অশ্রুমালা পর্ব ৩৬+৩৭

#অশ্রুমালা
part–37+ 38
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

বিকেল চারটা বাজে। রোদেলাকে বাসায় আনা হয়েছে। রুমটা গোছানোই আছে। এমন কি রোদেলার রেখে যাও টাওয়ালটা ও চেয়ারের হাতলের উপর ঝুলানো আছে। শুধু তফাৎ টা হলো সেটা আর ভেজা নেই। শুকিয়ে গেছে।

রোদেলা পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলানো। রোদেলার পাশেই আবেগ তার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। রোদেলার হাতের কনুইয়ের বিপরীত দিকে ব্যান্ডেজ করা।

সে রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে। রুমটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই রুমের মালিকের উপর কি ঝড়টাই না গেছে!

রোদেলার মনে হচ্ছে সে জড়বস্তু হলেই বুঝি ভালো হত। কোন অনুভূতি থাকত না। কষ্ট হত না! ব্যথা লাগত না!

আবেগ রোদেলাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। রুমে ততোক্ষণে ইভানাও চলে আসে সমুদ্র কে নিয়ে।

আবেগ ইশারায় ইভানাকে রোদেলার পাশে বসতে বলে রুম থেকে বের হয়।

ইভানা সমুদ্রকে কোলে নিয়ে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে। রোদেলা তার খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তি! ছোট বেলা থেকেই রোদেলা আপু তার খুব প্রিয়! সবসময় রোদেলার আশেপাশে সে ঘুরঘুর করত। রোদেলাও ইভানাকে খুব স্নেহ করে।

আজ এমন একটা তুফান তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেল যে কারোই কিছু করার ছিল না। পরোক্ষভাবে ইভানা বারবার নিজেকেই দোষারোপ করছে। কেন আগেই ভাবীকে তার সাথে হওয়া আক্রমণের ব্যাপারে কিছু জানালো না। যদি জানাত তাহলে আজকে আর এই দিন দেখতে হত না! তারা আগেই সর্তক হয়ে যেত। এতো বড় একটা দুর্ঘটনার কথা তার উচিত হয় নি লুকানো। এই ঘটনাকে স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া মোটেও ঠিক হয় নি৷ ইশ, ওই দিন রাতে বাসায় ফিরেই ভাইয়া-ভাবীকে সব সত্যটা জানিয়ে দিলে আজকে ভাবী সুস্থ থাকত!

রোদেলা ইভানাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মন খারাপ করিস না ইভু। আমি ঠিক আছি।

ইভানা রোদেলার দিকে তাকালো। এই অবস্থাতেও ভাবী কেবল তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই কথা বলছে? সে যেন কষ্ট না পায় তাই ভাবী এভাবে বলছেব।ইভানার বুকটা কষ্টে ভরে উঠে।

রোদেলা মাথা নিচু করে বলে, তোর ভাই এখনো আমাকে ঠায় দিচ্ছে এটা ভেবেই আমি আশ্চর্য হচ্ছি।

ইভানা ভ্রু কুচকালো।

রোদেলা ভেজা গলায় বলে, যদি আবেগ আমার সাথে আর সংসার করতে না চায় তাহলে আমি চলে যাব।

একথা শুনে ইভানা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। রোদেলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

★★★

আবেগ তার মায়ের রুমে প্রবেশ করল। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নক করে।এটা ভদ্রতাসূচক কাজ। রুমের গেট খোলাই তাই সব দেখা যাচ্ছে। বাবা ভেতরে নেই। মা একা আছেন। ভালোই হলো।

এতোদিন যাবত আবেগ খুবই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগত। একদম কঠোর ছিল না। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার মনে হচ্ছে আজকে যদি সে কঠিন না হয় তবে বাকী জীবন পস্তাতে হবে তাকে। একটা ইংরেজি প্রবাদ আছে, “I have to be cruel only to be kind”

আবেগকেও এখন কেবল মাত্র রোদেলার জন্য কঠোর হতে হবে।

আবেগের মা ভেতর থেকে বলে উঠে, আয় বাবা।

আবেগ ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে বলে, আম্মা! আপনাকে কিছু বলার ছিল।

জাবেদা খাতুন কিছুটা ভড়কে যায়। আবেগ লো
কোন দিন ই এভাবে কথা বলে না। উনি বলে উঠে, বল কি বলবি?

