অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব -১৪

#অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব~১৪

রুমের এক কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে পিহু। হার্টবিট দ্রুত ওঠানামা করতেছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। বারবার শ্বাস টানছে পিহু। চোখের পানি বাঁধন ছাড়া হয়ে গেছে তার। এতদিন পর ইফাজকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। মন মানছে না পিহুর। একবার ইচ্ছা করছে দৌড়ে গিয়ে ইফাজের কাছে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে কাঁদতে তো আরেকবার একরাশ অভিমান এসে ভড় করছে পিহুর উপর। এতদিন অভিমান গুলো না এলেও আজকে ইফাজকে দেখে পিহুর সব অভিমান গুলো এসে হাজির হয়েছে। তারা পিহুকে বলছে,যাবি না পিহু??ইফাজের কাছে যাবি না। তোর এখন ওর থেকে দূরে থাকা উচিত। ওকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে তুই ওকে ছাড়া ভালো আছিস। কাদিস না।
কিন্তু পিহুর যে এতেও শান্ত হতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে থেকে এতক্ষণ ইফাজ দরজা ধাক্কা দিলেও এখন আর দিচ্ছে না। সে পিহুকে শান্ত হওয়ার জন্য সময় দিচ্ছে।
ইফাজের ও পিহুর মতোই অবস্থা। হাত পা কাঁপছে,যদি পিহু ওকে ক্ষমা না করে?? তাহলে কি হবে??তবে যাই হোক আজকে সব ভুল বোঝাবুঝি সে মিটিয়ে তবেই যাবে। অনেক হয়েছে আর না। হয়তো পিহু ইফাজকে নিজের জীবনে আর ফেরাবে না কিন্তু ইশানকে তো ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে!!ইফাজের কাছে এটাই অনেক।ইফাজ চিন্তিত হয়ে সোফার এক কোনায় বসে আছে।

কিছুক্ষণ আগে,,,,,,,,
বই হাতে নিয়ে পিহু বসে ছিল। খুব মনোযোগ তার বইয়ের প্রতি। কিন্তু হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে উঠল। বইটা বন্ধ করে পিহু দরজার দিকে তাকালো। তবে কি মীরা চলে এলো?? কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তো আসার কথা না??অবশ্য মীরাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।কখন যে রাগ করে বসে তা ভাবা মুশকিল। যত বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে জেদটা ততই বাড়ছে মীরার। পিহু বইটা সোফায় রেখে উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে সামনে না তাকিয়ে বলতে লাগলো,’এতো তাড়াতাড়ি তোদের ভেলপুরি খাওয়া শেষ হয়ে গেল???’
বলতে বলতে সামনে তাকাতেই পিহু চুপ করে গেল। স্বয়ং ইফাজ দাঁড়িয়ে আছে পিহুর সামনে। ইফাজের পাশে আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তবে তা পিহু স্পষ্ট দেখতে পারলো না। কারণ তার চোখদুটো যে পানিতে ভরে গেছে। দুকদম পিছিয়ে এলো পিহু। শরীর প্রচন্ড কাঁপছে পিহুর। এই হতো পড়ে যাবে। পিহুর এরকম অবস্থা থেকে ইফাজ একটু এগিয়ে এসে বলল,’পিহু,,,,,’
এটুকু বলতেই পিহু তার হাত উঁচিয়ে ইফাজকে থামিয়ে দিলো। কিন্তু পিহু কিছু বলতে পারলো না। গলায় কথা আটকে গেছে ঠিক মাছের কাঁটার ন্যায়। পিহু দেরি না করেই নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। না ইফাজের সাথে কথা বলল আর না ইশানের সাথে। আগে পিহুর নিজেকে সামলানো দরকার তারপর না হয় ওদের সাথে কথা বলবে।
ইশান বুঝেছে যে মীরা ছাড়া কেউ ওর আম্মুকে রুম থেকে বের করতে পারবে না।তাই পিহুর কথামতো আশেপাশের ভেলপুরির দোকান ঘুরতে ঘুরতে মীরাকে পেয়ে গেল।
ইশানের হাতে থাকা টেডি বিয়ার দেখে মুহিত কিছুটা বুঝতে পেরেছে। কারণ এই টেডি নিয়ে ওর সামনে অনেক কাহিনী হয়েছে। তাই চিনতে ভুল করেনি মুহিত। তবুও সন্দেহ ছিল ওর। আন্দাজে কথাগুলো বলেছিল আর তা সত্য হয়ে গেল।

