আঁধারে_আলোর_হাতছানি ৫ম পর্ব

#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
৫ম পর্ব

নিজের রাগকে সংযত করে আলো আঁধারের পানে তাকায়। সে আগ্রহী দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করে,
“সেদিন তো খুব টাকার গরম দেখিয়েছেন। আজ আবার সরিও বলছেন!”
“নিজেকে হাই লেভেলের কিছু ভাবতে হবে না। ভুল করেছি, বুঝিয়ে দিয়েছ তাই সরি বলেছি।”
আঁধার বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলে উল্টো পথে ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আলো অস্পষ্ট কন্ঠে আঁধারকে ডেকে থামিয়ে দেয়। আঁধার পেছন দিকে ঘুরে। আলো বলে,
“আমার সরিতে কাজ হবে না। মানে, অন্যভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।”
“আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারা দেখো,” আঁধার নেতিবাচকভাবে কথা বলে।
“আরে, আরে। সম্পূর্ণ না শুনেই আমায় বিচার করে ফেলছেন? তবে বলে রাখি, আপনিও খুব সুদর্শন ব্যক্তি না।”
আলোর কথায় আঁধার বেশ বিরক্ত হয়। কিন্তু কেন যেন সে ভালোমতো দাঁড়ায়। গম্ভীর দৃষ্টিতে আলড় দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“সমস্যা কি?”
“সমস্যা আমি ম্যাথম্যাটিকসে দূর্বল। আমায় পড়াতে হবে,” আলো একদমে বলে উঠে।
“যত্তসব,” আঁধার আলোর কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে যেতে দুকদম পা বাড়ায়৷ আলো পুনরায় তাকে ডেকে বলে,
“নয়তো আপনার একটু আগের কর্মকাণ্ড আমি সকলের কাছে ফাঁস করে দিব।”
আঁধার থমকে দাঁড়ায়। তার চোখে এবার ভয় নেমে আসে। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়।
“কিছুক্ষণ আগের কর্মকাণ্ড? ”
“এই যে, এটা,” আলো আঁধারের দিকে নিজের মোবাইলটা বাড়িয়ে দেয়।
মোবাইলের স্ক্রিনে আঁধার এবং একটি ছেলের সদ্য তোলা ছবি, যেখানে আঁধার ছেলেটিকে কিছু টাকা ও একটি বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। আঁধার ভয়ে ভয়ে আলোকে জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি এটা কোথায় পেলে?”
“এই গুলো যে আমি দিয়েছি তা যেন কেউ জানতে না পারে, তবে খুব খারাপ হবে। কালকে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হবি। আর গ্যারেজে কাজ করতে হবে না। তোর দায়িত্ব আমি নিলাম। বুঝেছিস, রুহুল? ”
“শুধু ছবিই নয়, বরং তুমি সবটা শুনেও ফেলেছ?” আঁধার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“হুম, শুনেছি। যতটুকু বুঝেছি, আপনি খারাপ না, খারাপ হয়ে থাকেন। অন্যের সাহায্য বা উপকার করেও তা গোপন রাখেন। নিজের ক্রেডিট নিতে চান না। এখন আমার প্রস্তাবে রাজি না হলে, ক্রেডিট পাইয়ে দিব।”
আলো কথাগুলো বলে মুচকি হেসে ভ্রু নাচায়। আঁধার চিন্তায় পরে যায় এতে। কিছুক্ষণ মাথা চুলকে তারপর বলে,
“কবে থেকে পড়াতে হবে?”
“আপনার মোবাইল নাম্বার দিয়ে যান, আমি কল করে জানিয়ে দিব।”
আলোর কথানুযায়ী আঁধার তার মোবাইল নাম্বার দেয়। আলো পেছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“চিন্তা করবেন না, আমার সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই ছবি আমার কাছেই সুরক্ষিত থাকবে। আমার সমস্যা সমাধান হলে আপনারটাও সমাধান হবে।”

রাস্তায় রাতের অন্ধকারে আলো মিলিয়ে যায়। আঁধারের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এখন। এসমস্ত ভালো কাজের ব্যাপার লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছে সে। রাতের আঁধার ব্যতীত ও সে তার বেশ গোপনীয় ব্যাপার আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নি। কিন্তু আলো, সে জেনেছে। রাগে নিজের হাতে থাকা মোবাইলটি ভেঙে ফেলার জন্য শূন্যে তুলে আঁধার। কিন্তু পরক্ষণে সে ভাবে, মোবাইল নষ্ট করলে তাকে আবারও কয়েক হাজার টাকা দিয়ে নতুন মোবাইল ক্রয় করতে হবে। হয়তো এই টাকা দিয়ে অন্যকারোর দিকে নীরবে, গোপনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে। পকেটে মোবাইল রেখে সে হাঁটতে থাকে। চাঁদহীন রাতের আঁধার একেবারে কালো নয় যে , আশেপাশের কোন বস্তু দেখা যায় না। অস্পষ্ট বা ছায়ামূর্তির মতো হলেও অন্ধকারে আশেপাশের পরিবেশ বেশ ভালোমতো দেখতে পাওয়া যায়। আর রাতকে একেবারে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া থেকে নক্ষত্র বা তারা সাহায্য করে। মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা তারার আলোতে অমাবস্যা রাতের অন্ধকারও একেবারে অন্ধকার হয় না। আঁধার মাহমুদও অমাবস্যার রাতের সেই নক্ষত্রের মতোই। একটু হলেও অন্ধকার দূর করে কিন্তু নিজেকে এমনভাবে গোপন রাখে যেন সমাজের উন্নতি অবনতি নিয়ে তার কিছু যায় আসে না।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে করতে আলো আপন মনে বলতে থাকে,
‘আল্লাহ তায়ালা যা করেন আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। নয়তো আঁধারকে ব্ল্যাকমেইল করার উপায় এতসহজে ও তাড়াতাড়ি আমি পেতাম না।”