–আপনি একবারো রোদেলার সাথে ঠিক ভাবে দেখা করেন নি। কথাও বলেন নি।

–হু।

—আপনি কি রোদেলার উপর কোন কারনে রেগে আছেন?

–না তো!

–আমার তো মনে হয় আপনি রোদেলাকে দেখতে পারেন না। আপনি সবসময়ই রোদেলাকে কথা শুনাতেন। পছন্দ করেন না এটা আমি জানি। কিন্তু কেন করেন না সেটা অজানা। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ আজকের পর থেকে আর কোন দিন রোদেলা কে ওই বিষয় থেকে শুরু করে কোন ছোট ধরনের বিষয়ে বা কারনে কথা শুনানো, টন্ট করা বন্ধ করবেন। আপনার যদি রোদেলার সাথে ঘটা দুর্ঘটনার জন্য তার সাথে এক বাসার ছাদে থাকতে অস্বস্তুি লাগে আমাকে বলতে পারেন। আমি ব্যবস্থা নিব।

–কি ব্যবস্থা নিবি তুই? চমকে উঠে জাবেদা খাতুন প্রশ্ন ছুড়লেন।

–অন্য কোথায় শিফট হবো।

–মানে?

–মানে টা খুব সহজ! আপনার জন্য যদি আগামীতে রোদেলা কষ্ট পায় তাহলে সেই দিনটা আমার এই বাসায় শেষ দিন হবে।

জাবেদা খাতুন হা হয়ে গেলেন। আবেগ এসব কথা বলবে সে ভাবতেও পারে নি কোন দিন।

আবেগ মাথা নিচু করেই বলে, কাউকে কোন কারন ছাড়া ঘৃণা করা খুবই জঘন্যতম কাজ আর কাউকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আহত করা আমার কাছে পাপ মনে হয়! একটা মানুষ কে বেত মারলেও সে ওতোটা কষ্ট পাবে না যতোটা মুখে কটু কিছু বললে পাবে। জিব্হা হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষতিকর তলোয়ার যা মানুষের মনকে কেটেকুটে রক্তপাত করিয়ে দেয়। আম্মা আপনি শুনছেন আমার কথা?

–হুম!

–আপনার জিব্হার তলোয়ারটা একটু বেশিই ধারালো। রোদেলা এমনি আপনার আর আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন আমাদের উচিত ওকে সুখে রাখার চেষ্টা করা। আজকে রোদেলার জায়গায় ইভানা থাকতে পারত। রোদেলা চাইলেই কিন্তু রিশাদকে বলতে পারত, ইভানার সাথে যা করার করো আমি নিচে নামব না৷ কি এটা রোদেলা বলতে পারত না?

–পারত বোধহয়।

–বোধহয় না আম্মা। অবশ্যই পারত। রোদেলা নিজের বাসায় নিজের রুমে ছিল। রিশাদ সহজে ওর ক্ষতি করতে পারত না কিন্তু ইভু ও বাইরে ছিল । মা?

–হু?

–আজকে যদি আমাদের মধ্যে বন্ডিং ঠিক থাকত তাহলে কিন্তু অন্য ঘটনাও ঘটতে পারব! আপনি নাকি দেখেছিলেন রিশাদ ফোন করেছিল এটা সত্য?