ইফাজ সোফার উপর পড়ে থাকা বইটা তুলে হাতে নিলো। সে ভাবল পিহুর বই পড়ার অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে। বই পড়তে খুব ভালোবাসে পিহু। গল্প উপন্যাস সহ সব ধরনের বই পড়ে পিহু। ইফাজ অনেক বই কিনে দিয়েছিল পিহুকে। বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগল ইফাজ। মাঝেমধ্যে দরজার দিকে কয়েকবার তাকালো। ইশান সেই যে গেল আর আসার নাম নেই। মীরাকে কি খুঁজে পেয়েছে??যদি পেয়ে থাকে তো এতো দেরি করছে কেন?? পরক্ষণেই মনে পড়লো মীরা হয়তো আবার ইশানের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। ইফাজের ভাবনার মধ্যেই মীরার বাড়িতে এসে ঢুকলো। সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে ইফাজকে বসে থাকতে দেখে চমকালো। আশেপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো পিহু আছে কি না??নাহ নেই তাহলে ইফাজের সাথে এখনও কথা হয়নি পিহুর। মীরাকে দেখামাত্র ইফাজ উঠে দাঁড়ালো। মীরা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দৌড়ে আসার কারণে হাপাচ্ছে।
ইফাজ মীরার দিকে এগিয়ে আসতেই মীরা বলল,’কেন এসেছেন আপনারা?? এবার এই মানুষটাকে কি মেরে ফেলতে চান??’

ইফাজ খানিকটা হেসে বলল,’আমরা এখানে কেন এসেছি সেটা তোমার থেকে কেউ ভালো জানে না মীরা। তবে তোমার মনি’মাকে আমি তোমার থেকে কেড়ে নিতে আসিনি। শুধু কিছু কথা বলব যা পিহুর অজানা। আর আমি ইশানকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। দোষ আমার থাকা সত্ত্বেও ইশান শাস্তি পেয়েছে। তাই আমি চাই না ইশান আর তার মায়ের থেকে দূরে থাক।’

ইফাজের কথা শেষ হতে হতেই ইশান এসে পড়ে। মীরা এতো দ্রুত এসেছে যে সে মীরার সাথে পাল্লা দিয়ে হেঁটে পারলো না। এমনিতেই অনেক হেঁটেছে সে। মীরা এক পলক ইশানের দিকে তাকালো। ইশানের মুখে আগের সেই হাসি নেই। চোখে মুখে একরাশ চিন্তা তার মা’কে নিয়ে। এরপর কি হতে চলেছে সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। যদি পিহু ইশানকেও ফিরিয়ে দেয়??ইশান নিজের ব্যাগটা ধরে টানাটানি করতেছে। মীরা কি করবে বুঝতে পারছে না। পিহুকে ডাকার সাহস হচ্ছে না মীরার। কারণ মীরা খুব ভালো করে জানে পিহু এখন কাঁদছে। পিহুর কান্নামাখা মুখ দেখে মীরা নিজেকে সামলাতে পারবে তো??তাই মীরা চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। ইফাজ মীরার উওর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু মীরা চুপ করে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে।

ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে নিশ্চয়ই কিছু একটা গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছে। মীরাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই ইশানের কখন যে কি করে বসে তা বোঝা মুশকিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মীরা আস্তে করে বলল,’মনি’মা বের হোক তারপর না হয় কথা বলবেন। আপাতত মনি’মাকে একটু সময় দিন।’
মীরার কথা শুনে ইশান তো অবাক। এতোটা শান্ত কেন মীরা??
ইফাজ কোন কথা বলল না। তখনই মুহিত এসে ঢুকলো সাথে ওর বাবা মা ও।মুহিত আঁচ করেছিলো যে কিছু একটা হতে চলেছে তাই সে সামির আর মুক্তাকে নিয়ে এসেছে। সামির ইফাজকে দেখে অবাক হলো। আজ এতদিন পর ইফাজ এসেছে সে ভাবতে পারছে না। ইফাজের দিকে এগিয়ে এসে বলল,’ইফাজ ভাইয়া আপনি??এতো দিন পরে??’

ইফাজ কোন উত্তর দিল না দেখে মুক্তা বলে উঠলো,’এতদিন পর আপনার আসার সময় হলো??অবাক হচ্ছি আপনাকে দেখে। তবে যদি মীরা আপনাকে সত্যিটা না জানাতো তাহলে হয়তো কোনদিন ও আসতেন না। এতোটা অবিশ্বাস কিভাবে করলেন পিহুকে?? তাহলে কি আমি ভেবে নেব যে আপনি পিহুকে কোনদিন আপন ভাবেনি?? ভালোবাসেননি কখনো?? তাহলে আজকে কেন এসেছেন??’

ইফাজ বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো বলল, ‘আজকে আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। তবে পিহুর মুখোমুখি হয়ে সব বলব। পিহুকে আসতে দাও।’

মুক্তা ঘুরে তাকালো মীরার দিকে। মীরা এখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। হ্যা না কিছুই বলছে না। মুক্তা বুঝে গেল যে মীরাও চায় পিহু যাতে ইফাজের মুখোমুখি হয়। মুক্তা দরজা ধাক্কা দিয়ে পিহুকে ডাকলো। কিন্তু পিহু কোন সাড়া দিলো না। মুক্তা জোরে বলল,’তোর সাথে ইফাজ ভাইয়া কথা বলতে চায়। আর তোর ছেলেও এসেছে। তুই কি তোর ছেলের সাথেও দেখা করবি না?? ওদের কি চলে যেতে বলব??’
এবার ও পিহুর সাড়া নেই। মুক্তা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বের হলো পিহু। পিহুকে দেখেই নড়েচড়ে দাঁড়ায় ইফাজ। কতদিন পর আবার সেই চেনা মানুষের মুখটা দেখছে সে। একদিন এই মুখটা দেখার জন্য কত না ছটফট করতো ইফাজ। কতদিন নির্ঘুম কাটিয়েছে এই মুখটার কথা ভাবতে ভাবতে। আজ সেই মুখটা আবার দেখল। পিহু বের হওয়া সাথে সাথেই মীরা এগিয়ে গেল পিহুর দিকে। পিহুর দুহাত ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বলল,’আজকে তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিবে। তাই সবকিছু ভেবে চিন্তে নেবে।’

পিহু চোখ তুলে মীরার দিকে তাকালো। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। পিহুর এই অবস্থা দেখে মীরার চোখ থেকেও পানি পড়তেছে। পিহু মীরার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। ওর শরীর এখনও কাঁপছে। হেঁচকি উঠে গেছে পিহুর। মীরা পিহুকে নিয়ে ইফাজের মুখোমুখি দাঁড় করালো। এতে যেন পিহুর শরীরের কম্পন বেড়ে গেল। ইফাজ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’তোমার শরীর খারাপ পিহু সোফায় বসো।’
ইফাজের কথায় পিহু কে নিয়ে সোফায় বসালো মীরা। তারপর সামিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইফাজ পিহুর সামনাসামনি সিঙ্গেল সোফাটায় বসলো। একটু চুপ থাকার পর ইফাজ বলল,’আমি তোমাকে আজ অনেক কিছুই বলতে চাই পিহু। জানি না তোমার বিশ্বাস হবে কি না??’

পিহু এবার চোখ তুলে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমার অল্প কথা সেদিন বিশ্বাস না করে চলে গিয়েছিলে। আর আজকে তোমার এতো কথা শুনি কি করে??আর রইলো বিশ্বাসের কথা।’
কথা বলতে বলতে পিহুর গলা কাঁপছে। পিহুর কথায় ইফাজের মন খারাপ হলো না। ও জানতো যে এমন কিছুই হবে। ইফাজ বলল, ‘আমি সেদিনের কথাতেই যাবো। কারণ আমাদের দুজনের ভুল বোঝাবুঝির কারণই তো সেই দিন। তবে তার আগে আরেকটা কথা বলতে চাই। আমার সেদিন দোষ ছিল এটা আমি মানছি। কিন্তু তোমার ছেলে ইশানের তো কোন দোষ ছিল না। ও তো ছোট ছিল। যেখানে আমি ঠিক ভুল বিচার করতে পারিনি সেখানে ইশান কিভাবে পারবে??’

