অরুণিকা পর্ব – ২৯+৩০

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৯||

৪৭.
মেঝেতে একটা ডায়েরী আর অনেকগুলো ছবি পড়ে আছে। পাশে একটা গ্লু আর কিছু রঙিন কলম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন গুঁজে এক হাতে একটা ছবি আকাশের দিকে তাক করে, অন্য হাতে একটা ফোন নিয়ে ছবি তুলছে উপমা। ছবি তোলার পর ছবিটি ভালোভাবে দেখে বিড়বিড় করে বলল,
“উফ! আমার স্টারকে তো এই ছবিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে। এই ফোনটাও দিনদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভালোভাবে ফোকাসই হয় না। বাবাকে বলবো, নতুন ফোন কিনে দিতে।”

পরক্ষণই সে ইন্সটাগ্রামে ঢুকে আবার ইনবক্সে ঢুঁ মেরে এলো। দেখলো মেসেজটা এখনো দেখা হয় নি। ফোনটা একপাশে ফেলে উপমা চেঁচিয়ে বলল,
“একমাস ধরে মেসেজ দিচ্ছি, কিন্তু তার তো আমার জন্য সময়ই নেই।”

এসব ভাবতে ভাবতেই উপমা চিড়বিড় করে উঠলো। পাশ থেকে উপমার মা, মিসেস জুলেখা চেঁচিয়ে বললেন,
“সারাদিনেও কি তোর নাকি কান্না যায় না?”

তারপর জুলেখা মিনমিনিয়ে বলতে লাগলেন,
“পড়াশুনা বাদ দিয়ে মাথা ছাড়া ছেলে একটার ছবি কেটে কেটে ডায়রিতে লাগানো ছাড়া মেয়েটার আর কাজ নেই।”

উপমা রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“মা, আমি তোমার কথা শুনে ফেলেছি।”

জুলেখা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
“শুনে আমাকে উদ্ধার করেছিস। পরীক্ষা খারাপ হলে দেখিস, ডায়েরীটা আমি পুড়িয়ে ফেলবো।”

“মা, তুমি আমার স্টারের ছবি পুড়িয়ে ফেলতে পারো। কিন্তু আমার মন থেকে তার ছবি কখনো পোড়াতে পারবে না। কারণ ও আমার মনেই নিজের ছবি এঁকে ফেলেছে।”

মিসেস জুলেখা চুপ করে রইলেন৷ কোনো কথা বললেন না। তখনই উপমার বড় ভাই আদিল রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“মা, আমার মানিব্যাগ থেকে ২০০ টাকা উধাও হয়ে গেছে।”

মিসেস জুলেখা ছেলের দিকে তাকিয়ে, আরেকবার উপমার দিকে তাকালেন। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। মায়ের চোখ অনুসরণ করে আদিল বোনের দিকে তাকালো। উপমা ভাইয়ের কথা শুনে পা টিপে টিপে সরে আসতেই আদিল তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

উপমা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি না আমার লক্ষী ভাইয়া।”

তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমাকে বকা দিলে আমি কিন্তু মাকে তোমার হৃদি বাবুর কথা বলে দেবো।”

আদিল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। উপমা বুকে হাত গুঁজে জোরে জোরে বলল,
“ভাইয়া আমিই নিয়েছিলাম। আমার স্টারের ছবিগুলো ফোন থেকে প্রিন্ট করে বের করিয়েছি। রঙিন ছবি বের করতে অনেক টাকা লাগে, জানো না?”

আদিল রাগী কন্ঠে বললো,
“আমার টাকা খরচ করে তুই কোথাকার গায়কের ছবি প্রিন্ট করছিস? তাও যাকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি।”

“সে কোথাকার গায়ক না। ও আমার স্টার। আর শুনো, ও অনেক ভদ্র, তাই নিজের ছবি দেয় নি। ওকে ভালোবাসার জন্য আমার ওকে দেখার প্রয়োজন নেই। ওর গিটার, ওর পরণের শার্ট, ওর চুলগুলোই আমার জন্য যথেষ্ট। আর ওর কন্ঠ! আমি তো ভাবতে গেলেই পাগল হয়ে যাবো।”

মিসেস জুলেখা মেয়ের কথা শুনে আদিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সেই বয়সে আমরাও স্টারদের প্রেমে পড়েছি। ক্রিকেটারদের পোস্টার লাগিয়েছিলাম। কিন্তু তোর বোন তো ডায়েরী ভর্তি ছবি লাগিয়েছে একটা মাথা ছাড়া ছেলের।”

উপমা বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা ওকে মাথা ছাড়া ছেলে বলবে না। ও শুধু মুখটাই দেখায় না। ওর তো মাথা আছে।”

“মুখখানা হয়তো পেঁচার মতো, তাই দেখাতে লজ্জা পায়।”

উপমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের সামনে এসে হাত এগিয়ে দিলো। মিসেস জুলেখা ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“হাত এগিয়ে দিচ্ছিস কেন? মার খেতে চাস?”

আদিল বলল,
“মা, তোমার মেয়ে আমার মানিব্যাগ খালি করেছে। এখন আমাকে টাকা দাও। আমি এখন আগ্রাবাদ যাবো। আমার কাছে গাড়ি ভাড়াও নেই।”

“তোর বাইক কোথায়?”

“তেল শেষ হয়ে গেছে।”

মিসেস জুলেখা বললেন,
“রুমে ব্যাগ আছে। ওখান থেকে নিবি। ২০০ টাকায় নিবি কিন্তু। এর বেশি না। তোর বাবা আমাকে এই মাসের খরচ চালানোর জন্য টাকাটা দিয়েছে।”

করিম সিদ্দিক আর জুলেখা হোসেনের বড় ছেলে আদিল সিদ্দিক আর তাদের ছোট মেয়ে উপমা করিম। এইটাই তাদের চারজনের ছোট্ট সংসার। করিম সিদ্দিক প্রবাসী। তিনি দুবাই থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে আসেন। দেশে এলে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করা করিম সিদ্দিকের শখ। তার এই শখ আদিলও পেয়েছে। কিন্তু উপমা মায়ের মতোই ঘরকুনো স্বভাবের৷ তাদের দু’জনকে একপ্রকার টেনেই ঘর থেকে বের করতে হয়।

