আকাশী পর্ব ৩১

“আকাশী”
পর্ব ৩১.

মৃদু আলো মুখের ওপর এসে পড়ায় আকাশীর ঘুম ভেঙে যায়। বামপাশের বেলকনির সামনের হালকা সাদা পর্দাটা স্থির হয়ে আছে। উপরের দিকে অনেকগুলো ফুল দেখে তড়িঘড়ি করে সে ওঠে পড়ে। নিত্য দৈনন্দিন ব্যাপারে এসব ভিন্নতা দেখে তার শুরুতে মাথা কাজ করেনি। পরে অনুভূত হয়, সে আর মামার বাসার মামাতো বোনদের ছোট্ট ড্রয়িং রুমে নেই। এখন সে ছোটচাচির বাসায়। উফ, স্লিপ অফ টাং। সে এখন শ্বশুরবাড়িতে। তৎক্ষণাৎ তার কাছে অপূর্বের কথাও মনে পড়ে। কাল তার মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগেছিল। এরপর কবে চোখজোড়া বেঁধে এসেছে, তা সে টের পায়নি। ডানপাশ ফিরে সে অপূর্বকে দেখতে পায়। ছোট প্রস্থের এই বিছানার একপাশে তার বিপরীত দিকে ফিরে ঘুমিয়ে আছে। তার চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। পরক্ষণে চোখ পড়ে একটা বালিশের ওপর, যা তার আর অপূর্বের মাঝ বরাবর আছে। তা দেখে আকাশীর সকালটাই খারাপ হয়ে গেছে। তার মনে অনেক আগেই সন্দেহ ছিল। এতো সহজে অপূর্ব তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবেন না! তার হাবভাবেই সে বুঝত।
অতিরিক্ত চিন্তা না করে সে ওঠে পড়ল। চিন্তা যত বড়ই হোক, সে কখনও সকালের শুরুটা চিন্তায় মগ্ন থেকে করে না। সে ওঠে পর্দার দিকে এগিয়ে যায়। কালরাত বেলকনির দরজা খোলা ছিল। বাতাস আসছিল। বাতাসকে উপভোগ করার জন্যই খোলা রেখেছিল। কিন্তু লম্বা গ্লাসের দরজাটা এখন বন্ধ। আকাশী যদিও সময়টাকে মিস করেছে, তবু ভাবার চেষ্টা করল কালরাত কী হয়েছিল। অপূর্ব কাল বিয়েতে দামি একটা পাঞ্জাবি পরেছিলেন। ভেতরে সাদা প্লেইন পাঞ্জাবির ওপরে একটা গর্জিয়াস হালকা বাদামি রঙের ওভারকোট ছিল, যেটা বুকের পর থেকে ‘V’ শেইপে খোলা। তিনি আসার পর ওভারকোটটা আগেই খুলেছিলেন। সারারাত নরমাল পাঞ্জাবিটা পরে ছিলেন। রুমে এসে সম্ভবত প্রথমে ওটা খুললেন। তারপর ফ্রেশ হয়ে এখন পরে থাকা আকাশী রঙের শার্টটা পরেছিলেন। তারপর এখানের বেলকনির দরজা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়েছিলেন। এই ফাঁকে হয়তো ঘুমন্ত তার দিকে কয়েকবার তাকিয়েছিলেন। এমনটা হতেই পারে না তিনি একবারও তাকাননি। আকাশীকে পছন্দ না করলেও, অভ্যস্ত একা শোয়ার রুটিনটা থেকে বেরিয়ে এই মেয়েটার সাথে এখন থেকে থাকতে হবে, এই ব্যাপারটা তাকে সম্ভবত একবার হলেও আকাশীর দিকে তাকাতে বাধ্য করেছে। অপূর্বের স্থলে থাকলে তো সে এই কাজটাই করত। মানুষটা যেমনই হোক, এর সাথে যে এখন থেকে থাকতে হবে, তা ভেবে অন্তত একবার অদ্ভুত চোখে লোকটার দিকে সে তাকাত। এরপর সম্ভবত অপূর্ব ইতস্তত করেছেন, হুট করেই এই মেয়ের সাথে কেমনে ঘুমান! রাতে যদি আবার মেয়েটা তার কোমরের ওপর পা তুলে দেয়, কিংবা অর্ধরাতে তার চারকোণো মুখের ওপর ধাম করে আকাশী হাত ফেলে! না, সেফটি দরকার। হয়তো এজন্যই কিছুটা ইতস্তত করে মাঝখানে একটা বালিশ দিয়েছেন। নয়তো অন্য কোনো কারণে। অন্য কারণটা আকাশী ভেবে খুঁজে