৪ বছরের প্রেমের সম্পর্কটা যে বিয়ের পরে এক বছরও টিকবে না, কে ভাবে?
তবে না ভাবলেও আমার সাথে তাই হয়েছে। আমার শাশুড়ীর একমাত্র সন্তান তার মায়ের অবাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলো ঠিকি, কিন্তু বিয়ের পরে সে সম্পূর্ণ উল্টে গেলো।
এমনকি আমার পেটে তার অনাগত সন্তানের সংবাদ তাকে একটুও আটকায় নি। আমাকে তালাক দেওয়ার দুইমাসের মধ্যে তার মা’র কথামতো আবার বিয়ে করে।
আমার জীবনটা মনে হয় সেখানেই থেমে যেতো, কিন্তু নাহ আমি বেঁচে ছিলাম আমার পেটের সন্তানের জন্য, আর আমার অসুস্থ বাবার জন্য। তবে নিয়তির নির্মম পরিহাস বোধহয় আমাকে আরো নিঃস্ব করতে চেয়েছিলো,তাইতো সন্তানের মুখ দেখাও আমার ভাগ্যে জুটলোনা।
সন্তানকে হারিয়ে আমি পুরোপুরি ভেঙে গিয়েও আবার শক্ত হলাম, বাবার চিকিৎসা আর ভরনপোষণের জন্য একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলাম।
আমার বাবার জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। কারণ এই মানুষটা আমার মা চলে যাওয়ার পরে শুধু আমার জন্য পুরো জীবনটা একা কাটিয়েছেন, আমাকে সবকিছুর অভাব ভুলিয়েছেন। আমি আমার বাবার একমাত্র ভরসা, আমি উনার পাশে না থাকলে উনার কি হবে? জীবনের প্রতি মায়া উঠে যাওয়া আমার মনে শুধু বাবার অসহায়ত্ব ঘুরপাক খেতো। হ্যাঁ এখন শুধু বাবার আমাকে বাঁচতে হবে।
তবে জীবন থেকে বিয়ে নামক শব্দটা আলাদা করে দিলাম।
আর এভাবেই দেখতে দেখতে তিন বছর অতিক্রম হয়ে গেলো।
‘
‘
সেদিন অফিসের কাজে জেলার বাইরে গিয়েছিলাম। বাসে করে ফেরা সময় পাশের সিটে একটা ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠলো। কেন জানি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়েই আমার মধ্যে তিন বছরের মাতৃত্ব জেগে ওঠলো। আমি চলন্ত বাস থেকে নিজের সীট ছেড়ে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে ওর গাল ছুঁলাম। আস্তে আস্তে মাথায় হাত রাখতেই তাকে জড়িয়ে রাখা মেয়েটা আমার হাত ছিটকে সরিয়ে বললো,
___কি করছেন আপনি? জাগাবেন না, সে কান্না করতে করতে এতক্ষণে ঘুমিয়েছে মাত্র।
মেয়েটার কণ্ঠস্বর কেমন যেন কাঁপা, মনে হচ্ছে আমি কখনো এই স্বর শুনেছি। কোথায় শুনেছি? মনে করতে পারছিনা। তবে আমি নিশ্চয়ই কোথাও শুনেছি।
আমি আমার মুখের নেকাবটায় হাত রেখে আনমনা হয়ে আবার নিজের সীটে বসলাম। বারবার বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছি, কে এই বাচ্চা? আমার মতো নাক তার, থুতনির নিচে আমার মতো ডিম্পল। কপালে চুলের ভাঁজটাও আমার মতো। এক মূহুর্তের জন্য আমার মনে হচ্ছে নাহহ আমার সেদিন তাহলে মৃত সন্তান হয়নি। আমার সন্তান বেঁচে আছে। সে-ই আমার সন্তান নয়তো?
আজ থেকে তিন বছর আগেই তো আমার ডেলিভারি হয়েছিল, ডক্টর বলেছিল আমার মৃত সন্তান হয়েছে। আমার নিজের বাবাও বলেছিল আমার সন্তান বেঁচে নেই, এমনকি আমি জ্ঞান ফিরে তাদের বলা অনুযায়ী মৃত সন্তানের মুখটাও দেখিনি। বাবা আমাকে বুঝিয়েছে দেখলে আমার আরো বেশি কষ্ট হবে বলে উনারা না দেখিয়ে দাফন করে ফেলেছে। কেন জানি মেনে নিলেও আমার সেদিনও বিশ্বাস হয়নি। কি করে বিশ্বাস হবে? আমি যে থিয়েটারে যাওয়ার আগেও আমার বাচ্চার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলাম। আমি ভীষণ দূর্বল হলেও আমি মা সেটা বুঝতে পারতাম আমার সন্তান ভালো আছে।
তাহলে কি সেদিন ওরা আমার সাথে প্রতারণা করেছে? আমাকে মিথ্যে বলেছে? কিন্তু কেন বলবে? আমার বাচ্চাকে আমার থেকে কেন আলাদা করবে?
আমার বাচ্চার উপর অধিকার তো কেবল আমারই আছে! নাহ আর একজনের আছে। কিন্তু সে তো আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক। তাহলে সে আমার বাচ্চার উপর অধিকার কি করে দেখাবে? নাকি স্ত্রীকে ছিন্ন করলেও সন্তানের উপর অধিকার থাকে?
