অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.
ভূমিকম্পে হাজারো নিহত এবং আহত মানুষের ভীড়ে হসপিটাল গুলোতে এক প্রকার হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এই ভূমিকম্পে ঘরহারা হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এখনো নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ। প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা নিখোঁজ কারো বাঁচার আশা থাকলেও সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সেই আশাও ধীরে ধীরে নিভু নিভু হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসলেই কেবল বোঝা যায় মানুষ জাতি সৃষ্টিকর্তার সাহায্য ছাড়া কতটা অসহায়।
__________
রাবাতের হসপিটাল শেইখ যায়দে ফাতিহকে এডমিট করা হয়েছে। ইসাম নিজের সাথে ল্যায়লা এবং ইয়াসিরকে নিয়ে এসেছে। হসপিটালে ইতিমধ্যে ফাতিহর মা এবং বোন ফারাহও এসে পৌঁছেছে। ওয়েটিং এরিয়াতে তারা সকলেই অপেক্ষমান। ল্যায়লার তাদের সামনে যাওয়ার সাহস হয় না। সে ফোর্থ ফ্লোরের রিসিপশন এরিয়ার পাশে একটা সিটে চুপচাপ বসে আছে। ইয়াসির তার পাশে বসা। মেয়েটা থেকে থেকে নীরবে কান্নার দাপটে খানিকটা কেঁপে উঠছে। ইয়াসির কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করে,
” ভালোবাসো? ”
ল্যায়লা চোখ বড় বড় করে ইয়াসিরের দিকে তাকায়। ইয়াসির আবার প্রশ্ন করে,
” ফাতিহ আরাবকে ভালোবাসো? ”
ল্যায়লা উত্তর দেয় না। মাথা নত করে ফেলে। ইয়াসির নীরবে হাসে। মনে মনে দোয়া করে ফাতিহর সুস্বাস্থ্যের জন্য। ইসাম কিছুক্ষণের জন্য নিচে গিয়েছিলো। খানিক বাদেই সে নাহালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে। নাহাল ল্যায়লাকে দেখে এগিয়ে আসে। ধীর স্বরে ডাকে,
” ল্যায়লা? ”
ল্যায়লা চোখ তুলে নাহালের দিকে তাকাতেই ইসাম পাশ থেকে বলে উঠে,
” আমার বৌ কে চিনতে পেরেছো? ”
ল্যায়লা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” কেন চিনবো না? ”
নাহাল এগিয়ে এসে ল্যায়লাকে জড়িয়ে ধরে। পরপরই সে ল্যায়লাকে ছেড়ে ইসামের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” শি ইজ ইঞ্জুরড। ওকে এখানে বসিয়ে রেখেছো কেন? ”
নাহালের কথায় ইসাম আর ইয়াসির দুজনই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। নাহাল ল্যায়লার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কি অবস্থা করেছো নিজের! আমার সাথে চলো তুমি। ”
ইয়াসির তাকিয়ে দেখে আসলেই ল্যায়লার পায়ের ব্যান্ডেজ রক্তে লাল হয়ে আছে। একের পর এক এতো কিছু ঘটে গেলো যে এসবের মধ্যে তার এদিকে খেয়ালই ছিলো না। সে শিট বলে উঠে দাঁড়ায়। নাহাল ইংরেজিতে বলে উঠে,
” আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি সাথে আছি। সমস্যা নেই। ”
ল্যায়লা যেতে চায় না। সে নাহালের হাত শক্ত করে ধরে বলে,
” ফাতিহ? ”
” আমি নিশ্চিত ফাতিহও তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে রাগ করতো। তাই কোনো কথা না বলে আমার সাথে চলো। ”
নাহাল ল্যায়লাকে নিয়ে প্রস্থান করতেই ইসাম ধুপ করে ইয়াসিরের পাশে বসে পড়ে। সত্যি বলতে সে-ও অনেক ক্লান্ত। কিন্তু তার ভাই সমতুল্য বন্ধুর জীবন যেখানে শঙ্কায় সেখানে তার ক্লান্তি তাকে ঠিক ছুঁতে পারছে না।
ইসাম ঘাড় ঘুরিয়ে ইয়াসিরের দিকে তাকায়। আজকে সারাদিন ল্যায়লার সাথে এই লোকটাকে দেখছে সে। কিন্তু পরিচয় জিজ্ঞেস করার সঠিক সময় কিংবা সুযোগ পায় নি। তাই এখন সুযোগ পেতেই সে জিজ্ঞেস করে বসে,
” হু আর ইউ? ”
ইয়াসির আচমকা প্রশ্নের জন্য যেন প্রস্তুত ছিলো না। সে দু দন্ড অপেক্ষা করে উত্তর দেয়,
” ল্যায়লা’স ফ্যামিলি। ”
ইসাম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” হোয়াট ইজ ইউর এক্সাক্ট রিলেশন উইথ হার? ”
ইয়াসির এবার আসলেই বিব্রত বোধ করে। এই লোক খেলা ছেড়ে গোয়েন্দায় যোগ দিয়েছে নাকি? এভাবে প্রশ্ন করছে কেন? ইয়াসির সোজা হয়ে বসে উত্তর দেয়,