এদিকে ক্লাস শেষে কলেজের বাগানে চুপচাপ বসে রইলো মাওশিয়াত। ইভান দূর থেকেই তাকে দেখে তার পাশে এসে বসলো। মাওশিয়াত ইভানের দিকে এক নজর তাকিয়ে বসা থেকে উঠতে যাবে তখনই ইভান বলল,
“ইমন এসব ইচ্ছে করে করছে।”

মাওশিয়াত কোনো উত্তর দিলো না। ইভান আবার বলল,
“সবার মধ্যে কমবেশি জেদ থাকে। ইমন এখন যা করছে তা জেদের বশে। তোমার মধ্যেও এই জেদ ছিল। এখনো হয়তো আছে। কিন্তু আমাদের সামনে দেখাচ্ছো না। আর আগের চেয়ে তুমি অনেক পরিবর্তন হয়েছ।”

মাওশিয়াত বলল,
“পরিবর্তন হওয়ারই ছিল। এই জেদের বশে আজ পর্যন্ত আমার কোন বন্ধু হলো না। শতাব্দী কত মিশুক একটা মেয়ে! তোমরা ওকে কতো কথা বলো, তবুও কিছু মনে করে না। আর আমি সব কিছুতেই মন খারাপ করে বসে থাকি। আমি কারো সাথেই মিশতে জানি না। সায়ন্তনীও তো চুপচাপ থাকে, তবুও ওর কত বন্ধু! তূর্য, তাহমিদ, আহনাফ ওরা আমাকে পছন্দই করে না। শুধু আরাফই আমাকে কিছুটা বুঝে।”

“আমি বুঝি না তোমাকে?”

“অনেকদিন তো আমাদের কথাই হয়নি। তুমি তো আমার কাছ থেকে দূরত্ব রাখছো।”

“কারণ আমি চাইনা, ইমনের সাথে আমার আর ঝামেলা হোক। ইমন যা ভাবছে সেটা একদমই সত্য না। আমি সবসময় তোমাকে বন্ধুর চোখে দেখেছি। কিন্তু ইমন এই সম্পর্ককে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইমন তোমাকে ভালোবাসে, এটা আমি জানি। ও ভাবছে, এসব জানার পরও আমি তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছি। ও এখনো ভাবছে, আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি, আর আপাতত ওর জন্যই আমরা দূরত্ব রাখছি।”

মাওশিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কেন যেন মনে হচ্ছে ইমনকে বোঝানো সম্ভব হবে না।”

“ওকে বোঝানো সম্ভব, যদি ও আমাদের মুখোমুখি হতো। ও তো আমার সাথে ঠিকভাবে কথাই বলে না। এখন একটাই উপায় আছে।”

“কি উপায়?”

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও!”

“কি প্রশ্ন?”

“তুমি কি এখন ইমনকে পছন্দ কর? তোমার কি আমাকে নিয়ে এখনো দুর্বলতা আছে? দেখো মাওশিয়াত, কিছু মনে করো না, এটা আমার জানা জরুরি। তারপরই এই উপায়টা বাস্তবায়ন হবে।”

“ইভান তুমি আমার জেদ ছিলে। এটা ভালোবাসা ছিল না। তোমাকে আগেই বলেছি, আমি ভাবতাম ভালোবাসা বরাবরিতেই সম্ভব। তুমিও টপার ছিলে, আমিও টপার ছিলাম। ভাবতাম আমাদের ভালই মানাবে। কিন্তু ভালোবাসা এসব দেখে হয় না। ভালোবাসা তো আত্মার সম্পর্ক। এটা মুগ্ধতার সম্পর্ক। আর আমি ইমনের প্রতি মুগ্ধ হয়েছি। ওর প্রতি ভালো লাগা আমার কোন কারণ ছাড়াই চলে এসেছে। তাই আমার মনে হয় ভালবাসতে কোন কারণ লাগে না, কোন গুণ লাগে না, ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়। হুট করেই হয়ে যায়। আমি নিজেও জানিনা কবে থেকে আমি ইমনকে ভালবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু যেদিন থেকে আমার ওকে বারবার দেখার ইচ্ছে জাগলো, ওর সাথে কথা বলার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম, রাত-দিন শুধু ওকে নিয়েই ভাবতাম, তখন বুঝতে পেরেছি আমি অভিমানী ছেলেটিকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

ইভান মনে মনে হাসলো। সে জানে, ইমন মাওশিয়াতকে এখনো ভালোবাসে। ইমনের ভালো থাকা মাওশিয়াতকে ঘিরেই। ইভান এখন তাদের এক করেই ছাড়বে। হয়তো সায়ন্তনী কষ্ট পাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দু’টো মানুষের ভালো থাকা এক জনের ভালো থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা শুধু মাওশিয়াত আর ইমনের জন্য নয়। সে চায় ইমন আর তার সম্পর্ক যাতে ঠিক হয়ে যায়। শুধু কিছু ভুলের জন্য কি সে নিজের ভাইকে হারিয়ে ফেলবে?

অরুণিকা আজ স্কুলে যায় নি। সকাল থেকেই নিজের ঘরে বসে আছে। তূর্য তার ঘরে বসে গানের ভিডিও শুট করছে। আহনাফ আর তাহমিদ তাকে সাহায্য করছে। হঠাৎ তূর্য বলে উঠলো,
“টুইংকেল কোথায়?”

আহনাফ বলল, “দাঁড়া, আমি দেখে আসি।”

সে ঘরের বাইরে এসে দেখলো অরুণিকার ঘরের দরজা আটকানো। আহনাফ দরজায় দু’তিনবার ঠোঁকা দেওয়ার পরও অরুণিকা দরজা খুলছে না। তাই সে ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজা খুলেই অরুণিকাকে দেখে আহনাফ চমকে উঠলো। অবাক হয়ে বলল,
“কি করছো তুমি?”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। আহনাফ আবার বলল,
“এগুলো কি? তোমাকে দেখতে কেমন লাগছে!”

আহনাফের কন্ঠ শুনে তূর্য আর তাহমিদ এসে দেখলো পুরো ঘরে জামা-কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরুণিকা দুই তিনটা জামা একসাথে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। ঠোঁটের আশেপাশে লিপস্টিক লাগানো। তাহমিদ কাপড় গুলো মেঝে থেকে তুলে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“এগুলো কি করেছ?”