না না না আমার মাথা ঘুরছে, অরুণ আমার বাচ্চা কি করে নিবে? তারপরও সুযোগ থাকতো, যদি সে অন্য জায়গায় আবার বিয়ে না করতো। কিন্তু সে তো বিয়ে করেছে, বাবামায়ের ইচ্ছেতে বিয়ে করে সুখে আছে। তাহলে কেন আমার বাচ্চা সে নিবে? আর আমার বাবা কেন আমাকে মিথ্যা বলবে? বাবা তো জানে আমি অরুণকে হারিয়ে কতটা ভেঙে পড়েছি, কতটা এলোমেলো হয়েছি, আর কতটা যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছি। সবকিছুর পরে আমার একটাই আশা ছিল আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে । তার জন্য আগে থেকেই কতো স্বপ্ন জমিয়ে রেখেছি, একা একা পেটে হাত রেখে ওর সাথে কথা বলে বলে হেসেছি। মা হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় রাতদিন নির্ঘুম বিসর্জন দিয়েছি।
আমার বাবা এসবকিছু স্বচক্ষে দেখে কি করে এটা করতে পারবে? পারবেনা, হয়তো আমিই ভুল ভাবছি!
আমি ঘুমন্ত সেই বাচ্চাটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। হ্যাঁ বোধহয় এটা অন্য কারো সন্তান, অন্য কারো মেয়ে। আমার সন্তানকে তো আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন, আমি তো সন্তানহারা । আমি অন্যের সন্তানের উপর কেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি!?
দ্রুতগতিতে বাস এগিয়ে চলছে। তার মতোই দ্রুতগতিতে বইছে আমার ভারী নিঃশ্বাস। তবে থমকে গেছে আমার হৃদকম্পন। নিস্তেজ সতেজতার বিস্তারে সে পেরে উঠছেনা। আর আমিও বাচ্চাটার উপর থেকে আটকে রাখতে পারছিনা আমার আঁখিজোড়া।
দেখতে দেখতে বাসটা একটা জায়গায় এসে থামলো। আমি ছলছল চোখে আবারও তাকালাম, তাকিয়ে দেখি মেয়েটা বাচ্চাটাকে টেনে কোলে নিয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাড়াচাড়া করাতে বাচ্চাটা জেগে ফোলা ফোলা চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হয়তো অনেক্ষণ কান্না করেছে তাই চোখদুটো এমন লাল আর ফোলা। ওর চোখে তাকিয়ে আমার বুকটা কেন ফেটে যাচ্ছিলো, আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছু। আজ পর্যন্ত আমার চোখে অসংখ্য বাচ্চা পড়েছে, আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছি,খেলেছি কিন্তু কখনো মাতৃত্বের এই অনূভুতিটুকু পাইনি, কখনো বুকে টেনে নেওয়ার এতটা তীব্র আকুলতা জন্মায়নি। আমার খুব ইচ্ছে করছে তাকে এক টানে বুকের সাথে লেপ্টে আদর করতে!
দেখতে দেখতে মেয়েটা নেমে গেলো। বাস ছেড়ে দেওয়ার মূহুর্তে আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না, আমিও নেমে গেলাম। যদিও আমার গন্তব্য ছিল আরো সামনে!
এদিকে মেয়েটা বাচ্চাটাকে এমনভাবে কোলে নিয়েছে যে বাচ্চাটা পেছনের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। নেকাব পরা আমাকে তাদের পিছু আসতে দেখে সে দুবার মেয়েটার কাঁধে মুখ গুঁজলো। আমি বুঝলাম বাচ্চামানুষ কালো বোরকা পরিহিতা আমাকে দেখে হয়তো কিছুটা ভয় পাচ্ছে। আমি আস্তে করে আমার মুখের উপরের নেকাবটা খুলে ফেললাম।
বাচ্চাটা আড়চোখে আস্তে আস্তে আবার মুখটা অল্প তুলে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ লুকিয়ে ফেলার আগেই কেমন যেন একটা দৃষ্টিতে গলাটা উঁচু করে এক হাত বাড়িয়ে বললো,
___আম্মুউউ..
তার মুখের এই ডাকের তীর যেন আমার কলিজাটা ভেদ করে ফেললো। বুঝতে পারলাম না আমাকে আম্মু কেন ডাকলো, তবে সাথে সাথে আমি ডুকরে কেঁদে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কারণ বাচ্চার এই ডাকে এতক্ষণে মেয়েটা পেছনে তাকিয়েছে,তারপর আমাকে অন্যপাশে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছু না বুঝে বাচ্চাটার ঘাঁড়ে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো, এই যে আম্মু এখানে। তারপর রাস্তায় দাঁড়ালো, আমিও ওদের সাথে দাঁড়ালাম। আমার পুরো দৃষ্টি বাচ্চাটার উপর, বাচ্চাটাও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও বলছেনা আর। একটু পরে মেয়েটা রাস্তার ওই প্রান্তে ইশারা করে হাত নাড়িয়ে জোরে বললো,
___ এইইই একটা রিকশা নিয়ে আসেন।
আমি ওপাশে তাকিয়ে নিজের স্থিরতা হারিয়ে ফেললাম। অরুণ!
তার মানে এই বাচ্চা?
এই বাচ্চা কি আমার? আমার সন্তান বেঁচে আছে?
কিন্তু কি করে অরুণ ভালোবাসার মতো আমার সন্তানকেও ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে পারে? কি করে?
চলবে….
গল্পঃ #অসময়ে_রোদন (প্রথম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার