? এখান থেকে কিভাবে বেড় হবে? প্রহরের মনে কিভাবে নিজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করবে? কিছুই বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রহরের পাগলামি তো দিনদিন শুধু বেড়েই চলেছে।
প্রহর সেই ঘন্টাখানিক পূর্বে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেনি। কি করছে কে জানে? তখন থেকে খুশি ওভাবেই বসে আছে। খুশির ভাবনার মাঝেই প্রহর চলে এলো। রুমে এসেই মুখে হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো।
–খুশি চলো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
খুশি পূর্বের ন্যায় বসে থেকেই বললো।
–আমি কোথাও যাবো না তোমার সাথে। তুমি আমাকে কবে রিসোর্টে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেটা বলো?
প্রহর এবার কোন কথা না বলে এগিয়ে এসে সোজা খুশিকে কোলে তুলে নিল। কোলে তুলে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বললো।
–তুমিও না অনেক দুষ্টু। ইচ্ছে করেই এমন করো যাতে আমি কোলে করে নিয়ে যাই। নাও এখন খুশিতো?
খুশি কিছু বলতে গিয়েও আবার বললো না। জানে এই পাগলের সাথে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। এর যা করার তাই করবে। প্রহর খুশিকে কোলে নিয়ে সমুদ্রের হাঁটু পানির মাঝে এসে বললো।
–দুষ্টুপরি সামনে তাকাও।
প্রহরের কথামতো সামনে তাকালো খুশি। চোখের দৃষ্টি চকিত হয়ে উঠলো। সামনে সমুদ্রের নীল স্বচ্ছ জলরাশির ওপর ভাসছে বাঁশের অপূর্ব এক ভেলা। ভেলায় ছড়িয়ে আছে নানান বন্যফুলের সমাহার। খুশির চোখের পাতায় যেন চকচকে তাঁরারা ঝিলমিল করছে। মাধুর্যমন্ডিত হয়ে গেল সারা মুখমণ্ডল। প্রহর এতক্ষণ ধরে তাহলে এসব করছিল? অতিব মায়াপূর্ণ নজরে তাকালো প্রহরের পানে। প্রহর মুচকি হেসে খুশিকে আস্তে করে ভেলায় বসিয়ে দিল। তারপর সে নিজেও ভেলায় চড়ে একটা বাঁশের বানানো বৈঠা দিয়ে ভেলা ভাসালো সমুদ্রের বুকে।
মাথার উপর উন্মুক্ত নীল গগনতলে ভেলা ভাসছে সমুদ্রের নীল পানির ওপর।শীতল পবন বইছে আপন তালে। খুশি বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে পানির নিচে। স্বচ্ছ পানির নিচের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে হরেক রকম পাথরের মাঝে বাহারি মাছেরা দল বেঁধে ছুটে বেড়াচ্ছে।খুশি প্লাজু একটু উপরে তুলে আস্তে করে পা জোড়া পানির মাঝে নামিয়ে দিল। মাছেরা এসে খুশির পায়ের উপর ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে খুশির। এ যেন অদম্য অবিস্মরণীয় অনূভুতি। যা কোন ভাষায় মিলিয়ে বলা সম্ভব না। খুশি আপাতত বাকি দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে বিছিন্ন হয়ে গেছে। শুধু এই মুহূর্তের মুগ্ধতায় ডুবে আছে।
আর প্রহর ডুবে আছে তার প্রিয়তমার মুগ্ধতায়। চোখের দৃষ্টি স্থির। খুশির চেহারার এই মুগ্ধতা প্রহরকে এনে দিচ্ছে অনাবিল সুখানুভূতির প্রচ্ছায়া। প্রহর মুচকি হেঁসে বলে উঠলো।
–দেন ইটস ফাইনাল।
প্রহরের কথায় ঘোর কাটলো খুশির। ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রহরের পানে। প্রহর বৈঠা চালাতে চালাতে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ ফাইনাল। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো। এখানেই হবে আমাদের নতুন পৃথিবী। গড়ে তুলবো আমাদের সংসার। এখানে বানাবো আমাদের আলাদা রাজ্য। যেখানকার মহারাণী হবে তুমি। আর তোমার মহারাজা, কম সেনাপতি কম সিপাহী, কম বাবুর্চি, কম সেবক, কম সবকিছুই শুধু আমি। আমি তোমার জন্য রোজ সমুদ্র থেকে মাছ মেরে এনে, রান্না করে তোমাকে খাওয়াবো। তুমি চিন্তা করোনা তোমার কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু মহারাণী হয়ে আরাম করবে। তোমার কোন কাজ নেই। তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসবে। আর আমাদের ভালোবাসার ফসল গুলো পৃথিবীতে আনবে। আমি কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা হতে চাই বুঝেছ? নো ফিগার মেইনটেইন এন অল। আমরা দুটো ফুটবল টিম করবো। একটা গার্লস টিম,আরেকটা বয়েস টিম। চিন্তা করোনা আমার স্টেমিনা প্রচুর। দুটো টিমতো আরামছে করে ফেলবো।
অন্য সময় হলে হয়তো প্রহরের এই আউট ক্যারেক্টর কথাবার্তা শুনলে খুশি অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেত। তবে আপাতত ও নিজের মনে অন্য কোন অনুভূতির প্রবেশ ঘটাতে অনিচ্ছুক। তাই সে প্রহরের কথার কোন প্রতিত্তর না দিয়ে আবারও পানির নিচে মনোনিবেশ করলো। এখন আপাতত সবকিছু ভুলে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চায় ও। কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন নাহয় এখন নাইবা হলো। খুশি দুই হাত দুই পাশে রেখে মাথাটা গগন মুখী করে আবেশে চোখ বন্ধ মুহূর্ত টা উপভোগ করতে লাগলো।
প্রহরের আর কি লাগে। সে গুনগুন করে গান ধরলো।
♬ একা আছি তো কি হয়েছে
♬ সবই তো আছে আমারই কাছে
♬ এই তুমি আছ, হৃদয়ে আছ
♬ আমারই জীবন তোমারাই এখন
♬ একা আছি তো কি হয়েছে
___
পরম আয়েশ করে বসে তখন থেকে খেয়ে যাচ্ছে ফাহিম। আর তিশা ওর পাশে দাড়িয়ে ওয়েটারের মতো সার্ভ করে যাচ্ছে। আর মনে মনে রাগে জ্বলছে। একেই বলে কু কর্মের ফল। চালাকি করে বাবা মাকে বোকা বানাতে গিয়ে এখন নিজেই ফ্যাসাদে ফেঁসে গেলাম। এখন না পারছে কিছু বলতে, না পারছে কিছু করতে। কপাল মন্দ হলে যা হয় আরকি। ফাহিম খাবার চিবুতে চিবুতে বলে উঠলো।
–তুমি চাইলে আমার সাথে বসে খেতে পারো। আমি এতটাও নির্দয় না।
তিশা দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে বললো।
–না না থাক আমার এতো মেহেরবানী লাগবে না। আপনিই খান পেট পুরে।
–হুমম মনে হচ্ছে রেগে আছ। যাক ব্যাপার না। এ্যাজ ইউর উইশ। আচ্ছা বাইদা ওয়ে তুমি বিয়ে করতে চাওনা কেন? আই মিন তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? ডোন্ট মাইন্ড অ্যাম জাস্ট আস্কিং।
তিশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–নাহ তেমন কিছুই না। আসলে বিয়ে করে আমি আমার স্বাধীনতার জলাঞ্জলি দিতে চাই না। বিয়ের পরে নিজের কোন স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। অন্য কারোর হাতের কাঠের পুতুল হতে চাই না আমি।
–এটা কেমন কথা? বিয়ে হলেই স্বাধীনতা শেষ হয়ে যায় নাকি? বিয়ের পরেও মেয়েরা তাদের স্বাধীন মতো চলতে পারে।
তিশা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–এগুলো শুধুই কথার কথা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। আমি নিজের চোখের সামনে সব উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি দেখেছি আমার মাকে, আমার বোনকে। আমার মাকে আজপর্যন্ত নিজের ইচ্ছেই নিজের জন্য একটা জামাও কিনতে দেখিনি। সবসময় দেখেছি বাবাই যা এনে দেয় তাই পড়তে হয় মাকে। বাবা কখনও মায়ের ইচ্ছে কিংবা পছন্দের কথা কখনো জানার চেষ্টাই করেনি। আর না কখনো তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দিয়েছে। আমার বোনও বিয়ের পরে তার জীবনের সব ইচ্ছে আকাঙ্খার জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। আমার আপু অনেক ভালো পেইন্টিং করতে পারে। তার অনেক বড়ো আর্টিস্ট হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার স্বামী তার ইচ্ছেকে দলাই মোচড়াই করে ডাস্টবিনের কোনায় ফেলে দিয়েছে। আর আপুকে বানিয়ে বাড়ির পার্মানেন্ট কাজের বুয়া। কিন্তু আপু কিছু বলতে পারে না। কারণ মেয়েদের যে কিছু বলতে নেই। এটাই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম।
