#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৩১
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
ঈপ্সার কিছুই ভালো লাগছে না। কেঁদে কেঁদে চোখটা খা খা করছে এখন। ঠোঁট ফেটে চৌচির। কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে ঘাড়ের ওপর। বুকের ভেতর প্রাণ পাখিটা দাপাদাপি করছে। হাঁসফাঁস লাগছে। পৃথিবীতে কি ওর জন্য বরাদ্দ বায়ু কমে এলো? নাহলে শ্বাস নিতে এত কষ্ট হয় কেন? উপলব্ধি হয় বায়ু কমেনি। দুর্জয় ওর অক্সিজেন হয়ে উঠেছে৷ যে ওর হবে না ভাবলেই শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে আসে৷
গত কয়েকদিনে কত ভাবেই না নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে ঈপ্সা। ভুলতে চেয়েছে দুর্জয় নামের কাওকে ও মন দিয়েছিল গোপনে। গোপনেই ভেঙেছে সে মন। যত জোড়াতালি দিতে চায় ভাঙা মনটা ততই বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ও যেন দেখতে পায়। ক্ষত-বিক্ষত একটা মন। কাওকে এই আঘাত বুঝাবে কী করে? সকলে ঈপ্সার বয়সের দোষ দেবে৷ বয়স কম বলেই কি ওর মনে জন্মানো এই অনুভূতি মিথ্যা? মানুষের কথা বাদ দিলো না হয় কিন্তু দুর্জয় মেনে নেবে না। বুঝবে না। ঈপ্সা কল্পনা করে ওর মুখটা। লজ্জায়, ঘৃণায় ও রাগে ঈপ্সার দিকে চেয়ে আছে। আর ভাবতে পারে না। ওর এক মন লোকলাজে ভীত আরেক মন বিরহে কাতর। তার পরেও ঘরে থাকতে পারেনি। সাহস নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল দুর্জয়ের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে। যা হয় হোক তবুও মুখোমুখি হবে দুর্জয়ের। বলবে নিজের মনের কথা, ভালোবাসার কথা। ভালোবাসা! কবে কখন হলো ওর? এখন আর সেসবে জেনেই হবে কি? যা হওয়ার তা হয়েছে। এই এখন বড়ো সত্য ঈপ্সার জীবনে৷ কিন্তু সেই সত্য বড়ো নির্মম।
লিফটের দরজা খুলতে মারিয়াকে দুর্জয়ের ফ্লাটে দেখে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। দুজন হাসছে। এতক্ষণ যেন বেহুঁশ ছিল। একটা অদৃশ্য শেল বিদ্ধ হতে চেতনা ফিরল। মরণ যন্ত্রনা ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা দেহমনে। অশ্রু ভেজা চোখে চেয়ে দেখল, দেখতে দেখতে ওর পৃথিবী ঘুরে গেল। দুর্জয়ের সাথে চোখাচোখি হলো ঠিকই কিন্তু তা আর শুভদৃষ্টি নয়। ঈপ্সা আর দাঁড়ায়নি, দাঁড়াতে পারেনি। ছুটে বেরিয়ে গেছে। পাগলের মতো দিশাহীন দৌড়াচ্ছিল। পথচারীরা থেমে থেমে দেখল। প্রশ্ন করল, থামাতে চাইল। ঈপ্সা থামল না। মেঘ গর্জে বৃষ্টি এলো। ঈপ্সা এসে উবু হয়ে বসল মায়ের কবরের পাশে। বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি হয়ে বসে বসে কাঁদল কিছুক্ষণ। সেই প্রথম টের পেল ভালোবাসলে বুকে ব্যথা হয়। খুব ব্যথা!
একসময় মনে হলো কেউ যেন ওকে দেখছে। ভয় পেয়ে বসল। এদিক-ওদিক তাকালো। কাওকে দেখল না। সেখানে আর না বসে বাড়ি ফিরল। ক্যামেলিয়া ওকে দেখামাত্রই এগিয়ে আসে। চিন্তিত ওর মুখ।
“এ কী হাল করেছ নিজের? কী হয়েছে ঈপ্সা?”
ঈপ্সার আজ আর ওর ওপর রাগ হলো না। সজল চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। পড়েই যাচ্ছিল ক্যামেলিয়া হাত ধরল। শক্ত করে ধরল ঈপ্সা ওর হাতটা। বলল,
“আমাকে একটু রুম পর্যন্ত দিয়ে আসবে?”