ইফাজের কথা শেষ হতেই পিহু ইশানের দিকে তাকালো। ইশান অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে অনুতপ্ত। এতক্ষণ পর পিহু ইশানকে ভালো করে দেখলো। সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছে ইশান। দেখতেও বাবার মতোই হয়েছে। পিহু চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে ইশানের দিকে তাকিয়ে। ইশান আস্তে করে কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখল। পিহুর সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পিহুর হাতজোড়া নিজের মুঠিবদ্ধ করে বলল,’আমি জানি আমার ভুলের কোন ক্ষমা হয়না আম্মু। কিন্তু তুমি তো মা, আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না তুমি?? তুমি যেমন এত বছর ধরে তোমার ছেলেকে পাওনি তেমনি আমি ও আমার আম্মুকে পাইনি। সন্তান ভুল করলে তো বাবা মা তাকে ক্ষমা করে। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবেনা??’

কথা বলতে বলতে ইশানের চোখে পানি চলে এসেছে। ইশানকে এভাবে কাঁদতে দেখে পিহু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। ইশানের গালে হাত রেখেই বলল,’কে বলেছে আমি তোর উপর রাগ করে আছি?? আমি রেগে নেই ইশান। আমি তো আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। এরজন্য যদি আমাকে আরো সতের বছর অপেক্ষা করতে হয় তাহলে আমি করবো।’

ইশান পিহুর কোলে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে। পিহু ইশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রাণটা আজ জুড়িয়ে গেল পিহুর। এতবছর পর নিজের ছেলেকে পেয়ে। গভীর চুম্বন করলো ইশানের মাথায়। ইশান এখনও তার মায়ের কোলে মাথা রেখে আছে। ইফাজ গলা ঝেড়ে বলে,’ইশান আমাকে এবার তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে দাও।’

ইশান উঠে চোখ মুছে মায়ের পাশে বসে পড়লো। পিহু চোখ মুছে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার মতো আমি নই যে সহজেই রাগ বা জেদ করে চলে যাব!!আমি মানবতাহীন নই। সেদিন তোমার সময় ছিল কিন্তু ইচ্ছা ছিল না আমার কথা শোনার। কিন্তু আজ আমার কাছে থেকে সময় হারিয়ে গেলেও আমি তোমাকে সময় দিতে প্রস্তুত।বলো কি বলতে চাও??’
ইফাজের দৃষ্টি নত হয়ে গেলো। পিহু যে তাকে অপমান করে কথাগুলো বলেছে তা ইফাজ বেশ বুঝতে পেরেছে। ইফাজ মলিন হেসে পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’সবার আগে আমি সতের বছর আগে ফিরতে চাই যেখান থেকে আমাদের সম্পর্কের ভাঙন হয়েছিল। আমি জানি না আমি সেদিন কেন নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আজও সেই জেদের বশে করা কাজের প্রতি আমার আফসোস হয়। তোমার সাথে আমার সংসার সম্পর্ক সবকিছু সাধারন ভাবেই চলছিল। যেমনটা আর পাঁচজন দম্পতি একসাথে কাটায়। আমাকে কাজের জন্য ঢাকার বাইরে থাকতে হতো। আমি পারতাম না নিজের স্ত্রী সন্তানকে ভালো করে সময় দিতে। পারতাম না তোমাদের সাথে মন খুলে কথা বলতে। কারণ আমার তো কাজের চাপ বেশী ছিল। আমি চাইতাম যে আমার শত কষ্ট হলেও তুমি আর ইশান যেন ভালো থাকো। সেজন্য আমি নিজের পরিশ্রমকে তুচ্ছ মনে করতাম। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে হঠাৎ করেই নেহাল চলে আসলো।