অরুণিকা মুখ নামিয়ে বলল, “বউ সেজেছি।”

অরুণিকার কথা শুনে আহনাফ আর তূর্য অবাক হলো। পরক্ষণেই তূর্য হেসে বলল,
“কার বউ সেজেছ?”

অরুণিকা কোনো উত্তর দিলো না। সে তূর্যের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ বলল,
“যাও ওয়াশরুমে যাও। মুখ ধুয়ে আসো।”

অরুণিকা প্যাঁচানো জামা কাপড়গুলো খুলে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। তার মুখে এখনো লিপস্টিকের দাগ রয়ে গেছে। কাজল চোখের নিচে লেপ্টে রয়েছে। তাহমিদ তাকে আবার ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। তারপর নিজ হাতে তার মুখ ধুয়ে দিল। যাওয়ার আগে তূর্য আর আহনাফকে রুমটা পরিষ্কার করে ফেলার জন্য বলল।

এদিকে সন্ধ্যায় অরুণিকা মন খারাপ করে বসে আছে। আহনাফ তাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”

অরুণিকা মলিন মুখে বলল,
“জানো, আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান হবে। সবাই শাড়ি পরবে, বউ সাজবে, নাচবে, ছড়া বলবে। টিচার বলেছে ওদেরকে প্রাইজ দেবে। কিন্তু আমার কাছে তো শাড়ি নেই৷ আমি শাড়ি পরতেও পারি না, ভালো করে নাচতেও পারি না৷ আমার বান্ধবীরা কত সুন্দর করে নাচতে পারে। একদম শতু আপুর মতো করে। আমি তো ছড়াও বলতে পারব না।”

“ছড়া কেন বলতে পারবে না?”

“আমি যেই ছড়াগুলো জানি, সেগুলো বাকিরা বলবে। একই ছড়া দু’জন বলতে পারবে না।”

“আচ্ছা আমি তোমার জন্য একটা ছড়া খুঁজে আনব। তুমি মন খারাপ করো না।”

“কিন্তু আমি ছড়া বলবো না৷ আমি শাড়ি পরবো। আমার কাছে একটাও শাড়ি নেই।”

“বাচ্চাদের তো শাড়ি থাকে না। তুমি বড় হলে তারপর শাড়ি পরবে, ঠিক আছে?”

“না, আমি শাড়ি পরবোই পরবো।”

ইভান ঘরে ঢুকে অরুণিকার চেঁচামেচি শুনে বলল,
“ও চিৎকার করছে কেন?”

আহনাফ পুরো ব্যাপারটা বলতেই ইভান বলল,
“এসব ঢং করতে হবে না। নাচই তো পারো না, আবার শাড়িও পরবে!”

অরুণিকা ইভানের উপর কথা বলার সাহস পায় না। ইভানের ধমকটাই কান জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর। তাই সে উঠে চলে গেলো।

পরের দিন আহনাফ শতাব্দীকে ফোন করে বাসায় আসার জন্য বললো। এরপর অরুণিকার জন্য দোকান থেকে একটা শাড়ি কিনে আনলো। বাসায় এসে অরুণিকাকে শাড়ি দিতে যাবে, তখন দেখলো অরুণিকা আগে থেকেই একটা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। তূর্য আহনাফের কাছে এসে বলল,
“টুইংকেলের জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছি। দেখ কেমন হয়েছে?”

আহনাফের হাতের প্যাকেটটা দেখে ইমন বলল,
“তোর হাতে কি?”

আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আমিও কিনে এনেছিলাম। থাক, ফের‍ত দিয়ে দেবো।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ফেরত দিতে হচ্ছে কেন? একজনের দু’টো শাড়ি থাকতেই পারে।”

তূর্য আহনাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই বেল বেজে উঠলো। আরাফ দরজা খুলে দেখলো শতাব্দী এসেছে। শতাব্দীকে দেখে অরুণিকা দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। আহনাফ বলল,
“আমি ওকে আসতে বলেছিলাম।”

তূর্য জিজ্ঞেস করল,
“তুই হঠাৎ শতাব্দীকে কেন আসতে বললি?”

“অরুকে নাচ শেখানোর জন্য।”

কথাটি শুনে অরুণিকা খুশি হয়ে বলল,
“ওয়াও, আমি নাচ শিখবো!”

অরুণিকা শতাব্দীকে টেনে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। শতাব্দী আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাইকে দেখছি না!”

ইমন বলল,
“ও তো এখনো বাসায় ফিরে নি। কিন্তু ওর তো আরো আগেই চলে আসার কথা ছিল।”

ইভান তাহমিদের ফোনে কল দিয়ে দেখলো, ফোন বন্ধ। আরাফ বলল,
“রেস্টুরেন্টে কল দিয়ে দেখ।”

ইভান সেখানে কল দিলো। ওপাশ থেকে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ফোন উঠিয়ে বলল,
“কে বলছেন?”

“আমি ইভান বলছি। তাহমিদ কি এখনো বের হয় নি?”

ওপাশ থেকে কিছু হয়তো বলা হলো, যা শুনে ইভানের মুখটা জমে গেলো। ইভানকে এর আগে কেউ এভাবে দেখে নি। তার বিচলিত চেহারা দেখে সবাই ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“কি হলো ইভান?”

ইভান ফোন কেটে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমাদের এখনই হস্পিটালে যেতে হবে। তাহমিদের অবস্থা ভালো না। ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৪৮.
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তাহমিদ যেই না ক্যাবে উঠতে গেলো, তখনই একটা মিনি মাইক্রো তার ক্যাবটাকে জোরে ধাক্কা দেয়। ক্যাবে এক পা থাকা অবস্থায় ধাক্কাটা লাগায় মাইক্রোটা ক্যাবটাকে যতোদূর টেনে নিয়ে গেছে, তাহমিদের শরীরটাকেও ক্যাবটা ততোদূর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে। ইটের রাস্তায় ঘষা খেয়ে তার মুখের বাম পাশ ছিঁড়ে গেছে। বাম হাতের অস্থি ভেঙে গেছে। পা দু’টো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে, আপতত কয়েক মাস পর দুই পায়ে ভর দিতে পারলেও, সে কখনোই বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না, জোরে হাঁটা তো অসম্ভব। প্রায় পাঁচদিন পর তাহমিদকে রিলিজ দেওয়া হলো। হাস্পাতালের পাঁচদিনের বিল, অপারেশনের খরচ আর তাহমিদের ওষুধের পেছনে তূর্যের পুরো সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। আহনাফও বাইক কেনার জন্য অনেক মাস ধরেই টাকা জমাচ্ছিলো। সেই টাকাগুলোও তাহমিদের পেছনে খরচ হয়ে গেছে।

