অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -৩৩

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৩৩
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

জামশেদকে নিখোঁজ করার দুদিন পরও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য উঠল না। নিরুপমার ভয়ে ঘুম হয়নি ঠিকমতো। সারাক্ষণই আতঙ্কে ছিল, এই বুঝি বাড়িওয়ালির আর্তনাদ শুনতে পায়, পুলিশ আসে। কিন্তু কিছুই ঘটেনি। যেন সব স্বাভাবিক। স্বামীর থাকা না থাকাতে মহিলার কিছু এসে যায় না। না হলে তার অনুপস্থিতিতে এত নীরব কেন হবে? এহসাসের কি হাত আছে এতেও? কথাটা তোলার আগেই নিরুপমাকে একপ্রকার হুকুম করে নিচতলায় পাঠাল ও। আপাতত এ বাসা ছেড়ে যাওয়ার প্লানটা সফল করতে হবে। মাসের মাঝামাঝি বাসা ছাড়ার নিয়ম নেই। জামশেদের স্ত্রী নিরুপমাকে দেখে ভুরু কুঁচকাল। ভাড়া নেওয়ার প্রথম প্রথম যে আতিথ্য, সদয় আচরণ পেয়েছে এখন তা আর পায় না। হয়তো পুরানো হয়ে গেলে সবখানেই অবহেলা আর অবজ্ঞা চলে আসে। নিরুপমা ভয় গিলে বাসা ছাড়ার কথাটা তুলতে বাড়িওয়ালির মুখে আঁধার নেমে এলো।

“মাসের মাঝখানে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। এক তারিখ থেকে পাঁচ তারিখের মধ্যে বলতে হবে। উঠার আগে এমনই কথা হয়েছিল। হয় দু মাস থেকে যাবে নয়ত দু মাসের ভাড়া দিয়ে তারপর চলে যাও।”

“দু মাস থাকলে আমার যে বড্ড ক্ষতি হয়ে যায় আন্টি। অনেক ঝুট-ঝামেলা করে পৈতৃক ভিটার কিছু অংশ ভাগে পেয়েছি। যাদের সাহায্যে পেয়েছি তারাই পরামর্শ দিয়েছে দ্রুত সেটা দখলে নিতে। দু মাস পরে গেলে ঘর বাড়ি তুলে জায়গা দখল করে নিতে বাধবে না আমার সৎ ভাইয়ের।”

নিরুপমার হাত কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা বলতে গিয়ে। পাছে বাড়িওয়ালি না সন্দেহ করে!

“ওসব তো আমার দেখার কথা নয়। থাকতে না পারলে দু মাসের ভাড়া দিয়ে তারপর যাও। কেউ বাধা দেবে না। নয়তো দু মাসই থেকে ভাড়া মিটিয়ে তবেই যেতে পারবে।”

