আঁধারে_আলোর_হাতছানি অষ্টম পর্ব (অন্তিম)

#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
অন্তিম পর্ব

আলোর স্বপ্নের পথের দেয়াল হিসেবে আলোর বাবা ‘বিয়ে’ নামক শব্দটা এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ নিয়ে তার বেশ মন খারাপ। প্রায় সময় সে কান্নাকাটি করে। তার বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললে তার বাবা জানায়, তার বয়স হয়েছে। কোন কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই তাকে যোগ্য কারো হাতে তুলে দিতে চায়। এরপর আর কোন কথা বাড়ায় নি আলো।
কয়েকদিনের ভেতর পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসে। পাত্র নাকি তার কাজের ব্যস্ততার জন্য আসতে পারে নি। তাই তার বাবা-মা এসেছে। অবশ্য সমন্ধটি আফসানা বেগম এনেছিলেন। আফসানা বেগম ও পাত্রের বাবার আচার ব্যবহার আলোর কাছে ঠিক লাগে নি।
আলোর মন খারাপ দেখে তার বাবা তার কাছে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলে,
“মা-রে, মন খারাপ করিস না। আজ হোক বা কয়েক বছর পর, তোকে তো বিয়ে করতে হতো।”
“বাবা, সেটা কোন সমস্যা না। কিন্তু আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তা মেনে নিবে বলে মনে হয় না,” আলো মন খারাপ করেই বলে।
“দেখরে মা, তুই বেশিরভাগ সময় আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিস এটা বলে যে, আল্লাহ তায়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তবে কেন নানান চিন্তা করে মন খারাপ করছিস?”
“হুম,” আলোর মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের হয় না।
বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। পাত্রপক্ষ শুধুমাত্র মেয়েকে চায় এবং ইসলামিক ও সুন্নতি নিয়মে ঘরোয়াভাবে বিয়ে পড়াতে চায়। আলোর বাবা এতে সম্মতি জানায়। কিন্তু আলোর থেকে সিদ্ধান্ত জানতে গেলে সে অসম্মতি জানায়। এতে আলোর মা জিজ্ঞাসা করেন,

“কেন? এতে তোর কিসের আপত্তি? তুই তো এমনভাবেই বিয়ে করতে চেয়েছিস।”
“মা, তোমরা কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে যাচ্ছ? আমি তো তার আতাপাতা কিছুই জানি না, আর না তাকে আজও দেখেছি। তোমরা দেখেছ?” আলোর প্রশ্নে তার মা একটু করে হাসেন। সে মাথাকে হ্যাঁ সূচক নাড়িয়ে বলে,
“দেখেছি তো। সেদিন ছবি দেখেছি।”
“মা, এখনকার যুগেও ছবি? সামনা-সামনি দেখবে বলে কি একবারও ঠিক করো নি?” আলো বেশ বিরক্ত হয়ে যায়।
“তোর এতো সমস্যা তবে তোর বাবাকে বলে দেখা করানোর ব্যবস্থা করছি। তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই তোর?”

আলোর মায়ের প্রশ্নে আলো না সূচক মাথা নাড়ায়। আলোর মা কক্ষ থেকে চলে যায়। আলো শয়তানি হেসে বলে,
“এবার দেখব, আপনি কিভাবে আমায় বিয়ে করেন?”
দ্রুত খাতা কলম নিয়ে কিছু লিখতে বসে আলো। পয়েন্ট করে মোট ১৫টা পয়েন্ট লিখেছে সে। কাগজের বড় একটি খামের ভেতর কাগজগুলো ভরে হাত ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়৷ হাত ঝেড়ে বলে,
“কোন সমস্যা নেই। প্রথম পরিকল্পনা কাজ না করলে দ্বিতীয় পরিকল্পনা অবশ্যই কাজে লাগবে। ইয়া আল্লাহ, আমায় ক্ষমা করে দিও।”

