#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৩২
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
আজ শুক্রবার। দুপক্ষের ঘনিষ্ঠ ক’জন আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে দুর্জয় ও মারিয়ার বাগদান। পাত্র সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে রুমে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। ভেতরে ভেতরে ছটফটানি। এই আয়োজন, এত লোক ওর ফ্লাটের দেওয়ালগুলোকে যেন সংকীর্ণ করে ফেলছে। কাঁপা হাতে ড্রয়ারটা খুলে সিগারেট বের করল। আগুন জ্বালিয়ে ঠোঁটে গুঁজল। বহুদিন হয় এটা ও ছোঁয়নি। আজকাল আগের মতো নেই কিছু। দুর্জয় নিজেকে চিনতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। রুমের দরজা হাট করে খুলে গেল। ওর বোন দিলনাজ মলিন মুখে দরজায় দাঁড়াল। এ বিয়েতে ওর মত নেই। কেন নেই জিজ্ঞেস করেনি দুর্জয়।
“তোর বউকে তো পাওয়া যাচ্ছে না। তার বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজনের নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছে সে। তুই কিছু জানিস?” বলল দিলনাজ। দুর্জয় বলল,
“বোধহয় অন ডিউটিতে আছে। ও খুব সময় মেনে চলে। দেখবি ঠিক টাইমে চলে আসবে।”
“তুই তো সিগারেট খাস না৷ হঠাৎ এ বিশ্রী অভ্যাস কবে থেকে হলো?” দিলনাজ দরজা ভিজিয়ে বিছানায় এসে বসল। দুর্জয় খুব লজ্জিত হলো। সিগারেট ফেলতে গেলে দিলনাজ বাধা দিলো,
“ফেলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি আজ ওটা তোর ভীষণ প্রয়োজন।”
“ভীষণ প্রয়োজন বলতে কী বুঝাচ্ছিস?”
সিগারেট ফেলে দিলো দুর্জয়। জেনে-বুঝে বোনের সামনে এমন অশোভন আচরণ ও কখনোই করবে না।
“কিছু না। ওহ! আরেকটা কথা। ইকরাম আঙ্কেল আসতে পারবেন না। কী একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে গেছেন তিনি।”
“ওহ!”
“তিনি না আসলেও অন্তত ঈপ্সাটা তো আসতে পারত? মা কতবার যে ওর নাম নিলো এসে অব্দি। পাষাণ মেয়ে একটা! ঢাকা এসেছি জানার পরও একটা খবর নিলো না। দেখা হোক আচ্ছা মতো মারব দেখিস।”
দুর্জয়ের গলা দিয়ে ওহ শব্দটাও বের হলো না এবার।
“আচ্ছা আমি যাই। তুই তোর বউকে কল করে তাড়াতাড়ি আসতে বল।”
দিলনাজ উঠে কয়েক পা এগোতে দুর্জয় বলল,
“তুই এই বিয়েতে খুশি না, তাই না নাজ?”
দিলনাজ ফিরল ভাইয়ের দিকে।
“যদি বলি না তবে কি বাগদান ক্যান্সেল করবি?”
“মারিয়া ভালো মেয়ে। তোকে আদর করবে। বাবা-মাকে কখনো বিরূপ চোখে দেখবে না।”
হঠাৎ দিলনাজের চোখ ভরে ওঠে জলে। দুর্জয় আর্ত মুখে এগিয়ে এলো। বোনের মুখটা আঁজলা ভরে তোলে। দিলনাজ বলল,
“তুই ওকে বিয়ে করিস না ভাই। মারিয়া আপুকে আমার অপছন্দ না। কিন্তু ভাবি হিসেবে ও আমার পছন্দ না ভাই।”
কাকে পছন্দ এই প্রশ্ন করার দুঃসাহস দুর্জয় করল না। মৃদু হেসে বোনের চোখ মুছে বলল,
“পাগলি একটা! বিয়েটা হোক তারপর দেখবি মারিয়া ভাবি হিসেবে তোর পছন্দের এক নাম্বারে থাকবে।”
ভাইয়ের হাত ঠেলে সরিয়ে দেয় রাগে।
“তুই কিছুই বুঝিস না। ঘোড়ার ডিমের ডাক্তার হয়েছিস।” ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে যায় দিলনাজ। দুর্জয় আস্তে আস্তে গিয়ে বিছানায় বসে। বিড়বিড় করে বলে,
“কিছু না বুঝতে পারলেই যে শান্তি হতো নাজ।”
একটু পর বাইরে হৈচৈ উঠল। কী হয়েছে জানতে উঠে দাঁড়ায় দুর্জয়। তখনই বেড সাইডে রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। মারিয়ার নাম ভাসছে স্ক্রিনে।
“হোয়ার আর ইউ মারিয়া?”