পায় না। তারপর একসময় হয়তো তার রাজকুমারটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশ, খেয়ালই করেনি, রাজকুমারের চেহারাটা সে একবারও দেখেনি। তড়িঘড়ি করে আকাশী বেলকনি থেকে বেরিয়ে এসে দেখে অপূর্ব বিছানায় নেই। বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ এলে সে বুঝতে পারে, ঘুমন্ত মুখটা দেখতে একটু দেরি করে ফেলেছে। তার খেয়ালে এতোই মগ্ন ছিল যে, তার দিকে তাকানোর কথাই ভুলে গিয়েছে।
আকাশী নিজে এখনও ফ্রেশ হয়নি। কেন যে আগেভাগে বেলকনির দিকে গিয়েছে! সকাল ঘুম থেকে উঠলে বিগড়ে থাকা চেহারা, চুল কিংবা শরীর কাউকেই দেখাতে ইচ্ছে হয় না। সে এক কোণায় মুখের ওপর চুল এনে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেই অপূর্ব বেরুয়, আকাশীর দিকে তার চোখ যায়। মেয়েটা অন্যদিকে ফিরে আছে। এলোমেলো চুল এসে মুখটাকে ঢেকে দিয়েছে। শাড়ির কুঁচিগুলো ডানদিকে আরও খানিকটা চলে এসেছে। অগোছালো অবস্থায় কাউকে এতো ভালো দেখায় তা জানা ছিল না। এসবের পরোয়া না করে সে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার দিকে এগিয়ে যায়। আকাশী সে সুযোগে একপ্রকার তড়িঘড়ি করে ছুটে ওয়াশরুমে চলে আসে। সে আয়নায় দেখে, চোখের নিচের কাজল অনেকটাই লেপ্টে গিয়েছে। ওপরে দেওয়া শেডও অনেকটা মিইয়ে গিয়ে কালচে হয়ে থেকেছে। চেহারার বেহাল অবস্থা। ভাগ্যিস, চুল দিয়ে সে ঢেকে রেখেছিল। নইলে প্রথমদিনেই তার স্বামী তাকে অতৃপ্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলত। সে তোড়জোড় করে ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পালটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
কিছুটা দেরি হয়েছে ঘুম থেকে উঠতে। নতুন জায়গায় এসে এলার্মও সেট করতে ভুলে গিয়েছে। সকালের নামাজটা পড়া হয়নি। গতকাল শরীরের ওপর প্রবল ধকল যাওয়ায় অপূর্বও সম্ভবত উঠতে পারেননি। এখন হয়তো বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন।
অতিথিরা উঠার আগে আকাশী তড়িঘড়ি করে নাস্তার আয়োজন করতে যায়, তখন দেখে আগে থেকেই এক কাজের মেয়ে কাজগুলো করছে। সে নিজের রুটিনে অভ্যস্ত থাকায় মনেই ছিল না, এখন সবগুলো কাজ হয়তো তার একার করতে হবে না। একটা সময় ছিল, যখন সে পড়ার জন্য আর সকালের বাতাস উপভোগ করার জন্য মামার বাসায় সবার আগে ওঠে যেত। এক ফাঁকে গ্যাসে চা বসিয়ে দিয়ে যাবতীয় কাজ সেরে সে চা বানানোর পাশাপাশি আধা ঘণ্টার মধ্যে রুটি বা পরোটা কিংবা পাউরুটি ছ্যাঁকে ডিম ভাজা কিছু একটা পাঁচ সদস্যের জন্য করে ফেলত। তারপর একটু পড়াশোনা করে মামাতো ভাই-বোন দুটোকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করতে মামিকে সাহায্য করে দিত। ফের নিজে কলেজে চলে যেত। এখন ওই পরিস্থিতি নেই। এখন থেকে রুটিনও আরেকটা হবে। আকাশী রান্নাঘরে গিয়ে দেখে কিছু রেডিমেড নাস্তা আগে থেকে আছে। মহিলাটা এখন চা বানাচ্ছেন।
আকাশী বলল, ‘আপনি কি রাতে বাসায় যান না?’
