অন্তরিক্ষ প্রণয় পর্ব -০২

#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২
রিপোর্টে লিখা ছিল,
“বেবি এবোর্ট হয়েছে ও মানসিকভাবে বড় ধাক্কার কারনে বাকশক্তি কিছু সময়ের জন্য হারিয়েছে এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।”

আজ তিন বছর এই হাসপাতালে আছে প্রিয়তা। প্রিয়তার সব কথা মনে পড়ে না। মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর ও মাঝে মাঝে কিছু আবছা মনে পড়লে চিৎকার করে উঠত মাথা চেপে। প্রিয়তার ব্রেনের কিছু নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেছে অতিরিক্ত মানসিক আঘাতের কারনে। প্রিয়তাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে তিনবার। ইলেকট্রিক শক প্রিয়তা দিতে চায় না। নিয়ন ও রাত্রিকে কান্না করে করে মানা করে বলত বলেই আর ওদেরো মায়া হতো তাই তিন বছরে মাত্র তিন বার দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস আগে প্রিয়তা নিজের আসল নাম বলতে পেরেছে সকলকে। নিয়ন ছাড়া বাকিরা এখন প্রিয়তাকে প্রিয়তা বলে ডাকে তবে নিয়ন এখনে ‘প্রণয়ি’ বলে। প্রণয়িনীর সংক্ষিপ্ত রূপে ডাকা প্রণয়ি।

_________

প্রিয়তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে নার্সরা নিয়নকে ফোন করে। নিয়ন ও রাত্রি এখন সদ্য রেজিস্টার ডাক্তার হয়েছে। দুজনেই পাবনা মেডিকেলে আছে। নিয়ন প্রিয়তার এতোদিন পর আবার হাইপার হবার ঘটনা শুনে হাতের কাজ সেরে ছুটে আসে। এর আগে তিনবার এতোটা হাইপার হয়েছিল আর ঘুমের ইনজেকশন দিলে ঘুমাতো এরপর ঘুম ভাঙলে আবার হাইপার হতো তাই তখন শক দিতো। এমনিতে প্রিয়তা সবার থেকে দূরে একাকি ও চুপচাপ থাকতে বেশি পছন্দ করে।

নিয়ন আসার পর নার্সের কাছ থেকে জেনে নেয় যে প্রিয়তা চিৎকার করে কি কি বলেছিল। নিয়ন বুঝতে পারে এবার প্রিয়তার আরো কিছু মনে পড়েছে আর যা কষ্টের তাই হয়তো ওরকম কথা বলে চিৎকার করেছিল।

নিয়ন প্রিয়তাকে দেখে আবার রোগী দেখতে চলে যায়। এরপর ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব শেষ হবার কিছুক্ষণ আগে নিয়ন ও রাত্রি আসে প্রিয়তার কাছে।

নিয়ন ও রাত্রি প্রিয়তার পাশে বসে আছে। রাত্রি প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পিটপিট করে চোখ খুলে প্রিয়তা। আর চিৎকার করছে না। তখন রাত্রি ডেকে উঠে,

–প্রিয়তা? তুমি চিৎকার কেন করেছিলে? তোমার কিছু মনে পরেছে?

চুপ করে আছে প্রিয়তা। দৃষ্টি তার জানালার বাহিরে নীল আকাশে। শরৎকালের সাদা মেঘপুঞ্জ ভাসমান নীল আকাশে। প্রিয়তা চুপ দেখে রাত্রি নিয়নের দিকে তাকায়। নিয়ন এরপর আদুরে স্বরে বলে,

–প্রণয়ি! এই প্রণয়ি! কি হয়েছিল বলো?

