অরুণিকা পর্ব – ২৬+২৭+২৮

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||

৪৩.
নতুন বাসায় আসার পর থেকেই সবারই ভালো সময় যাচ্ছে। তাহমিদের বেতন বেড়েছে। তূর্যের শেষ গানটি ভাইরাল হয়ে গেছে। এখন ইউটিউবে তার গানগুলোতে ভালোই ভিউ হচ্ছে। সে এবার নিজের লেখা গানেও সুর দিতে যাচ্ছে। নতুন গানটি নিয়ে কাজ করা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হলে সে একটা ছুটি নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এদিকে আরাফ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। পাশাপাশি অনেকগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে সে একসাথে পড়াচ্ছে। ইভান এবং আহনাফ দু’জনই পড়াশুনার পাশাপাশি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। আর ইমন বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলে মোটামুটি আয় করতে পারছে। অরুণিকাও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। তাদের ভালোই সময় কাটছে।
এদিকে তিন রুমের এই বাসায় পানির ট্যাংক থাকায় এখন আর তাদের পানি ধরার জন্যও ছুটোছুটি করতে হয় না। রান্নাঘরের পাশেই ড্রয়িংরুম। সেখানেই আরাফ আর ইভান মেঝেতে বিছানা করে থাকে। বাকি তিনরুমের একটি অরুণিকার। বাকি দুইটির একটিতে তূর্য আর ইমন, অন্যটিতে আহনাফ আর তাহমিদ থাকছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, যেই কয়েক বছর তারা কলকাতায় থাকবে, এই বাসাটি আর পরিবর্তন করবে না। তাই তারা ঘরের জন্য আসবাবপত্র কেনার চিন্তাভাবনাও করলো। এখন তাদের একটি বড় ডায়নিং টেবিল, আর সাতটা চেয়ার প্রয়োজন। সেখানেই তারা বসে পড়াশুনাও করবে আবার খাওয়া-দাওয়ার কাজও সারবে। রান্নাঘরের জিনিসপত্র আগের বাসা থেকেই নিয়ে এসেছে। তবে এখন দুইটা আলমারি, আরেকটা ফ্রিজ কেনা প্রয়োজন। এতোদিন আলমারির পরিবর্তে বড় বড় ড্রামেই তারা কাপড় রেখেছিল। যেখানে কাপড়ের ভাঁজ একদমই ঠিক থাকতো না। তাই আলমারি অবশ্যই কিনতে হবে। এরপর বই রাখার জন্য একটা বুকসেল্ফ, আর অরুণিকার জন্য ছোট একটা খাট কেনার তালিকা করলো। এগুলো একটি একটি করে তারা প্রতিমাসে কিনবে।
এসবের তালিকা তৈরি করে বাজারের তালিকা করতে বসলো তূর্য। তখনই বেল বেজে উঠলো। ইমন দরজা খুলতেই শতাব্দী আর মাওশিয়াতকে দেখে অবাক হলো। ইমন মাওশিয়াতকে বলল,
“তুমি এতো সকাল সকাল?”

মাওশিয়াত কোনো উত্তর দিলো না। তারা দু’জনই বাসায় ঢুকলো। মাওশিয়াত পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর শতাব্দী অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার ছোট সখীকে দেখতে এসেছি। কেমন আছো সখী?”

অরুণিকাও শতাব্দীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি ভালো আছি। আপু, জানো আমি তোমাকে অনেক মিস করি।”

“আমিও। জানিস তুই চলে আসার পর থেকে মহল্লায় ভূত নেমে এসেছে।”

“কি বলো? সত্যি?”

“হ্যাঁ। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সবাইকে কেমন স্বার্থপর মনে হয়। তাই এখানে এসেছি। এখানে তো আর ভালোবাসার অভাব নেই।”

তাহমিদ নাস্তা বানিয়ে মেঝেতে রাখলো। শতাব্দীকে দেখে সে চমকে উঠলো। শতাব্দী তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো।”

তাহমিদ মুচকি হাসলো। শতাব্দী এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মিস শতাব্দী আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি।”

তাহমিদ তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“বাণীতে তাহমিদ হোসেন।”

মাওশিয়াত বলল, “বাসাটা খুব সুন্দর।”

ইমন ততোক্ষণে নিজের ঘরে চলে গেছে। মাওশিয়াত এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমনকে খুঁজতে লাগলো। ইমনকে না দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ছাড়া কেউই মাওশিয়াতের সাথে এতোটা কথা বলে না। কারণ তার জন্য ইমন আর ইভানের মধ্যে এখনো সব কিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি। ইভান তার দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইমনই ভাইয়ের সাথে কথা বলতে আগ্রহ দেখায় না। তাই ইভান একপ্রকার মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। মাওশিয়াতকে দেখে সেও একপাশে সরে দাঁড়ালো।

সবাই শতাব্দীর সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। মাওশিয়াত একপাশে চুপচাপ বসে আছে। ইমনকে নাস্তা করার জন্য ডাকা হলো। সে তাহমিদের পাশে বসে গেলো। একবারো মাওশিয়াতের দিকে তাকালো না। মাওশিয়াতের খুবই খারাপ লাগলো। যাদের বাসায় এসেছে, তাদের কেউই তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়৷ শতাব্দী নিজের ঘরের মতোই সবাইকে খাবার প্লেটে তুলে দিতে লাগলো। মাওশিয়াতকে দিতে যাবে তখনই সে বলল,
“আমি খাবো না। আসলে বাবা আর মা বলেছিল একবার অরুণিকাকে দেখে আসতে। তাই এলাম। আমি চলে যাচ্ছি।”

কথাগুলো বলার সময় মাওশিয়াতের গলা কাঁপছিলো। ইমন তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মাওশিয়াত উঠতে যাবে, তখনই অরুণিকা তার হাত ধরে বলল,
“আপু, চলে যাচ্ছো কেন?”

