অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.
সমুদ্রের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তিনটি তাবু টানানো হয়েছে। সেই তাবুগুলোর একপাশে বনফায়ারের আগুনে শীতের তীব্রতা ও রাতের অন্ধকার অনেকটাই কম অনুভব হচ্ছে। তার পাশেই গোল হয়ে ফাতিহ, ইসাম ও ল্যায়লা বসে কিছু একটা করছে।
গোল গোল করে ঘুরে বোতলের মুখ এসে ইসামের দিকে থামে। সাথে সাথে ফাতিহ প্রশ্ন করে,
” ট্রুথ নাকি ডেয়ার? ”
ইসাম নিজের কলার নাচিয়ে বলে,
” আমি জীবনে এসব সহজ ট্রুথ ফ্রুথ নেই না। আমি আজীবন ডেয়ারিং কাজ করতে ভালোবাসি। সো অবশ্যই ডেয়ার। ”
ল্যায়লা ইতস্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
” আমি ডেয়ার দেই? ”
ফাতিহ হেসে বলে,
” শিওর। ”
ল্যায়লার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়। সে বলে,
” আমার প্লে করা গানে তোমাকে নাচতে হবে এই মুহুর্তে। ”
ফাতিহ ল্যায়লার ডেয়ার শুনে মজা পায়৷ সে মুখ টিপে হাসছে। ইসাম এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” ইট’জ নট এ বিগ ডিল। প্লে দ্যা মিউজিক। ”
ল্যায়লার ফোনে আপাতত এই দেশের কোনো সিমও নেই৷ তাই সে ইন্টারনেটও ইউজ করতে পারছে না৷ সে ইসামকে বলে,
” কিছু মনে না করলে, ক্যান আই টেক ইউর ফোন ফর এ মিনিট প্লিজ? ”
ইসাম নিজের ফোন বাড়িয়ে বলে,
” এনি টাইম। ”
ল্যায়লা ফোনে গান প্লে করে দেয়।
” পান মে পুদিনা দেখা
নাককা নাগিনা দেখা
চিকনি চামেলি দেখি
চিকনা কামিনা দেখা
চান্দ নে চিটার হোকে,
চিট কিয়া তো
সারে তেরে বোলে
গিলি গিলি আক্ষা। ”
ইসাম উড়াধুরা গানের সাথে নাচা শুরু করে। ল্যায়লা ইসামের নাচের ভঙ্গি দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। ফাতিহ মুখে শিষ বাজিয়ে হাত তালি দিতে থাকে। নাচ শেষ হতেই ইসাম এসে বসে আবার বোতল ঘুরায়। এবার বোতল থামে ল্যায়লার দিকে। ল্যায়লা সত্যি বলা এড়িয়ে গিয়ে ডেয়ার চুজ করে। ফাতিহ সামান্য ভেবে বলে,
” তোমার ডেয়ার তোলা রইলো। সময়মতো আমি বলবো কি করতে হবে। ”
ল্যায়লা মেনে নেয়। অবশিষ্ট রয় ফাতিহ। এবার তার দিকে বোতলের মুখ থামতেই সে বলে উঠে,
” আমি ট্রুথ চুজ করছি। ”
ইসাম হেসে বলে,
” তোর ব্যাপারে আমি সবই জানি। তাই এই সুযোগটা আমি ল্যায়লার হাতে তুলে দিলাম। ”
ল্যায়লা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলে,
” আমি কি প্রশ্ন করবো? ”
ফাতিহ ল্যায়লার দিকে তাকায়। স্পষ্ট স্বরে বলে,
” তোমার যা ইচ্ছা। ”
ফাতিহর কথা শুনে ল্যায়লা তার দিকে তাকাতেই সে আচমকা ফাতিহর চোখে হারিয়ে যায়। ফাতিহর চোখে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে সে উপলব্ধি করে তার সামনে বসা এই মানুষটা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। ইসাম সামনে বসে দুজনকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেখান থেকে নিঃশব্দে সড়ে নিজের তাবুতে চলে যায়।
এই মুহুর্তে কেবল ল্যায়লা এবং ফাতিহ একাই বাহিরে বসে আছে। ল্যায়লা ফাতিহর চোখ হতে দৃষ্টি না ফিরিয়েই প্রশ্ন করে,
” কে তুমি? ”
ফাতিহ শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
” ফাতিহ আরাব। ”
” আমার জীবন বাঁচানোর পিছনে কারণ কি? ”
” কারণ আমি অনুশোচনা নিয়ে বাঁচতে চাই না। ”
ল্যায়লা এবার শেষ প্রশ্নটা এরাবিকে করে,
” লিমাদহা তাবতেইদ দায়মান ইয়ান আলহুশুদি? ”
যার অর্থ,