এখন পাঁচ জনই পড়াশোনা, কাজ সব বাদ দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে তাহমিদকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এদিকে ইভান মাইক্রোবাস চালকের উপর মামলা করে এসেছিলো। এখন এই মামলা চালাতে গেলে, আর কোনো টাকাই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই শেষমেশ মামলাটা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হলো। মামলা উঠানোর পর বাসায় এসে ইভান চুপ করে বসে রইলো।

মাইক্রোবাসের চালককে তার মালিক ঝামেলায় পড়তে দেন নি। তিনি সম্মানের সাথে তার চালককে ফিরিয়ে এনেছেন, আর ইভান কিছুই করতে পারলো না। মামলা উঠানোর পর থেকেই ঘরে নিরবতা বিরাজ করছে।

অরুণিকাও এখন সেই নিরবতা বুঝতে পারছে। সে ইদানীং তাহমিদের কাজগুলো কাঁচা হাতে করার চেষ্টা করে। অরুণিকা এখন প্রতিদিন সবার কাপড় ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখে, ঘরটাও ঝাড়ু দিয়ে ফেলে। এতোদিন তাহমিদই তাকে খাইয়ে দিতো। এখন সে নিজ হাতে খায়। আবার নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেলে। তূর্য আর ইমন এসব দেখে প্রথম কয়েকদিন তাকে আটকাতে চেয়েছিল। আর নিজেরাই সেই কাজগুলো কর‍তে চেয়েছিল। কিন্তু আরাফই তাদের বারণ করেছে। যদিও অরুণিকা এখনো ছোট, কিন্তু তাকে এখন থেকেই নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হবে। কারণ আজ তাহমিদের সাথে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাল বাকিরাও যে সুস্থ থাকবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তো অরুণিকাকে একাই চলতে হবে। তাই এখন থেকেই তাকে কাজ শিখতে হবে। সংসারের কাজগুলো বুঝে নিতে হবে।

তাহমিদের পরিবর্তে এখন রান্নার কাজ আহনাফ আর আরাফ ভাগাভাগি করেই করে। মাঝে মাঝে সায়ন্তনী অথবা সুরাইয়া এসে রান্না করে দেন। আবার মাঝে মাঝে মাওশিয়াত আর শতাব্দী নিজেদের বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসে।

বিকেলে তূর্য বারান্দায় বসে ছিল। ইমন তার পাশে এসে বসলো। তূর্য ইমনকে দেখেই দুর্বল হয়ে পড়ল। সে ইমনের কোলে মাথা ফেলে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইমন তূর্যকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”

তূর্য চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“তাহমিদের জন্য খারাপ লাগছে। এখনো ও দাঁড়াতে পারছে না। হুইলচেয়ারে বসে আছে। আর ওইদিকে ওর এই অবস্থা যেই করেছে, তার কোনো শাস্তিই হলো না!”

ইমন বলল,
“এটাই তো দুর্ভাগ্য। টাকার জন্য মানুষ অনেক নিঃস্ব হয়ে যায়।”

“আমাদের পরিবারের খুনিদেরও এখনো শাস্তি হয় নি। যেখানে আমরা তাহমিদের জন্য এতোটুকু করতে পারলাম না, সেখানে সেই খুনিদের কিভাবে শাস্তি দেবো? আমরা তাদের বিরুদ্ধে কখন প্রমাণ পাবো! কখন আদালতে তাদের শাস্তির রায় হবে? আদৌ রায়টা আমাদের পক্ষে হবে কিনা, এর নিশ্চয়তা নেই।”

তূর্যের কথা শুনে পেছন থেকে ইভান বলে উঠলো,
“কে বলেছে রায় আমাদের পক্ষে হবে না? যখন রায় আমরাই দেবো, সেখানে বিপক্ষে থাকার প্রশ্নই আসে না।”

তূর্য মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকালো। ইমনও ইভানের কথা শুনে অবাক হলো। ইভান বলল,
“খুনিদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। আর তা আমি নিজ হাতে ওদের দেবো। একটা একটা করে সবাইকে খুঁজে বের করে আমিই ওদের মারবো।”

ইমন বলল,
“ভাই, তুই খুন করবি?”

“এটাকে খুন বলে না। ন্যায়বিচার বলে। হত্যার বদলে হত্যা। এটাই তো বিচার। এখনকার বিচার বিভাগের উপর আমার কোনো আস্থা নেই। তাই আমি ওদের নিজ হাতে শাস্তি দেবো। আর ওই মাইক্রোবাস চালককে আইনগতভাবে শাস্তি দিতে পারি নি তো কি হয়েছে। ওর তো আপতত শাস্তি হয়েই গেছে।”

তূর্য বলল, “মানে? কেমন শাস্তি?”

আহনাফ পেছন থেকে এসে বলল,
“হত্যার বদলে হত্যা, আঘাতের বদলে আঘাত।”

ইমন বলল,
“ভাই তোরা কথাটা এভাবে ঘোরাচ্ছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”

“আমি আর ইভান মিলে গতকাল ওই লোকটাকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছি। লোকটা যেই নতুন মাইক্রোটা চালাচ্ছিলো, সেটাও ভেঙে দিয়ে এসেছি। তার লাইসেন্সও পুড়িয়ে ফেলেছি। তার পকেটে যা টাকা ছিল, সব রাস্তায় বসা ভিক্ষুকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিয়ে চলে এসেছি। ওই লোকটা অন্তত দুই-তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”

“লোকটা তোদের দেখে নি?”

“না, আগে মুখে পিপার স্প্রে করেছি। তাই চোখ খুলতে পারে নি৷”

ইভান বলল,
“তাহমিদ যেই কষ্ট পাচ্ছে, সেটার তুলনায় এই শাস্তি খুবই নগন্য ছিল। কিন্তু তবুও এখন একটু শান্তি লাগছে।”

এদিকে শতাব্দী তাহমিদের ঘরে এসে তার পাশে বসলো। তাহমিদ কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ খুললো। শতাব্দীকে দেখে সে উঠে বসতে যাবে, তখনই শতাব্দী তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও, আমি সাহায্য করছি।”

শতাব্দী তাকে ধীরে ধীরে বসালো। তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কখন এসেছো?”