তিশার কথায় ফাহিম কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিশার দিকে। তারপর বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হয়তো আপনার কথা কিছুটা ঠিক আছে। তবুও একটা কথা অবশ্যই বলবো। সব ছেলেরা কিন্তু এক হয়না। হ্যাঁ হতে পারে তাদের সংখ্যা কম। তবে আছেতো অবশ্যই। জানি আপনি যা এক্সপেরিয়েন্স করেছেন তাতে হয়তো বিশ্বাস করা কঠিন। তবে আমি বলবো সবাইকে এক মাপকাঠিতে দেখা কিন্তু ঠিক না। যেমন দেখুন আমাদের পরিবার। আমার মা একজন ডক্টর। বাবা সবসময় মাকে তার ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে। তারপর আমার ভাবিও ওয়ার্কিং ওম্যান। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে। ভাইয়া কখনো ভাবিকে কোন কাজে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং সবসময় প্রোৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি বাচ্চাদের দেখাশোনাও ভাইয়াই বেশিরভাগ সময় করে। আমাদের পরিবারে আমরা ছেলে মেয়ে সমান অধিকার ভাবি। এবং যথাযথ স্বাধীনতাও দিয়ে থাকি। আপনি এটা ভেবেন না যে, আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য আমি এসব বলছি। মোটেও না। আমি বলছি যা না যে আমাকে বিয়ে করুন। আমি শুধু বলতে চাইছি সবাই এক হয়না। তাই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনকে পায়ের শেকল ভেবেন না। যে আপনাকে যথাযথ সম্মান,স্বাধীনতা দিবে তাকে বিয়ে করতেই পারেন।
ফাহিমের কথায় কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তিশা। কেমন ভাবনায় পরে গেল ও। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটাও খারাপ না। ফাহিম এবার বাঁকা হেসে বললো।
–আর এমনিতেও বয়স তো আর কম হচ্ছে না। দুদিন পর আর তোমার ছেলেদের সামনে এক্টিং করতে হবে না। এমনিতে তোমার নরমাল চেহারা দেখেই সবাই মানা করে দিবে।
তিশা দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–ও হ্যালো, অ্যাম জাস্ট নাইন্টিন ওনলি। আপনি নিজের কথা ভাবুন। মেয়েরা তো দূরের কথা আন্টিরাও রাজি হবে কিনা সন্দেহ হুহ্। যে না চেহারা নাম দিয়েছে পেয়ারা।
ফাহিম কিছু না বলে শুধু হাসলো। মেয়েটাকে রাগাতে ভালোই লাগে। রাগলে অনেক কিউট লাগে ওকে। মনে হচ্ছে এবার বোধহয় কাম তামাম হয়েই যাবে।
____
দিবাভাগ গড়িয়ে নেমেছে ঘোর কালো যামিনী। ঘরের মধ্যভাগে টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেনের আলো। ইলেক্ট্রিসিটি নেই এখানে। তাই এই অরগ্যানিক উপায় বের করেছে প্রহর। দিনটা কাটলেও রজনীর আঁধার খুশির মাঝে বয়ে আনছে অধীরতা। কিভাবে কাটবে এই নিশি? এই একটা মাত্র রুমের ভেতর দুজন কিভাবে থাকবে? হাজার ইচ্ছে থাকা সত্বেও প্রহরের সাথে একসাথে এক রুমে থাকা যে সম্ভব না। ওর মনে কোনভাবে নতুন করে কোন আশা জাগানো যাবে না। ওর কাছাকাছি থাকলে যে আমি নিজেও দূর্বল হয়ে পড়ি। যেটা মোটেও ভালো লক্ষণ না। ওকে যে আমার দূরে সরাতেই হবে।
বাহিরের সব ঠিক ঠাক করে রুমে এসে ঢুকলো প্রহর। রুমে এসে সোজা বেডের ওপর এসে সটান হয়ে আয়েস করে শুয়ে পড়লো। খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি ব্যাপার ঘুমাবে না? সারারাত দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান আছে নাকি?
খুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো কোথায় ঘুমাবো?
–ওমা তোমার চোখের পাওয়ার বেড়ে গেছে নাকি? এতবড় একটা বেড তোমার চোখে পড়ছে না? এসো এসো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। অ্যাম সো মাচ টায়ার্ড। আই ওয়ান্ট টু স্লিপ।
–এসব কি বলছ তুমি? আমি তোমার সাথে কিভাবে ঘুমাতে পারি? কখনোই না। আমরা এক বেডে শুতে পারবো না।
–কেন কি সমস্যা? আর তুমি কি এই প্রথম ঘুমাচ্ছ নাকি আমার সাথে?
–ত তখনকার কথা আলাদা। কিন্তু এখন আমি তোমার সাথে এক বেডে ঘুমাতে পারবোনা।
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ঠিক আছে তাহলে আর কি করার? তোমার যেখানে খুশি ঘুমাতে পারো। আমার আবার বেড ছাড়া ঘুম হয়না। তাই আমিতো এখানেই ঘুমাবো। তুমি দেখে নাও কি করবে।
প্রহরের কথায় খুশির একটু রাগ হলো। প্রহর এমন নিশ্চিন্তে কিভাবে শুয়ে পড়লো। ওর কি আমার জন্য কোন চিন্তা হচ্ছে না? ঠিক আছে থাক ও ওখানে শুয়ে। খুশি বলে উঠলো।
–ঠিক আছে থাক তুমি এখানে। আমি বরং বাইরে গিয়ে ঘুমাবো।
প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–ওকে ফাইন যাও।
খুশি আবারও বিস্মিত হলো। ওতো ভেবেছিল প্রহর ওকে আটকাবে। আমাকে বেডে দিয়ে নিজে অন্য কোথাও বিছানা করে নিবে। খুশি এবার সত্যি সত্যিই বাইরে চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ প্রহর পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললো।
–আচ্ছা শোন, যেতে যেতে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যেও। শুনেছি এখানে রাতে নাকি জঙ্গলের ভুত পেতনীর দল ঘোরাঘুরি করে। আর আমার মতো সুন্দর মানুষ দেখলে ঘাড় মটকে কচকচ করে খেয়ে ফেলে। আমার ভাই এতো তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই। তাই দরজা ভালো করে আটকে দিয়ে যেও।
বেচারি খুশি আর এক পা ও এগুনোর সাহস পেল না। ভয়ে অন্তর আত্মা শুঁকিয়ে আসছে। ছোট বেলা থেকেই ভুতের কথায় অনেক ভয় পায় ও। কিন্তু এটাতো আর প্রহরের সামনে জাহির করা যাবে না। মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। তাই গলা ঝেড়ে আমতা আমতা করে বললো।
–উহুম,, বাইরে অনেক শীত। তাই ঘরেই মেঝেতে বিছানা পেরে শুবো।
প্রহর এবারও কোন ভাবাবেগ না দেখিয়ে বললো।
–ঠিক আছে জাহা তোমার ইচ্ছে। তবে হ্যাঁ মাটির ভেতর থেকে লম্বা লম্বা কেঁচো গুলো উঠে তোমার কানের মাঝে ঢুকে ডিসকো ডান্স করলে তখন যেন আমাকে বলোনা।
ব্যাস এবার বাকি অবশিষ্ট মনোবল টুকুও বিদায় নিয়ে পালালো খুশির কাছ থেকে। এখনতো মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও শরীর কাঁপছে। আর পেরে উঠলো না নিজের সাথে। দ্রুত পায়ে গিয়ে বেডের ওপর উঠে বসে বললো।
–ঠিক আছে আমি বেডেই শুবো। তবে মাঝখানে ডিস্টেন্স রেখে। ঘুমের মাঝে আমার এডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবে না একদম।
প্রহর দুষ্টু হেসে বললো।
–লুক হু ইজ টকিং। এডভান্টেজ এর কথা তুমি বলছ? ঘুমের মাঝে কে কার কেমন করে এডভান্টেজ নিয়ে থাকে সেটা কি আমার এখন মনে করিয়ে দিতে হবে?