–হু।

–সেই সময় যদি আপনি রোদেলাকে আজেবাজে কিছু না বলে তাকে সাহায্য করতেন বা এট লিস্ট ওর পাশে থাকতেন তাহলে দুইজন মিলে অন্য কোন সমাধানে যেতে পারতেন। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা যদি আলাদা আলাদা থাকি তাহলে ঠিক এভাবেই বাইরের মানুষ এসে আমাদেরকে ভেঙে দিবে আর যদি আমরা এক জোট হয়ে থাকি তাহলে বাইরের কেউ তো আমাদের ভাঙ্গতে পারবেই না বরং কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমরাই তাদেরকে খুব সহজে মোকাবিলা করতে পারব৷ কিন্তু আমি জানি, আমাদের এক জোট হওয়া সম্ভব না। আপনি দুই দিন পর ই রোদেলাকে দুশ্চরিত্রা বলবেন। আপনি বললে প্রতিবেশী রা ও এসে বললে। আর আমরা যদি শক্ত থাকি তাহলে সমাজ ও চুপ থাকবে। সমাজ হচ্ছে সুযোগ সন্ধানি। সুযোগ পেলেই লাফাবে। আমি চাই না সমাজকে সেই সুযোগ দিতে। আপনাকে আবারো বলছি আপনার কি সমস্যা হবে রোদেলা যদি এই বাসায় থাকে?

জাবেদা খাতুন চুপ রইলেন।

আবেগ বলে উঠে, আপনি সময় নিয়ে ভাবুন। আমি রাতে আবারো আসব উত্তর জানতে। আম্মা শেষ বারের মতো একটা কথা বলতে চাই, আমার সমস্ত সুখ রোদেলাতেই! যাই তাহলে।

আবেগ রুম ছেড়ে বের হলো।

রোদেলা চুপচাপ বসে আছে। পাশেই সমুদ্র শুয়ে আছে। হাত পা নাড়াচ্ছে সমুদ্র আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। রোদেলা এক ধ্যানে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। আবেগ রুমে ঢুকল এবং রোদেলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রোদেলা বিনিময়ে হাসল না।

তখনি সমুদ্র কেদে উঠে। রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিল। আবেগ রোদেলার কাছে গিয়ে বসে পড়ল এবং বলল, দাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই।
রোদেলা আবেগের দিকে না তাকিয়ে বলে, আমি রিশাদের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করতে চাই!

আবেগ রোদেলাকে শক্ত করে ধরে বলে, মেঘ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তুমি কোন চিন্তা করবে না প্লিজ। সব ভুলে যাও।

রোদেলা করুন গলায় বলে, এতো সহজ সব ভোলা?

–সহজ না কিন্তু অসম্ভব তো না। প্লিজ সব ভুলে যাও। আমরা নতুন করে সব শুরু করব। তুমি আমি সমুদ্র আমরা তিনজন মিলে তোমার মনের সেই ছোট্ট পাখির বাসার সমান বাসাটায় থাকব। সেদিন তুমি আমার নামে মালিকানা দিতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি অধম নিতে পারি নি। আজকে সৌভাগ্যক্রমে আবারো সুযোগ পেলাম। এবার আর হাতছানি করতে চাই না। এবার আমি নিজে থেকে তোমার মনের বাড়িটা কিনতে চাইছি। করে দিবে তোমার মনের নীড়টা আমার আর সমুদ্রের নামে?

রোদেলা আবেগের দিকে তাকালো। চোখ আজকে কেবল তার না আবেগের ও ভেজা!

–কি হলো কিছু তো বল!

–মামা-মামী, ইভু কি দোষ করল? ( রোদেলা)

এতো কষ্টের মধ্যেও আবেগের হাসি পেয়ে গেল।সে খুশি মনে বলে উঠে, ওরাও থাকবে।

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। এই হাসিতে বেদনার পরিমাণ বেশি!

আবেগ প্রথমবারের মতো রোদেলার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। যদিও এর আগেও একবার দিয়েছিল। কিন্তু তখন রোদেলা ঘুমাচ্ছিল।

আবেগের প্রসিদ্ধ ভালোবাসার ছোয়ায় রোদেলা সদ্য সাগর থেকে খুজে পাওয়া মুক্তার মতো পবিত্র হয়ে গেল!