” ইট’স কম্পলিকেটেড একচুয়্যালি। আই এম হার স্টেপ ব্রাদার। ”
ইসামের ভ্রুয়ের মাঝে ভাবনা রেখার ভাজ ফুটে উঠে। কিন্তু মনে মনে এটুকু শুনে সে খুশি হয় যে ইয়াসির আর ল্যায়লার সম্পর্ক ভাইবোন টাইপ। নাহয় এখনই সে ইয়াসিরকে কাঁচা চিবিয়ে খেতো। নিজের বন্ধু ছাড়া অন্য কাউকে ল্যায়লার পাশে মানতে নারাজ সে।
ইয়াসির ইসামের দৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রশ্ন করে,
” তুমি কিভাবে ল্যায়লাকে চিনো? ”
ইসাম বিড়বিড়িয়ে বলে,
” নিজের ব্রো এর অলিখিত বৌ হিসেবে চিনি। ”
__________
দুই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে হসপিটাল বেডে বসে আছে ল্যায়লা। চিন্তা এবং অস্থিরতায় হাসফাস করছে সে। নাহালের দৃষ্টি এড়ায় নি তা। কিন্তু সে ল্যায়লাকে আপাতত এখান থেকে কোথাও যেতে দিবে না। তখনই কেবিনের দরজা খুলে ইসাম এবং ইয়াসির প্রবেশ করে। ল্যায়লা তাদের দেখে চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
” ফাতিহ? ”
ইসাম হাসি হাসি মুখের আড়ালে একটু আগে ডাক্তারের কাছ থেকে শুনে আশা বার্তা লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত৷ সে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠে,
” ফাতিহ তোমার মতো এতো দূর্বল না। হি ইজ অলরাইট। অবজারভেশনে আছে। ”
ইসামের কথা শুনেও ল্যায়লা স্বস্তি অনুভব করে না৷ ইয়াসির ল্যায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” আমি ব্যাগ গুলো হোটেলে রেখে ফ্রেশ হয়ে আসি? তাড়াতাড়ি এসে পড়বো। সমস্যা হবে? ”
ল্যায়লা মাথা নেড়ে বলে উঠে,
” সমস্যা নেই। তুমি যাও। ”
ইয়াসির যাওয়ার আগে নাহালকে বলে যায় ল্যায়লার খেয়াল রাখতে। সে চলে যেতেই নাহাল ইসামকে বলে উঠে,
” আমার সাথে একটু চলো তো। ”
ইসামও নাহালের পিছু পিছু কেবিন থেকে বের হয়। কেবিনের বাহিরে গিয়েই নাহাল প্রশ্ন করে,
” ফাতিহর কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলেছে? ”
ইসামের গলা ধরে আসে। সে কোনোমতে বলে উঠে,
” হি ইজ ক্রিটিক্যাল। ওর পা হয়তো ভারী কিছুর নিচে চাপা পড়েছিলো। ওর দুই পা বাজে ভাবে ইঞ্জুরড হয়েছে। ”
নাহাল হতভম্ব স্বরে বলে,
” আল্লাহ! ওর ক্যারিয়ার? ”
ইসাম আর নিজেকে সামলাতে পারে না। সে নাহালকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
” ও শুধু বাঁচলেই হবে না। ওর সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হতে হবে। ফুটবল ওর আত্মার সাথে মিশে আছে। খেলতে না পারলে ও মরে যাবে। ”
নাহাল ইসামকে আগলে ধরে। সে কি বলে শান্তনা দিবে? এরকম পরিস্থিতে শান্তনা দেওয়া আদৌ সাজে? ইসাম সোজা হয়ে নিজের ভেজা চোখ জোড়ার অশ্রু মুছে বলে উঠে,
” তুমি আন্টি আর ফারাহ আপুর কাছে যাও। আমি ল্যায়লার কাছে আছি। ”
নাহাল যাওয়ার আগে ইসামকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বলে,
” সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
__________
ল্যায়লার শরীর বিরতিহীনভাবে কাঁপছে। সে নিজেকে যতটাই শান্ত করার চেষ্টা করছে ততটাই এলোমেলো হয়ে পড়ছে। এরকম হচ্ছে কেন? ইসাম তো বলে গেলো ফাতিহ ঠিক আছে। তবুও তার মন মানতে নারাজ কেন? ল্যায়লা চাইলেও পারছে না ফাতিহর পরিবারকে ডিঙিয়ে তার কাছে যেতে। কি পরিচয়ে কিংবা কোন অধিকারে যাবে সে?
তার ভাবনার মাঝেই ইসাম রুমে আসে। ল্যায়লার বেডের পাশে একটি চেয়ারে বসে। তারপর আচমকাই প্রশ্ন করে,
” কাউকে হারানোর ভয় অনুভব করতে পারছো ল্যায়লা? ”
ল্যায়লা মাথা তুলে ইসামের দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। ইসামকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। খুব গম্ভীর আর ক্লান্ত। ইসাম বলে,
” জানতে চাইবে না ফাতিহ কেন অ্যাটলাস শৃঙ্গে গিয়েছিল? ”
ল্যায়লা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ইসাম নিজেই জবাব দেয়,
” ফাতিহ যোহরার জন্য ১২ই ফেব্রুয়ারী অ্যাটলাস শৃঙ্গে গিয়েছিলো। ”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]