“অলরেডি মিস মি উডবি?”
“ম্যারি!”
“আ’ম সরি দুর্জয়, বিয়েটা করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”
দুর্জয় চুপ করে রইল। পাশ থেকে কারো ফুপানোর শব্দ ভেসে আসছে। মারিয়া বলল,
“জানতে চাইলে না কেন?”
“কী দরকার? তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত। তাই বলে নিজের খামখেয়ালিপনায় আপনজনদের হেনস্তা করা অনুচিত। তোমার কাছে আশা করিনি এমন কিছু ম্যারি। রাখছি।” কল কেটে দেবে সেই মুহূর্তে মারিয়া বলল,
“একটু দেখা করতে পারবে?”
“আবার কেন?”
“দেখা করলেই বুঝতে পারবে। অপেক্ষা করছি। ওহ! দেখা করার কথাটা কাওকে বলো না।” মারিয়া দেখা করার স্থান বলে কল ছাড়ল।
এই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না দুর্জয়ের জন্য। মারিয়ার পরিবারের লোক এক প্রকার রাগ করে বেরিয়ে গেছে। রাগটা অবশ্য দুর্জয়দের ওপর না, নিজের মেয়ের স্বেচ্ছাচারিতার ওপর। দুর্জয়ের নিজের পরিবারের লোকজনও নাখোশ। কিন্তু ওর মারিয়ার ওপর রাগ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঠিকই হয়েছে। ও যা পারেনি মারিয়া পেরেছে। এখানেই মারিয়ার সাথে ওর পার্থক্য। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করে না। হঠাৎ ওর মন কী কারণে বিরোধী হলো?
গাড়ি নিলো না। পায়ে হেঁটে চললো। বেশিদূর নয় গন্তব্য। খোলা হাওয়ায় হাঁটতে ওর ভালোই লাগছে। ভেতরের অস্থিরতা একটুও টের পাচ্ছে না। বড্ড হালকা লাগছে। মারিয়ার বলা সেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে মিনিট বিশেক লাগল। এককোণে নিরিবিলি বসে আছে মারিয়া। এদিকেই মুখ। ওকে দেখে কফির কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। মুচকি হাসল। দুর্জয় হাসল না। টেবিলের কাছাকাছি যেতে দুর্জয়ের পা থমকে গেল। মারিয়া একা নয়। সাথে আরেকজন আছে। পিঠ ওর দিক করে বসা। মাথা গুঁজে আছে। দুর্জয়ের বুক ঢিপঢিপ করছে। ঢোক গিললো বার কয়েক।
“এসো দুর্জয়। বসো।” দুর্জয় দৃষ্টি সরালো না সামনের মেয়েটির ওপর থেকে। ধীর পায়ে মেয়েটির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। ওই আনত মুখ দেখে ওর সর্বাঙ্গ ঝংকৃত হয়ে জমে যায়।
“ঈপ্সা!”
ঈপ্সা চোখ তোলে না। কিন্তু ওর চোখ গড়িয়ে নিচে পড়া অশ্রু দুর্জয় দেখতে পায়। অনেক কিছু হয়। দুর্জয় বর্ণনা করতে পারে না। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে কেবল দেখে।
“বসো দুর্জয়।”
“ও এখানে কী করছে? খবরদার বলো না বাগদান ক্যান্সেল করার কারণ ও। এখানে কী করছ তুমি ঈপ্সা?” আচমকা মেঘ ডেকে উঠলে যেমন চমকে যায় মানুষ। দুর্জয়ের কঠোর স্বরে ঈপ্সাও তেমনই চমকে গেল।
“ধমকাবে না ওকে দুর্জয়। ওর কোনো দোষ নেই।” বলল মারিয়া। দুর্জয় ফের ওকে উপেক্ষা করল।
“আমি কিছু জানতে চেয়েছি ঈপ্সা। আমাকে বাধ্য করো না সৈয়দ সাহেবকে কল করতে।”
“দুর্জয়! স্টপ ইট। লোকে দেখছে।” মারিয়া দুর্জয়ের বাহু চেপে ধরতে ঈপ্সা তাকায় সেদিকে। দুর্জয়ের মুখ লাল হয়ে আছে। কীসে কে জানে? মারিয়া এই দুর্জয়কে কোনোদিন দেখেনি। মারিয়ার হাত থেকে বাহু ছাড়িয়ে ঈপ্সার দিকে এগিয়ে যায়। লোক লাজের ভয় গিলে খেয়েছে দুর্জয়।
“স্ট্যান্ড আপ!