হুট করে তাকায় নিয়নের দিকে। প্রিয়তার আঁখিযুগলের ভাষা নিয়নের বোধগম্য হচ্ছেেনা। নিয়ন ও রাত্রিকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তা রুক্ষ স্বরে বলে উঠে,

–আমায় প্রণয়ি বলবে না। আমি প্রিয়তা! প্রিয়তা আমি। প্রণয়ি সে ছাড়া আর কেউ বলবে না। সে আমাকে না চাইলেও আমি তার প্রণয়ি। বলবে না আমাকে প্রণয়ি বলে।

নিয়নের হঠাৎ বুকে চিনচিন ব্যাথা করে উঠে। নিয়ন জানে প্রিয়তার একটা বাচ্চা নষ্ট হয়েছে আর হয়তো এজন্যই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে এটাও মনে হতো, হয়তো কাউকে অনেক ভালোবাসতো প্রিয়তা। কিন্তু সেসব ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতো কারন এতোদিনে নিয়নের মনের কিছুটা জুড়ে প্রিয়তার স্থান হয়ে গেছে। তাই তো প্রিয়তার আসল নাম জানার পরেও নিয়ন ওকে প্রণয়ি বলে ডাকে। প্রিয়তা যে কাউকে এখনো ভালোবাসে সেটা নিয়ন আজ বুঝতে পেরে কষ্ট হচ্ছে তার। প্রিয়তা নিজের বউ পুতুল নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত।

নিয়ন উঠে যায় সেখান থেকে। নিয়নকে এভাবে বিমুর্ষ মুখ নিয়ে উঠে যেতে দেখে রাত্রির কেমন যেনো মনে হয়। রাত্রিও নিয়নের পিছু পিছু যায়।
করিডোরের একটা ফাঁকা স্থানে গিয়ে নিয়ন সিগেরেট ধরায়। সিগেরেটে একটান দিয়ে দ্বিতীয় টান দিবে তখনি কেও একজন ওর হাত থেকে সিগরেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। নিয়ন পাশে তাকিয়ে দেখে রাত্রি চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নিয়ন পকেটে হাত ঢুকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। রাত্রি এখনো ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
এবার রাত্রি জিজ্ঞাস করেই বসে,

–এই নিয়ন, তুই সিগেরেট কবে থেকে খাচ্ছিস? তুই তো সিগেরেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারতিস না। তাহলে এখন কিভাবে খাচ্ছিস?

নিয়ন ভাবলেশহীন। নিরুত্তর রইল। রাত্রি এবার নিয়নকে খোঁচা দিলে নিয়ন খোলা অসীম অন্তরিক্ষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

–আগে সহ্য হতো না কিন্তু এখন হয়!

রাত্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। তার কাছে নিয়নকে অচেনা লাগে এখন। মেডিকেলের চার বছর শেষ করার পর ইন্টার্নে ঢুকার কয়েকমাস হবার পর থেকে নিয়ন কেমন পাল্টে যেতে শুরু করলো। নিয়ন যেখানে তার বেষ্টফ্রেন্ডকে সব কিছু বলতো, সেই নিয়ন রাত্রির সাথে কিছু শেয়ার করে না। ইন্টার্ন শেষ করার পর নিয়ন অন্য কোন মেডিকেলে এপ্লাই পর্যন্ত করেনি।

রাত্রি নিয়নকে নিজের দিকে ঘুরায়। এরপর জিজ্ঞাসা করে,
–কি হয়েছে তোর? আমার সাথে শেয়ার করতে পারিস। আমি সবসময় তোর পাশে আছি। তোর সুখ-দুঃখ সবেতে আমি থাকতে চাই। আমি “দুধের মাছি” না যে সুসময়ে থাকবো কর দুঃসময়ে চলে যাবো!

নিয়ন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তার দোষ-গুন সবটাকে ভালোবাসি। তার দোষ গুলো সুধরাতে ভালোবাসি। সে খারাপ দিকে থাকলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে ভালোবাসি। সর্বোপরি তার আত্নাকে ভালোবাসি। কিন্তু যখন মনে সংশয় জমে, সে কি আদোও আমাকে ভালোবাসে! তখন? তখন কি করতে হয়? এরপর যখন এটা জানতে পারি যে তার হৃদ অন্তরিক্ষে আমি কোথাও নেই! তখন? তার অন্তরিক্ষের প্রণয় অন্যকারো নামে! তখন কি করা উচিত? বলতে পারবি? কি করা দরকার?