রোদেলা চোখ বুজে ফেলে। খুব শান্তি লাগছে তার।

সেই ভয়ংকর রাতে সে আল্লাহর কাছে মরন চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেনি বিধায় মনক্ষত হয়েছিল রোদেলা। কিন্তু আজকে সে উপলব্ধি করছে, হয়তো এই দিনটা দেখানোর জন্যই আল্লাহ তাকে এখনো জীবিত রেখেছে!

★★★

নেহা পুরা রুম জুড়ে পায়চারি করছে। খুব টেনশড সে। সাত দিন ধরে সে গৃহ বন্দী। বাবা বাসা থেকে বের হতে দেয় না। ফোন ও নিয়ে গেছে।বাসার সব টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন নেহার বাবা। সে কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারেনি বিগত সাত দিন ধরে। কোন ফ্রেড তো দূরে থাক। কাজিনদের সাথেও পারছে না যোগাযোগ করতে। সাত দিন পর তার প্রাচুর্যের সাথে বিয়ে। পারিবারিক ভাবে। নেহা কিছুতেই এই বিয়েতে রাজী না। প্রাচুর্য জোড় করে তাকে বিয়ে করছে এতে আবার তার বাবা সায় দিচ্ছে। নেহার চোখ ভরে উঠল। সে চায় না প্রাচুর্যকে তার জীবনে। একদমই পছন্দ না প্রাচুর্যকে তার৷ কেন পছন্দ না তা নিজেও জানে না নেহা।

নেহা মনে মনে ঠিক করল, আর যাইহোক সে কোনক্রমেই প্রাচুর্যকে বিয়ে করবে না!

চলবে।

[আজকে রাতে একটা বোনাস দিতে পারি যদি পড়তে চান! ]

#অশ্রুমালা
part–38(বোনাস)
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রাতের পরেই নাকি আলো ফুটে। উজ্জ্বল একটা সকাল হয়! এটাই জগতের নিয়ম। রোদেলা কোথায় যেন শুনেছিল, যে রাত যত গভীর হয়, যতো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় সেই রাতের পরে যে দিনটা শুরু হয় সেটা নাকি অনেক ঝলমলে হয়। কে জানে কথাটা কথা কত ভাগ সত্য। তবে আবেগ ও রোদেলা দুজনেই একটা উজ্জ্বল ঝলমলে আনন্দময় সকালের আশায় প্রহর গুনছে।

আপাতত সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে। আযান পড়ে গেছে। সবাই নামাজ পড়ে আবেগ আর রোদেলার রুমে বসে আছে। সবাই বলতে আবেগ, মেঘ ইভানা আর রোদেলা।

মেঘ আর ইভানা টুকটাক রোদেলার সাথে কথা বলছে। সবই সেই ভয়ংকর রাতের বিপ্রতীপ কথা-বার্তা। আবেগ তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। রোদেলার মধ্যে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। মানুষ গুলো তাকে একটু হাসানোর জন্য কতো প্রচেষ্টা করছে। সত্যি! আজকে এই প্রথমবারের মতো নিজেকে লাকি মনে হচ্ছে। মেঘ তার কেউ না তবুও নিজের ভাইয়ের মতো তার পাশে এসে দাড়িয়েছে। ইভানা ও তার অনেক আপন একজন। মামা তো তাকে নিজের মেয়েই ভাবে।

মেঘ সমুদ্রকে কোলে নিতে নিতে বলে, সমুদ্রকে আমি ঠিক মতো আদরই করতে পারি নি৷

আবেগ বলল, তুই তো আসিস না আর আগের মতো তেমন একটা।

মেঘ সমুদ্রকে চুমু খেয়ে বলে, বিজি ছিলাম অনেক।আচ্ছা শোন! আমি কি ভেবে রেখেছি জানিস?

আবেগ উৎসাহের সাথে বলে, কি?

–সমুদ্রের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব।

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, তোর মেয়ে?

মেঘ বলে, ইয়েস, মাই ডটার!

