অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব -১৪+১৫

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৪.

হাঁটার মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা বারবার আয়াজের পানে তাকাচ্ছে আবার নিজেকে দেখছে। কখনোবা নিরবে দুজনের হাইট মাপছে। সে আয়াজের থেকে অনেকটাই খাটো। মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট লম্বা হলেও আয়াজের কাঁধ সমান তার হাইট।

‘ফুচকা খাবেন?’

প্রিয়তার পেট ভরা। তবুও সে এমন সুন্দর অফার মিস করতে চাইল না। মাথা ঝাঁকাতেই আয়াজ তার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। প্রিয়তা আবারো মুগ্ধ হয়ে তাকালো আয়াজের পানে। কত যত্নশীল ছেলেটা। তার মনের মাঝে প্রেমের হাওয়া বইতে লাগলো। এই ছেলের প্রেমেতো সে বহু আগেই পড়েছে। তবুও নতুন ভাবে যেন সে প্রেমে পড়ছে। প্রিয়তা বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করলেও আয়াজের জন্য তা পারল না। আয়াজের চোখ রাঙানিতে ভদ্র মেয়ের মতো অল্প ঝালে এক প্লেট ফুচকা নিলো। আয়াজ খেল না।

‘তুমি কেন খাচ্ছ না?’

‘এসব আনহাইজেনিক ফুড আমি পছন্দ করি না।’

প্রিয়তা মুখ বাঁকাল। ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে খোঁচা দিল।

‘নিজে খাওনা কিন্তু বউকে তো বেশ খাওয়াচ্ছ। তাড়াতাড়ি মেরে অন্য একটা বিয়ে করার ধান্দা। বেশ বুঝেছি আমি!’

আয়াজ শীতল চোখে তাকালো। কোনো কথা না বলে প্রিয়তার হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিল। প্রিয়তা সবে তিনটা ফুচকা খেয়েছে। বাকি ফুচকা প্লেট কাত করে ময়লার বালতিতে ফেলে দিল আয়াজ। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো।

‘এই কি করছ! খাবো তো!’

আয়াজ বাঁকা হাসলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,

‘যদি মরে যান? দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আমার।’

প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারেনি। খুব আফসোস হলো। ওমন কথাটা বলা কি খুব জরুরী ছিল? গাল ফুলিয়ে আয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। দ্বিতীয়বার আর সে এই ছেলের পেছনে লাগবে না।
____________

পেপার হাতে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তরিকুল সাহেব। শাকিলা উশখুশ ভাবে পায়চারি করছে। এতবছরের সংসারে এখনো তিনি স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। তার উৎকণ্ঠা চোখের আড়াল হলো না তরিকুল সাহেবের। তিনি আড় চোখে অবলোকন করে বললেন,

‘কিছু বলবে?’

শাকিলা সাহস পেল। এগিয়ে এসে পাশে বসলো। ধরে আসা গলায় বললো,

‘ছেলেটার খোঁজ নিয়েছেন?’

আয়াজের কথা স্মরণ হতেই চোয়াল শক্ত হলো তরিকুল সাহেবের। হাতের পেপারটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে জ্বলন্ত চোখে চাইলেন। তীব্র রাগ নিয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন।

‘তোমার ঐ অভদ্র বেয়াদপ ছেলের কথা আমায় বলবেনা। কতটা অবাধ্য হলে এভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়! আমার সম্মানের কথা একবারও ভাবলো না।’

শাকিলা বেগম অসহায় মুখে তাকালেন। অনুনয় করে বললেন,

‘ছোট ও। না বুঝে ভুল করে ফেলেছে। আপনি এভাবে রাগলে মানায়?’

তরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন,

‘তোমার ছেলে যে ছোট বিয়ে করার সময় মাথায় ছিল না তার? তুমি বা কোন আক্কেলে ছোট ছেলের বউকে ধেই ধেই করে বরণ করতে গেলে! বোঝাতে পারলেনা সে ছোট বিয়ে করার বয়স হয়নি!’