অল্পবয়সী শ্যাম বর্ণের মহিলাটা মোটা স্বরে বললেন, ‘আমি এখানেই থাকি।’
গলার আওয়াজ শুনে আর তাঁর স্বাস্থ্য দেখে তাঁর বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের কোঠায় লাগছে।
‘আপনার পরিবার নেই?’
মহিলা শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। আবেগ ছাড়াই বললেন, ‘ছিল। এখন নাই। আমার স্বামী আমারে তালাক দিছে।’
আকাশী অস্ফুট একটা শব্দ করল, ‘ওহ্।’
যদিও মহিলার মুখে কোনো দুঃখ দেখাচ্ছে না। বরং গড়ন দেখে শক্ত একটা মহিলা লাগছে, আকাশী আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না। মহিলা তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘আপনি যান আপা। আমার শেষ হইয়া গ্যাছে।’
মহিলার কথা বলার ধরন কিছুটা ভিন্ন। আকাশী বলল, ‘আমি আপনার ছোট বোনের মতো হব। আমাকে আকাশী বলেই ডাকবেন।’
এবার শক্ত মহিলাটি তার দিকে আবেগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আকাশীর উজ্জ্বল চেহারা দেখে তিনি সৌজন্যে মৃদু হাসলেন। আকাশী দেখল ইতোমধ্যে ছোটচাচি রান্নাঘরে ঢুকেছেন। তার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, তিনি এখন তার শাশুড়ি। চাচি ডাকতে গিয়ে থেমে পড়ে মা ডেকে সে তাঁর পায়ে ধরে সালাম করল। সারাটা দিন আকাশীর অত্যন্ত ভালো কাটে। অপূর্বের বন্ধুরা তাকে পেয়ে অপূর্বের নানা দোষ উগলে দিতে শুরু করেছে। অপূর্ব সেসময় কী করবে ভেবে পায় না। উঠে যেতে চাইলে বন্ধুরা তাকে যেতে দিলো না। একসময় হলুদের রাতে আকাশীর উঁকিঝুঁকি করার কথাও উঠল, ‘ভাবীকে সেদিন যা লেগেছিল না.. পুরাই হিরোইন। তিনি কীভাবে তার হিরোকে উঁকি মেরে দেখছিলেন! এখানে যদি ফিল্মের একটা সীন হতো না, তবে বেশ জমত। আর আমাদের দুলামিয়া কত লাকি এমন একটা ফিল্মি বউ পেয়ে।’
আকাশী লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। সে একবার অপূর্বের দিকে তাকাল। সে কী ভেবে ইতস্তত করে উঠে যেতে উদ্যত হয়।
জয় বলল, ‘কী হয়েছে? বোস না। বন্ধু-কাজিন সকলে আর কখনও এভাবে একত্র হবে নাকি? ওরা এই তো খানিক বাদে চলে যাবে। আর একটু-আধটু মজা তো হবেই।’
‘আমার কাজ আছে।’ অপূর্ব চলে যায়।
জয় আকাশীর পাশে বসে বলল, ‘দেখ, এর কী করা যায়। এতো সুন্দর একটা বউ পেয়েছে, অথচ দুষ্টুমিই সহ্য করতে পারছে না।’
‘আমার মনে হয় না, উনি বন্ধু ব্যতীত আর কারো সাথে ফ্রি হন। আর আমাদের সবে বিয়ে হয়েছে। হয়তো এই কারণেই এগুলো সইতে পারছেন না।’
‘তুমি ঠিক ধরেছ। তবে এই ছেলেটাই আই থিংক একদিন তোমাকে চাইত। অবশ্য আমার মনের কথা তুমি জানো কিনা জানি না, তবে যখন অপূর্বের মনের কথা একটু-আধটু বুঝেছি, তখন ভেবেছি তোমাদের এক হওয়া উচিত। কারণ ওর মতো ছেলে তুমি সহজে পাবে না। এতদিন একা থাকায় হয়তো ফ্রি মাইন্ডেড হতে এখনও পারছে না। আর সেও তোমাকে ডিজার্ভ করে। তাই আমার পদটা…’ জয় চোখ বাঁকিয়ে তাকায়, ‘ইউ নো।’
আকাশী মৃদু হাসল, ‘তাহলে আপনি ওই টাইপ ফিলিংস রাখেননি যে, পদটা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে সঙ্কোচ করেননি।’
‘অফ কোর্স, তুমি জানো না। অন্যদিকে আমার জোগাড় আছে। তোমার কথা মাকে বলে দেখেছি ঠিক, কিন্তু এর পরপর আমি আমার কারেন্ট গার্লফ্রেন্ডকে পেয়ে যাই।’
‘তাহলে পদটা এখন তার?’