খুশি মন নিয়ে বাড়ি ফিরে আলো। নিজের বাবাকে আঁধারের ব্যাপারে জানায়। আলোর বাবা অসম্মতি জানায় না। তিনি বলেন,

“তবুও একটু সাবধানে কাজ করিস। আজকালের কাউকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”
“জ্বি, বাবা। অবশ্যই,” আলো উত্তরে মুচকি হেসে বলে।

পরদিন,

হাজার চিন্তাভাবনা করে আঁধার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, আলোকে পড়ানোর ব্যাপারটা তাকে গোপন রাখতে হবে। সেজন্য একটি কোচিং সেন্টারে কথা বলে। কিন্তু কথায় কাজ হয় না বলে বিল্ডিংয়ের মালিককে টাকা দেয়। বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম নিয়ম। টাকা থাকলে আবার না করতে নেই। দুই ঘন্টার জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময় ঠিক করা হয়। অন্যান্য টিচাররা তাদের ছাত্রছাত্রীদের পড়াবে এবং আঁধার আলোকে। এতে অন্যকোন বাজে কথাও ছড়বে না, আলোকেও পড়াতে পারবে। সবকিছু ঠিক করে আঁধার এবার স্বস্তি পায়।
বিকালের দিকে আতিফ ও হায়দারের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় অপরিচিত নাম্বার থেকে তার ফোনে কল আসে। আঁধার আতিফ ও হায়দারের থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে কল রিসিভ করে। কথার শুরুতে নারী কন্ঠে সুন্দরভাবে ও গুছিয়ে অপরপাশ থেকে একজন সালাম দেয়। আঁধার বুঝতে পারে মেয়েটি আলো। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞাসা করে,
“কে আপনি?”
“আমি আলো। সালামের উত্তর নেওয়া ওয়াজিব।”

আলো ভদ্র ও শান্তভাবে বলে। কিন্তু তবুও আঁধার সালামের উত্তর নেয় না। সে আলোর কথা উপেক্ষা করে জিজ্ঞাসা করে,
“কয়টা থেকে পড়াতে হবে? আমি ঠিকানা মেসেজ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“আপনি সালামের উত্তর নিবেন নাকি আপনার ছবি ভাইরাল করব?” আলো কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। এবার বলো,” আঁধার বিরক্ত হয়ে বলে।
“এবার ঠিকাছে। এরপর আরেকদিন এই ভুল হলে না, ছবি ভাইরাল। আর হ্যাঁ, ঠিকানাটা মেসেজ করে পাঠিয়ে দিন। সপ্তাহে যে কয়দিন পড়াবেন, আসরের নামাজের পর থেকে শুরু করবেন।”
“হুম, আচ্ছা।”

আলো কিছু বলার আগেই আঁধার কল কেটে দেয়। আঁধার কল কেটে দিতেই আলো বলে উঠে,
“কি রে বাবা? কথা বলা শেষ হলে যে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলতে হয়, তাও বলল না।”

আঁধার কলে কথা বলে তার বন্ধুদের কাছে ফিরে আসে। বাইকে চড়ে বসে হেলমেট লাগাতে লাগাতে বলে উঠে,
“আজ থেকে বিকাল টাইম আড্ডা দিতে পারব না। একটু কাজ আছে। আসছি আমি,” আতিফ ও হায়দারের ক্ষেত্রেও কোন প্রশ্ন করার সুযোগ দেয় না আঁধার।
ইতিমধ্যে আলোকে ঠিকানা ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিয়েছে। আলোর নিজ এলাকায় হওয়ায় সে বেশ খুশি হয়েছে। ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না তার। কোচিং সেন্টারের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আছে আলো। আঁধারের আসতে দেরি হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আঁধারের আগমন ঘটে। বাইক থেকে নামতে না নামতেই আলো বলে উঠে,