” তুমি সবসময় এতো গোপনীয়তা রক্ষা করে চলো কেন? ”
ফাতিহ ল্যায়লার প্রশ্ন শুনে চমকে যায়। সে পাল্টা প্রশ্ন করে,
” তুমি আমাদের ভাষা জানো? ”
ল্যায়লা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ফাতিহ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
” তাহলে এতদিন ইংরেজিতে কথা বলেছো কেনো? ”
” তোমরা ধরে নিয়েছিলে আমি তোমাদের ভাষা জানিনা। তাই নিজ থেকেই ইংরেজিতে কথা বলছিলে। আমার কাছে কখনো জানতে চাও নি আমি এরাবিক পারি কিনা। ”
ফাতিহ নিজেদের বোকামির উপর বিরক্ত হয়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে যায় যে ল্যায়লার সামনে ইসাম এরাবিকে অনেক কথাই বলেছে। সেইসব কথা তারমানে ল্যায়লা বুঝতে পেরেছে? ফাতিহর ভাবনার মাঝে ল্যায়লা তার সামনে তুড়ি বাজিয়ে প্রশ্ন করে,
” আমার প্রশ্নের উত্তর? ”
ফাতিহ একবার ল্যায়লার দিকে তাকায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
” এটুকু নিশ্চিত থাকতে পারো আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। বাকি আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ না। ”
ল্যায়লা আর কিছু বলে না। সে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়৷ ফাতিহ প্রশ্ন করে,
” কোথায় যাচ্ছো? ”
” ঘুম আসছে না। হাঁটতে যাচ্ছি। ”
কথাটা বলে ল্যায়লা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ফাতিহ পিছন থেকে বলে উঠে,
” একা যাওয়া নিরাপদ হবে না। ”
ল্যায়লা পিছনে না ফিরে জবাব দেয়,
” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি এরাবিক জানি। তাই তোমাদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি যে এটা প্রাইভেট বীচ। এখানে অন্য কারোর আসার অবকাশ নেই। ”
ফাতিহ আরেক দফা চমকে যায়। এই কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। ল্যায়লা কি আজকে তাকে চমকে দেওয়ার খেলায় মত্ত্ব হয়েছে? ফাতিহ চুপচাপ উঠে ধীর পায়ে ল্যায়লার পিছুপিছু হাঁটতে থাকে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে।
ল্যায়লা এখন আপন ধ্যানে মগ্ন। আচমকা এক দমকা হাওয়া এসে গায়ে ধাক্কা খেতেই তার গলার স্কার্ফ উড়ে পিছনের দিকে চলে যায়। ল্যায়লা স্কার্ফ ধরার জন্য পিছনের দিকে তাকাতেই দেখে তার স্কার্ফ ফাতিহর হাতে।
ফাতিহ কখন তার পিছুপিছু এসে পড়েছে সে বুঝে উঠতে পারে নি। ফাতিহ স্কার্ফ হাতে ল্যায়লার কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর স্কার্ফ সে ল্যায়লার মাথায় দিয়ে ঘাড়ের পিছনে নিয়ে বেঁধে দেয়। এতে ল্যায়লার মাথার তালু সম্পূর্ণটা আবৃত হয়। কিন্তু নিচে খোলা চুল সব উন্মুক্ত রয়। ফাতিহ এক পলক ল্যায়লাকে দেখে বলে,
” তোমার চেহারায় একধরনের মরক্কান ঐশ্বরিক ভাব আছে। যা এখন সম্পূর্ণ রূপে ফুটে উঠেছে। ”
ল্যায়লা ফাতিহর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে নিজেও জানে তার চেহারায় মরক্কান ভাব আছে। কিন্তু এতো বছর ধরে এই চেহারাকেই সে ঘৃণা করতো। সবসময় আয়না এড়িয়ে চলতো যেন এই চেহারার সম্মুখীন না হতে হয় তাকে। কিন্তু জীবনে প্রথম সে নিজের চেহারা নিয়ে মন্তব্য শুনে ক্ষুন্ন অনুভব করছে না। এমন কেন হচ্ছে? তার নিজের চারিদিকে গড়ে তোলা এতো উঁচু নিয়মের দূর্লভ দূর্গ কেন ফাতিহর সামনে একটু একটু করে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]