–কিন্তু তোর তো বিয়েই হলোনা মেয়ে আসল কোথা থেকে? পালিয়ে বিয়ে করেছিস নাকি?

মেঘ মুখ বাকিয়ে বলে, আরে যখন হবে, তুই কি এখনি তোর ছেলের বিয়ে দিবি নাকি?

–ও৷

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। তা দেখে মেঘ বলে, দেখ, সমুদ্রের বিয়ে হওয়ার জন্য ও এট লিস্ট আমাকে একটা মেয়ে খুজে দাও আর কত কাল সিঙ্গেল থাকব।

আবেগ আবারো প্রশ্ন করে, তোর কথার আগা মাথা কিছু ই বুঝি না।

–তুই বুঝবিও না৷

এমন সময় মেঘের ফোন আসে। সে সমুদ্রকে বিছানায় শুইয়ে বারান্দায় চলে যায় ফোনে কথা বলতে।

কলিং বেল বেজে উঠল। আবেগ ইভানাকে বলে, এখন কে আসল?

ইভানা বলে, জানি না তো!

–গিয়ে দেখে আয়। আর আগে চেক করে নিবি৷

–আচ্ছা।

বলে ইভানা গেট খুলতে চলে যায়। কিছু মিনিট পর সে আর অথৈ রোদেলার রুমে প্রবেশ করল।

রোদেলা অথৈকে দেখে কিছুটা চমকালো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না অথৈ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। অথৈ হলো রোদেলার ভার্সিটি ফাস্ট ডে থেকে কনভোকেশন পর্যন্ত বেস্টফ্রেন্ড। পড়াশোনা শেষ করেও তাদের বন্ধুত্ব ঠিক ছিল। কিন্তু মাঝে আবেগের সাথে বিয়ের পর ফাটল ধরেছিল তাদের সম্পর্কে।

কিছু দিন ধরে অথৈয়ের সাথে কোন যোগাযোগ নেই তার। সত্যি বলতে সে খুব মিস করে অথৈকে। অথৈ হচ্ছে তার সুখ-দুঃখের গল্প করার সাথী। প্রত্যেকের জীবনে একটা করে বেস্টফ্রেন্ড থাকা ম্যান্টাডোরি! বেস্টফ্রেন্ড হলো কথা জমানোর ব্যাংক। তাকে সবকিছুই বলা যায়। যা অন্য কাউকে বলা যায় না। রোদেলা আর অথৈ দুইজন ই খুটিনাটি সব শেয়ার করে পরস্পরের সাথে।

অথৈকে আসতে দেখে আবেগ হেসে বলে, কেমন আছো অথৈ?

অথৈ হালকা হেসে বলে, ভালো ভাইয়া৷

ইভানা আর অথৈ পাশাপাশি রুমে দাঁড়িয়ে রইল। আবেগ চেয়ারে বসা আর রোদেলা সমুদ্র কে নিয়ে বিছানায় বসেছে।

রোদেলা অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলে, দাড়িয়ে আছিস কেন? বস আমার পাশে। কতো দিন দেখা হয় নি তোর সাথে। কথা হয় নি অনেক দিন।

অথৈ ধপ করে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ল৷ সে কিছুটা সংকোচের মধ্যে ছিল কিভাবে সব নরমাল করবে। কিন্তু রোদেলার এমন স্বাভাবিক কথা-বার্তা পরিস্থিতিটা অনুকূলে এনে দিল।

অথৈ কিছু বলবে তার আগেই রোদেলা অথৈয়ের হাতে হাত রেখে বলে প্রায় ফিসফিস করে বলে যাতে অন্যরা শুনতে না পায়

“আগে যা হয়েছে সব বাদ। আমি অতীতের সব কিছু ভুলে গেছি। কিছুটা মেমোরি লসের মতো সব অতীত ভুলে গেছি। তাই অতীতের কথা বাদ দিয়ে সব নতুন ভাবে শুরু করব। এক নতুন অধ্যায় যাকে বলে। এই অধ্যায়ে তোকে আমার সাথে চাই।”

অথৈ কাদো গলায় বলে, আমি সবসময়ই তোর আছি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দে। আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ।

–আহা! মাত্র কি বললাম। আমি সব ভুলে গেছি তো!