ক্যামেলিয়া ঈপ্সার এই দুর্বল গলার স্বরে একটু অবাকই হলো। আশাতীত ছিল এই আকুতি। মমতাডোরে জড়িয়ে ওকে রুমে নিয়ে গেল। ওয়াশরুমের ভেতর বসিয়ে শাওয়ার ছেড়ে শুকনো কাপড় নিয়ে রাখল। ঈপ্সা কাঁপছিল। চিন্তা হলো ক্যামেলিয়ার।
“তুমি ঠিক নেই ঈপ্সা। যাই ডাক্তার দুর্জয়কে একটা কল দিতে বলি।”
সাথে সাথে আগুন চোখে তাকাল ঈপ্সা।
“না, না, ওঁকে নয়।” ক্যামেলিয়া কপাল কুঁচকাতে দেওয়াল ধরে উঠে শীতল গলায় বলল,
“আমার কাওকে প্রয়োজন নেই। কাওকে ডাকবে না। ঠিক হয়ে যাব আমি। যাও তুমি এখন।”
ক্যামেলিয়া কিছু বলতে চাইল কিন্তু সাহস পেল না ঈপ্সার মুখ চেয়ে। দরজার কাছে যেতে ঈপ্সা ডাকল,
“বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু বলো না।”
ক্যামেলিয়া অবশ্যই বলবে। কিন্তু লোকটা ওকে এড়িয়ে চলছে। পরক্ষণেই সে সিদ্ধান্ত পালটে গেল ঈপ্সার কাতর গলা শুনে,
“প্লিজ!”
এরপর দুটো দিন ঈপ্সা আর রুম ছেড়ে বের হয়নি। ক্যামেলিয়া গিয়েছিল খাবার নিয়ে। বইয়ে মুখ গুঁজে পড়েছিল বিছানায় ঈপ্সা।
“খাবার রেখে যাও।” এইটুকু ছাড়া আর কোনো কথা ওর সাথে বলেনি। ক্যামেলিয়া কথা বলার চেষ্টা যে করেনি তা নয়, কিন্তু ঈপ্সা বড্ড জেদি মেয়ে। তাছাড়া ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও বুঝিয়ে দেয় ক্যামেলিয়া ওর চোখে কেবলই সৎ মা। রূপকথার সেই সুয়োরানী।
গতরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। এখনও মেঘলা আকাশ। সকালে আজ আর তাই রুটি বানালো না নিরুপমা। ভুনা খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা করবে। এহসাস বেগুন ভাজা দিয়ে খিচুড়ি খাবে না। মাংস ভুনা লাগবে তার। দেশি মুরগী ছিল ফ্রিজে। খিচুড়ি হয়ে এলে মাংসটা চড়াবে এমন সময় বাসার কলিং বেজে উঠল। ঘড়িতে বাজে সকাল আটটা। এত সকালে কে এলো? হঠাৎ মনে হলো বাড়িওয়ালা নয়ত? লোকটার আসল মতলব বুঝতে পারার পর থেকে এড়িয়ে চলছে। দেখাসাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। নিয়ম করে আগে সকালে কলিং বেল বাজাত। মা জেগে থাকলে দরজা খুলে কাজের ছুতো ধরে হয় ব্যালকনিতে, রান্নাঘরে নয়ত বাথরুমে বসে থাকে। যতক্ষণ না যেত মায়ের রুমে আসত না।
কেন যেন ওর মা বাড়িওয়ালাকে দেখতে পারে না৷ নিরুপমার আগেই বোধহয় সে লোকটার কু মতলব বুঝতে পেরেছিল বলে৷ এই অপছন্দ এক পাক্ষিক নয়। বাড়িওয়ালাও ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চায় না। এদিক সেদিক তাকিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিরুপমার মা বিড়বিড় করে গালি দেয়,
“নজর খারাপ বুইড়া খাটাস একটা! মনডা চায় ওর চোখ দুইডা গাইল্যা দি।” তারপর গলা চড়িয়ে বলে,
“ও নিরু, এই বাসায় থাকুম না আমি। নতুন বাসা দ্যাখ! খালেদা কই? ও খালেদা, তুমি একটা সুন্দর বাসার খোঁজ দিতে পারো না বা..মা?”
নিলুফা হঠাৎ অকারণেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসেন। তাঁর মাথা কি আস্তে আস্তে বেশি খারাপ হচ্ছে? ফের রাগ ওঠে মায়ের ওপর। কথায় কথায় খালেদা নামের ছদ্মবেশী ওই এহসাসের কাছে এত আবদার করে কেন ওর মা?
কলিং বেল আবার বেজে উঠতে নিরুপমা দরজায় গেল।
“কে?”
“আমি বাড়িওয়ালা। একটু কথা ছিল। দরজাটা খোলো তো নিরু।” আগের মতো চাচা বা নিরু মা বলার ভং করে না। কতটা বিকৃত এই লোক! কিন্তু নিরুপমা এখন কী করবে? মায়ের ঘুম এখনও ভাঙেনি। একবার ভাবল খুলবে না। যা ভাবে ভাবুক। কিন্তু বার বার কলিং বেল বাজাচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজনও হতে পারে। বাড়িওয়ালা বলে কথা। ভয়ও করছে। বাধ্য হয়ে দরজা সামান্য খুলে নিজেকে আড়াল করে জিজ্ঞেস করল,
“জি, চাচা বলু..”