আলোর মা আলোকে বলা কথানুযায়ী কাজ করে। পাত্রের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়। সপ্তাহের শুক্রবার ছুটির দিন, তাই এই দিনটিকেই ঠিক করা হয়। বিকালে প্রাত্যহিক দিনের মতোই আলো প্রস্তুত হয়ে নেয়। মায়ের থেকে নেওয়া ঠিকানায় গিয়ে অপেক্ষা করে।
ক্যাফের একটি টেবিলের চেয়ারে বসে আছে আলো। একবার ঘড়িতে তো একবার ক্যাফে প্রবেশের পথে তাকাচ্ছে। তার মায়ের দেওয়া বর্ণনানুযায়ী কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
আলো ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল সে সময় কেউ একজন এসে তার সামনের চেয়ারটিতে বসে। আলো তাকানোর আগেই ব্যক্তিটি সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়ে আলো ব্যক্তিটির দিকে তাকায়। বেশ অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকায়। সে বলে,
“আঁধার, আপনি এখানে কি করছেন?”
“আমি প্রতি শুক্রবার এই ক্যাফে আসি। হঠাৎ তোমাকে একা বসে থাকতে দেখে ভাবলাম একটু সঙ্গ দেওয়া যাক। তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছ?” শেষোক্ত বাক্যটি আঁধার থেমে থেমে বলে।
“হুম, অপেক্ষা করছি। আর আপনি যদি এখান থেকে মানে আমার থেকে দূরে গিয়ে বসেন তো ভালো হবে,” আলো জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে।
“আমি তো দূরেই আছি। দেখো, কতটা দূরত্ব। দুই ফুটের বেশি,” আঁধার দুজনের মাঝের টেবিলে তাকিয়ে মাপতে মাপতে বলে।
“আমি তা বলি নি। অন্য একটি টেবিলে গিয়ে বসুন। আমার হবু স্বামী আসবে৷ তিনি এসে যদি আপনাকে আমার সাথে দেখে তো সমস্যা হবে,” আলো বিরক্ত হয়ে বলে।
“ওহ, তাই নাকি? তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ? আমায় জানালেও না। আর তোমার তো পড়ালেখা শেষ হয় নি এখনও,” আঁধার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“যাক, কেউ তো আমার পড়ালেখা নিয়ে চিন্তা করল। বাসায় মানছে না এ ব্যাপারটা। বাবা ভয়ে আছেন, আমাকে যোগ্য কারো হাতে তুলে দেওয়ার আগে তার কিছু হয় যদি, তা নিয়ে,” আলো স্বাভাবিক হয়ে বলে।
“তাহলে কি করার? বিয়েটা করেই নিবে! আচ হা, খামে কি রাখা আছে?” আঁধার খাম দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব তাকে। না মানলে এটায় কিছু কনট্রাকট আছে, যেগুলোতে স্বাক্ষর করাবো।”
“যদি স্বাক্ষর করতে না চায় তো?” আঁধার এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে।
“বিয়ের আগে কথানুযায়ী একটা স্বাক্ষর করতে পারবে না, সে যে বাকি জীবন আমায় কি সুখে রাখবে সেটাই বাবা মাকে বলব। বিয়ে আপনা-আপনি ক্যান্সেল।”
“বাহ! খুব ভালো। আমি কি একটু দেখতে পারি?”
“আপনি এখনও এখানেই বসে আছেন কেন?”
“আজব তো! আমি তোমায় একদিনের জন্য হলেও শিক্ষা দিয়েছি তো! তো তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী কেমন হবে তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা আমার কর্তব্য।”
আলো উত্তর দেয় না। কাগজের খামটি আঁধারের হাতে দিয়ে ভেঙচি কেটে বসে থাকে। এর মাঝে আঁধার দুই কাপ কফির অর্ডার করে। আলো প্রথমে রাগান্বিত হলেও পরবর্তীতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে পান করে। কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা সে-ই আসছে না। এদিকে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। রাগান্বিত ও বিরক্তি নিয়্যে আলো তার মা’কে কল করে। কল রিসিভ হতেই অগ্নি কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কোথায় তোমাদের হবু মেয়ের জামাই? এতক্ষণ যাবত অপেক্ষা করাচ্ছে এখনই। ইচ্ছে করছে ভর্তা বানাতে।”
“সে-কি? সে তো তোর আগেই ক্যাফে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে বলে জানিয়েছিল।”
আলোর মায়ের কথায় আলো আশেপাশে ভালোমতো তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু জোড়া কবুতর ব্যতীত একা কাউকে দেখা যায় না। এবার আলো আরো বেশি রেগে যায়। সে তার মা’কে বলে,
“সে আসে নি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না। আমি বাসায় ফিরছি।”
ফোন কেটে দিয়ে আলো বিরবির করে কিছু পাঠ করে। আঁধার জিজ্ঞাসা করে,
“কি কি বকা দিচ্ছ?”
“বক্স নয়, আয়াতুল কুরসি পাঠ করছি, এতে রাগ কমে যায়,” আলো তার ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বলে।
আঁধার নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেই।”
“দরকার নেই, ধন্যবাদ।”
“সমস্যা নেই, তোমার বাবা আগে থেকেই আমার সম্পর্কে জানেন। যখন তোমায় পড়িয়েছি, তখন,” আঁধার বাইকের চাবি ঘুরিয়ে বের হয়ে যায়।
আলো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবছে এক।আপদের সাথে দেখা করতে এসে অন্য আপদের সাথে তার দেখা। উপায় না পেয়ে আঁধারের সাথেই বাড়ি ফিরে আলো। কেননা এমনিতেও রাত হয়ে গিয়েছে। আঁধারের থেকে বিশ্বাসী এই রাতে কাউকে যে পাবে না তা ভালোই বুঝতে পারছে আলো।
বাড়ির সামনে এনে নামিয়ে দিতেই আলো আঁধারের উদ্দেশ্যে ভদ্রতার খাতিরে বলে,
“ভেতরে আসুন।”

