অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৩.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

বৌজনিকা বীচ। কাসাব্লাঙ্কা থেকে ৫৩ কি.মি দূরে এর অবস্থান। পৌঁছাতে সময় লাগে ৫০ মিনিট। ফাতিহ, ইসাম এবং ল্যায়লা বৌজনিকা বীচের কাছে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামায়। ফাতিহ এবং ইসাম নাস্তা কিনতে চলে যায়। গাড়িতে রয়ে যায় কেবল ল্যায়লা। তার হাতে ফোন। কাসাব্লাঙ্কা থেকে রওনা হওয়ার সময় ফাতিহ তাকে একটা সিম কার্ড দিয়েছিলো। বলেছে মরক্কোতে যতদিন আছে এই সিম কার্ড ইউজ করতে। আর তাছাড়া ফাতিহ ল্যায়লার ফোনে নিজের, ইসামের এবং ফিরুজে খালার নাম্বারও সেভ করে দেয়। যেন ল্যায়লার প্রয়োজন পড়লে কল দিতে পারে।

ল্যায়লা ফোনে ফিরুজে খালার নাম্বার বের করে ভাবছে কল দিবে কিনা! ভদ্রমহিলা তার জন্য অনেকটা কষ্ট করেছেন। কালকেও দুবার ফোন দিয়ে ল্যায়লার সাথে কথা বলেছেন। অবশেষে নিজের দ্বিধা কাটিয়ে ল্যায়লা কল ডায়াল করে। কিছুক্ষণের মাঝেই অপর পাশ হতে ফোন রিসিভ হয়। ল্যায়লা শান্ত স্বরে বলে,

” মারহাবান। আনা ল্যায়লা। ”

ফোনের অপর পাশে থাকা ফিরুজে হতভম্ব হয়ে যায়। তিনি অশান্ত সুরে বলে,

” ল্যায়লা? আম্মা? এটা তুমি? ”

ল্যায়লার মনে হঠাৎ হাহাকার ছেয়ে যায়। কি আদুরে ডাক! সে যাদের থেকে এরকম আদর আশা করতো তারা কখনো তাকে এভাবে স্নেহ নিয়ে ডাকে নি। অথচ ফিরুজে খালা কি সহজে তাকে আপন করে নিলো। ফোনের অপর পাশ থেকে আবার ডাক শুনতেই ল্যায়লার ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে উত্তর দিতেই ফিরুজে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

” তুমি এরাবিকে কিভাবে কথা বলছো? ”

ল্যায়লা ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি এঁকে সিটে হেলান দিয়ে বলে,

” আমি আপনাদের ভাষা জানি। ”

__________

কলে কথা বলতে বলতে ল্যায়লার আচমকা চোখ পড়ে রাস্তার অপর পাশে থাকা বড় বিলবোর্ডের দিকে। সাথে সাথে সে সোজা হয়ে উঠে বসে। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে কোনোমতে বলে,

” খালা আমি আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি। ”

কথাটা বলেই সে ফোন রেখে দেয়। আর গাড়ি ছেড়ে নেমে আসে। বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে রাস্তা পার হতে থাকে। যেন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছে। হঠাৎ এক গাড়ির সামনে পড়তে নিয়েও অল্পের জন্য বেঁচে যায়। ল্যায়লা এবার সাবধানে রাস্তা পার করে ওই বিলবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। বিস্ময়ে মুখে হাত দিয়ে সে বলে উঠে,

” ফাতিহ আরাব? ”

__________

নাস্তা নিয়ে ফিরার সময় ইসাম ফাতিহকে উদ্দেশ্য করে হঠাৎ প্রশ্ন করে,

” খুব বড় রিস্ক নিয়ে চলাফেরা করছি আমরা ফাতিহ। যেই কারণে এই রিস্ক নিচ্ছিস তা যদি বিফলে যায়? ”

ফাতিহর পা থেমে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ইসামের দিকে তাকায়। তারপর খুব বিশ্বাসের সহিত জবাব দেয়,

” ল্যায়লার মন থেকে সুইসাইডের চিন্তা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে ইসাম। ও আগের তুলনায় আমাদের সাথে কিছুটা হলেও ফ্রি হয়েছে। তুই জানিস কালকে ও সমুদ্রে নামতে ভয় পাচ্ছিলো। কারণ ও ভাবছিলো যদি সমুদ্রের ঢেউ ওকে দূরে নিয়ে যায়? তার মানে ও এখন মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে। ”

ইসাম প্রশ্ন করে,

” আর তুই? তুই এসব কেন করছিস ফাতিহ? ওকে বাঁচানোর জন্য তুই কেন ডেস্পারেট হচ্ছিস? ”

ফাতিহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” কাউকে বাঁচাতে না পারার অনুশোচনা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না আমি। ”

কথাটা বলেই ফাতিহ সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

” ল্যায়লা অপেক্ষা করছে। চল। ”

__________

গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলতেই ফাতিহর কপালে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। সে পিছনে ফিরে ইসামকে প্রশ্ন করে,

