অবুঝ বেলার তুমি পর্ব ৩

#অবুঝ বেলার তুমি
নিলান্তিকা ইসলাম
পর্ব ৩

কলেজ থেকে ফিরেই গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো গুঞ্জন।বারবার চোখের সামনে অঙ্কুর স্যারের চেহারা টা ভেসে আসছে।সেই কাটা দাগ সেই শরীর আর সেই লাল রঙা চুলগুলো।গুঞ্জন একদিন জিজ্ঞেস করলো,
____তোমার কপালের ওই কাটা দাগ টা কিসের বাবুন দা?ইশ!কত্তখানি কেটে গেলো।
____বাবুন দা বললো এটা যে কিছুই না।শুধু একটা স্মৃতি যেটা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেবে তোর কথা।

জানিস তুলতুল আমি সেদিন আমার কপাল টা কেটে যাওয়ার জন্য যতটুকু না ব্যাথা পেয়েছি তার থেকে বেশি ব্যাথা পেয়েছি তোর থুতনি আর ঠোঁট কেটে গিয়েছিলো বলে।

বাবুন দা সেদিন গুঞ্জন কে সব টা বলেছিলো গুঞ্জন কে সামলাতে পারবে না ভেবে আর গুঞ্জন কে কষ্ট দেয়ার অপরাধ বোধে কিভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো।এরপর থেকে বাবুন দা কখনোই তুলতুলকে এতোটুকু ব্যাথা অবদি পেতে দেয় নি।সব সময় আগলে রেখেছে।
মাঝে মধ্যে বাবুন দা গুঞ্জনের দুষ্টোমিতে রাগ করলে গুঞ্জন বাবুন দাকে মানানোর জন্য “আহ ” করে একটা শব্দ করলেই হতো।অমনি বাবুন দার চোখে যে ভয় টা গুঞ্জন দেখতো হেসে কুটোকুটো হতো।আর বাবুন দা গুঞ্জনের মজা করা বুঝতে পেরে দশবার কান ধরে উঠবস করাতো।

আজ তোমার তুলতুল আবার পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে বাবুন দা।শুধু আজ নয় আরো কতবার যে পড়েছে হিসেব নেই।এই যে দেখো হাটুতে অনেক টা ছিলে গেছে। কোথায় তুমি বাবুন দা।একবার তোমার ওই দুচোখে আবার ভয় টা দেখতে ইচ্ছে করছে।বাবুন দার চোখ দুটো ছিলো অন্যরকম।কেমন ঘোলাটে দেখতে বিদেশীদের মতো।ওই দু চোখে যখন রাগ জমতো ভীষন ভয়ংকর দেখাতো।শেষবার গুঞ্জনরা চলে আসার সময় যখন বাবুন দাকে একবার দেখতে ছাদে এসেছিলো সেদিন ই গুঞ্জন ওই ভয়ংকর চোখের তাকানো টা দেখেছে।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।গুঞ্জনের মনে পড়লো।ছাদে নতুন ছোট কয়েকটা গোলাপের চারা আছে।যেগুলো ঝড়ের কবলে পড়ে ধুমড়ে মুচড়ে যেতে পারে।গুঞ্জন এক দৌড়ে গিয়ে ছাদ থেকে চারা গাছ গুলো এনে সিড়ি ঘরে রাখলো।একেক টা গাছ কত যত্ন করে লাগানো।গুঞ্জনদের পুরো ছাদ আর বারান্দা নানান রঙের ফুল গাছে ভর্তি।

আজ সকালে ও কত শত ফুল ফুটলো। সব গুলো ফুল আর গাছ বাবুন দার নামেই। বাসা চেঞ্জ করার সময় মা তো পুরো বারণ করে দিলো যেনো ওগুলো না নিয়ে আসি। কিন্তু গুঞ্জন সব গুলো গাছ যত্ন করে এনে সাজিয়েছে আবার।
সে তো বাবুন দার কত্ত ফুল রাগের বসে ছিড়ে ফেলেছে।তাই তো বাবুন দা এলেই গুঞ্জন সব ফুল একত্রে বাবুন দা কে দিয়ে দিবে।এই সব ফুল সব গাছ তোমার বাবুন দা। তোমার গাছের একটি ফুল ও আমি আর ছিড়বোনা প্রয়োজনে আমার সব গাছ আর সব গুলো ফুল তোমার নামে করে দেবো।তবুও তুমি এসো প্লিজ!