“একটু আগে।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“মিষ্টিমশাই!”

“হুম!”

তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকালো। শতাব্দী তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”

“আমাকে আর মিষ্টিমশাই ডেকো না। আমি আর মিষ্টি তৈরী করতে পারবো না।”

“মিষ্টি তো হাতে বানায়। তাহলে কেন তৈরি করতে পারবে না? ব্যথা তো তুমি পায়ে পেয়েছো। হাতে তো এখন আর তেমন ব্যথা নেই।”

“আবার ঘরে বসে মিষ্টি বানানো, তারপর হুইলচেয়ারে বসে রাস্তায় নেমে বিক্রি করা, আমি তো এমন জীবন চাইনি। একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি পেয়েছিলাম। ভালোই তো দিন কাটছিল। এখন চাকরিটাও হারিয়ে ফেলেছি।”

“তুমি অন্যের রেস্টুরেন্টে কাজ না করে, নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসো।”

“এখন আর এসব সম্ভব না।”

“অবশ্যই সম্ভব।”

“শুধু শুধু মিথ্যে আশা দিও না।”

“আমি কোনো মিথ্যে আশা দিচ্ছি না। আজকালকার সবাই অনলাইনে ব্যবসা করছে। কে বলেছে তোমাকে রাস্তায় নেমে খাবার বিক্রি করতে হবে? তুমি ঘরে বসে রান্না করবে, তারপর ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়বে। সেখান থেকেই তোমার খাবারের অর্ডার আসবে। এভাবে একদিন তুমি অনেক বড় ব্যবসায়ী হতে পারবে।”

“এসব এতটাও সহজ না। কেউ টেস্ট না করেই কেন আমার থেকে খাবার কিনবে?”

“আরেহ, টেস্ট না করেই তো সবাই অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো।”

তাহমিদ মলিন হেসে বলল,
“আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই। হুইলচেয়ারে বসে আমার আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার সাহস নেই।”

শতাব্দী তাহমিদের গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমার পাশে আছি। তোমার আকাশকুসুম স্বপ্নগুলো খুব শীঘ্রই হাতের নাগালে চলে আসবে।”

তখনই অরুণিকা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
“শতু আপু, তুমি কবে এসেছো?”

শতাব্দী হেসে বলল,
“এই তো একটু আগে। কেমন আছো সখী?”

“ভালো আছি।”

“শুনলাম, মিষ্টি মশাইয়ের ভাগের কিছু কাজ তুমিও করছো?”

অরুণিকা বিছানায় উঠে তাহমিদের পাশে বসে বলল,
“আমি সকালে উঠেই ব্রাশ করে নিজে নিজে স্কুলের ড্রেস পরি, নিজ হাতে নাস্তা করি। আরাফ এখন আর আমাকে জুতো পরিয়ে দেয় না। আমি নিজেই পরতে পারি। এরপর বাসায় এসে সব গুছিয়ে রাখি। আর তাহমিদকে দেখায়। ওর খুব পছন্দ হয়, তাই না?”

তাহমিদ হেসে বলল, “হ্যাঁ, অনেক পছন্দ হয়।”

অরুণিকা হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা ক্রিম নিয়ে তাহমিদের পায়ের কাছে এসে বসলো। শতাব্দী বলল,
“কি করছো সখী!”

“ডাক্তার বলেছে, প্রতিদিন তিন বেলা পুরো পায়ে এই ক্রিমটা লাগাতে হবে। বিশেষ করে, হাঁটুতে আর গোড়ালিতে। তারপর খুব তাড়াতাড়ি তাহমিদ হাঁটতে পারবে।”

তাহমিদ মুচকি হাসলো আর বলল,
“এই কাজটা অরুণিকা নিয়েছে। ও সময়মত আমাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। পায়ে ক্রিমটা মালিশ করে দেয়। আমাদের অরুণিকা অনেক সংসারী হয়ে গেছে।”

কিছুক্ষণ পর আহনাফ রুমে ঢুকে তাহমিদের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তখন শতাব্দী বলল,
“আমি বাসায় বলেছি, কয়েকদিন এখানে থাকবো।”

তাহমিদ আর আহনাফ অবাক হয়ে শতাব্দীর দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল, “তারপর!”

“কিন্তু মা অনুমতি দিচ্ছে না।”

আহনাফ বলল,
“অনুমতি দেওয়ার কথাও না। তুমি একা উপযুক্ত একটা মেয়ে একটা ব্যাচেলর বাসায় এসে থাকবে, এটা তো সুন্দর দেখায় না।”

অরুণিকা বলল,
“কেন সুন্দর দেখাবে না? আপু আমার সাথে থাকবে।”

“আপু তোমার বোন বা কাজিন হয় না, যে তোমার সাথে থাকতে দেবে।”

তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি এখানে কেন থাকার কথা বলেছো?”

শতাব্দী বলল
“কেন আবার? তোমার দেখাশুনা করার জন্য।”

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০||

৪৯.
দুই সপ্তাহ পর শতাব্দীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু তার মনোযোগ একটুও পড়াশুনায় নেই। সে তাহমিদের ভাবনায় ডুবে আছে। সকালে নাস্তা করেই সে তাহমিদকে দেখতে চলে গেলো। বাসায় ইমনই তাহমিদের সাথে ছিলো। শতাব্দীকে দেখে সে বলল,
“শতাব্দী, তুমি কি কয়েক ঘন্টা বাসায় থাকতে পারবে? আমি একটা কাজে বের হবো। এরপর অরুণিকাকেও স্কুল থেকে আনতে যাবো। আমি না আসা পর্যন্ত থাকবে?”

শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন থাকবো না? তুমি যাও।”

তাহমিদ তখন হুইলচেয়ারে বসে শতাব্দীর উৎসাহিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে মনে মনে ভাবছে,
“শতাব্দী আমার সাথে থাকার জন্য এতো উৎসুক হয়ে যাচ্ছে কেন? ওইদিনও বাসায় বলেছিলো, এখানে এসে থাকবে। ও কি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?”

ইমন চলে যাওয়ার পর শতাব্দী মেইন দরজা আটকে দিয়ে তাহমিদের হুইলচেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি নাস্তা করে এসেছ?”