এতে আমি কিছু মনে করিনি। তুমি আমাকে নেহালের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে। এতেও আমি স্বাভাবিক ছিলাম। স্বাভাবিক থাকারই কথা। কারণ নেহালকে নিয়ে আমার কোন প্রকার মাথাব্যথা ছিল না পিহু। কিন্তু আমার অবর্তমানে নেহাল যখন বাড়িতে আসা যাওয়া করতো ব্যাপারটা তখনই দৃষ্টি কটু দেখায়। সেটা আমার কাছে না আশেপাশের লোকজনের কাছে। পাশের বাসার কয়েকজন মহিলা ছিল যারা আমাকে প্রতিনিয়ত নেহালের সম্পর্কে বলতো।নেহাল নাকি প্রায়ই এখানে আসে অনেক রাত করে বাড়িতে ফেরে আরো অনেক গল্প। আমি নেহাল সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। আমি তোমার সম্পর্কে অবগত ছিলাম। আমি ভাবতাম যে পিহু কোনদিন এমনটা করবে না। পিহু তো আমাকেই ভালোবাসে। শত কথা শুনেও আমি এই বিষয়ে তোমাকে একটা প্রশ্নও করিনি। সবকিছু মেনে নিয়েছি। মাঝেমধ্যে মনে হতো যে আমি তোমাকে সময় দিতে পারি না ঠিকমতো কথা বলতে পারি না এইজন্য কি আমার থেকে তোমার মন উঠে গেছে??পরক্ষণে মনকে শান্তনা দিতাম যে এমন কিছুই হবে না। আমার পিহু আমারই থাকবে। কিন্তু ওই মানুষগুলো যেন আমার পিছু ছাড়ছে না সবসময় একটা না একটা কিছু বলবেই তোমাকে নিয়ে। এটা বোধহয় তাদের জন্মগত স্বভাব ছিল। তবুও আমি তাদের কথায় পাত্তা দিতাম না। কিন্তু মনের ভেতর একটা অস্বস্তি থেকেই যেতো আমার।কি করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও অস্বস্তি হতো। এভাবে কিছু না জেনে কাউকে সন্দেহ করা ঠিক ও না। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি তেমন কিছু তোমার আর নেহালের মধ্যে দেখিনি। নেহালের সাথে তোমার স্বাভাবিক আচরণ আমার মন থেকে সন্দেহ দূর করে দিয়েছিল তাই আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি তোমায়।

কিন্তু এর পর এলো সেই দিন। তোমাকে ওভাবে দেখে আমার মাথা কাজ করছিল না। মনের ভেতরে চাপা সন্দেহগুলো আবার নাড়া দিয়ে ওঠে। বারবার একটা কথা মনে হচ্ছিল যে তুমি সত্যি নেহালের কাছে থাকতে চাও আমার কাছে না। এটা ভেবে সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কি করছিলাম তার কোন খেয়াল ছিল না আমার। তবে ইশানকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর আমি সারারাত ঠান্ডা মাথায় ভেবেছি। হয়তো আমার কোথাও ভুল হয়েছে এই কথা ভেবে। আমি ভেবেছিলাম যদি আমার কোথাও বুঝতে ভুল হয় তবে আমার সেই ভুল ধরিয়ে দিতে তুমি আসবে। কিন্তু তুমি এলে না। কারণ তোমাকে তো আসতে দেওয়া হয়নি। মিথ্যা বলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি সেদিন লন্ডন যাইনি পিহু।’

এটুকু বলে ইফাজ থামলো। লম্বা কয়েটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,’আমি থমকে গিয়েছিলাম তোমার পাঠানো ডিভোর্স পেপার দেখে। যদি আমার বুঝতে কোন ভুল হতো তাহলে তুমি ডিভোর্স পেপার পাঠাতে না।উল্টে আমার ভুল ধরিয়ে দিতে। আমি সেদিন ভেবে নিয়েছি যে তুমি সত্যি নেহালের সাথে থাকতে চাও। তাই আমি বিনা বাক্যে সাইন করে দেই। কিন্তু এরমধ্যে যে অনেক বড় ষড়যন্ত্র ছিল তা আমি টের পাইনি। তখন আমার এতোসব বোঝার মতো হুঁশ ছিল না। আর তার পর ইশানকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমাই।