ওদিকে অঙ্কুর এর চোখেও বারবার গুঞ্জনের চেহারাটা ভেসে আসছিলো।সেই তুলতুলে ফুলোফুলো দুটো গাল।শুভ্র আকাশের মতোই ধবধবে সাদা গায়ের রঙ টোকা দিলেই যেনো রক্ত বেরোবে।অঙ্কুর যখন গাল দুটোকে ধরে টেনে টেনে গুলু মুলু করে দিতো।কেমন যেনো রক্ত এসে জমাট বেধে যেতো।হাসার সময় গালে টোল পড়া টা। কি করে এতো টা মিলে যেতে পারে! কি করে?

অঙ্কুর মোবাইল টা হাতে নিতেই ভাবলো একবার গুঞ্জনের নাম টা সার্চ দিয়ে দেখবে।সার্চ দিতেই গুঞ্জনের প্রোফাইলে মধ্য বয়স্ক একটা লোকের পাশে বসা পিক দেখতে পেলো।গুঞ্জনের চেহেরার সাথে মিলে যায় কিছুটা।ইশ!কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি।তুলতুলের বাবাকে কখনো দেখাই হয় নি।লোক টা রাতে এসে খুব সকালে বেরিয়ে যেতো।

সবসময় বাসায় আন্টিকেই দেখতে পেতো।আঙ্কেলের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো ভোরেই বেরিয়ে গেছে।একেবারে রাতে ফিরবে।ঘুরে ঘুরে আরো কয়েকটা ছবি দেখতে পেলো।একটা ছবিতে এক গুচ্ছ গোলাপ হাতে দাড়িয়ে ছিলো তুলতুল।আর ক্যাপশানে লিখাছিলো,
“তোমার অনেকফুল ছিড়ে তোমার নিকট দায়বদ্ধ আছি, এখন আমার বাগান ভর্তি সব ফুল তোমার নামে করে দিলাম।আমার অবুঝ বেলার সেই তুমিটা ফিরে এসো প্লিজ।”কিন্তু নিচে একটি অক্ষর ও দেয়া ছিলো “T”

মুহুর্তেই অঙ্কুরের বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা টা নড়ে চড়ে উঠলো আবার।গুঞ্জন তো “G”দিয়ে হবে তাহলে “T” দিলো কেনো?নাহ খোঁজ লাগাতে হবে।

পরদিন কলেজ যেতেই অনেক ছেলে মেয়ে গতকাল অঙ্কুর স্যারের কথায় মোহিত হয়েছিলো বলে ফুলের তোড়া দিতে লাগলো।স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ভালোবাসার মানুষ কিংবা ভালোবাসার ব্যক্তিকে ফুল দিয়েই তো বরণ করা হয়।অনেকেই আবার ক্রাশ অবদি নাকি খেয়ে ফেলেছে।মেয়ে গুলো না পারে ও বটে।গুঞ্জন ও তো কত ছেলেকে দেখেছে।দেখতে শুনতে ভালো এমন অনেক ছেলেই প্রপোজ করেছে।গুঞ্জন তো কারোর উপর ক্রাশ খেয়েছে বলে মনে হয় না।