“হ্যাঁ, তুমি খাও নি?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। শতাব্দী হুইলচেয়ারটি ঠেলে ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেলো। তারপর হুইলচেয়ার ঘেষে মেঝেতে বসে পড়লো। তাহমিদ চুপ করে আছে। শতাব্দীও কিছু বলছে না। কিন্তু এই নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে নিরবতা ভাঙলো। শতাব্দী তাহমিদের চোখের দিকে তাকালো। তাহমিদ সেই চোখের গভীরে ভিন্ন কিছু দেখে ফেলেছে, তাই সে কিছুক্ষণ পর চোখ সরিয়ে নিলো। শতাব্দী কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তোমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় একদম মন বসে না। মনটা সবসময় এখানেই পড়ে থাকে।”

তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

শতাব্দী তাহমিদের প্রশ্ন শুনে অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল,
“তোমার আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না। আমি তো একা থাকি না। আরাফ, তূর্য ওরা সবাই আমাকে দেখছে। ওদের মতো বন্ধু থাকতে আমার কিছুই হবে না।”

“শুধু কি বন্ধুরাই চিন্তা করে? আর কারো বুঝি চিন্তা হয় না!”

তাহমিদ প্রসঙ্গে পালটে বলল,
“এখন অরুণিকাও আমার যথেষ্ট যত্ন নেয়।”

শতাব্দী অভিমানী কন্ঠে বললো,
“ছোট সখীর যত্ন আর আমার যত্ন কি এক?”

তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। শতাব্দীর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ বলল, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

“কেন? এখানে কি সমস্যা? এই মিষ্টি হাওয়া কি তোমার ভালো লাগছে না?”

“না। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে।”

তাহমিদ হুইলচেয়ার চালাতে যাবে তখনই শতাব্দী পেছন থেকে হাতল ধরে বলল,
“কোথায় যাবে বলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

“আমার ঘরে।”

শতাব্দী তাহমিদকে ঘরে নিয়ে যেতেই সে উঠার চেষ্টা করতে যাবে, তখনই শতাব্দী তাকে ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

“ওয়াশরুমে যাবো।”

শতাব্দী কিছু একটা ভেবে বলল,
“কিভাবে যাবে? তুমি তো এখনো পায়ে ভর দিতে পারো না।”

তাহমিদ মনে মনে ইমনকে বকে যাচ্ছে। শতাব্দী বলল,
“আমি নিয়ে যাবো?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে শতাব্দীর দিকে তাকালো। শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। চলো আমিই নিয়ে যাচ্ছি। আমি তোমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে আসবো।”

হুইলচেয়ারটা টেনে ওয়াশরুমের কাছে আনতেই তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি রুমের দরজা বন্ধ করে বাইরে যাও।”

“কিন্তু তুমি!”

“তোমাকে যেতে বলছি, যাও।”

শতাব্দী বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদের অপেক্ষায় রুমের বাইরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার ড্রয়িংরুমে রাখা টেবিলের উপর চোখ পড়লো। কাচের টেবিলের নিচে একটা কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তাহমিদের খাবার আর ওষুধের সময়সূচি লেখা আছে। শতাব্দী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, এখন তাহমিদকে ফল কেটে দিতে হবে। সে রান্নাঘরে গিয়ে আনার, আপেল, কমলা আর আঙ্গুর সাজিয়ে একটা প্লেটে রাখলো। তাহমিদ অনেকক্ষণ পর শতাব্দীকে ডাক দিলো। শতাব্দী প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো। তাহমিদ আলমারির দিকে ইশারা করে বলল,
“উপরের তাকে আমার জামা আর প্যান্ট রাখা আছে। কিছু মনে করো না তোমাকে বিরক্ত করছি। কাপড়গুলো একটু নামিয়ে দিতে পারবে?”

শতাব্দী মুচকি হেসে এক সেট জামা নামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার তো ভালোই লাগে তুমি কোনো কাজ দিলে।”

এরপর শতাব্দী তাহমিদের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই, এখন একটু এসব বন্ধ করো। এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখতে গেলে, তোমারই কষ্ট হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছো না, সেখানেও তোমার শুচিবায়ু যায় নি!”

“পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা ঈমানের অঙ্গ। আমাকে নামাজ পড়তে হবে। তাই জামা পাল্টাবো। তারপর ওজু করবো।”

“তুমি এই অবস্থায় নামাজ পড়বে?”

“হ্যাঁ, এতোদিন সুস্থ ছিলাম, কিন্তু সিজদা দেওয়ার জন্য একটু সময় বের করতে পারি নি। আজ আমি যার রহমতে বেঁচে আছি, তাকে ভুলে থাকতে পারবো না। সেদিন আমার কিছু হয়ে গেলে, অনেক পাপ নিয়েই মরতে হতো। আল্লাহ আমাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। আমি আর তাকে অসন্তুষ্ট করবো না। এমনিতেই ছোটখাটো অনেক পাপ করি। নিজেকে পুরোপুরি শুদ্ধ করতে অনেক সময় লাগবে। অন্তত একটা ভালো কাজ করলে, কিছুটা ভারমুক্ত হবো।”

শতাব্দী মুগ্ধ হয়ে তাহমিদের কথা শুনছে। সে বলল,
“আমি তোমাকে ওজু করিয়ে দিতে পারবো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে সম্মতি দিলো। শতাব্দী এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর তাহমিদ একা একাই কাপড় পাল্টাতে লাগলো। তাহমিদের অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। শতাব্দীর তা দেখে অনেক খারাপ লাগছে। সে ইমনকে ফোন দিয়ে বলল,
“ইমন, কোথায় তুমি?”

ফোনের ওপাশ থেকে ইমন বলল,
“আমি একটা কাজে আটকে গেছি।”

“দুপুরের রান্নাও তো হয় নি। আমি তো জানতামই না এগারোটায় তাহমিদকে ফল দিতে হবে। একটু আগেই দেখলাম। আর অরুণিকার তো অনেক আগেই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ও কোথায়?”

“ও আরাফের সাথে। সামনে ইদ আসবে। রোজা রেখে ইদের কেনাকাটা করা সম্ভব না। তাই শপিং করতে গেছে।”

“এখন তাহমিদ কি খাবে না কিছু?”