মাওশিয়াত অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“পরে আবার আসবো।”

আরাফ মাওশিয়াতকে আটকাতে যাবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। আরাফ ইশারায় বলল তাকে আটকাতে। আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“ওকে দেখে ইভান আর ইমন অনেক অপ্রস্তুত হয়ে গেছে৷ এখন ওর জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে আর ঝামেলা না হলেই ভালো। ওকে যেতে দেওয়া উচিত। কমনসেন্স থাকলে আর আসবে না।”

আরাফ বলল,
“অরুকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওর বাবা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।”

“হ্যাঁ, জানি। তাই ওর বাবাকে আমরা সম্মান করবো। ওকে নয়।”

শতাব্দী খাওয়া-দাওয়ার পর তাহমিদকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘর ঘুছিয়ে দিতে গেলো। তাহমিদ বারবার শতাব্দীকে চলে যেতে বলছিল। কিন্তু শতাব্দী কোনো ভাবেই শুনছে না। দু’জনই একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো। শতাব্দীর মেজাজ খারাপ হতেই সে হাতে লেগে থাকা ফেনাগুলো তাহমিদের গালে লাগিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে বেরুনোর সময় ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। তাহমিদ সেখানে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। তাহমিদকে হাসতে দেখে শতাব্দী বলল,
“তোমার জন্য আমি নিচে পড়ে গেছি, আর তুমি হাসছ?”

তাহমিদের হাসি বন্ধই হচ্ছে না। শব্দ শুনে বাকিরাও রান্নাঘরে এলো। দেখলো শতাব্দী মেঝেতে বসে আছে। তূর্য ওকে টেনে তুললো। তাহমিদ এবার নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে আপন মনে এখনো সে হাসছে। শতাব্দী তাহমিদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ কি ভেবে বাঁকা হাসি দিলো। তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“গায়ক সাহেব, তোমাদের মিষ্টিমশাইয়ের বিছানাটা কোথায়?”

তাহমিদ কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। শতাব্দীর বাঁকা হাসি দেখে সে বুঝে ফেললো শতাব্দী কি করতে চাইছে। তাহমিদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না প্লিজ। এমন করো না। তূর্য, ওকে রুম দেখিয়ে দিস না।”

কিন্তু কে শুনে কার কথা। তূর্য শতাব্দীকে টেনে এনে বিছানাটা দেখিয়ে দিলো। তাহমিদ হাতে থাকা ফেনাগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করে রান্নাঘর থেকে বেরুনোর আগেই শতাব্দী ধপ করে তাহমিদের বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার পা দুটি উপরে উঠিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। তাহমিদ ঘরে এসে শতাব্দীর কান্ড দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। শতাব্দী বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নিচে নেমে পড়লো। তারপর তাহমিদের সামনে এসে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই তোমার বিছানাটা তো নোংরা হয়ে গেছে। আমার পায়ে কতো ময়লা ছিল, জানো। মহল্লায় খালি পায়ে হেঁটে পায়ে জুতো লাগিয়ে একেবারে এই বাসায় এসেছি।”

তাহমিদ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো। শতাব্দী তার হাত তাহমিদের মুখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“আচ্ছা, যাচ্ছি আমি। টা টা।”

তাহমিদ তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তূর্য দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে তাহমিদের সামনে থেকে চলে আসলো।

বিকেলে আহনাফ নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোন চালাচ্ছিল। বাসায় তখন অরুণিকা ছাড়া কেউই ছিল না। অরুণিকা টিভি বন্ধ করে এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো বাসায় কেউ আছে কি না। আহনাফ আর তাহমিদের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, আহনাফ বিছানায় শুয়ে আছে। সে আহনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা বলল,
“তুমি আমাকে গেইম খেলতে দেবে?”

আহনাফ আঁড়চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেবো না।”

অরুণিকা মলিন মুখে চলে যেতে নেবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো আর বলল,
“কি গেইম খেলবে?”

অরুণিকা খুশি হয়ে বললো,
“ওই যে ইমন খেলে, একটা ছেলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, ওইটা খেলবো।”

আহনাফ প্লে স্টোর থেকে গেইমটি নামিয়ে অরুণিকার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিল। অরুণিকাও মনোযোগ দিয়ে খেলতে লাগলো। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই অতীতের স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।

অরুণিকা যেদিন জন্মেছিল তখন তাকে দেখতে মায়ের হাত ধরে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। মেয়ে হয়েছে শুনে দাদা-দাদী অনেক খুশি হয়েছিল৷ কারণ তাদের কোনো মেয়ে ছিল না। আর তাদের প্রথম চার জনই নাতি ছিল। তাই অরুণিকার জন্ম পুরো পরিবারেই খুশির বন্যা বয়ে আনে। আরাফ তখন থেকেই বাচ্চাদের খুব পছন্দ করতো৷ অরুণিকাকে যখন প্রথম তার কোলে দেওয়া হয়েছিল, আরাফের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠেছিল। আরাফ আহনাফকে বলল,
“আহনাফ, দেখ। বাবুটা আমার কোলে এসে চুপ করে ঘুমিয়ে আছে।”

আহনাফ বলল,
“তুই খুব বোরিং মানুষ তাই ওর তোকে দেখেই ঘুম পেয়েছে।”

আরাফ আহনাফের কথা শুনে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর সে অরুণিকাকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে দিয়ে তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো। চাচী পেছন থেকে এসে আহনাফকে বলল,
“আহু, তুই নিবি না বাবুকে?”

আহনাফ দূরে সরে বলল,
“না না ও পিসু করে দিবে।”

আহনাফের কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। এসব মনে পড়তেই আহনাফ আনমনে হেসে উঠলো। আহনাফকে হাসতে দেখে অরুণিকা তার দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাতের আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“অনেক বড় হয়ে যাচ্ছো।”

অরুণিকা বলল,
“তুমি এই জন্য হাসছো, আমি বড় হয়ে যাচ্ছি তাই?”

আহনাফ মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
“পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই হাসি পেয়েছে।”

মুহূর্তেই আহনাফের বুকটা কাঁপতে লাগলো। সেই মুহূর্তের সবার হাসিমাখা মুখটা তার আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছবির এলবামটি বের করলো। এলবামের শুরুতেই একটা ছবি আছে। আহনাফের চৌদ্দতম জন্মদিনে সবাই একই ফ্রেমে দাঁড়িয়ে এ ছবি উঠিয়েছিল। এই ছবিটি তার ফোনে ছিল। সে ছবিটি ফোন থেকে বের করেছে। ছবি বাঁধানোর সময় পায় নি, তাই এখনো ছবিটি এলবামে রয়ে গেছে। অরুণিকা এলবাম বের করতে দেখে তার দিকে দৌঁড়ে এলো। বলল,
“দেখি দেখি, আমাকে দেখি। আমি কোথায়?”