আবেগ বলে উঠে, দুই বান্ধবী কি ফুসফাস করছো? কিছুই তো শুনি না!

রোদেলা বলল, শুনতে হবে না। এটা আমার আর ওর সিকরেট কথা।

অথৈ আসায় রোদেলা কিছুটা স্বাভাবিক হলো। যার কারনে সবচেয়ে খুশি আবেগ। এতোক্ষণ একেবারে মূর্তির মতো চুপ থাকলেও এখন কিছুটা কথা বলছে রোদেলা। যা দেখে ভালো লাগলো আবেগের৷

মেঘ কথা বলা শেষ করে রুমে এসে অথৈকে দেখে শক খেল। অথৈ ও চমকে উঠে দ্রুত রোদেলার দিকে তাকালো। সে আর ভুলেও মেঘের দিকে তাকাবে না৷

মেঘ আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, একটু বাইরে আয়।

–চল।

আবেগ আর মেঘ বাইরে এসে ইভানার রুমে গিয়ে ঢুকল। আবেগ লাইট জ্বালিয়ে দিল।

মেঘ বলে উঠে, রিশাদের সাথে কেউ একজন ক্ষমতাধীন লোক আছে যে ওকে সেইভ জোনে রেখেছে। বুঝলি? পলিটিকস আছে এর মধ্যে।

–কে ওই জানোয়ার কে হেল্প করছে? (আবেগ)

মেঘ নির্লিপ্ত গলায় বলে, হবে কোন জানোয়ারই।
আবেগ বলল, এখন কি করব?

মেঘ বলল, তোকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি ই করব। তুই শুধু রোদেলার পাশে থাক আর নিজেও একটু রেস্ট নে। চেহারার হাল দেখেছিস?

–হুম।

— একয়েকদিন আর হাসপাতাল যাস না। বাসায় থাক।ইভানাকেও বাইরে বের দিস না। এক কথায় তোরা কেউ বাহির হবি না। সাবধান থাকা ভালো।

–আচ্ছা৷

–তোদের গেস্ট রুমটা ঠিকঠাক করে দে। রিশাদ ধরা না পড়া পর্যন্ত আমি তোদের সাথেই থাকব ভাবছি।

–থ্যাংকস। এই সময়ে তোকে খুব প্রয়োজন ছিল। সত্যি বলতে আমার নিজেরই আব্বা-আম্মা ইভু রোদেলাকে নিয়ে থাকতে ভয় লাগছে। কখন কি হয়ে যায়!

— চিন্তা করিস না। তোদের বাসার নিচে একটা কালো মাইক্রো পার্ক করা আছে। ওখানে পুলিশ ফোর্স টহল দিচ্ছে।

–হু।
–চল রোদেলার কাছে গিয়ে বসি।

–চল।

আবেগ রুমে ঢুকেই অবাক। তার মা বিছানায় বসে আছেন। হাতে স্যুপের বাটি। তিনি রোদেলাকে জোড়াজুড়ি করে স্যুপ খাওয়াচ্ছেন৷

তা দেখে মেঘ আবেগকে ফিসফিস করে বলে, তোর বাসায় তো হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিল রে দোস!

আবেগ মনে মনে হাসল। যাক তার কথা টনিকের মতো কাজ করছে হুইজ ইস রিয়েলি গুড।

এবার অথৈয়ের ফিরে যাওয়ার পালা। অথৈ যেতে ধরলে মেঘ প্রশ্ন করে, একাই যাবা?