শাকিলা হতাশ হলেন। বাপ-ছেলে কেউ কারো থেকে কম না। এভাবে চললে এর শেষটা কিভাবে হবে! সে তো মা! সন্তান বাড়ির বাহিরে আছে। কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুদন্ড স্থির থাকতে পারছেন না তিনি। একটা মাত্র ছেলে একটুনাহয় অবাধ্য হয়েছে। তাই বলে এভাবে বের করে দিতে হবে কেন? চোখ জ্বলে উঠলো তার। ভিষণ অভিমান হচ্ছে তার। ছেলেটাও বা কম কিসে? বাপ বলল অমনি সুরসুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের কথা একবার ও ভাবল না। শাকিলা শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করলেন। ছেলে বাড়ি ফিরলে তবেই এই দরজা খুলবে। অন্যথায় সে রুমের বাহিরে এক পা ও ফেলবে না। আর নাইবা খাবে। দেখা যাক পানি কতদূর গড়ায়।
___________

রোদ ঝলমলে সকাল। প্রিয়তার অফ পিরিয়ড চলছে। আয়াজকে কয়েকবার কল করেও পেল না। প্রিয়তা ওদিকে তেমন পাত্তা দিল না। হয়তো ব্যস্ত আছে।

‘প্রিয়তার মুখ উজ্জ্বল লাগছে খুব। কারণ কি?’

প্রিয়তা তাকালো। তার সামনের ডেস্ক থেকে শর্মিলা ম্যাম হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তিনি এই স্কুলে সবথেকে সিনিয়র। বয়স চাকরি দুদিক থেকেই। তাছাড়া ভিষণ মিশুক। কেমন হেসে হেসে কথা বলে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। বিয়ের কথা বলেকি সে সবাইকে একটু চমকে দিবে? কিন্তু হাতে টাকা নেই। এভাবেতো বলা যায় না। তাই সে চেপে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,

‘আমার হাসতে মানা?’

‘তা নয়। তবে তোমার হাসি তো ধুমকেতুর মতো। বহু অপেক্ষার পর দেখা মেলে। তাই কিউরিয়াস!’

প্রিয়তা মুচকি হাসলো। কোনো জবাব দিলো না। কি বা জবাব দিবে?
আজ বহুদিন পর নিখিলের সাথে দেখা। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়ে গেল।

‘কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তো খোঁজ পাওয়া যায় না।’

অনেকটা টিটকারী করেই বলল নিখিল। প্রিয়তার মন আজ ভীষণ রকম ভালো। মন ভালো উপলক্ষে নিখিলের এই সামান্য কথাকে গায়ে মাখাল না সে। সৌযন্যমূলক হেসে বলল,

‘এই একটু ব্যস্ত ছিলাম মাত্র।’

‘এতটাই ব্যস্ত যে সামান্য ম্যাসেজ ওপেন করার সময়টাও হয়নি!’

নিখিলের কন্ঠ জুড়ে হতাশা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট গুলো অভিমাণ হয়ে বের হতে চাইল। নিখিল রুখল। তার সামনের এই রূপবতী রমনীর কৃষমতা নেই তার হৃদয়ের ব্যাথা অনুভব করার। তার অভিমান গুলোকেও হয়তো সে অবহেলায় উড়িয়ে দিবে ঠিক যেভাবে মেয়টার মোবাইলে এক অংশে তার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো পড়ে রয়েছে নিদারুণ অবহেলায়। নিখিল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুখে মিথ্যা একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে ব্যাথিতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘এক কাপ কফি একসাথে বসে খাওয়ার মতো বন্ধুত্বটুকু আছে নিশ্চয়ই!’

প্রিয়তা নিখিলের আকুতি ভরা দৃষ্টি দেখলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মতী জানালো। প্রিয়তার বলতে ইচ্ছা হলো,’আমার যদি আরো একটা হৃদয় থাকতো সেখানেও হয়তো আপনাকে দেওয়ার মতো বিন্দু জায়গা অবশিষ্ট থাকতো না। আমার পিচ্চি বরটা জানেন তো ভিষণ হিংসুটে। দুটো হৃদয়েই থাকতো তার রাজত্ব। আপনি তখনো কষ্ট পেতেন। এখনো পাচ্ছেন। এটা আপনার ডেস্টিনি। যা হয়তো আপনিই চেয়ে এনেছেন!’