বাড়িওয়ালি ঝগড়ার মুখ নিয়ে বসে রইল। তার চেহারাটা মেয়ে মানুষের মতো নরম না। জামশেদের শরীরের তুলনায় তিনি বেশ ভারি। নিরুপমা শুনেছে স্বামীকে খুব একটা মূল্য দেন না। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার সব। সেই মেয়েটি হাসপাতাল থেকে ফিরে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। বাসার বাইরে দেখা মেলে না। সারাক্ষণ মনে হয় ঘরেই থাকে। ঘরটা থমথমে। আগেও এসেছিল কিন্তু এতটা গম্ভীর লাগেনি।
নিরুপমা এমনিতেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। কিন্তু উপরে উপরে কিছুক্ষণ এমন ভাব করল যেন সে মানবেই না কথাগুলো। ঝগড়া ওর দ্বারা হবে না। এহসাস বলেছিল একটু ঝগড়াঝাটি করতে পারলে সন্দেহ হতো না আবার বাসা ছাড়তে সুবিধা। দেখা গেল বাড়িওয়ালি রেগেমেগে বলে ফেললো,”এক্ষুনি আমার বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি।” কোনো সন্দেহ ছাড়ায় ওরা চলে যেতে পারত। কিন্তু সেটা সহজ না। নিরুপমা এই রাগী মূর্তি মহিলার সাথে ঝগড়া করার কথা ভাবতে ফের ঢোক গিললো। ওকে এক হাতে অনায়াসে আছড়ে মারতে পারবে। কোনো ভাবে যদি টের পায় তার স্বামীর সাথে কী ঘটেছে তবে আর রেহায় নেই। অগত্যা বিনয়ের সাথে অনুরোধ করল কয়েকবার। বাড়িওয়ালি মানে না। তার রাগ হচ্ছে নিরুপমার বার বার করা অনুরোধে। নিরুপমা এবার হতাশ হওয়ার ভান করে উঠল। এহসাস বলেছে তখনই কিছু বলতে না।
নিরুপমা সোজা দোতলায় চলে এলো। বিদ্যুৎ নেই। চার্জার ফ্যান ছেড়ে চোখ বুঁজে আছে ওর মা। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে প্রশান্তির রেখা। এ ঘর নানান অপ্রয়োজনীয় ও মায়ের বিলাসিতার জিনিসে সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। সব এহসাসের দেওয়া। ওর মায়ের পরনের সবুজ কারুকাজের জামদানিটাও। কাপড়টা বেশ দামি। নিরুপমা ছুঁয়েই বুঝে গিয়েছিল। নিরুপমার মা বরাবরই সৌখিন। সব সময়ে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। স্বামী বেঁচে থাকতে তাঁর ঠোঁট থেকে লিপস্টিক মোছেনি কোনোদিন, কাজল ওঠেনি। বৈধব্য, পক্ষাঘাত তাঁর জীবনের রঙ ফিকে করে দিয়েছিল। আজ অনেকদিন পরে মাকে পুরোনো রূপে দেখে ওর ভালো লাগল। এই ভালো লাগার কৃতিত্ব কার? সৈয়দ এহসাস আরমানের। ওর মায়ের সাধ-আহ্লাদের, ইচ্ছা পূরণের জাদুর মানুষ। যাকে এই তো কদিন আগেও ভীষণ অপছন্দ করত ও। যার ছায়া পর্যন্ত ঘেঁষতে রাজি ছিল না। তাড়াতে গিয়ে নিজের নীতি নৈতিকতার বিপক্ষে গিয়েছে। সেই নিরুপমার দুঃসময়ে ঢাল হয়ে দাঁড়াল। শক্তি দিলো, সাহস দিলো, ভরসা হলো। নিরুপমা নিঃশব্দে ও রুমের ভেজানো দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। এহসাস মুঠো ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। কপালের দুপাশ টিপছে। বিরক্ত হচ্ছে। নিরুপমা ভেতরে ঢুকতে শুনল।

“নানু, আমি ঠিক আছি। প্লিজ থামো তুমি।”

“ওহ! নানু!” নিরুপমা বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলল। এহসাস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এক পলক। নিরুপমা ওর ওই দৃষ্টির সামনে জড়োসড়ো হয়ে গেল।

“আদরূপকে এসবে জড়াতে যেয়ো না। ও আমাকে বাঁচানোর বদলে ফাঁসির কাষ্ঠে উঠিয়ে দিয়ে আসবে। এসব বলছি কেন? তোমার ওই তার ছেঁড়া সাইকো নাতিকে আমার বিশ্বাস নেই। ও আমাকে শত্রু ভাবে। আমার ক্ষতি হলেই খুশি হয়।”

একটু থামল। দৃষ্টি আগের স্থানে সরিয়ে বলল,

“সাইকোকে সাইকোই বলে মানুষ নানু। তুমি কাঁদবে না। আচ্ছা বলছি না সাইকো ওকে। পৃথিবীর সেরা ভালো লোক তোমার নাতনি। আবার কেন কাঁদছ? বললাম তো ঠিক আছি। হ্যাঁ, শীঘ্রই দেখা করতে আসব। লক্ষী মেয়ের মতো কান্না বন্ধ করো। এই তো আমার সুন্দরী নানুটা। আচ্ছা ঠিক মতো ওষুধ খেয়ো। হ্যাঁ, বললাম তো শীঘ্রই আসব। ভালো থেকো।” কল ছাড়তে একটু আগের সহজ মুখে কাঠিন্য এলো। নিরুপমা এগিয়ে এলো আস্তে আস্তে। কী ভাবে কথা শুরু করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলে ফেললো।

“নানুকে খুব ভালোবাসেন?”