খুশি অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে, এখন চুপচাপ শুয়ে পড়ো।
মাঝখানে ডিস্টেন্স রেখে খুশি বেডের একপাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রহরের সব কৌশলই কাজে লাগছে। এবার পরবর্তী স্টেপের পালা। আজতো দুষ্টুপরিকে তার বুকে নিয়েই ঘুমাবে প্রহর। আর সেটা কার্যকারী করার পদ্ধতিও জানা আছে তার। প্রহর খুশির দিকে কাত হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বোতাম গুলো খুলতে লাগলো। খুশিকে আকর্ষিত করার মূল মন্ত্রই এটা। খুশি একবার আরচোখে তাকিয়ে প্রহরের কার্যক্রম দেখে হকচকিয়ে উঠে বললো।
–এই এই কি করছ? শার্ট কেন খুলছ?
–এমনি আমার কেমন জানি হট হট লাগছে। তাই শার্ট খুলছি।
–এই হার কাঁপানো শীতে তোমার গরম লাগছে? আর ইউ কিডিং?
–আরে আমার শরীর আমার চেয়ে কি তুমি ভালো জানবে? আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
প্রহর শার্টের সবগুলো বোতাম খুলে শার্ট টা দুই দিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকটা উন্মুক্ত করে দিল। প্রহর যে এসব ইচ্ছাকৃত ভাবে করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে খুশি। তবে সে এতো সহজে গলবে না। প্রহরের মনকামনা সফল হতে দিবে না কোনমতেই। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেও তাতে টিকে থাকা যথেষ্ট দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। বেহায়া চোখের দৃষ্টি খুশির সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়ে বারবার প্রহরের পানেই তীর নিক্ষেপ করছে।চোরা চোখে ঘুরেফিরে দেখার চেষ্টা করছে পাশের সু বলিষ্ঠ যুবকের সুঠাম বুকটাকে। আরচোখে তাকানো দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনতে নিলেই কিছু একটাই ভ্রু কুঁচকে আসে খুশির। খুশি কাত হয়ে এবার সরাসরি তাকায় প্রহরের বুকের দিকে। বুকের বামপাশে যেখানে একবার খুশি কামড় দিয়েছিল সেখানে খুশি নামের ট্যাটু দেখে হৃদপিণ্ড থমকে গেল খুশির। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো সে। প্রহরের চোখের পানে চেয়ে ধরা গলায় বললো।
–এ এটা কবে করেছ?
প্রহর মায়াবী চোখে তাকিয়ে বললো।
–তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে। আমি যখন বিজনেসের কাজে ক্যানাডা গিয়েছিলাম তখন ওখানে এটা করিয়েছিলাম।তোমার দেওয়া প্রথম চিহ্নটাকে জীবন্ত রাখার জন্য এটা করেছিলাম। তুমি শেষ যেদিন আমার সাথে দেখা করেছিলে সেদিন তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে? এটাই সেই সারপ্রাইজ ছিল। তোমাকে সেদিন এটা দেখাতে চেয়েছিলাম। আর তোমাকে সেদিন বিয়ের জন্য প্রপোজ করার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু পরদিন তোমার বাসার সামনে গিয়ে তোমাকে আর পেলাম না। তোমার ফোন বন্ধ। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। জানো সেদিন সারাদিন তোমার বাসার বসে ছিলাম তোমার অপেক্ষায়। শেষে পাইপ বেয়ে তোমার ব্যালকনিতে গিয়েও দেখলাম দরজা আটকানো। মেইন দরজায় এসে দেখলাম সেখানেও তালা মারা। দিয়া শাহিন সবার কাছে তোমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তোমার কোন খোঁজ নেই। সে দিনটা যে আমার কি অবস্থা হয়েছিল সেটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্বিষহ দিন ওটা। কিন্তু আমি কি জানতাম এরপরের দিনগুলো তারচেয়েও ভয়াবহ হতে চলেছে। কারণ আমার দুষ্টুপরি হারিয়ে গিয়েছিল ……..