ঈপ্সা দাঁড়ায়। ওর মাথাটা দুর্জয়ের বুক বরাবর। ঈপ্সা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সেই শুভ্র বস্ত্রে। থম ধরে রইল দুর্জয়। ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন থাকে। মারিয়ার মনে হলো ঈপ্সাকে গিলে খেতে চাইছে ও। সন্দেহ তো আগেই হয়েছিল। বিয়েতে রাজি হওয়ার কারণ ছিল দুর্জয়কে স্বীকার করানো। একরোখা, পাষাণ পাথর। ভাঙতেই পারল না মারিয়া ওকে। স্বীকার না করলে মারিয়া হয়তো ওকে বিয়ে করলেও করত। কিন্তু ঈপ্সাকে দুর্জয়ের ফ্লাটের সামনে বিধ্বস্ত বেশে দেখে সেই ইচ্ছে একেবারে মরে গেছে। ও কারো জীবনের ভিলেন হতে চায় না।
“আমি ট্যাক্সি ঠিক করে দিচ্ছি তুমি বাসায় ফিরে যাবে।” দুর্জয় কঠিন গলায় বলতে ঈপ্সা চোখ তোলে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“না।”
“না?”
“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ো না ঈপ্সা।”
“নয়ত কী করবেন? তিল তিল করে মরছি। একেবারে মেরে ফেলবেন? তাই করুন। শেষ করে ফেলুন। আমি আর পারছি না। আপনাকে ভালোবেসে এভাবে মরতে হবে জানলে কোনোদিন বাসতাম না। কিন্তু মনের ওপর কার ক্ষমতা চলে বলুন? আপনি পাষাণ, পাথর, আপনাকে পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার সমতুল্য জেনেও সে ভালোবেসেছে।”
দুর্জয়ের ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে হাসি পেল মারিয়ার। যদিও চোখ পর্যন্ত সে হাসি পৌছাল না। এখানে ওর আর দরকার নেই। নীরবে সরে গেল। দুর্জয় অনেকক্ষণ পর স্বর ফিরে পেল। কিন্তু এক নাম ছাড়া বলতে আর পারল কই কিছু।
“ঈপ্সা!”
ঈপ্সা নাক টেনে কাঁদছে।
“জানি, এখন লেকচার দেবেন এসব আমার বাচ্চামো। বয়সের দোষ। অল্প বয়সের আবেগ। সময়ের সাথে যা থাকবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি।” ঈপ্সা শরম, সংকোচ, ভয় বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যায়। এত কাছাকাছি কোনোদিন ওরা দাঁড়ায়নি। দুর্জয় সরতে গেলে ঈপ্সা ওর পাঞ্জাবি খামচে ধরে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে ঈপ্সার।
“আপনাকে আমার চাই দুর্জয় আহমেদ। একান্ত আমার করে। বাচ্চামো, পাগলামি, অতি আবেগ যা ইচ্ছে হয় ভাবুন। সময়ে পৃথিবী বদলে যাবে কিন্তু আপনার জন্য আমার ভালোবাসা বদলাবে না। এই ঈপ্সা আপনাকে সত্যি ভালোবাসে। একবার ওর ভালোবাসায় বিশ্বাস করে দেখুন না।”
“আমার পাঞ্জাবি ছাড়ো ঈপ্সা।” দুর্জয়ের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে পড়ে ঈপ্সার মুখে। ধমক দিতে গিয়েও ধমক আর হলো না। ঈপ্সা মুষ্টি আরও শক্ত করল।
“আগে বলুন আপনি আমার হবেন।”
“তুমি আবেগ দিয়ে সবকিছু ভাবছো।”
“আবেগ আছে বলেই আমি আপনি বেঁচে আছি। পৃথিবী জীবন্ত, এত সুন্দর।”
“পৃথিবীর রূঢ়তা তুমি কল্পনা করতে পারছ না সেই আবেগের মোহে। তোমার আমার সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না। তোমার বাবা-ভাইয়েরা মেরে ফেলবে আমাকে।”
“এত ভিতু কেন আপনি?”