আহনাফ চাচার কোলে অরুণিকাকে দেখিয়ে বলল,
“এই তো তুমি।”

অরুণিকাকে জুবাইয়ের চৌধুরীকে দেখিয়ে বলল,
“এটা আমার বাবা।”

আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠল। সে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না, অরু। তুমি আমার সাথে, মানে আমাদের সাথে, থাকবে তো সারাজীবন? আমাদের ফেলে চলে যাবে না তো!”

“আমি কেন চলে যাবো, বলো তো!”

আহনাফ বিড়বিড় করে বলল, “বিয়ে হলে!”

অরুণিকা আহনাফের কথা শুনতে পেলো না। সে বলল,
“আমি তোমাদের ফেলে যাবো না।”

আহনাফ মনে মনে বলল,
“এখন তো বলছো থাকবে, কিন্তু বড় হলে যদি তুমি থাকতে না চাও, অরু? এই মায়া তো একপাক্ষিক। তোমারও কি সেই মায়া থাকবে? তোমার কাউকে ভালো লাগতেই পারে। তখন? আগের কথা কি মনে রাখবে তুমি? যেই বাবাকে ছাড়া তুমি খাওয়া-দাওয়া করতে না, যেই মাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসতো না, তাদের তো ভুলিয়েই দিয়েছি আমরা। অন্য কেউ এসে তখন যদি আমাদেরই ভুলিয়ে দেয়?”

অরুণিকা এলবাম থেকে চোখ উঠিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন?”

আহনাফ শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিলো। অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ফোনাপুর জন্য? ও তো তোমাকে আর ফোন দেয় না।”

আহনাফের যতির কথা মনে পড়তেই রাগ উঠে গেল। সে ধমকের সুরে বলল,
“চুপ। যাও পড়তে বসো। সারাদিন টিভি, ফোন, নয়তো অন্য কিছু। যাও, পড়তে বসো।”

অরুণিকা এক ধমকে ভয় পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এখন তো পড়ার সময় না।”

আহনাফ আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল,
“তাও এখন পড়তে বসবে। যাও।”

অরুণিকা দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। হঠাৎ তার চুক্তিনামার কথা মনে পড়ে গেলো। চোখে ভেসে উঠলো, সেই কাগজটি যেটিতে তার স্বাক্ষরের পাশে অরুণিকার কাঁচা হাতের স্বাক্ষর আছে। সে বিছানায় মাথা ফেলে দিয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“অরু, আমার মনে অনেক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর তুমি বড় হলেই আমাকে দিতে পারবে। এই উত্তর যতোদিন আমার কাছে আসবে না, আমি ততদিন মানসিক শান্তি পাবো না। কিন্তু সময় যতো বাড়ছে আমি ততোই দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি চাই না আমার এই দুর্বলতা তোমার জীবনে কোনো বাঁধা ফেলুক। আমি চাই, আমাদের অরু সুখে থাকুক। অতীতের সেই ভয়ংকর রাতের কথা যাতে কখনোই অরুর মনে করতে না হয়।”

এদিকে আরাফ সায়ন্তনীর পাশে বসে রইলো। সায়ন্তনী বলল, “কি ভাবছো?”

আরাফ বলল,
“কই! কিছু তো ভাবছি না।”

“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”

“হুম করো।”

“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”

আরাফ প্রশ্নটি শুনে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। সায়ন্তনী বলল,
“আমার আসলে ইমনকে জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই। ও যদি কিছু মনে করে।”

আরাফ বলল,
“ইমনের ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো তো সে নিজেই বলতে পারবে। তুমি ইমন কে জিজ্ঞেস করতে পারো। ও কিছুই মনে করবে না।”

“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল!”

“হুম, বলো!”

“আমার না, ইমনকে ভালো লাগে।”

আরাফ এই কথা শুনে অবাক হলো না। সে আগে থেকেই জানতো সায়ন্তনী ইমনকে পছন্দ করে। কারণ তার হাবভাব দেখলেই বোঝা যেতো। সায়ন্তনী বাকিদের তুলনায় ইমনের ব্যাপারেই বেশি সচেতন ছিল। ইমনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তার আলাদা সচেতনতা আছে, যা আরাফ লক্ষ্য করেছিল। চায়ে চিনি কম হলে ইমনের হাবভাব দেখে সায়ন্তনী চিনির পট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। অন্যদের ব্যাপারে এত উদ্বিগ্নতা সে কখনো লক্ষ্য করেনি।

সায়ন্তনী বলল, “তুমি কিছু বলবে না?”

আরাফ বলল,
“এখানে আমার বলার কি আছে? তোমার ভালো লাগতেই পারে।”

সায়ন্তনী মাথা নিচু করে মলিন মুখে বললো,
“ইয়ে মানে, আমি তো সাধারণ পরিবারের মেয়ে। চায়ের দোকান চালিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমার বাবা নেই। একটা সময় মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি কারখানায় কাজ করে। আমার তো কোন যোগ্যতা নেই। স্কুল পর্যন্তই পড়েছি। বাকিটা হয়তো আর সম্ভবও না।”

আরাফ চুপ করে রইল। সায়ন্তনীর কোন যোগ্যতা আছে কি নেই তা সে কখনো ভেবে দেখেনি। হুট করেই তার ভালো লেগে গিয়েছিল মেয়েটিকে। ইমনেরও কি তার মতো সায়ন্তনীকে ভালো লাগতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব আরাফ দিতে পারবে না। তাই সে আর কিছুই বলল না। শুধু সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে রইল।

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭||

৪৪.
রহমত চাচার সাথে ফোনালাপ করে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো ইভান। ইভানকে চিন্তিত দেখে আহনাফ তার কাঁধে হাত রেখে তার পাশে বসলো। ইভান আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল, তারপর বলল,
“রহমত চাচা ফোন দিয়েছেন।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আজকে চার মাস হয়ে গেছে, উনি কোনো টাকা পাঠান নি। এখন ফোন করে অজুহাত দেখানো ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।”

“উনি অজুহাত দেওয়ার জন্য ফোন করেন নি।”

“তো, কেন ফোন দিয়েছেন?”