আঁধার আপত্তি না করে বাইকের চাবি নিয়ে আলোর সাথে ভেতরে যেতে আরম্ভ করে। আলো এতে বেশ হতবাক হয়। আঁধার হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“আচ্ছা, আলো। তুমি তো ইংরেজি ভালো পারো, তাই না?”
“মুটামুটি, কেন?”
“আমি A,B,C,D ভুলে গিয়েছি। একটু শুনাবো, তুমি ভুল ধরিয়ে দিবে। প্লিজ না করবে না।”
“আচ্ছা।”
আলো ও আঁধার আলোদের বসার ঘরে চলে এসেছে ইতিমধ্যে। আলো বেশ অবাক হয়ে যায় উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখে। পাত্রপক্ষ, আফসানা বেগম ও তার বাবা মা একত্রে বসে আছেন, সাথে কাজী সাহেবও। কিন্তু পাত্রের দেখা নেই।
” A,B,C,D,E,F,G,,,”
টুইংকেল টুইংকেল ছন্দের সুর দিয়ে বলতে বলতে আঁধার হাঁটতে হাঁটতে আলোর পেছন থেকে সামনে চলে আসে। হঠাৎ আলোর সামনে প্রপোজ করার স্টাইলে হাঁটু গেড়ে বসে একটি স্বর্ণের আঙটি বের করে তার সামনে ধরে। আঁধার বাকিটুকু একই সুরে বলে,
“Alo, I love you. Will you marry me?”