অথৈ ভাবলেশহীন ভাবে বলে, একাই এসেছি একাই যাব।

বলে চলে গেল অথৈ। মেঘ ও অথৈয়ের পিছে পিছে চলে যায় রুম ছেড়ে। কেউ তাদের কিছু বলল না।

বাসার গেটের সামনে আসতেই মেঘ অথৈকে আটকে দিয়ে বলে, একা যেতে হবে না। আমি পৌছে দিচ্ছি তোমাকে। দিনকাল ভালো ন একা যাওয়া লাগবে না।

–লাগবে না। শুধু শুধু কষ্ট করে আসা,,,,

–ওইদিক থেকে সিগারেট কিনব।

–সেটা তো এখান থেকেও কিনতে পারো।

–কথা কম বল তো মেয়ে। (বিরক্ত হয়ে)

অথৈ চুপ হয়ে গেল।। মেঘ তাকে নিয়ে রিকশাই উঠে বসল।

দুজনের মাঝে কিছুটা ফাকা। অথৈ রিকশার হুট ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ বারবার রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিতে দিতে বলছে, ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালান না৷ আমার কাজ আছে।

অথৈ এহেন কথায় বিরক্ত হচ্ছে৷ রিকশায়ালা বিরক্ত নিয়ে বলে, এইডা রিকশা। হেলিকপ্টার না যে উইড়া যামু। এতো তাড়া থাকলে উড়োজাহাজ ভাড়া নিতেন৷

অথৈ হিহি করে হেসে দিল। মেঘ মুখ কালো করে বলে, তাও একটু দ্রুত আগানোর চেষ্টা করেন। আমার কাজ আছে।

অথৈয়ের বাসায় এসে রিকশা থামল। অথৈ নেমে পড়ে এবং বলে, এতো তাড়াই যখন ছিল শুধু শুধু আসতে গেলে। আমাকে নামাতে না এসে এই সময়টায় ওই কাজ টা করতে যার তাড়া আমার সামনে দেখাচ্ছো।

মেঘ কিছু বলে নি। অথৈ উপরে উঠে গেল।

অথৈ বাসায় এসে বাথরুমে গিয়ে সময় নিয়ে ফ্রেস হয়ে বারান্দায় গামছা নেড়ে দিতে এসে তার চোখ অক্ষিকোটরের বাইরে আসার জো। মেঘ এখনো রিকশা নিয়ে তার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে৷ মেঘ আর রিকশা ওয়ালা দুইজন ই মাথা উচিয়ে তার বারান্দায় দিকে তাকানো৷

তাকে বারান্দায় আসতে দেখে রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে সামনে আগালো।

অথৈ বিড়বিড় করে বলে, পাগল-ছাগল কোথাকার।

রিকশা চলছে আপন গতিতে। ডিসেম্বরের হুহু বাতাস গায়ে মাখাচ্ছে মেঘ। ভালোই লাগছে তার৷ রিকশা ওয়ালা নিজ থেকে ই বলে উঠে, বুঝলেন ভাই, আজ-কাল মাইয়ারা কোথাও নিরাপদ না৷

মেঘ ভ্রু কুচকে বলে, কেন এমন বললেন?

–আমার মাইয়াটার নাম ফুল৷ ফুলের মতোই সুন্দর আর স্নিগ্ধ। মেধাও খুব। ওর কলেজের শিক্ষক বলছে, ফুল নাকি ডাক্তার হওয়ার মতো মেধাবী। কিন্তু,,,

—কিন্তু কি? (বিচলিত হয়ে বলে মেঘ কারন ফুল নামক অচেনা মেয়েটার কথা শুনে তার বেশ মায়া ধরে গেছে)

–আমার মাইয়াডার কলেজের এক পোলা ওরে খুব ডিস্টার্ব করে। বুঝলেন আগে মাইয়াডা প্রতিদিন কাদতে কাদতে বাসায় ফিরত। এখন কলেজ বন্ধ দেখে কলেজ যায় না। অনলাইনে ক্লাস হয়। ও করতে পারতেছে না৷ আমাদের ফোন নাই। মাইয়াডার জন্য চিন্তা হয় আমার। বাসায় ও আর ওর ছোট ভাই একা থাকে। না জানি আমি না থাকলে কি হয়। ওই ছেলে একবার আমাদের বাসায় এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছে। বিয়ে করতে চায় আমার মেয়েটাকে। কিন্তু ছেলেটা ভালো না। আর আমি চাই আমার মেয়ে ডাক্তার হবে এখনি বিয়ে দিতে চাই না।