“এসব বাদ দে। আগে বল, জুবাইয়ের আংকেল সেই রাতে একটা কাগজ দিয়েছিল, মনে আছে?”

“কোন কাগজ?”

“যেই কাগজে সব তথ্য ছিল। উনি সেদিন দিয়েছিল কাগজটা। কোথায় সেটা?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু পাঁচ বছর আগের কাগজ তুই এখন খুঁজছিস?”

“কাগজটা কি তুই খুলে দেখিস নি? আরাফ, তাহমিদ কেউই দেখে নি?”

“আমি তো দেখি নি। বাকিদের জিজ্ঞেস করে দেখ।”

ইভান চেয়ার ছেড়ে উঠে সবাইকে ডাকলো। একই প্রশ্ন বাকিদেরও করলো৷ কিন্তু কারোই সেই কাগজটির কথা মনে ছিল না। তখন তূর্য কিছু একটা ভেবে বলল,
“আমার মনে পড়েছে। আংকেল কাগজটা আহনাফের হাতে দিয়েছিল। আহনাফ তুই কাগজটা কোথায় রেখেছিস?”

আহনাফ ভেবে বলল,
“পকেটেই রেখেছিলাম। কিন্তু এরপর তো আর বের করা হয় নি।”

আরাফ বলল,
“আমি তো সেই কাগজটির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। চাচ্চু বলেছিলেন, ওখানে কিছু তথ্য আছে।”

আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“প্যান্টের পকেটে ছিল। সিলেট যাওয়ার পর প্যান্টটা ধুয়ে ফেলেছিলাম। তারপর কলকাতায় আসার পর থেকে আর সেই প্যান্ট পরা হয় নি৷ আমি ড্রামেই রেখে দিয়েছিলাম হয়তো।”

তাহমিদ বলল,
“আর আমি সেই ড্রামে থাকা সব পুরোনো কাপড় বিক্রি করে দিয়েছি।”

সবাই তাহমিদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ আবার বলল,
“সেই মাসে ঘর চালানোর মতো কোনো টাকাই ছিল না। অরুণিকা অনেকদিন ধরে মাংস খেতে চাইছিল। মাংস কেনার জন্যই আমি জামাগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আর আমি তোদের জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তোরাই বলেছিস এসবের প্রয়োজন নেই। আর জামাগুলো অনেক ছোটও হয়ে গিয়েছিল।”

ইমন মলিন মুখে বলল,
“তাহলে কি আমরা নিজেদের ভুলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হারিয়ে ফেলেছি?”

আরাফ এবার ইভানকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইভান, তুই হঠাৎ কাগজটির কথা বলছিস কেন?”

ইভান বলল,
“পাঁচ বছর আগে আমবাগানে দাঁড়িয়ে রহমত চাচা বলেছিলেন, আমাদের বাড়ির কয়েকজন দারোয়ান, মৈত্রী গ্রুপের কিছু সদস্য, পরিচিত কিছু মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তারপর সিলেটে যাওয়ার পর বলেছিলেন, অরুণিকার মামা আর আমাদের শত্রুপক্ষ মির্জা গ্রুপ এর সাথে জড়িত আছে। আজ বলছে, বাস্কার গ্রুপের মালিক রিয়াজুর রহমানও জড়িত আছেন।”

ইমন বলল,
“উনি কি আমাদের পাগল করে ফেলবেন নাকি?”

“এখানে আমাদেরই কিছু একটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। এমনিতেই মির্জা গ্রুপ সেই সময় থেকেই আমাদের শত্রুপক্ষই ছিল। এর আগেও কয়েকবার তাদের সাথে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আমাদেরই কোম্পানির একজন মহিলা কর্মচারীকে অপহরণ করে ফেলেছিল। তাই মির্জা গ্রুপের উপর আমার শুরু থেকেই সন্দেহ আছে।”

আহনাফ বলল,
“রিয়াজুর রহমান তো আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।”

তূর্য বলল,
“আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। উনার সাথে বাবার অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিল।”

ইভান বলল,
“আর মৈত্রী গ্রুপের কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না। কারণ গ্রুপের সবাই আমাদের পরিবার থেকেই ছিল। আর সবাইকেই খুন করে ফেলা হয়েছে।”

আরাফ বলল,
“গ্রুপের দুইটা অংশ ছিল। প্রথম অংশটার দায়িত্ব জুবাইয়ের চাচ্চুর হাতে ছিল, দ্বিতীয় অংশটা ইমতিয়াজ আংকেলের হাতে ছিল।”

ইমন বলল,
“হ্যাঁ, বাবা দেখেশুনেই সব কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি বাবার সাথে অনেক বার অফিসে গিয়েছিলাম। সবাই অনেক মিশুক ছিল। আমার তো কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।”

ইভান বলল,
“আমার কথা তোরা কেউই ধরতে পারিস নি।”

সবাই ইভানের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান বলল,
“রহমত চাচা অনেক কিছুই জানেন, যা আমরা জানি না। উনি আমাদের সেদিন বাঁচিয়েছেন, অথচ অনেক কিছুই লুকাতে চাইছেন৷ আমি বুঝতে পারছি না, উনি আসলে কি কর‍তে চান। আর কাগজটার ব্যাপারে উনিই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। উনি আমার কথা শুনেই বুঝেছেন, আমরা সেই কাগজ পাই নি। আমার কাগজটার কথা ফোন রাখার পর মনে পড়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি।”

আরাফ বলল,
“কি বিষয়!”

“প্রথমত উনি কিভাবে জানলেন, আমাদের একটা কাগজ দেওয়া হয়েছিল? আর আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমরা কাগজটা পাই নি জানার পর উনার কন্ঠে একটা স্বস্তি ছিল। আর এই স্বস্তির জন্যই আমার এখন রহমত চাচাকে সন্দেহ হচ্ছে।”

তূর্য বলল,
“তুই কি বোঝাতে চাইছিস, ইভান? উনিই এসবে জড়িত ছিল? কিন্তু উনিই তো আমাদের বাঁচিয়েছেন!”