দুহাতে দরজা ঠেলে অতর্কিতে ঘরে ঢুকে গেল জামশেদ। নিরুপমা চিৎকার করার আগেই ওর মুখ চেপে জাপটে ধরল।
“সোনা মেয়ে, হুঁশ, হুঁশ। শব্দ করে না। লোকের শুনলে মন্দ বলবে।”
নিরুপমা ছটফট করে। ছাড়িয়ে নিতে চায় নিজেকে। লোকটার গায়ে যেন অসুরের শক্তি। ওকে চেপে ধরে রেখেছে। ওর সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল।
“চাচা তোমাকে অনেক আদর করবে। কত কষ্ট করে টিউশনি করাও। মাস চালাতেও হিমশিম খাও, না? চাচা তোমার বাড়ি ভাড়া মাফ করে দেবে। যখন যা চাও তাই দেবে। বিনিময়ে চাচাকে একটু খালি আনন্দ দিবা।”
জামশেদ ওর মায়ের ঘুমন্ত মুখ চেয়ে হেসে বলে,
“বুড়িটা জেগে উঠার আগেই হয়ে যাবে। ছটফট করে না সোনা আমার। চাচা তোমাকে খুশি করবে।” এই বলে নিরুপমার ওড়নাতে হাত দেয়। কিন্তু কোথা থেকে এক কঠিন মুষ্টি এসে পড়ে ওর চোয়ালে। নিচে পড়ে যায়। ঘুরে দেখার আগেই কেউ পেছন থেকে ওর মুখটা গামছায় বেঁধে ফেলে। চিৎ করে উরুর মাঝ বরাবর লাথি দেয়। এরপর এলোপাতাড়ি লাথি আর ঘুষিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল জামশেদ। ওই একই হাত ওর মুখ ঠেসে ধরে ফ্লোরে। চিৎকার গোঙানি হয়ে মেঝেতে মিশে যায়। মারের চোটে একসময় মনে হলো মরেই যাবে। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে।
নিরুপমা থরথর করে মায়ের বিছানা ধরে কাঁপছিল। এহসাসের রাগী মূর্তি বাড়িওয়ালাকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। শয়তানটা মরে গেল না তো? এহসাসের এই হিংস্র রূপ দেখে যে কারোরই ভয় পাওয়ার কথা। নিরুপমাও পেল। ওর শিরায় শিরায় যেন রক্ত জমে গেছে ভয়ে। এহসাসকে মারতে দেখে নয়। এহসাস যদি এই বাসায় না থাকত কী হতো তাই ভেবে। বাড়িওয়ালা একা পেয়ে আজ ওকে ছিঁড়ে খেত। নিরুপমা দু’হাতে খামচে ধরল নিজের বাহু। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। ওর মা কী আয়েশে বিছানায় শুয়ে আছে! কিছুই টের পাচ্ছে না?
“নীড়, কথা বলো। এই নীড়!” নিরুপমার সাদাটে মুখ এহসাসের খুন চেপে যাওয়া রাগ ঠেলে ভয়ের জন্ম দেয়। পাজাকোলে নিজের রুমে নিয়ে যায়। বিছানায় বসিয়ে হাঁটু ভেঙে বসল ওর সামনে। দু-হাত নিলো হাতে।
“নীড়, কথা বলো। এই!”
এক হাত ওর গালে রাখতে চমকে ওঠে নিরুপমা। জ্বলন্ত বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। থাপ্পড় দিয়ে এহসাসের হাত গাল থেকে সরিয়ে পিছিয়ে যায় দূরে,
“স্পর্শ করবেন না আমাকে। ছি! ছি!”
নিরুপমা সারা গা ঝারতে লাগল। যেন নোংরা লেগে ভরে আছে৷ এহসাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। জানোয়ারটাকে ও মেরেই ফেলবে। উঠে দাঁড়াতে নিরুপমা চেঁচিয়ে উঠল,
“কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে একা রেখে কোথাও যাবেন না প্লিজ। ওই জানোয়ারটা যদি আবার আসে। প্লিজ যাবেন না এহসাস।”
নিরুপমার চোখ গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। এহসাস ফের হাঁটু ভেঙে বসল বিছানার পাশে।
“কোথাও যাচ্ছি না আমি। কিছু হবে না। কেউ আসবে না। আমি আছি তুমি শান্ত হও।”
নিরুপমা দু হাঁটু জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে রইল। একটু পর সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদে। এহসাসের এত অসহায় লাগছে!
“নীড়!”
“আমার ভয় করছে এহসাস।” অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল মুখ না তুলেই। এহসাস কাছে যেতে চেয়েও ইচ্ছেটা দমালো। বলল,
“আমি থাকতে তোমার ভয় নেই, নিরুপমা।”
নিরুপমা যেন কিছুই শুনতে পেল না। একমনে বলে গেল,
“একটু পর সবাই এই ঘটনা জেনে যাবে। এই সমাজে সব দোষ মেয়েদেরই হয়। আমাকেও দোষ দেবে ওরা এহসাস। কলঙ্ক দেবে৷ কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি। কিছু না করেও ভয়ে মরে যাচ্ছি। আমাকে ওরা ছাড়বে না এহসাস। আ..আপনাকেও ছাড়বে না। আপনি পালিয়ে যান। আর আ..মি! আমি কী করব? কোথায় যাব?”
চলবে,,,