হ্যাঁ , সে মানছে, অঙ্কুর স্যারের প্রতি তার ও একটা দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সেটার ভিন্ন একটা কারণ আছে বলে।গুঞ্জন খেয়াল করলো অঙ্কুর স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলো,
আর মুহুর্তেই তার হাসি খুশি মুখটা কেমন কালো মেঘে ঢেকে গেলো।
পরক্ষনেই ব্যাপার টা বুঝতে পারলো গুঞ্জন।অঙ্কুর স্যার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
____আমি জেনে খুশি হয়েছি যে তোমরা আমাকে এতোটা পছন্দ করো।কিন্তু আমার ফুল জিনিস টা মোটেই পছন্দ নয়।তার চেয়ে বরং কয়েকটা বই দিতে তা ও ভালো ছিলো।বই তো যত্ন করে আগলে রাখা যায় নিজের কাছে।কিন্তু ফুল দুদিন পরেই ঝরে যাবে।

মুহুর্তেই গুঞ্জনের মুখটা এতখানি হয়ে গেলো।কি ভাবতে বসেছিলো সে।অথচ এ তার বাবুন দা হতেই পারে না।তার বাবুন দার তো ফুল অনেক পছন্দের। কত যত্ন করে আগলে রেখেছিলো।এ শুধু দেখতেই বাবুন দার মতো কিন্তু মোটে ও তার বাবুন দা না।ঝুম নিজের মত করে পড়া বুঝে নিতে লাগলো।

ক্লাস শেষ হতেই অঙ্কুর গুঞ্জন কে তার অফিস রুমে যেতে বল লো।কিন্তু অঙ্কুর স্যার কে নিয়ে গুঞ্জনের মনে যে অনুভূতি টা এসেছিলো সেটাকে মুহুর্তেই দূরে সরাতে হবে।এতোটা বছর গুঞ্জন তার মনের দরজায় খিল দিয়ে এসেছে।অনেকেই এসে কড়া নেড়ে গেছে।কিন্তু গুঞ্জন কখনো খুলেও দেখেনি।আর আজ কি করে সে এতো বড় একটা ভুল করতে বসেছিলো।এবার শুধু খিল নয় বড় একটা তালাও ঝুলিয়ে দেবে গুঞ্জন।যতক্ষন না বাবুন দা এসে কড়া নাড়বে ততক্ষন সে খুলবে না।

অফিস রুমে যেতেই গুঞ্জন দরজায় দাড়িয়ে অনুমতি নিলো,
____আমি কি আসতে পারি স্যার?
____অঙ্কুর মুখে হাসি টা ধরে রেখে বললো হ্যা এসো।
____অঙ্কুর তাকে একটা ফরম পূরন করতে দিলো।
____গুঞ্জন জিজ্ঞেস করলো এটা কিসের ফরম?
_____অঙ্কুর বললো, যেকোন সমস্যায় ছাত্র ছাত্রীর ব্যাপারে অভিভাবকদের সাথে যাতে যোগাযোগ করা যায় এটা তারই ফরম।
____অঙ্কুর আগে থেকেই ধারণা করে নিয়েছিলো গুঞ্জন এটা নিয়ে প্রশ্ন করবে।তাই বললো সবার ফরম ওরা আগেই পূরন করে নিয়েছে।কাল তুমি লেইটে এসেছো বলে ওটা পূরন করা হয়নি।

গুঞ্জন কিছুটা আস্বস্ত হলো এবার।ফরম টা হাতে নিয়ে পূরন করে দিলো।সেই মুহুর্তেই পিওন কে বলে অঙ্কুর কফি অর্ডার করে ছিলো।সব কফি গিয়ে ফরম টা পড়ল।অঙ্কুর এবার ভীষন রেগে গেলো।পিওনের উপর চেচাতেই,,
গুঞ্জন খেয়াল করলো সেই দু টো চোখ।অবিকল একই রকম দেখতে যেদিন সে চলে আসার সময় বাবুন দার চোখ দুটো দেখেছিলো।