মানুষের ডেস্টিনি সত্যিই অদ্ভুত। কেউ জানে না তার ভাগ্যে কি আছে। কি হবে বা হতে চলেছে। প্রিয়তাও কি জানত সে তার অতি বরক্তিকর এক পিচ্চিকে এতটা ভালবেসে ফেলবে। কিংবা তার সাথেই ঘর বাঁধবে! কিন্তু সেটাই হয়েছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে মানুষের জীবনে। কিছু ঘটনা খুব নাটকিয় ভাবে ঘটে যা নিঃসন্দেহে কোনো অস্কার প্রাপ্ত সিনেমাকে হার মানাবে। ঠিক প্রিয়তার জীবনের গল্পের মতো করে।

এই রেস্টুরেন্টে প্রিয়তা আগেও এসেছে। নিখিলের সাথেই। এখানের কফিটা ভালো। পরিবেশটাও ভিষণ সুন্দর। এমন নিরব পরিবেশ আয়াজের ভিষণ পছন্দ। প্রীয়তা চট করে ভাবল আয়াজকে সাথে নিয়ে এখানে একদিন আসবে। দুজন এই নিরব পরিবেশে কিছুটা সময় পার করবে।
কফি এসেছে। প্রিয়তা তৃপ্তি নিয়ে কফিতে চুমুক বসালো। উদাস গলায় বলল,

‘আপনার বোধহয় একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত নিখিল। এভাবে অন্যের বউয়ের পেছনে ছোটা মোটেই শোভনীয় নয়।’

নিখিল প্রিয়তার কথা বুঝলো না। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো। প্রিয়তার মায়া হলো। মানুষের হৃদয় ভাঙতে ভিষণ রকম দুঃখ দুঃখ অনুভব হয়। তার ও হচ্ছে। প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল। কিন্তু বলার সময় এলোমেলো অগুছালো হয়ে গেল।

‘রিসেন্টলি একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

নিখিল আগ্রহ নিয়ে চাইল। ভ্রুদয়ের মাঝে সামান্য ভাঁজের সৃষ্টি হলো। নিখিলের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েই প্রিয়তা ঝটপট বলল,

‘বিয়ের মতো অত্যন্ত চমৎকার কাজটা আমি করে ফেলেছি।’

চলবে……..#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫.

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে প্রিয়তা সোজা হাঁটতে শুরু করেছে। বাসের জন্য তাকে আর নাহলেও দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো। অদ্ভুত ভাবে আজ একা হাঁটতেও ভিষণ আনন্দ অনুভব হচ্ছে। নিখিলকে সবটা জানাতে পেরেও নিজেকে হালকা লাগছে। হয়তো সে একটু কষ্ট পেয়েছে কিন্তু একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়তার আজকাল নিজেকে সুখি মানুষ মনে হয়। সম্পূর্ণ লাগে নিজেকে। টোনা টুনির সংসার তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। ছোট হাঁড়িতে করে ভাত রান্না, একটা মুরগি, একপদের মাছ আর সবজি দিয়ে সপ্তাহ পার করা। এসব যেন ভিষণ ইন্টারেস্টিং ঠেকছে তার কাছে। খুব বেশি বিলাসিতা নয় আবার অভাব ও না। একদম সচ্ছ সাচ্ছন্দ্যের সংসার তার। তার নিজ হাতে গড়া নিজের সংসার।

শীতের আমেজ পড়ে গিয়েছে। বিকেল হতেই ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস শরীর মন দুটোকেই শীতল করে দিচ্ছে। প্রিয়তার অবশ্য এই শীতকালটা ভিষণ অপ্রিয়। কাজে বড্ড আলসেমি অনুভব হয়। চোখ জুড়ে শুধু ঘুম ঘুম পায়। ভোরে উঠে স্কুলে যেতে প্রায় শরীর আর মনের সাথে যুদ্ধে নামতে হয়। তখন মন চায় বাচ্চাদের বলতে তোমাদের ছুটি। পুরো শীতকাল জুড়ে তোমরা কেবল ঘুমাবে। তোমাদের দায়িত্ববান শিক্ষিকা হিসেবে আমিও অত্র কাজ যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করব।

আয়াজ দুপুরে বাসায় ফেরেনি। একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। প্রিয়তা চিন্তিত হয়ে ডায়াল করলো আয়াজের নাম্বারে। কিন্তু অফ বলছে। প্রিয়তা মন খারাপ করলো। এভাবে গায়েব হ ওয়ার মানে কি? আয়াজ জানেনা প্রিয়তা তার জন্য অপেক্ষা করছে? তার লেট প্রিয়তাকে কতটা টেনশন আর পীড়া দেয় তা সে বোঝেনা?
__________