“এটাই তো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছি। আরেকটা ব্যাপার আমি খেয়াল করলাম।”

“কি!”

“অরুণিকা আর ইমনের ব্যাপারেই উনার যতো মাথা ব্যথা। যতোবার ফোন দেয় অরুণিকার বয়স জিজ্ঞেস করেন। আর ইমন কি করছে এসব জানতে চান। বাকিদের কথা আলাদা ভাবে জিজ্ঞেস করেন না। কিন্তু কেন?”

ইমন ভাব নিয়ে বলল,
“আমরা বয়সে ছোট তাই হয়তো!”

“মোটেও না। এখানেও কিছু একটা আছে। যা আমি বুঝতে পারছি না।”

“এখন কি আমরা খুনিদের খুঁজে পাবো না?”

“অবশ্যই পাবো। কিন্তু পাঁচ বছর আগে যদি এতোটুকু বুদ্ধি থাকতো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারতাম। আমাদের কি বিশ্বাস করার মতো কেউই নেই? আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই তো আর সেদিন খুন হয় নি। অনেকেই তো ছিল বাইরে। তারাও কি এখনো বেঁচে আছে?”

তাহমিদ বলল,
“কাদের কথা বলছিস?”

“আরাফ, আহনাফ, অরুণিকা আর তোর নানার পরিবারের অনেকেই আছে। তূর্যের দাদার ভাইয়ের পরিবার আছে। ওরাও তো আত্মীয়! আমাদের না হয় নানার বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তোদের তো আছে।”

তূর্য বলল,
“ওদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। একদিন বিয়ের দাওয়ার দিতেই বাবার একজন চাচাতো ভাই এসেছিলেন। ওরা তিন ভাই ছিল। তার মধ্যে একজন অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। বাকি দুইজনের মধ্যে যার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারা এসেছিল, সেও মারা গিয়েছে। ছোটটাকে আমরা কখনোই দেখি নি। উনি বাইরের দেশে থাকতেন।”

আহনাফ বলল,
“আমার নানার পরিবারে মায়ের একজন ফুফুই আছেন। আর তার ছেলে। ওদের সাথেও বিয়ের পর মা আর তেমন যোগাযোগ রাখে নি। রাখলেও আমি হয়তো জানি না। বাসায় তো কখনো আসতে দেখি নি। আর আমাদের পরিবারের কারোই তো বিয়ে হয় নি। একটা অনুষ্ঠান বা দাওয়াত পড়লে বোঝা যেতো কতো আত্মীয় আছে।”

আরাফ বলল,
“মায়ের মৃত্যুর পর নানুর পরিবারের কেউই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে নি। ওরা সবাই দাদু আর বাবাকে মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করতো। কারণ মা ঘরের বড় বউ ছিলো। তাই নিষেধ করার পরও অনেক কাজ করতো। আমার জন্মের সময় মা অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে দাদু আর বাবার কোনো দোষ ছিল না। এরপর ওরা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা আমাকে যেতে দেয় নি।”

এবার তাহমিদ বলল,
“আমার নানুর পরিবারের তো অনেকেই আছে। আমাদের তো প্রায়ই যাওয়া আসা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন মায়ের সাথে মামার একটা ঝামেলা হয়। এরপর আর যাওয়া হয় নি৷”

ইভান জিজ্ঞেস করলো, “কি ঝামেলা?”

“জানি না। আমাকে তো জানানো হয় নি। আমি ওদের কথাবার্তা শুনে এতোটুকু বুঝেছি ঝামেলা একটা হয়েছে।”

“তাহলে তোর মামাও জড়িত থাকতে পারে।”

তাহমিদ রাগী কন্ঠে বললো,
“ইভান, কি বলছিস এসব? ওরা মানুষ খুন করার মতো হিংস্র নয়।”

সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছে। কিন্তু কারণগুলো মানুষের জীবন নেওয়ার মতো নয়। কারো জীবন কেঁড়ে নেওয়া এতোটা সহজ বিষয় না। হাসিমুখে কারা পিঠে ছুরি চালিয়ে দিতে পারে, তা বোঝা অনেক কঠিন।

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||

৪৫.
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই যতিকে দেখে থমকে গেলো আহনাফ। যতি তার কাছে এসে বলল,
“আহনাফ, আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি, জানো?”

আহনাফ যতিকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে তখনই যতি বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

আহনাফ যতির দিকে ফিরে বলল,
“দেখো, যা করার করে ফেলেছো। আর শুনো, তোমার সেই মহান কাজের জন্য আমি কোর্ট থেকে লিখিতভাবে অরুর হবু বর হওয়ার অনুমতি পেয়েছি। অরুর আঠারো হলেই আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো। এখন শুধু আট কি নয় বছরের অপেক্ষা!”

“এভাবে অনুমতি দিলে হয় নাকি! অরুণিকা যদি না চায়।”

“কেন? আমার মধ্যে কি কোনো সমস্যা আছে যে চাইবে না?”

যতি আহনাফের পা ধর‍তে যাবে তখনই আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে বলল,
“এসব অভিনয় আমার সামনে না করে, কোনো ডিরেক্টরের সামনে করতে পারো। সিনেমায় ভালো একটা সুযোগ হবে তোমার।”

আহনাফ ক্যাম্পাস থেকে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই যতির বাবাকে ফোন করে বলে দিলো, যতি বার-বার তাকে বিরক্ত করছে। যতির বাবা সব শুনে এবার মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। যতির কাজকর্ম তার আত্মীয়রা জানার পর যতির বাবা-মাকে কথা শুনাচ্ছে। সবাই যতির মাকেই দোষ দিচ্ছেন। বাসায় মেয়ের সাথে না থেকে বাইরে চাকরি করতে গিয়েই নাকি মেয়ের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। যতির মা এসব শুনে মেয়ের উপর আরো ক্ষুব্ধ হয়ে যান। তিনি আবার মেয়েকে ইচ্ছেমতো মারলেন। যতি এবার নিজেকে বাঁচাতে বলল, সে আর কখনোই আহনাফের সামনে যাবে না।

আহনাফ শুয়ে মুখে বালিশ দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তখনই তার মনে হলো কেউ তার পায়ের উপর ভর দিয়েছে। সে বালিশ সরিয়ে দেখলো অরুণিকা তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি চাও?”

অরুণিকা ধপ করে লাফিয়ে এসে আহনাফের সামনে বসতেই আহনাফ মাথা তুলে উঠে বসলো৷ অরুণিকা বলল,
“তোমার ফোনটা দাও।”

আহনাফ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার ফোন দিয়ে কি করবে?”

“আমার বন্ধুর সাথে কথা বলবো।”

আহনাফ ফোনটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বলল,
“যাও। আমি ঘুমাবো।”

“ফোন দিবে না?”

“না।”

অরুণিকার হাসিমাখা মুখে মুহূর্তেই বিষন্নতা ভীড় জমালো। আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, দেবো। আগে বলো, কোন বন্ধুর সাথে কথা বলবে?”

অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“আমার নতুন বন্ধু।”

“নাম কি?”

“বিয়োন। ও ক্লাসে নতুন এসেছে। আমাকে ফোন নম্বর দিয়েছে। বলেছে ফোন করতে।”

“ফোন দেওয়ার কারণ?”

“কথা বলবো, তাই।”

আহনাফ ফোন এগিয়ে দিতেই অরুণিকা নম্বরটি ফোনে তুলে নিলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মুখস্থ করে ফেলেছো?”

“হ্যাঁ, বিয়োন মুখস্থ করে ফেলতে বলেছে।”

ততোক্ষণে অপর প্রান্ত থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শুনা গেলো। অরুণিকা সেই কন্ঠের স্বর শুনেই উৎসুক হয়ে বলল,
“বিয়োন, আমি অরুণিকা।”

বিয়োন বলল,
“হাই, কেমন আছো?”

“ভালো। তুমি ফোন করতে বলেছো, তাই ফোন করেছি।”

“এটা কার নম্বর?”

“এটা আহনাফের নম্বর। আমার তো ফোন নেই।”

“আহনাফ কে, ওই তোমাকে সারাদিন বকা দেয় ওইটা?”

আহনাফ চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে বিয়োনের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। অরুণিকা উত্তরে বলল,
“না, না। ও আমাকে এখন বকে না। ওর ফোন দিয়েই তো আমি গেইমস খেলি। ও আমার জন্য চকোলেট এনে দেয়। খেলনাও কিনে দেয়৷”

আহনাফ বিড়বিড় করে বলল,
“কতো আহ্লাদ, বাহ! আর এদিকে যত্তোসব বিয়োন-ফিয়োনের সাথে কথা বলতে গিয়ে এই মেয়ে আমার ব্যালেন্স শেষ করে দিচ্ছে।”

অরুণিকার কাছ থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে আহনাফ বলল,
“আর কথা বলতে হবে না। অনেক বলেছো।”

কল কেটে দেওয়ার পর আহনাফ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে তোমাকে সারাদিন বকাঝকা করে?”

অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে বলল,
“তুমি কিভাবে জানলে?”

আহনাফের ফোনের ভলিউম বড়, তাই স্পিকারে না থাকলেও সব শুনা যায়। আহনাফ বলল,
“জেনে ফেলেছি। এখন বলো কে তোমাকে বকা দেয়?”

“ইভান।”

আহনাফ মুচকি হেসে বললো,
“আর কে তোমাকে বেশি ভালোবাসে?”

অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আরাফ আর রকস্টার।”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?”

“আরাফ আর রকস্টারকে।”

“আর আমাকে?”

“তোমাকেও ভালোবাসি। সবাইকে ভালোবাসি।”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“রকস্টার, রকস্টার, সারাদিন রকস্টার।”

এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুনো অরু, ওর একটা নাম আছে। ওর নাম তূর্য৷ রকস্টার না।”

অরুণিকা বলল,
“না, আমি ওর টুংইকেল, ও আমার রকস্টার!”

কথাটা বলেই অরুণিকা ধিন ধিন করে চলে গেলো। আহনাফ সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“বাচ্চা মেয়েটা বলে কি! এগুলো নিশ্চয় ওই তূর্যের বাচ্চাই ওকে শিখিয়েছে।”

৪৬.

চায়ের দোকানে ভীড় জমেছে। সবাই জড়ো হয়ে প্রেম নিবেদন দেখছে। তাহমিদ, আহনাফ আর তূর্য একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আরাফের চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে। আর ইভান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাওশিয়াতের চোখ দুটি ছলছল করছে। হয়তো এখনোই অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। সায়ন্তনীর চোখ দু’টিও ভিজে যাচ্ছে। ইমন তার এক হাত এগিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ইমন সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হলো, চুপ করে আছো কেন? তুমি কি আমার হতে চাও না?”

সায়ন্তনী কাঁদোকাঁদো মুখে মাথা নেড়ে ইমনের হাত ধরলো। ইমন শক্ত করে সায়ন্তনীর হাত ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“সেদিন তুমি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছ। আজ আমি তোমাকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছি। তুমি আর ভাই, দু’জনই আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। এখন আমি তোমাদের সামনেই সুখী হয়ে দেখাবো।”

আরাফ আহনাফকে এক পাশে টেনে এনে বলল,
“তুই ইমনের এমন কাজে তালি দিচ্ছিস?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“সায়ন্তনী হ্যাঁ বলেছে, তো তালি দেবো না নাকি!”

“ইমন সায়ন্তনীকে ভালোবাসে না।”

“তো, কিছুক্ষণ আগে কি হলো এটা!”

“ছেলেটার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ইভান আর মাওশিয়াতকে দেখানোর জন্য ও এমন অভিনয় করেছে।”

“ও!”

“ও কি! সায়ন্তনী এসব অভিনয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ও তো সব এখন সত্য ভেবেই বসে আছে।”

“তো বলে দিলেই তো সব জেনে যাবে।”

আরাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই বুঝতে পারছিস না আমার কথা?”