“কল কাটার সময় আল্লাহ হাফেজ বলতে হয়, তা কি জানেন না?”
“পরবর্তী সময় থেকে এমন হবে না। ভেতরে চলো,” বাইকের চাবি হাতে নিয়ে বলল।
“এক মিনিট,” আলো এক কদমও এগোয় না।
“কি হলো আবার? ভয়ের কোন ব্যাপার যেন না থাকে, তাই কোচিং সেন্টারে ব্যবস্থা করেছি।”
“না, সেসব না। আপনি নামাজ আদায় করেছেন?” আলো প্রশ্ন করে।
“না, ” আঁধারের চোখেমুখে আবারও বিরক্তিভাব।
“আমি এমন স্যারের থেকে জ্ঞানার্জন করব না, যে কি না তার সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসে না, তার ডাকে সাড়া দেয় না।”
“না পড়লে নাই, আমারও সময় নষ্ট করার ইচ্ছা নেই,” আঁধার বলতে বলতে বাইকের দিকে যায়।
আলো নিজের ফোন বের করে ঘাটতে ঘাটতে বলে,
“তবে আপনার ভাইরাল হওয়ার খুব শখ জেগেছে, বুঝেছি।”
“যাচ্ছি তো। কথায় কথায় ভাইরাল করার হুমকি,” আঁধার বিরক্ত হয়ে বাইক থেকে নামে। আলোর হাতে বাইকের চাবি দিতে দিতে সে বলে,
“এক আমানত যখন রেখেছি, কয়েক মুহুর্তের জন্য আরেকটা রাখো।”

কোচিং সেন্টার থেকে একটু দূরেই এক মসজিদ। আঁধার সেদিকেই চলে যায়। আলো দাঁড়িয়ে বিজয়ী হাসি হাসে। নামাজ আদায় করে আঁধার ফিরে আসে। শুরু হয় আলোকে পড়ানো।
বেশ কয়েকবার একটি টপিক আলোকে বুঝাচ্ছে সে। কিন্তু যখনই আলোকে প্রশ্ন সমাধান করতে দেয়, তখন বারংবার আলো ভুল করে। আঁধার বই দিয়ে আলোর মাথায় বারি দেয়। সে বলে,
“একটস থিওরি কতবার বুঝাবো? এবারই শেষ। পারলে পারবে, নয়তো বাসায় চেষ্টা করবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।”
আলো উত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। শেষবারের মতো বুঝিয়ে দিলে আলো সমাধান করতে সক্ষম হয়। কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে আলো আঁধারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার ব্যাপারটা খেয়াল করে। সে ইশারায় কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করে। আলো তার পেছনের মসজিদের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আযান শেষ হয়েছে। আঁধার বুঝতে পারে আলো কি বলতে চাচ্ছে। কপাল কুঁচকে মসজিদের দিকে এগিয়ে যায় আঁধার। আলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ধমক দিয়ে উঠে তাকে। আলোও পাল্টা ধমক দেয়। নামাজ আদায় করে আঁধার ফিরে আসে। আলো তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার বেশ অবাক হয় এতে। সে আলোকে প্রশ্ন করে,
“যাও নি এখনও?”
“হ্যাঁ, আমি চলে যাই তা দেখে আপনি মসজিদে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যান। তাই তো?” আলো একটু ব্যঙ্গ করে বলে।
আঁধার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাইকে না উঠে রিকশা ডেকে আলোকে রিকশায় উঠিয়ে দেয়। সে আলোকে কড়াভাবে বলে,
“বাসায় পৌঁছে কল বা ম্যাসেজ দিয়ে জানাবে। আর সমস্যা হলে মিসড কল দিবে। কেমন?”
“আমি তো ভাবছি আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য আপনি ছটফট করছেন। এখন দেখি আমার নিরাপত্তার চিন্তা করছেন!” আলো অবাক হয়ে বলে।
“তুমি নারী, আমার মায়ের জাত। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই কাজ করতাম৷ এক্সিডেন্টের ঘটনাটা আলাদা হিসাব। সেসব জানতে হবে না। যাও এখন,” আঁধার কথাটা বলে রিকশাওয়ালাকে ইশারা করে যাওয়ার জন্য।
আলো চলে গেলে নিজেও বাইকে উঠে বসে। আঁধারের কথায় আলো কেমন যেন অনুভব করে। তার মনে হয় আঁধারের কোন খুব কষ্ট ও গোপন কোন বিষয় আছে, যা সে কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না।
দেখতে দেখতে, একমাস, দুইমাস তিনমাস পার হয়ে যায়। আলোকে পড়ানোর সাথে তার প্রাত্যহিক জীবনের কিছু নিয়মের ব্যঘাত ঘটে অর্থাৎ নতুন কিছু ব্যাপার যুক্ত হয়, যা আলো তাকে হুমকি দিয়ে দিয়েই করায়। সকালের ঘুম ভাঙে আলোর একশত ফোন কলের মাধ্যমে। দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাতেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটে না। এতবার কল করার একটামাত্র কারণ, আর তা হচ্ছে নামাজ আদায়। ধীরে ধীরে এসব ব্যাপার আঁধারের কাছে বেশ বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে আতিফ ও হায়দায় আলোকে পড়ানোর ব্যাপারটা জেনেছে। মাঝেমধ্যে আঁধারকে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে ভেবে দুজন খুব করে হাসি ঠাট্টা করে।

চলবে,,,,,, See less

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here