আলো বেশ অবাক হয়ে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা ঘটছে তা আলোর বুঝতে বেশ সময় লাগে। আলো অবাক হয়ে আঁধারের উত্তরের পরিবর্তে প্রশ্ন করে,
“তবে পাত্রটা আপনি?”
“যেই মেয়ে আমার প্রাত্যহিক অগোছালো জীবনকে কয়েকমাসের মধ্যে গুছিয়ে দিয়েছে, যেই মেয়ে আমায় নামাজ আদায়ের অভ্যাস গড়ে দিয়েছে, যেই মেয়ে কথায় কথায় ‘আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ’ বলতে শিখিয়েছে সেই মেয়েকে কিভাবে হাতছাড়া করি? তুমিই তো এই ‘আঁধারে আলোর হাতছানি’।”
“আমি কেন আপনাকে বিয়ে করতে যাবো?” আলো কঠিন গলায় প্রশ্ন করে।
এই প্রশ্নের উত্তর আঁধারকে দিতে হয় না। আঁধারের বাবা,মা ও সৎ মা এর উত্তর দিয়ে দেয়। আঁধারের মাঝেত সকল পরিবর্তন সম্পর্কে বলে। যখন তারা জানতে পারে এতো পরিবর্তনের মূল কারণ আলো, তখনই আলোকে নিজের ঘরের পুত্রবধু করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আঁধার আলোর উদ্দেশ্যে বলে,
“ওহ হ্যালো, ম্যাডাম। আর কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকব? পা ব্যথা হয়ে আসছে তো। আপনার শেষ প্রশ্নের উত্তর, আমি কাগজেও সাইন করে দিয়েছি। চেক করে দেখুন এবং আমায় উত্তরটা জানান।”

আলো দ্রুত ব্যাগ থেকে কাগজের খাম বের করে দেখ্ব সত্যিই আঁধার স্বাক্ষর করে দিয়েছে। আলো বুঝতে পারে আঁধার ক্যাফেই এই কাজ করেছে। আলো কিছু একটা ভাবার অভিনয় করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“কনট্রাকটে যখন স্বাক্ষর হয়েছে, তখন আমার কোন আপত্তি নেই।”

আঁধার হেসে আলোর হাতে আঙটি পরিয়ে দেয়। এরপর ইসলামিক নিয়মনীতি অনুযায়ী দুই পরিবারের মাঝে বিয়ের কাজটাও সম্পন্ন হয়ে যায়।

আঁধার ও আলোর বিয়ের ছয়মাস পরের ঘটনা। আলো সবে মাত্র ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। অমনি আঁধার আলোকে টেনে তুলে বসিয়ে দেয়। আলো বিরক্ত হয়ে বলে,
“কি হয়েছে? টানাটানি করছেন কেন?”
“কুরআন তেলওয়াত শুনবো,” আঁধার বলে।
“হায় আল্লাহ! বাঁচাও আমায়। যখন তখন এটা করো, ওটা করো।”
“দেখো আলো, তুমি আমার বউ। আমি এমন একজনের সাথে কখনও সংসার করব না, যে ফরজ ও শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত করে না।”
আলো আঁধারের কথা শুনে নিজের কপালে হাত দেয়। কারণ এমন কিছুই আলো একসময় আঁধারকে বলেছিল। আঁধার হেসে বলে,
“মাথায় হাত দিয়ে লাভ নেই। পরকালেও আমার সাথেই জান্নাতে যেতে হবে এবং তার জন্য নিজেকেও কাজ করতে হবে সাথে আপনাকেও।”

উপায় না পেয়ে আলো বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। মাঝে মাঝে আলো বেশ অবাক হয়ে যায় এটা ভেবে যে, আঁধারের মাঝে এতো পরিবর্তন কিভাবে এসেছে। পরমুহূর্তে আলো আল্লাহ তায়ালার নিকট শুকরিয়া আদায় করে।
আলো মনোযোগ সহকারে কুরআন তেলওয়াত করছে এবং আঁধার চোখ বন্ধ করে তা শুনছে। আঁধারের মনে হচ্ছে, এখন সে পরম শান্তিময় একটি স্থানে বসে সবচেয়ে শ্রুতিমধুর তেলওয়াত শুনছে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা, এক অদ্ভুত শান্তি কাজ করছে তার সমস্ত দেহ ও মনে।

সমাপ্ত।।।।।। See less

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here