আহনাফ জোরেই বলল, “না।”

“সায়ন্তনী ইমনকে সত্যিই পছন্দ করে। আর ইমন ওর সাথে অভিনয় করছে, এটা শুনলে ও অনেক কষ্ট পাবে।”

আহনাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আপতত ইমনের মাথা থেকে মাওশিয়াত বের হলেই হবে। সায়ন্তনী মেয়েটা অনেক ভালো।”

আরাফ আহনাফকে এখনো কিছুই বোঝাতে পারলো না। ইমন এখন যা-ই করছে জেদের বশে করছে। জেদ কেটে গেলে সায়ন্তনী নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু ইমনকে এখন বুঝিয়েও লাভ নেই। কারণ সে কারো কথা শোনার মতো ছেলে না। সে নিজে যা বুঝে তাই করে।

এদিকে মাওশিয়াত বাসায় এসে ইচ্ছেমতো কান্নাকাটি করলো। আজ সে ভেবেছিলো ইমনকে বলবে, সেও ইমনকে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ ইমন এমন কিছু করে বসবে, তা মাওশিয়াত ভাবতেও পারে নি৷ সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“যাকেই আমি ভালোবাসি, সেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। কেন বার-বার আমার সাথে এমন হচ্ছে?”

কয়েক সপ্তাহ ধরেই সায়ন্তনী আর ইমনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। সায়ন্তনী এখনো বুঝতে পারছে না, ইমন এসব মাওশিয়াত আর ইভানকে দেখানোর জন্যই করছে। আজ সে সেজেগুজে চায়ের দোকান খুলেছে। ক্লাস শেষে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য আরাফ সায়ন্তনীর দোকানে এসেই অবাক হয়ে গেলো। সায়ন্তনী কোন পরিবেশে কেমন সাজ দিতে হয়, তা জানে না। তাই এই মুহূর্তে তাকে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। আশেপাশের সবাই কেমন যেন বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। আরাফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে, তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে কেমন লাগছে দেখতে? তাড়াতাড়ি মুখটা মুছে ফেলো।”

সায়ন্তনী অবাক হয়ে বলল,
“কেন? অনেক সময় নিয়ে সেজেছি। ইমনের সাথে আজকে বাইরে ঘুরতে যাবো। ও বলেছে, আমাকে এসে নিয়ে যাবে।”

“আমি বলছি তো তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে না।”

সায়ন্তনী আরাফের কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। তার মনে হচ্ছে আরাফ তাকে ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলছে। সে নিজেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আয়না দেখে এসেছিলো। তার মোটেও নিজেকে খারাপ লাগে নি। তখনই মাওশিয়াত তার দোকানে এলো। মাওশিয়াতকে দেখে সায়ন্তনী বলল,
“চা দেবো?”

মাওশিয়াত আরাফের দিকে তাকিয়ে সায়ন্তনীকে বলল,
“আমার তোমার সাথে কথা আছে।”

সায়ন্তনী বলল, “বলো।”

“ইমন, তোমাকে ভালোবাসে না। শুধু শুধু ওর পেছনে সময় নষ্ট করো না।”

সায়ন্তনী মাওশিয়াতের কথা শুনে আবার চা বানাতে লাগলো। মাওশিয়াত সায়ন্তনীর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে বলল,
“তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো না?”

সায়ন্তনী মাথা নেড়ে বলল,
“তোমার কথা বিশ্বাস করলে, সবাই ঠকবে। সেই স্কুল থেকেই দেখেছি, তোমার যা ভালো লাগে, তা তুমি অন্য কাউকে দিতে পছন্দ করো না। এখন তুমি ইমনকে পছন্দ করো, তাই আমাকে নিষেধ করছো। কাল ইভানকে ভালো লাগতো, তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছ।”

মাওশিয়াত মলিন হেসে বললো,
“আমি তখন বোকা ছিলাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না। হ্যাঁ, আমার ইভানকে ভালো লাগতো। তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছি। আর আমার তোমার সাথে কোনো বন্ধুত্ব নেই, যার জন্য তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি। আমি ইমনকে ভালোবাসি। তাই আমি চাই না, ও এমন কাজ করুক, যার জন্য ও নিজেই অনুতপ্ত হোক।”

ইমন তখনই সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে মাওশিয়াতকে দেখে নেশা লাগানো কন্ঠে বলল,
“সায়ন্তনী, তোমাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।”

ইমন মাওশিয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজকন্যা।”

মাওশিয়াত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি এসব অভিনয় কখন শিখেছো? তুমি মানুষের অনুভূতি নিয়ে তামাশা করছো।”

ইমন মাওশিয়াতের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আর ভাই মিলে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। তাই অনুভূতি নিয়ে অন্তত তুমি আমাকে কোনো ভাষণ দিও না।”

ইমন সায়ন্তনীকে টেনে দোকান থেকে বের করলো। এরপর একটা ছেলেকে দোকানে বসিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীকে নিয়ে চলে গেলো।

আজ অরুণিকার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছ’জন মিলেই তার জন্মদিনের আয়োজন করেছে। শতাব্দী, সায়ন্তনী আর মাওশিয়াতও দাওয়াত পেয়েছে। সাথে সুরাইয়া খোকা আর ডুমুরকে নিয়ে এসেছেন। অরুণিকা অনেক জোরাজোরি করছিলো, তাই বিয়োনসহ তার দুই-তিন জন বন্ধুদেরও বিকেলে দাওয়াত দেওয়া হলো।
কেক কাটার পর উপহার নিয়েই অরুণিকার যতো আগ্রহ। সে সবার উপহার খুলে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলো। শেষমেশ একটা একটা করে বক্স খুলতে লাগলো। ইমন তাকে একটা খেলনার গাড়ি উপহার দিয়েছিল। সেই গাড়িটা দেখেই শতাব্দী হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইমন রাগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে হাসার কি আছে?”

শতাব্দী হাসতে হাসতে বলল,
“ছোট সখী, তুমি ইমনের দেওয়া গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেও।”

শতাব্দী আবার হাসতে লাগলো। মাওশিয়াত তার দেওয়া উপহারটি এগিয়ে দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। কারণ সে বুঝেছিলো ইমনের উপহার দেখে অরুণিকা তেমন একটা খুশি হয় নি, আর তাই ইমনেরও মন খারাপ হয়ে গেছে। মাওশিয়াত অরুণিকাকে একটা ছোট ব্যাগ উপহার দিয়েছে। অরুণিকা সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল,
“সামনে ইদ আসলে আমি এই ব্যাগটাতে আমার সব টাকা রাখবো।”

মাওশিয়াত মুচকি হেসে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মাওশিয়াতের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো। এবার অরুণিকা বাকিদের উপহারগুলো দেখতে লাগলো। সুরাইয়া অরুণিকার জন্য একটা জামা এনেছেন, তাহমিদ হাতের বালা কিনেছে, শতাব্দী দিয়েছে মেকাপ বক্স, আর আরাফ দিয়েছে বড় একটা পুতুল। অরুণিকা পুতুলটা দেখেই আরাফের কাছে দৌঁড়ে গেলো। আরাফ হাঁটু গেড়ে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এখন থেকে ঘুমানোর সময় এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। কেমন?”

“আচ্ছা।”

ইভান তার উপহারটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিও তোমার জন্য স্পেশাল গিফট এনেছি।”

অরুণিকা প্যাকেটটি খুলে দেখলো কয়েকটা বই। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান বলল,
“এখানে ফল, ফুল, প্রাণি, পাখি, যানবাহন, পোকামাকড় সব কিছুর নাম আছে। এখন থেকে ছুটির দিনে তুমি এক পৃষ্ঠা করে শিখে আমাকে মুখস্থ দেবে।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না। আমি এটা নেবো না। তুমি নাও তোমার গিফট।”

“ভালো জিনিসের তো কোনো মূল্যই নেই। শুনো, এখন আর তোমার পুতুল খেলার বয়স নেই।”

তাহমিদ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ অন্তত এসব বন্ধ কর।”

শতাব্দী অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখেছে। আরাফ তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে সরে যেতে বললো। শতাব্দীও একপাশে সরে হাসতে লাগলো। ইভান সেটা খেয়াল করে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

শতাব্দী হাসি আটকে বলল,
“ভাবছি অরুণিকার বিয়ের দিন তুমি ওকে কি গিফট দেবে! কিভাবে সংসারে সুখী হওয়া যায়, এমন বই? মিষ্টি মশাই তাহলে রান্নাবান্নার বই পাবে, যেখানে অনেক ধরণের রেসিপি থাকবে৷ আরাফকে তুমি কঙ্কাল গিফট করবে আর তূর্যকে গানের বই। ইমনকে হয়তো ফুটবলের ইতিহাস আছে এমন বই দেবে। আর আহনাফকে কি স্ক্রু দেবে নাকি জিনিসপত্র ঠিক করার জন্য?”

ইভান ধমকের সুরে বলল,
“চুপ করো তুমি!”

শতাব্দী চুপ হয়ে গেলো। এরপর আহনাফ অরুণিকার হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। বলল,
“তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?”

অরুণিকা কিছু বলার আগেই তূর্য এসে বলল,
“টুইংকেল, সারপ্রাইজ!”

তূর্য একটা সাইকেল অরুণিকার সামনে এনে রাখলো। অরুণিকা সাইকেলটি দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। সেটা নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহনাফ চুপচাপ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আরাফ আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকাকে সাইকেলে বসিয়ে সাইকেলটা চালাতে তাকে সাহায্য করছে। অরুণিকাও উৎসাহ নিয়ে সাইকেলটা চালাচ্ছে। আহনাফ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে এলো। আরাফও তার পিছু পিছু এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও এখনো ছোট! পুতুল, সাইকেল এসব জিনিসগুলো ওকে বেশি আকর্ষণ করবে। তোর ঘড়িটির মূল্য বুঝতে ওর অনেক বড় হতে হবে, আহনাফ।”

“তূর্য কি ইচ্ছা করে এসব করছে?”

“ও তো এতোকিছু জানে না। তুই কি কাউকে জানিয়েছিস এসব?”

“আমি কি ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাবো? তাহমিদ কি ঢোল পিটিয়ে বলেছে ওর শতাব্দীকে ভালো লাগে? কিন্তু আমরা তো সবাই বুঝে ফেলেছি।”

“শতাব্দীর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অরুর মাত্র দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। তোর ওকে ভালো লাগে, এটা সবাই কিভাবে বুঝবে?”

“তাহলে তুই কিভাবে বুঝেছিস?”

“কারণ আমি শুরুর গল্পটা জানি। আর বাকিরা এর মধ্যের অংশটা দেখছে। আর শুরুটা না জানলে, কেউ কিছুই বুঝবে না। তুই কেন অরুকে অপছন্দ করতি? কেন ওর সাথে অকারণে ঝগড়াঝাটি করতি? কেন যতির সাথে জোর করে সম্পর্কে জড়িয়েছিস? কেন এই চুক্তিতে বিনা দ্বিধায় সাক্ষর করেছিস? এসব আমি জানি, আহনাফ। কারণ আমি শুরু থেকেই এসবের সাক্ষী ছিলাম।”

“তুই সেদিন আমার জায়গায় থাকলে কি করতি?”

“বুঝতে পারছি না।”

“আমি অনেক খারাপ অবস্থায় আছি, আরাফ। বিশ্রী একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে কেমন কীট মনে হচ্ছে! কি ভাবছি আমি? কি হচ্ছে আমার সাথে? আমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র দাদা-দাদিই দায়ী।”

আরাফ আহনাফকে কিছু বলতে যাবে তখনই ইভান এসে বলল,
“তোরা দুই ভাই এখানে কি করছিস!”

ইভান আসায় আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তূর্য অরুণিকাকে সাইকেল গিফট করেছে, এটা দেখে তুই বিরক্ত হয়েছিস মনে হচ্ছে!”

আহনাফ আর আরাফ দু’জনই ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ মনে মনে ভাবল,
“এভাবে সামনে থেকে চলে আসা হয়তো উচিত হয় নি। কেউ যদি এসব জানতে পারে, তাহলে আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here