এহসাস তাকাল না৷ মোবাইলটা হাতে চেপে রইল। নিরুপমা এই সুযোগে ওকে দেখছে। আজকাল নিয়ম করে শেভ করে। শেভ নয় ট্রিম করে। তাতেই ধারালো চোয়ালের কাঠিন্য চোখে ধরা পড়ল। উন্নত নাসিকা, বড়ো বড়ো চোখের ওপর ঘন কালো সরু ভুরু যুগল।মাথার কালো চুলগুলো ঘাড়ে নেতানো। সামান্য কার্লি। ওর কপালে সব সময়ই কয়েক গুচ্ছ অবাধ্য চুল লুটোপুটি খায়। আজ মনে হলো, এহসাসের মতো সুন্দর পুরুষ ও জীবনে দেখেনি। নিরুপমার দৃষ্টি নিচে নামে। একটার সাথে আরেকটা এঁটে থাকা ঠোঁটে। ওর দৃষ্টি থমকে যায় কিছুক্ষণের জন্য। শিহরণ জাগে। দৃষ্টি সরায়। বন্ধ করে। এলোমেলো কিছু অনুভূতি ঝড়ো হাওয়ার মতো ওর ভেতর-বাইরের আঙিনায় দোলা দিয়ে যায়। নিরুপমা বিব্রত হয়, ভীতও। এতদিন ভয়টাকে সামনে আনত না। আজকাল খুব বেশি আসছে। নিরুপমার কী সতর্ক হওয়া উচিত না?

“কথা বলেছিল বাড়িওয়ালির সাথে?”

“হুঁ?” এহসাসের রুক্ষ স্বরে খানিক চমকে উঠল অন্যমনস্কতার কারণে। এহসাস ভুরু যুগল এক করতে নিরুপমা বলল,

“জি।” তারপর সব কথা বলল এহসাসের সামনে। বিছানা ছেড়ে উঠে সিগারেট ধরাল ও। ধোঁয়া উড়িয়ে বলল,

“কাল দু’মাসের টাকা দিয়ে না করে এসো। চিন্তা নেই। শিখিয়ে দেবো কী বলতে হবে। আমজাদ নতুন বাসা পেয়েছে। কিন্তু… ”

“অত টাকা কোথায় পাব? নতুন বাসাটার ভাড়া কেমন? আমার সার্মথ্যের মধ্যে থাকবে তো?”

এহসাস সিগারেট কামড়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর দু’আঙ্গুলে সেটা নিয়ে বলল,

“তুমি বলেছিলে আমি যা বলব তাই করবে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু.. ”

“কোনো কিন্তু না। আপাতত ভাবনা চিন্তার ফাংশনটাকে রেস্ট দিয়ে আমার কথামতো চলবে। কোনো প্রশ্ন করবে না।”

নিরুপমা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল,

“টাকাগুলো আপনি দেবেন? ওই বাসা ভাড়াও? কতদিন?”

“কতদিন? এত হিসাব করে চলো কেন বুঝি না। মানুষের জীবনের কোনো গ্যারান্টি আছে? আজ আছি তো কাল নেই। দিন-তারিখের হিসাব রাখা বোকামি। যেভাবে চলছে চলতে দাও।”

“আপনার জন্য এসব বলা সহজ।” ক্ষোভ ঝরে নিরুপমার কণ্ঠে। এহসাস ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। সিগারেট ধরা হাতটা নিরুপমার সামনে নাড়িয়ে বলে,

“করানোও সহজ হবে৷ হতেই হবে।” নিকোটিনের গন্ধে নিরুপমা নাক কুঁচকাতে এহসাস ওটা সামনে নিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল,

“এখনও এই গন্ধে অভ্যস্ত হতে পারলে না?”

আর কত অভ্যস্ত হবে নিরুপমা? এত কাছে গন্ধটা পেয়েও পেট গোলাচ্ছে না। নড়ল না। অপছন্দ করে পৃথিবীময় জিনিসটার নিষিদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে মনে মনে প্রকাশ করল না। কিন্তু পুরোপুরি সয়ে উঠতে পারেনি এটা ঠিক। সময়ে সেটাও সয়ে যাবে৷ কিন্তু কেন সইবে? সইবে না।

“এমন বিশ্রী গন্ধে অভ্যস্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।” বলল নিরুপমা। ঘুরে খাটের অপরপাশে এলো। রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই ভালো হয়। কিন্তু নিরুপমা গেল না। এহসাস হাসল শব্দহীন। তারপর নিরুপমাকে বোবা করে দিয়ে একটা প্রশ্ন করে বসল,

“আমাতে অভ্যস্ত হতে পারলে?”

চলবে,,,

এই পর্ব অল্প হয়ে গেল। আসলে সময়ের অভাবে লেখা হচ্ছে না৷ আজ একটু সময় পেলাম লিখে ফেললাম। পরবর্তীতে বড়ো করার চেষ্টা করব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here