প্রহর আরও কিছু বলতে লাগলো। কিন্তু খুশির কানে আর ঢুকছে না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।চেপে রাখা কষ্ট গুলো বাঁধ ভাঙা সমুদ্রের পানি হয়ে উপচে পড়তে চাচ্ছে ওর দুচোখ দিয়ে। আর যে নিজেকে আটকাতে পারছেনা ও। খুশি প্রহরের বুকে নিজের নামের ট্যাটুর ওপর আলতো করে বোলাতে লাগলো। মাথা টা এগিয়ে নিয়ে ট্যাটুর ওপর একটা চুমু একে দিল খুশি। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো প্রহর। প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে গেল শরীর মন জুড়ে। খুশির চোখের বাধ ভেঙে গেল।প্রহরের বুকে হাত বোলাতে অঝোর ধারা বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন দিতে লাগলো।প্রহরও দুই হাতে জড়িয়ে নিল প্রিয়তমাকে।তবে খুশির শরীরের কাঁপুনি উপলব্ধি করে প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–খুশি? তুমি কি কাঁদছ?
নীরব কান্নার সাথে এবার আওয়াজের সংযোজন ঘটলো। সাথে শক্ত হলো হাতের বাঁধন।নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারছে না ও।আজ যেন সব কষ্টের প্রতিধ্বনিরা বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসছে। খুশির কান্নার শব্দ টের পেতেই প্রহর খুশিকে ছাড়িয়ে সামনে আনার চেষ্টা করলো। তবে খুশির শক্ত বাঁধন খুলতে পারলোনা প্রহর। ধীরে ধীরে খুশির কান্নার আওয়াজের গতি বাড়তেই লাগলো। আর বাড়ছে হাতের বাঁধন। প্রহর ভয় পেয়ে গেল। খুশিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। খুশি দুই হাতে প্রহরকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। সারা শরীর কাঁপিয়ে হৃদয়বিদারক কান্না করছে করছে খুশি। কাঁদার সময় খুশির দাঁত গুলো লেগে আছে প্রহরের বুকের সাথে। চোখের পানি আর লালায় ভিজে যাচ্ছে প্রহরের বুক জমিন।
আমি মরতে চাইনা প্রহর। আমি বাঁচতে চাই তোমার সাথে। তোমার সাথে বুড়ো হতে চাই। প্লিজ বাঁচাও আমাকে। আমাকে যেতে দিওনা। আগলে রাখো তোমার বুকে। প্লিজ আমাকে আটকে রাখো তোমার পিঞ্জরে।
মনে মনে চিৎকার করে এসব বললেও, মুখ দিয়ে শুধু কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারলোনা। চিৎকার করে কাঁদছে খুশি। প্রহরের কলিজা যেন ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। খুশির এই নিদারুণ কান্না সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। প্রহর ধরা গলায় বললো।
–প্লিজ সোনা আমার, থাম না। আর যে সহ্য হচ্ছে না। কি হয়েছে আমার লক্ষি সোনাটার? একবার শুধু বল না? আমি আছিতো। সব ঠিক করে দিবো। কান্না থামা। কি হয়েছে বল একবার?
খুশি চেয়েও নিজের কান্না থামাতে পারছে না। খুশি এবার কান্না থামানোর জন্য প্রহরের বুকে কামড়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর নিজের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ পেল সে। ধীরে ধীরে কান্নার গতি থেমে এলো। কান্না কমে এলে খুশি প্রহরের বুকের মাঝে থেকেই বলে উঠলো।
–প্লিজ এইমুহূর্তে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করোনা। আমাকে এভাবেই একটু থাকতে দাও।
খুশির কথা রেখে প্রহরও আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলোনা। খুশিকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। খুশি ফোপাঁতে ফোঁপাতে একসময় প্রহরের বুকে ঘুমিয়ে পড়লো। প্রহর খুশির মাথার উপর চুমু খেয়ে মনে মনে বললো।
–আমি জানতাম আমার দুষ্টুপরি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া ও কখনো ভালো থাকতেই পারে না। তবে আমি এখন এসে গেছিতো। আর কোন কষ্ট পেতে দেবোনা আমার খুশিকে। নতুন করে শুরু করবো আমাদের প্রেমকাব্য।
চলবে……
/