“হ্যাঁ, আহনাফকে ফোন দিয়েছি। ও বাইরে থেকে খাবার নিয়ে বাসায় যাবে। ও হয়তো এখন রাস্তায় আছে।”

“বাইরে থেকে কেন আনবে? আমিই রান্না করি।”

ইমন বলল,
“না, বাসায় কিছু নেই। এই সপ্তাহে আমরা বাজার করার সময় পাই নি। আর তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? কোনো তাড়া আছে?”

শতাব্দী বলল,
“আমার সমস্যা নেই। আমি বাসায় বলেই এসেছি। তাহমিদেরই কষ্ট হচ্ছে।”

“ওর কেন কষ্ট হবে?”

“ওয়াশরুমে যাওয়া নিয়ে।”

“ওহ শিট। আমার মাথায়ও আসে নি এতোকিছু। আহনাফ আসলে ওকে এসব বলো না, প্লিজ। ও আমাকে আস্ত রাখবে না।”

“আচ্ছা।”

শতাব্দী কল কেটে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ হাঁটাহাঁটি করে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, তাহমিদ কাপড় পালটে ফেলেছে। এবার শতাব্দী রুমে এসে ফলগুলো এগিয়ে দিলো। তাহমিদও সেগুলো খেতে লাগলো। এদিকে শতাব্দী ততক্ষণে একটা চেয়ার ওয়াশরুমে রেখে তাহমিদকে সেই চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এরপর তাহমিদের কথা মতো তাকে ওজু করিয়ে দিতে লাগলো। এরপর সে হুইলচেয়ারটিও ভালোভাবে মুছে দিলো। তারপর শতাব্দী একটা জায়নামাজ মাটিতে বিছিয়ে তাহমিদকে আবার হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিলো। তাহমিদ নামাজ শুরু করে দিয়েছে। শতাব্দী এবার ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তাহমিদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলো। তাহমিদ নামাজ শেষ করার আগেই আহনাফ বাসায় চলে এলো। তারপর তিনজন একসাথে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারলো। এরপর শতাব্দী চলে গেলো।

বিকেলে আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অরুণিকা তাহমিদের সামনে এসে বলল,
“তুমি দুপুরে পায়ে ক্রিম লাগিয়েছো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, আহনাফ লাগিয়ে দিয়েছে।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি গোসল সেরে তোমাকে আমার ড্রেসগুলো দেখাবো।”

অরুণিকা চলে যেতেই তাহমিদ ভাবনায় ডুবে গেলো। তার ভাবনায় এখন শতাব্দীর বিচরণ হচ্ছে। আজ সে শতাব্দীকে যতোটা কাছে পেয়েছে, এর আগে কখনোই পায় নি। সে বুঝতে পারছে শতাব্দী তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর তার জীবনেও শতাব্দীই প্রথম মায়াবী কিশোরী। কলকাতায় আসার পর থেকে শতাব্দী ছাড়া কোনো মেয়েকে নিয়েই তার বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতি ছিলো না। বরং কোনো মেয়েই তাকে আকর্ষণ করতে পারে নি। কিন্তু এখন তার নিজেরও মনে হচ্ছে এই অনুভূতি দিনদিন গভীর হয়ে যাচ্ছে। তাহমিদ চায় না, এই অনুভূতি ভালোবাসায় রূপান্তর হোক। তার শতাব্দীর প্রতি মায়া জমে গেছে। কিন্তু এই মায়া বাড়তে থাকলে, সে কখনোই মানসিক শান্তি পাবে না। কারণ শতাব্দী অন্য ধর্মের। শতাব্দীর বাবা-মা এই সম্পর্ক কখনোই মানবেন না। আর তাহমিদও এই কাজ করতে পারবে না। বাবা-মা হারিয়ে সে প্রতিটা বাবা-মার অনুভূতি বুঝে ফেলেছে। সে চায় না কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়ে ফেলুক। তাহমিদ মনে মনে বললো,
“আমাকে শতাব্দীর কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে হবে। ওর এই বাসায় ঘনঘন আসা বন্ধ করতে হবে।”

৫০.

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়, ঠিক তেমনি ইভান প্রেম দিয়ে প্রেম তুলবে। মাওশিয়াত ইভানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইভান তার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“ইমনকে পাওয়ার জন্য এটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এখন তুমি বলতে চাইছো, আমরা এক সাথেই কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হবো। আর সেখানেই ইমনকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করবো?”

“হ্যাঁ, কারণ ইমন ওখানেই ক্লাস করছে।”

“ওকে ডান। তাহলে কাল থেকেই আমরা আমাদের নতুন মিশন শুরু করবো। মিশন ইমনকে ফিরে পাওয়া।”

মাওশিয়াত কথাটি বলেই হাসতে লাগলো। ইভানও তার সাথে হাসছে। আর তাদের একসাথে দেখে ইমন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে ইমনকে দেখে মাওশিয়াতের হাত ধরলো। মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইভান বলল,
“প্রেম দিয়ে প্রেম তোলার মিশন এই মুহূর্তেই শুরু করতে হবে। কারণ তোমার প্রিয় দূরে দাঁড়িয়ে আছে।”

মাওশিয়াত ওদিকে তাকাতে যাবে তখনই ইভান তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল,
“বোকা নাকি তুমি? তুমি ওদিকে তাকাচ্ছো কেন? ইমন ভাববে আমরা ওকে নিয়ে কথা বলছি। চলো, উলটো দিকে হাঁটি।”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে শক্ত করে ইভানের হাত ধরলো। ইভান বলল,
“এভাবে হাত চেপে ধরেছো কেন?”