‘নট শিওর।’ তারা দু’জনই হাসে, ‘আমি ওরকম অগাধ টাইপের ভালোবাসতে জানি না। প্রতিটি মেয়েকে আমি কিছুটা জানার পর বিরক্ত হয়ে যাই। পারফেক্ট কাউকে কখনও পাই না। পেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেকে তার যোগ্য ভাবিনি।’ জয়ের স্বর নম্র হয়ে এলে সে তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি পাল্টাতে অন্যান্যদের আড্ডায় শরিক হয়।
আকাশী ভাবে, জয় লোকটা সাধারণ নয়। এমন লোক খুব কমই থাকে। ছেলেদের আড্ডা দেখে সে মেয়েদের সাথে ভেতরে চলে আসে। জয়, তার বোন মেঘলা আর তার মা-বাবা বাদে বাকিরা বিকেলের দিকে চলে যায়। তারপর সন্ধ্যা আসে। রাত হয়। এভাবেই সারাটা দিন কেটে গেছে। আজকেও অপূর্ব তাদের মাঝখানে বালিশ দিতে যাচ্ছিল। আকাশী তাকে থামায়, ‘বালিশের কী দরকার?’
‘তোমার না হলেও আমার দরকার আছে।’ অপূর্বের স্বর অনেকটা কোমল শোনায়। যতক্ষণ এর রেশ কানে ছিল, ততক্ষণ আকাশী বিমুগ্ধ বনে ছিল। বিয়ে হওয়ায় একপ্রকার সে স্বাধীন হয়েছে, নিজের ভাবনাকে চাপিয়ে রাখতে হচ্ছে না। আকাশীর চেয়ে থাকাকে সে ভ্রূ কুঞ্চিত করে দেখে, ‘কী হয়েছে?’
‘বালিশের কী খুব প্রয়োজন? এখন আমি আছি না?’
‘তো?’ সে একটা ভ্রূ উঁচু করল।
‘তো.. তো কিছু না।’ আকাশী তার কিছুটা কাছে গেলে সে শুয়ে পড়লো।
বালিশটা ওই জায়গায় রেখে সে এবার বলল, ‘মানহানির সমস্যা হতে পারে।’
আকাশী শব্দ করে হাসে, ‘আপনার মনে আমাকে নিয়ে কিসের এতো বিদ্বেষ আছে তা আমার জানা নেই। তবে আপনার সিরিয়াস মুডে এই কথা কেন যেন সাজেনি অথবা কথাটা ঠিক করে বলতে জানেননি।’ সে আবারও সামান্য শব্দ করে হাসল, ‘আমি কিছু করব না। আপনার আমাকে বলতে হবে, কী কারণে এবং কোন বিষয়ে আপনার এতো আক্ষেপ।’
অপূর্ব নড়েচড়ে শোয়। বালিশের জন্য মাঝ বরাবরও আসতে পারল না। আবার বিছানার এককোণে ঠেশাঠেশিও করতে পারছে না।
তাকে উত্তর না দিতে দেখে আকাশী শুয়ে পড়ে। সাথে সাথে তার মনটা কেন যেন অনেক ঠান্ডা হয়ে গেল। কালরাত সে অনুভব করতে পারেনি কিছুটা দূরত্বে শোয়া অপূর্বের উপস্থিতি। কিন্তু আজ পারছে। সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রেম আজ তার পাশে। সে নম্র হয়ে পড়ে বিড়বিড় করল, আমার পাশে আপনার উপস্থিতি উপলব্ধি করছি এও স্বপ্নের চেয়ে কম কিছু নয়। অপূর্ব হয়তো শুনতে পেল না। আকাশী একটু আগে বলা কথাটার রেশ ধরে অপূর্বকে স্রেফ ভয় দেখানোর জন্য বালিশটা নিয়ে ফেলেল এবং অতিশীঘ্র তার গায়ে হাত দেয়। অপূর্ব সেই হাত সরিয়ে দিলো। আকাশী