গুঞ্জন কেমন অস্থির হতে লাগলো।এ কিভাবে হতে পারে।সেই চোখ সেই চুল সেই মুখ সব হুবাহুব মিলে যাচ্ছে।কিন্তু অঙ্কুর স্যার তো সেটাই পছন্দ করেন না যেটা তার বাবুন দার সব চাইতে পছন্দের।

গুঞ্জন কাপাকাপা গলায় বললো আপনি আমাকে আরেকটা ফরম দিন স্যার আমি পূরন করে দিচ্ছি।
অঙ্কুরের মন থেকে ভয় টা কাটলো।এই তো সে এক পা এগোচ্ছিলো তার তুলতুলের সন্ধানে আর সেটাতেই কফি ঢালতে হলো।
যাক গুঞ্জন যে আবার ফরম টা পূরন করতে চেয়েছে সেটাই অনেক।

গুঞ্জন ফরম পূরন করে আর এক মুহুর্ত ও দাড়ালো না।ভীষন অস্থির লাগা শুরু হলো তার।
এদিকে রাস্তায় হাটতে হাটতে একটা ছেলে ওকে ফলো করা শুরু করলো।গুঞ্জন এবার ভেজায় রেগে গেলো একেতো অঙ্কুর স্যার বাবুন দা কে নিয়ে দ্বিধায় আছে সে।আর অন্যদিকে এসব ছেলেপুলের দল।বেশ কিছুদুর গিয়েও দেখলো ছেলেটা এখনো তাকে ফলো করে যাচ্ছে।গুঞ্জন এবার থেমে দাড়ানোর সাথে সাতে ছেলে টা ও থেমে গেলো।
গুঞ্জন এবার ছেলেটার দিকে এগিয়েন এলো।
____এভাবে রাস্তা ঘাটে কাউকে ফলো করার মানে কি?কি ভেবেছো! রাস্তা ঘাটে মা বোন নেই দু একটা কথা শুনিয়ে ছেড়ে দেবো।এই ব্যাগ টা দেখেছ? এখানে শুধু বই থাকেনা তোমাদের মত ছেলেদের শায়েস্তা করার জন্য অনেক কিছুই থাকে।এক্ষুনি ফলো করা বন্ধ করো নইলে?

ছেলেটা কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু গুঞ্জন না শুনে আবার হাটা ধরলো।
ছেলেটা আবার ডাকতে লাগলো,। ____একটু শুনুন না আপু জাস্ট একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।
____গুঞ্জন এবার ব্যাগ থেকে ছোট একটা ছুরি বের করলো আর এটা দেখিয়ে বললো আর এক পা এগোলে না রগ কেটে ছাড়বো।
____ছেলেটা কাগজে কিছু একটা লিখে একটা ইট ভরে দিয়ে গুঞ্জনের দিকে ছুড়ে দিলো।

তারপর জোরে চেচিয়ে বললো আমি আপনাকে যার মতো ভেবেছিলাম আপনি একদমি তার মত নন।আমার তুলতুল দি অনেক ভালো।

শেষের কথাটা গুঞ্জনের কানে হালকা ভাবে শোনা গেলো।কারণ দৌড়াতে দৌড়াতে বলছিলো ছেলেটা।পেছন ফিরেই দেখলো একটা অটোতে উঠে চলে যাচ্ছে।
গুঞ্জনের মনে হলো ছেলেটা তুলতুল বলে কিছু একটা বলেছে।কাগজ টা কুড়িয়ে নিয়ে দেখলো
সেখানে লিখা,
_____ আপনাকে দেখতে একদম আমার তুলতুল দি র মতো।

গুঞ্জন ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো “বিহান” বলতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
কি করে সে এত বড় একটা ভুল করলো সে যে বিহান কেই চিনতে পারলো না।অথচ ওই রস কষহীন অঙ্কুর স্যার কে তার বাবুন দা বলে ভেবে নিলো।
কি করে খুজে পাবে সে এখন বিহান কে বাবুন দা কে।চারপাশে লোকেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে গুঞ্জন দ্রুত উঠে হাটা ধরলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here