আয়াজ যখন ফিরল তখন রাত দশটা। ক্লাঞ্ত শরীরটাকে টেনে দ্বিতীয় তলা অবদি তুলতে তার ভিষণ কষ্ট হলো। পরিপাটি মানুষটার চেহারায় কেমন বিধ্বস্ত অবস্থা। পরপর দুবার বেল দিতেই দরজা খুলে গেল। প্রিয়তা দরজা খুলে চুপ করে পাশ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভুল করেও একবার চাইল না আয়াজের পানে। আজ তার মন ভিষণ খারাপ। আয়াজ প্রিয়তার দিক তাকিয়ে অল্প হাসার চেষ্টা করল। ক্লান্ত মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘খেয়েছেন?’

প্রিয়তা এ কথার উত্তর দিল না। রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,

‘ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার গরম করছি।’

আয়াজ ব্যথিত হলো। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে প্রিয়তার পানে চাইল। কিন্তু পাষাণ রমণী মুখ তুলে চাইল না। না দেখলো আয়াজের করুণ সে দৃষ্টিকে। আয়াজ লম্বা করে বেডে শুয়ে পড়লো। মাথাটা ধরেছে খুব। গলা উঁচিয়ে সে প্রিয়তাকে ডাকল।

‘এক কাপ কফি হবে?’

জবাব এলো না। আয়াজ চোখ বন্ধ করলো। চাকরিটা তার হয়নি। চাকরির সন্ধানে তার এক বন্ধুর মামার সাথে দেখা করতে মিরপুর গিয়েছিল। ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে থেকে তবেই তার দেখা পেয়েছে। সেখান থেকে বের হতেই জানতেপারে শাকিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। সে অবস্থাতেই সে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটেছে। আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার কারণ বসত দুর্বল হয়ে সেন্স হাড়িয়েছে। সেলাইন দিয়েছে ডাক্তার। আজ রাত থেকে কাল তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল থেকে একনাগাড়ে এত দৌড়াদৌড়িতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাছাড়া দুপুর থেকে‌ পেটে কিছু পড়েনি।

‘কফি নাও।’

আয়াজ চোখ মেলল। প্রিয়তা এখনো তার দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বউয়ের অভিমানটা তার ভালো লাগলো। আয়াজ ধীরে উঠে বসলো। প্রিয়তার হাত থেকে কাপ নিয়ে তার হাত ধরে কাছে টেনে বসালো। যত্ন করে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিল। আদুরে ভাবে বলল,

‘এত অভিমান এর কারণ?’

প্রিয়তা জবাব দিল না। আজ সে পন করেছে আয়াজের কোনো মিষ্টি কথায় সে ভুলবে না। আয়াজ মুচকি হাসলো। সে জানতো উত্তর পাবেনা সে। এতদিনে প্রিয়তার এসব স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছে সে।

‘মা অসুস্থ প্রিয়। হসপিটালে এডমিট। হঠাৎ করে খবর পাওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আপনাকে জানানোর কথা মাথায় ছিল না। প্রমিস আর এমন হবে না।’

প্রিয়তা চমকালো। মা সুলভ মানুষটা অসুস্থ শুনতেই বুকের ভেতর কেমন করলো। যদিও পরিচয় খুব বেশি দিনের না। কিন্তু অল্পতেই মানুষটা কেমন করে যেন প্রিয়তার প্রিয়ের তালিকায় নাম করে নিয়েছে। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। তার মন খারাপ হলো ভিষণ রকম। তার মুখে আঁধার নামতে দেখে আয়াজ তাকে নিশ্চিত করলো তিনি সুস্থ আছেন। তবুও প্রিয়তার অশান্ত মনটা শান্ত হলো না।
_____________

‘আপনি আমার যত্ন নিচ্ছেন না বউ।’