” ল্যায়লা কোথায়? ”

ইসাম ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” ল্যায়লা কোথায় মানে? ও নেই এখানে? ”

ফাতিহ অশান্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে ল্যায়লাকে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ ভয়ার্ত চোখে ইসামের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

” ইসাম, ল্যায়লা ঠিক আছে তো? ”

তখনই ফাতিহ নিজের কাধে একটা শীতল হাতের ছোঁয়া অনুভব করে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে ল্যায়লা তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ল্যায়লাকে দেখতেই ফাতিহর অশান্ত দৃষ্টি শান্ত হয়ে আসে। ল্যায়লা সামান্য হেসে বলে,

” কি ভেবেছিলে? পালিয়ে গিয়েছি? ”

ইসাম প্রশ্ন করে,

” কোথায় ছিলে তুমি? আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ”

ল্যায়লা বলে,

” আশেপাশে শপিং মল খুঁজছিলাম। আই নিড টু চেঞ্জ। ”

ফাতিহ নিজের চিন্তা লুকিয়ে রেখে বলে,

” নাস্তা করে নাও গাড়িতে বসে। আরেকটু সামনে শপিং মল আছে। পরে যাচ্ছি। ”

__________

সমুদ্রের তীরে পাশাপাশি তিনটা উটের উপর বসে আছে ফাতিহ,ল্যায়লা এবং ইসাম। উট ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনজনের জন্যই নতুন। ল্যায়লা প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও এখন উপভোগ করছে। ফাতিহ হঠাৎ দু হাত দুই দিকে ছেড়ে দিয়ে মুক্ত পাখির মতো চোখ বুজে সমুদ্রের মাতাল হাওয়া উপভোগ করতে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ল্যায়লা প্রথমে নিজের ক্যামেরা অন্য কাউকে ধরতে দেখলে রাগ হলেও এখন আর তেমন হচ্ছে না। ইসাম ক্যামেরা হাতে ল্যায়লার আর ফাতিহর আলাদা ক্যান্ডিড ছবি তুলতে ব্যস্ত।

ল্যায়লা দুপুরে শপিং মল থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে একটি হালকা গোলাপি রঙের মরক্কান কাফতান কিনে পড়ে। সাথে মাথার চুল ছেড়ে রেখে একটি স্কার্ফ দিয়ে গত রাতে ফাতিহ যেভাবে বেধে দিয়েছিলো সেভাবে বেধে রেখেছে।

ফাতিহ আড়চোখে একবার ল্যায়লার দিকে তাকায়। চলন্ত উটের উপর ল্যায়লা উল্লাসে চিল্লাচ্ছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। আচমকা ফাতিহর নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়। তার কাছে মনে হয় তার জীবনে দেখা সবথেকে সুন্দর দৃশ্য এটা। ল্যায়লা হঠাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে ফাতিহর দিকে তাকায়। ফাতিহকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ফাতিহ হেসে মাথা নেড়ে বলে,

” কিছু না। ”

__________

পড়ন্ত বিকালে সমুদ্র পাড়ে একা বসে আছে ফাতিহ। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের জলরাশির দিকে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক আর মনে ভাসছে কেবল ল্যায়লার মুখশ্রী। এই মুখশ্রী তাকে অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়। অতীতের অনেক তিক্ত স্মৃতি। কখনো কখনো ল্যায়লার দিকে তাকালে ফাতিহর মনে হয় দৃষ্টি না ফেরাতে। আবার কখনো কখনো মনে হয় এই চেহারা থেকে দূরে পালাতে। নিজের অতীতের পুনরাবৃত্তি সে আবার নিজের চোখের সামনে দেখতে চায় না। যেই অতীত তার দু চোখের পাতা এক হলেই দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয়, সেই অতীতকে নিজের বর্তমানে রূপ নিতে দেখতে চায় না সে। আপাতত তার একটাই চাওয়া। ল্যায়লা যেন বাঁচতে শিখে। শুধু নামে না বরং সত্যিকার অর্থে বাঁচতে শিখে।

” অটোগ্রাফ প্লিজ। ”

আচমকা কারো কণ্ঠস্বর শুনে ফাতিহ পাশ ফিরে তাকায়। ল্যায়লা তার দিকে একটি ডায়েরি এবং কলম বাড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে। ফাতিহ চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে,

” কি? ”

ল্যায়লা কিছুটা দূরত্ব রেখে ফাতিহর পাশে বসে। তারপর স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন করে,

” মরক্কোর ন্যাশনাল ফুটবল টিমের অধিনায়ক ফাতিহ আরাব। তবে এটাই তোমার এতো গোপনীয়তা রক্ষা করে চলার কারণ? ”

ফাতিহ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয় ল্যায়লার দিকে। প্রতিদিন যেন ল্যায়লা তাকে এক নতুন বিস্ময়কর পরিস্থিতিতে ফেলার আয়োজন করে বসেছে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here