মাওশিয়াত হাত আলগা করে বলল,
“উত্তেজনায় কি করবো, কি করবো না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।”

ইভান মাওশিয়াতের কথা শুনে হাসলো। আর এদিকে ইমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর সে সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে তড়িঘড়ি করে একটা বাটি মুছে কড়াই থেকে পেঁয়াজু নামিয়ে নিলো। ইমন আনমনে বসে আছে। সায়ন্তনী ইমনের হাত ধরে বলল,
“তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।”

ইমন বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় সায়ন্তনীর হাত ছাড়িয়ে নিলো। সায়ন্তনী কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। তখনই মাওশিয়াত আর ইভান সায়ন্তনীর দোকানে এলো। তাদের একসাথে দেখে সায়ন্তনী খুব অবাক হলো। মাওশিয়াত বলল,
“সায়ন্তনী, এক কাপ চা, আরেক কাপ কফি দাও।”

ইমন মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাওশিয়াত আর ইমনের চোখাচোখি হতেই মাওশিয়াত চোখ সরিয়ে ইভানের হাত ধরল। সায়ন্তনী চা বানাতে বানাতে একবার মাওশিয়াত আর ইভানের দিকে তাকালো, আরেকবার ইমনের দিকে। সায়ন্তনী মনে মনে ভাবছে,
“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”

এদিকে তূর্য অরুণিকাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। তারপর মেকাপ বক্স সামনে নিয়ে তাকে সাজিয়ে দিতে বসেছে। আহনাফ তূর্যের ঘরে এসে দেখলো, অরুণিকা আর তূর্য অনেক হাসাহাসি করছে। আহনাফকে দেখে তূর্য বলল,
“তাহমিদের এক্সিডেন্ট হওয়ায় টুইংকেল স্কুলের প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারে নি। তাই ভাবছি আজ ওর ইচ্ছেটা পূরণ করে দেব।”

আহনাফ চেয়ার টেনে বসে বলল,
“কি করবি?”

“আজ টুইংকেলকে নিয়ে শুট করবো। আমার গানটার একটা অংশে ও থাকবে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওটা তো প্রেমের গান! অরু ওই গানে কি করবে?”

“প্রেম করবে!”

অরুণিকা বলল, “বউ হবো না আমি?”

তূর্য হেসে বলল,
“অবশ্যই মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার৷ তুমি বউ হবে।”

আহনাফ বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না ওর ভিডিওটাতে কাজ কি!”

“দেখ, গানটা ছোটবেলার প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে। ওই ভিডিওর একটা অংশে টুইংকেল সেই নায়িকার ছোট বেলার অংশটাতে থাকবে।”

“ওখানে ছেলে কে হবে?”

“কোনো ছেলে থাকবে না। বাসার ছাদে একটা দোলনা লাগাবো। ওখানেই টুইংকেলের শট নেবো।”

অরুণিকা বলল,
“রকস্টার তুমি অনেক ভালো।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বললো,
“এখানে ভালো হওয়ার কি আছে!”

তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তোর এতো জ্বলছে কেন? ও আমাকে ভালো বললে তোর সমস্যা কোথায়।”

আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। তূর্য আবার বলল,
“এটা বলিস না যে, তুই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এখন থেকেই পজেজিভ হয়ে গেছিস। ওটা শুধু টুইংকেলকে ফেরত পাওয়ার একটামাত্র উপায় ছিলো।”

আহনাফ বলল,
“বাই এনি চান্স, যদি এই চুক্তি আমি ভবিষ্যতে মেনে নিতে চাই, তখন?”

তূর্য কথাটি শুনে হাসতে লাগল। আহনাফ বলল,
“হাসছিস কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”

তূর্য অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“লিটল স্টার, তুমি একটু বাইরে যাও।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে শাড়ির কুঁচি ধরে বেরিয়ে পড়ল। তূর্য বলল,
“তুই একটা সময় ওকে একদমই পছন্দ করতি না।”

“হ্যাঁ করতাম না। তুই যেভাবে জিজ্ঞেস করছিস, মনে হচ্ছে তুই খুব পছন্দ করতি!”

“অদ্ভুত! আমি তো কখনোই ওকে অপছন্দ করি নি।”

আহনাফ বসা থেকে উঠতেই তূর্য বলল,
“টুইংকেল এখন অনেক কিছুই বুঝে। ও চুক্তির ব্যাপারটা না বুঝলেও আমরা যে ওর ভাই না, এটা ও ভালো করেই জানে। এটাও বুঝে কে ওকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর যার কাছে ও গুরুত্ব পাবে, ও তার কাছেই থাকতে চাইবে।”

“হোয়ট ডু ইউ মিন, তূর্য!”

“আমি বোকা না, আহনাফ। তোর ব্যাপারগুলো আমি অনেক আগে থেকেই খেয়াল করেছি। একদম শুরু থেকেই। শুধু আমার সাথেই তোর যতো ঝামেলা। এই বাসায় সবাই টুইংকেলের সাথে কথা বলে, কিন্তু আমি কথা বলতে গেলেই তুই প্রহরীর মতো বসে থাকিস। আমি অনেক বার মজা করে বলেছি ওকে বিয়ে করবো। এই মশকরা সবাই বুঝেছে। শুধুমাত্র তুই বুঝিস নি। কেন আহনাফ!”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে তূর্যের সামনে এনে দাঁড় করালো। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য আহনাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কি করছিস তুই?”

আহনাফ বলল,
“আমি প্রহরীর মতো বসে থাকি? ওকে ফাইন, আমি আর এখানে বসে থাকবো না। আমি তো শুধু দেখতে এসেছি তোরা কি করছিস। আমার হয়তো এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে, দুঃখিত। এখন তোরা যা ইচ্ছা কর। আই ডোন্ট কেয়া’র!”

আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দেখলো তাহমিদ বিছানায় শুয়ে আছে। তাহমিদ আহনাফকে দেখে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে পাশের বেডে শুইয়ে বাতি নিভিয়ে দিলো। তাহমিদ দুই-তিনবার ডাকলো। কিন্তু সে কোনো সাড়া দিলো।

এখন আহনাফের মাথায় ঘুরছে অরুণিকা কেন তাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না? আরাফের ব্যাপারটা আলাদা। কারণ আরাফই একপ্রকার অরুণিকার বাবা-মার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তূর্য ও তো ওভাবে অরুণিকাকে সময় দেয় নি। তাদের মধ্যে আরাফ, তাহমিদ আর ইভানই অরুণিকাকে অনেক বেশি সময় দিয়েছে। অন্যদিকে তূর্য যতোটুকু সময় দেয়, তার চেয়ে বেশি সময় আহনাফ অরুণিকাকে দেয়। তবুও আহনাফের চেয়ে অরুণিকার কাছে তার রকস্টারই প্রিয়। আহনাফ এখন ভাবছে, কি করলে সে অরুণিকার কাছ থেকে আলাদা মনোযোগ পাবে, যেই মনোযোগটা এখন তূর্য পাচ্ছে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here