“আমি এমনই ঈপ্সা। আমাকে ভালোবেসে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবে না তুমি। ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তোমার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ। বাসায় ফিরে যাও। আজকের কথা ভুলে যাব দুজনে।”
“না, কিছুই ভুলব না আমি। না ভুলতে দেবো।”
“ভুল করছো তুমি ঈপ্সা। পস্তাবে। প্লিজ ছাড়ো আমাকে।”
“আমাকে আজ কোনো ভয়েই ভীত করতে পারবেন না। বলুন আপনি আমার হবেন।”
“অসম্ভব।” ঈপ্সার বুক মুচড়ে ওঠে। খামচে ধরে দুর্জয়ের বুক।
“অসম্ভব? আপনি আমাকে চেনেন না দুর্জয় আহমেদ। এই ঈপ্সা আপনাকে চেয়েছে। আপনাকে হাসিল করেই দম নেবে। তা না পারলে দম আজীবনের জন্য বন্ধ করে ফেলবে।”
ঈপ্সা ওর পাঞ্জাবি ছেড়ে আহত মুখে সরে যায়। দুর্জয় বলে,
“তুমি পাগলামি করছো ঈপ্সা।”
“কারণ আমি পাগল হয়ে গেছি! আপনি অন্যের হবেন জেনে মাথার বোধবুদ্ধির তার ছিঁড়ে গেছে আমার। কেন বুঝতে চাচ্ছেন না?”
“আমি কারো হচ্ছি না। মারিয়া ক্যান্সেল করে দিয়েছে সব।”
“কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে?”
“কী বললে?”
“মারিয়া ক্যান্সেল করেছে আপনি তো করেননি? দুদিন পর আরেক মারিয়া আসবে আপনার জীবনে। সে ক্যান্সেল করবে না। হ্যাবলার মতো তাকে ঠিকই বিয়ে করে নেবেন। তারপর আমি কী করব? আপনার বিরহে মাথার সব তার ছিঁড়ে পথে পথে পাগলিনী বেশে ঘুরব?”
“কাওকে বিয়ে করব না আমি হ্যাবলার মতো। কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবো না। চিরকুমার থাকব। খুশি?” দাঁত কামড়ে বলল দুর্জয়।
“আমি ছাড়া কাওকে না। চিরকুমার! হুঁ! সে সময়ে দেখা যাবে।” হাত বাড়িয়ে বলল,”যা হোক, ওয়াদা করুন অন্য কাওকে বিয়ে করবেন না।”
“আর ইউ সিরিয়াস!” বিড়বিড় করে বলে ঈপ্সার হাত ঠেলে বলে,
“ওয়াদা।”
ঈপ্সা এতক্ষণে হাসল। চোখ মুছে বলল,
“ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই আর… আপাতত এগুলোই অর্ডার করুন। গত পরশু থেকে একপ্রকার না খাওয়া। খিদের চোটে মাথা ঘুরছে। চোখে আপনি ছাড়া কিছুই দেখছি না।” চেয়ারে বসে সামনে রাখা জুসের স্ট্র ঠোঁটে গুঁজল। দুর্জয় মুচকি হাসল। অর্ডার করে বসল ওর সামনে। ঈপ্সা সত্যি শুকিয়ে গেছে। খারাপ লাগল খুব। জুস শেষ করে তাকাল ওর দিকে ঈপ্সা। লজ্জা খেলে গেল চাহনিতে। কী দুঃসাহসের কাজই না করেছে আজ।বিজয়িনী বিজয়িনী মনে হচ্ছে নিজেকে।
মাঝ রাতে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বের হলো এহসাস। পেছনে নিরুপমা। ওর আসার প্রয়োজন ছিল না। তবুও এলো জোর করে। জামশেদের অচেতন শরীর হুইল চেয়ারে বসানো। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে তার মধ্যে চেতনা নেই। সারাদিনে টর্চারও তো কম হয়নি। ঠোঁট ফোলা, চোখ ফুলে কালো হয়ে আছে। হাতের পাঞ্জা থেতলানো। দেখে চেনার উপায় নেই। এই সবকিছু করেছে এহসাস। নিরুপমা মনে মনে এহসাসকে আগের চাইতে বেশি ভয় করে। কী ভয়ংকর রাগী, নির্দয়! তবে খারাপ ভয় না হয়তো। কিন্তু ভরসাও করছে। নিরুপমার জন্য এতবড় ঝুকিপূর্ণ কাজটা করতে যাচ্ছে। এমনিতেই পাশা হকের টার্গেট হয়ে আছে। জামশেদের কারণে বিপদ আরও বাড়ল। কিন্তু ভয়-ডরের বালাই নেই ওর মধ্যে।