মেঘের মনটাই বিষিয়ে উঠল।আসলেই আমাদের দেশের মেয়েরা কিছুটা হলেও অনিরাপদ! ফুল নামের মেয়েটাকে তার সাহায্য করতে মন চাচ্ছে৷

রিকশা আবেগের বাসার সামনে এসে থামল।

রিকশাওয়ালাকে তার বাসার এড্রেস দিতে বলল সে। রিকশাওয়ালা বলল, কেন? আমার বাসা ঠিকানা জেনে লাভ কি আপনার ?

–আমি হচ্ছি অনেক বড় পুলিশ অফিসার । আমার আন্ডারে অনেক পোস্ট৷ আপনাকে সাহায্য করব। ওই ছেলেকে পুলিশ দিয়ে ক্যালানি দিব। প্রমাণ পাইলে জেল খাটাব৷ কালকে এই বাসার তিনতলায় আসবেন প্লিজ।

রিকশা ওয়ালা অবাক হয়ে গেল । মেঘ তা উপেক্ষা করে উপরে উঠে গেল।

★★★

খাওয়া শেষ করে রোদেলা বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। রাত যতোই হচ্ছে তার মনটা ততোই অস্থির হয়ে পড়ছে। রোদেলার চোখ ভেজা। কোন কারন ছাড়াই। কেউ কিচ্ছুটি বলে নি তাকে। বরং ভালোবাসার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে আগের তুলনায় ৷ এমন কি মামী ও তার সাথে ভালো করে কথা বলছে।

কিন্তু তবুও সে অনুতপ্ত। অনুশোচনায় ভুগছে। সে আবেগকে ঠকালো কি?

রোদেলার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। হুট করে আবেগ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। রোদেলা হালকা কেপে উঠে।

আবেগ পেছন থেকে বলে উঠে, বারান্দায় ঠান্ডা তো। রুমে চল।

–আবেগ?

–হুম?

–আমি কি তোমার অনুপযোগী? তুমি আমার চেয়ে বেটার কাউকে ডিজার্ভ কর তাই না? আমি তোমার জীবনে কেবল সমস্যাই বয়ে এনেছি। কখনো সুখ দিতে পারি নি আজ পর্যন্ত!

আবেগ রোদেলাকে পেছন থেকে খুব শক্ত করে ধরে রোদেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

“i” এর পর যেমন কোন দিন “are” বসে না তেমন ই আবেগের পর শূন্যস্থানে অন্য কেউ বসবে না!

You এরপর যেমন সবসময় are বসবে তেমনি আবেগের পর খালি জায়গায় কেবল রোদেলাই থাকবে! এটা অভিধান থেকে দেওয়া নিয়ম।
–নূর

রোদেলা বিষ্মিত হলো। মৃদ্যু শিহরণ বয়ে গেল তার গা বেয়ে।

আবেগ রোদেলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

পা না ভিজিয়ে সাগর পাড়ি দেয়া যায় কিন্তু চোখের পানি না ফেলে জীবন পাড়ি দেয়া যায়না।(কালেক্টেড)

রোদেলা আবেগকে জড়িয়ে ধরে। বাইরে হীম হাওয়া। তবুও বুকটা গরম হয়ে গেছে তার। উথাল-পাতাল চলছে মনে৷

আবেগ রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, মাত্র বললে না আমাকে সুখ দাও নি। ভুল বলেছো সামান্য। আমি নিজেই তো সুখের ঝুলি। কালকে থেকে এক নতুন আলোর সন্ধ্যানে আমরা যাত্রা শুরু করব। ঠিক আছে?

–হুম।

চলবে৷

[আপনার থাকবেন তো পাশে আবেগ-রোদেলার নতুনভাবে পথ চলার যাত্রায়?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here