তোয়ালে হাতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল আয়াজ। সদ্য গোসল করায় চুল থেকে টুপটাপ পানি পরছে। উদম দেহটাতেও পানিকণা বিন্দু বিন্দু আকারে জ্বলজ্বল করছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকালো প্রিয়তা। প্রেম সাগরে উপচে পড়লো ঢেউ। এত সুন্দর কেন! প্রিয়তা জানে আয়াজ ইচ্ছে করেই এরূপে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তবুও সে নিজেকে আটকাতে পারল না। যাকে বলে নিজ পায়ে কুড়াল দেওয়া। তেমনটাই করলো সে। তার অবাধ্য চোখ দুটো স্হির হয়ে রইল আয়াজের উদম বুকের দিকে। আয়াজ ক্রুর হাসলো। এগিয়ে এসে তোয়ালে প্রিয়তার দিকে ছুড়ে দিল। শুধাল,

‘তাকিয়ে না থেকে পতি সেবা করুণ। বেহেস্তে যাওয়ার কতশত পথ দেখেছেন? তবুও আপনারা মেয়েজাতি আমাদের স্বমীদের মূল্য দিলেন না। কবে বুঝবেন বলুনতো!’

শেষের কথাটা খানিকটা আফসোস নিয়ে বলল আয়াজ। প্রিয়তা কথা বাড়ালো না। তার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এখন জবাব দেওয়া মানেই ঘুমের গলায় ফাঁস পড়ানো। যা সে একদমই চায় না। প্রিয়তা আগালো। চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো আয়াজের চুল মুছে দিতে লাগলো।
___________

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করতে লেগে পড়েছে প্রিয়তা। নাস্তা সাথে নিয়ে শাশুড়ি মাকে দেখতে যাবে। শাকিলা বেগমের সাথে তার তেমন একটা আলাপ হয়নি। তবুও তার কাছে ভিষণ আপন মনে হয়। কেমন মায়া জাগে। প্রিয়তার একটা মায়ের সখ বহুদিনের। এতদিনে সে একটা মা পেয়েছে। ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে। সেই কবে মা কে হারিয়েছে সে। চেহারাটাও মনে নেই। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে। মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই পেল না।

‘দুটো সংবাদ আছে। একটা গুড অন্যটা ব্যাড। কোনটা আগে শুনতে চান?’

প্রিয়তা কপাল কুঁচকে তাকালো। রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখ মুখ জুড়ে বিস্তার হাসি। প্রিয়তা আগাগোড়া আয়াজকে অবলোকন করল। সকাল সকাল কোন ড্রামা স্টার্ট করলো আবার? প্রিয়তা পুনরায় রুটি বেলায় নজর দিল। মুখে বলল,

‘যদি সত্যি কিছু বলার থাকে ঝটপট বলে বিদায় হও। হাতে একদমই সময় নেই।’

‘আপনাকে জব করতে হবে না। ছেড়ে দিন।’

প্রিয়তার হাত থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ছেলেটার নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়েছে। পরক্ষণেই হেসে দিয়ে বলল,

‘জব ছাড়লে চলব কি দিয়ে পিচ্চিছেলে?’

আয়াজ রাগ করলো না। হাসি মুখে প্রিয়তার পেছনে এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে হাত গলিয়ে মাজা আঁকড়ে ধরলো। প্রিয়তার নরম কাঁধে থুতনি রেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,

‘একটা জব পেয়েছি প্রিয়তা। একটু কষ্টের। কিন্তু মাস শেষে যা পাব তা দিয়ে খুব সুন্দর করে হয়ে যাবে। দু তিনমাস এভাবে চলি। তত দিনে নাহয় একটা ভালো জব খুজে নিব।’

প্রিয়তা মুচকি হাসলো। উত্তর করলো না। কিছু কিছু সময় উত্তর না দেওয়াই ভালো। পরে নাহয় বুঝিয়ে নিবে।

‘ব্যাড নিউসটা কি ছিলো?’

আয়াজ প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়ালে হেলান দিল। ভিষণ রকম মন খারাপ নিয়ে বলল,

‘ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম যেখানে সেখানে জবটা হয়নি।’

প্রিয়তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না। সে আগের মতোই রুটি বেলতে বেলতে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘মানুষের অফিসে কাজ করে লাভ নেই আয়াজ। চলো নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাই। নিজেদের এতবড় অফিস থাকতে মানুষের হয়ে কাজ করে কি লাভ?’

আয়াজ ভ্রুকুচু করলো। প্রিয়তাকি জানেনা ও বাড়ি তাদের জন্য নিষিদ্ধ!

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here