খুব সাবধানে শব্দ না করে নেমেছে ওরা। রাস্তা ফাঁকা। দু একটা কুকুর শুয়ে আছে। একবার নড়েচড়ে ওদের দেখে ঘাড় নামিয়ে নিলো। নিরুপমা ভয় পেয়েছিল ডেকে না ওঠে। ডেকে উঠল না। উবু অবস্থায় মাথা মাটিতে লাগিয়ে জড়ানো চোখে ওদের চলে যেতে দেখল।
গাড়িটা একটু দূরেই পার্ক করা। কাছে যেতে আজমল বেরিয়ে এলো। জামশেদকে শিকারি চোখে দেখে বস্তা তোলার মতো তুলে গাড়ির ডিঁকিতে তুললো।
“আমি না বলা পর্যন্ত ও যেন জনসমক্ষে না আসে।” আদেশ করল এহসাস। আজমল বাধ্য লোকের মতো মাথা নাড়িয়ে হুকুম তামিল করে।
“এখন যা। আর শোন, এই সপ্তাহে বনানীতে দু রুমের নতুন বাসা খুঁজে বের করবি। এখানে ওরা নিরাপদ না।”
“মনসুর ভাই জরুরি দেখা করতে চেয়েছেন আগামীকাল। কী বলব তাকে?” জানতে চাইল আজমল। এহসাস বিরক্ত মুখে বলল,
“কাল না। আমি পরে সময় বলে দেবো।”
আজমল বিদায় হতে নিরুপমা বলল,
“আগামী সপ্তাহে বাসা ছাড়া হবে না। বাড়িওয়ালি মানবে না।”
“আমার কথামতো কাজ করলে ঠিকই মানবে। এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবে তুমি। স্বাভাবিক হও।”
“কী?”
“তোমার হাত কাঁপছে। কথা বলতে গিয়ে বার বার ঢোক গিলছো। এসব করা চলবে না। নিজেকে বিশ্বাস করাও কিছু ঘটেনি। জামশেদ নামে কেউ তোমার জীবনে এক্সিট করত না। বি নরমাল।”
“বলা সহজ।”
“করাও সহজ। জেলে যেতে না চাইলে, সমাজে কলঙ্কিত হতে না চাইলে বলার মতোই সহজ করতে হবে সব।”
নিরুপমা আর কথা বাড়াল না। ভুল তো বলেনি এহসাস। কিন্তু ওর ভয়ই কাটছে না। এখনও গতকালের কথা ভাবলে গা শিউরে উঠছে। জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে। গা ঘিন ঘিন করছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শাওয়ারের নিচে বসে ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ঘৃণ্য মানুষটা এখন ওর কাছে জামশেদ। আর সেই মানুষটার নোংরা হাত ওকে ছুঁয়েছে।
“ভীষণ সিগারেটের নেশা পেয়েছে। একটা ধরালে কি খুব বেশি সমস্যা হবে তোমার?”
নিরুপমা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এই প্রশ্নে। আগে কখনো অনুমতি চায়নি।
“আচ্ছা থাক।” এহসাস বলল। নিরুপমা চট করে জবাব দিলো,
“না, সমস্যা নেই।”
“আর ইউ সিওর?”
নিরুপমা মাথা নাড়াল শুধু। এহসাস সিগারেট ধরালো। স্তব্ধ, বিশুদ্ধ বাতাসে মিশে গেল নিকোটিনের তীব্র গন্ধ। নিকোটিন অসহ্য, দমবন্ধকর লাগত নিরুপমার। ভীষণ অপছন্দের। আজ তাই মানিয়ে নিতে চাইল। একটু একটু করে শ্বাস টেনে নিজের শ্বাস রন্ধ্রে মিশিয়ে নিলো।
চলবে,,,,