স্তব্ধ হয় রাত্রি। তার ভাবনাতেও কখনো আসেনি যে তার বেষ্টফ্রেন্ড কাউকে ভালোবাসে! যাকে নিয়ে সে নিজের হৃদমাজারে প্রণয় প্রহর সাঁজাতে ব্যাস্ত সে কিনা অন্য কাউকে তার অন্তরিক্ষ ভাবে!

জলে টইটুম্বুর নেত্রযুগল সুকৌশলে মুছে নেয় পাশে দাঁড়ানো অবুঝ মানবটির আড়ালে। অবুঝই তো! নাহলে ছয় বছর ধরে বন্ধুত্বের আড়ালে থাকা ভালোবাসাটা বুঝতে পারলো না! এটাও কি একবার প্রশ্ন আসেনি যে মেয়েটা কেনো তার সব কাজের সাপোর্ট করে ও সহযোগী হয়?

ভাবতে পারছে না রাত্রি। নিয়নকে কিছু না বলে চলে যায়। রাত্রি নিয়নের হাত ছেড়ে চলে যাবার পর নিয়ন রাত্রির দিকে তাকায়। তখন রাত্রিকে কথা গুলো বলে আবারো আগের ভঙ্গিমায় আকাশ দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ রাত্রির কিছু না বলে চলে যাওয়াটা বোধগম্য হলো না নিয়নের।

________

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে নিয়ন। সে নিজেও ডাক্তার তবে প্রিয়তার চিকিৎসা তো সে করে না। ডাক্তারকে নিয়ে প্রিয়তাকে দেখিয়ে এনেছে এরপর প্রিয়তার কিছু টেষ্ট করায়। এরপর ইনস্টেন্ট রিপোর্ট বের করে ডাক্তারের কাছে আলাপ করতে যায়। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলে,

–দেখুন ডাক্তার নিয়ন, মিস প্রিয়তার ড্যামেজ হওয়া কিছু নার্ভ রিকোভার করেছে নতুন করে। তাই তার স্মৃতি ফিরছে আর ওনার পাগলামি কমছে। নার্সরা অভজার্ব করেছে, উনার বিগত তিন মাসে অস্বাভাবিক আচরণ আগের তুলনায় কম করেছে। তিন মাস আগে সে এক জায়গায় বিমূঢ় হয়ে বসে থাকতো আর কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে উঠতো আবার দৌড়ে ছুটে যেতো। কিন্তু এখন সে সবার সাথে হাসি-খেলাও করছে। সে রিকোভার করছে। অনেক কিছুই তার মনে পড়েছে। আই থিংক, তাকে আরো বার দুয়েক ইলিকট্রিক শক দেওয়া লাগবে। তাকে হিপনোটাইজ করে তার কি মনে পড়েছে তা জানতে হবে।

নিয়ন ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে যায়। এরপর রাত্রিকে ফোন করে। তবে রাত্রির ফোন বন্ধ বলছে বারবার। নিয়ন বুঝতে পারছে না কি হলো রাত্রির? ফোন তো সহজে বন্ধ থাকে না। নিয়ন হসপিটালে যায়। রাত্রির চেম্বারে খোঁজ করে কিন্তু পাচ্ছে না। এক নার্স জানায় রাত্রি নাকি সকাল এগারোটার পর আর হসপিটালে আসেনি।

নিয়ন চিন্তায় পরে যায়। রাত্রি একটা গার্লস হোস্টেলে থাকে। এখন কিভাবে খবর নিবে! সে ভাবলো, গার্লস হোস্টেলের সুপারকে বলবে রাত্রিকে যেনো বলে একটু দেখা করতে। হোস্টেল সুপার আবার নিয়নকে ভালো জানে।

হোস্টেল সুপারকে কয়েকবার রিকুয়েস্ট করাতে সে রাত্রিকে আসতে বলে। তবে নিয়ন রাত্রিকে এভাবে দেখবে আশা করেনি!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here