এখন তোমার প্রশ্ন যে আমি এতদিনে একবার ও তোমার খোঁজ কেন নেইনি??তার উওর ও আমার কাছে আছে। পিহু আমি আগেই বলেছি যে আমার ধারণা ছিল তুমি নেহালের সাথে নতুন করে সংসার করবে বলে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। তাই আমার একটাই ভাবনা ছিল যে,যদি আমি বাংলাদেশে এসে দেখি তুমি নেহালের সাথে সুখে সংসার করছো তাহলে আমি সেটা সহ্য করবো কিভাবে?? কিভাবে নিজের প্রিয় মানুষটিকে অন্যের সাথে থাকতে দেখবো?? নিজেকে তখন তো শেষ করে দিতে ইচ্ছে করবে। আর আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ইশান থাকবে কীভাবে??ও তো মা ছাড়া থাকে আর যদি আমিও হারিয়ে যাই তাহলে ইশানের কি হবে??বিশ্বাস করো পিহু এই একটা চিন্তাই আমাকে এতবছর কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। আমি তোমাকে আর নেহালকে একসাথে দেখতে পারব না। আমার এই চিন্তা ধারাই এতগুলো বছর পার করার মূল। বাংলাদেশে আসার জন্য অনেকবার টিকেট বুক করলেও তা বারবার ক্যান্সেল করে দিয়েছি। সবসময় এই একটা কথাই মনে পরতো যে তুমি অন্য কারো সাথে সংসার করছো। আমার তখন নিজেকে সামলাতে কষ্ট হতো। কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতাম তবুও ব্যর্থ হতাম। নিজের মনকে বারবার কুরবান করার চেষ্টা করতাম। আর এভাবেই যে আমার জীবন থেকে এতগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারিনি। হয়তো তুমি এসব বিশ্বাস করবে না। তবে ইশান খুব ভালো করেই জানে যে ওর বাবা কিভাবে এতদিন কাটিয়েছে।
আর তোমার শেষ প্রশ্ন হলো তোমাকে কেন সন্দেহ করলাম?? মানুষের মনে সন্দেহ বলে কয়ে আসে না হঠাৎ করেই চলে আসে। এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই সন্দেহের দাস। তাদের মনে সন্দেহ হবেই। সেখানে আমার সন্দেহ করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু ছিল??’

ইফাজ আবার থামলো। অনেক কথাই বলে ফেলেছে সে। পিহু নির্বাক হয়ে গেছে। ইফাজের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই তার। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছে সে। ইফাজ নিজের কথা শেষ করে মীরার দিকে তাকালো বলল,’মীরার একটা প্রশ্ন ছিল যে আমি কেন চিঠির লেখাগুলো বিশ্বাস করলাম?? আমি যখন নেহালের চিঠিটা পড়লাম তখন আমার মনে হচ্ছিল যে এটা কি আদৌ নেহাল পাঠিয়েছে??এতগুলো বছর পর এসব বলার মানে কি?? নেহাল নিজের সব দোষগুলো চিঠিতে তুলে ধরেছে। নেহাল তো আগেও পাঠাতে পারতো তাহলে এতদিন পর পাঠালো কেন?? কিন্তু যখন আমি পিহুর দেওয়া চিঠিটা পড়লাম তখন আমার কাছে সবটা ধোঁয়াশা লাগছিল। আমি ভাবছিলাম এ কোন বেড়াজালে আমি পড়লাম। যদি পিহু আর নেহাল একসাথে থাকে তাহলে তারা আমাকে কেন চিঠি পাঠাবে। একবার পড়ে আমি বুঝেছিলাম না তাই বারবার চিঠিদুটো পড়ছিলাম। তখন আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি যে এই লেখাগুলোতে কোন ভুল ছিল!!!!আমি কিভাবে পিহুকে এতটা অবিশ্বাস করলাম পিহুকে।

এই দুটো কথা আমি বারবার ভেবেছি। তবুও কেন যেন সবটা অন্যরকম লাগছিলো আমার কাছে। আমি তখন ছুটে যাই মীরার কাছে। হয়তো মীরার থেকে আরো কিছু জানতে পারবো??সেটাই হলো মীরার থেকে বাকি সবটা জানতে পারলাম।’

ইফাজ চুপ করে গেল। এখনও তার আরো কিছু বলার বাকি আছে। বড়বড় শ্বাস ফেলছে সে। মীরাকে সামির ধরে রেখেছে। সেও কাঁদছে পিহুর মতোই। এতোসব সত্য কেন আরো আগে সামনে আসলো না?? তাহলে কাউকেই এতটা কষ্ট পোহাতে হতো না??
মুক্তা বলে উঠলো,’মানলাম আপনি এবং পিহু পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। কিন্তু আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। ডিভোর্সটা তো হয়ে গেছে। আর এখন এসব বলে কোন লাভ নেই। আপনার আর পিহুর জীবন আর কোনদিন ও স্বাভাবিক হবে না।’

মুক্তার কথায় ইফাজ চোখ তুলে তাকালো। পিহু তাকালো না। তার দৃষ্টি এখনও মেঝের দিকে। সবাই ইফাজ এর দিকে তাকিয়ে আছে ওর প্রশ্নের জবাব শোনার জন্য। ইফাজ আরো কি বলতে চায়??

#চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here