খানিক বাদে আবারও দেয়। অপূর্ব আবারও সরিয়ে দেয়। এবার আকাশী নিজেই একটু ভীত হচ্ছে। পাছে যদি অপূর্বের মেজাজ চটে যায়! তবু আবার সে পেট বরাবর তার গায়ে হাত রাখে। এবার অপূর্ব কিছু করছে না। আকাশী দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডিমবাতির আলোয়ও অপূর্বের কালো ভ্রূজোড়া, চোখের পাতা থেকে আসা ঘন পাপড়ি, ঘুমন্ত শিশুর মতো চেপে রাখা ঠোঁটজোড়া দেখে সে তার গায়ে হেলিয়ে পড়ে তার দিকে অবিরাম চেয়ে থাকে। এভাবে সম্ভবত ঘণ্টাখানেক পার হয়ে যায়। আকাশীর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। কেবল লাগছে, এই দেখা কখনও শেষ হবে না। করতেই চায় না। তৎক্ষণাৎ অপূর্বের পাশ ফেরানোতে সে পড়ে যায়। অপূর্ব তার গা হাতড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল, বালিশ… বালিশ কই। আকাশী বালিশটা দিতেও চায়। কিন্তু অতিশীঘ্র দেখল অপূর্ব কথাটি আধঘুমন্ত অবস্থায় বলতে বলতে পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশী মৃদু হেসে অপূর্বের বাম হাত টেনে গালের পাশের এনে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালটা আকাশীর সৌভাগ্যক্রমে অপূর্বের ঘুমন্ত মুখ দেখে শুরু হয়। সে সকালে সবার সাথে নাস্তা সেরে এসে দেখে অপূর্ব ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। সে পাশে এসে এই প্রথম বারের মতো স্ত্রীর দায়িত্ব বহন করে বলল, ‘অফিস থেকে ছুটি কয়দিন নিয়েছেন?’
‘ছুটি শেষ। কাল থেকে জয়েন করব।’
আকাশী মৃদু হাসে, ‘মায়ের কাছে শুনেছি, আপনার বস সামহাউ আপনাকে অনেক আপন মনে করেন। আর আপনি পনেরো দিনের ছুটি পেয়েছেন। দ্যাট মিনস, আরও সাতদিন ছুটি আছে। অবশ্য এগুলো বিয়ের খাতিরেই পাওয়া।’
অপূর্ব ধরা খায়। কিন্তু পরাজয় উপর থেকে স্বীকার করল না।
আকাশী বলল, ‘আপনি যদি আগে অফিসের নাম দিয়ে কোনোদিকে টাইমগুলো কাটিয়ে আসার কথা ভেবে থাকেন, তবে কিন্তু বলে দিই এতটা সহজ না।’ এবার তার মনের কথা বুঝে ফেলতে পারায় অপূর্ব তাকায়, ‘আমি আপনাকে সহজেই ছাড়ব না।’
অপূর্ব শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’
‘শুনুন, আপনি অবশ্য আমার ভালোবাসা চান না। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গ চাই। আই মিন আমি এই পর্যন্ত ট্রাভেল খুব কমই করেছি, একা থাকায়। এখন আপনি আমার শখগুলো পূরণ করুন। আমি নানাদিকে ঘুরতে চাই। ইউ নো, কক্সবাজার, সীবিচ, কাপ্তাই, বান্দরবন এ ধরনের জনপ্রিয় জায়গায় আমি কখনও যাইনি।’
‘মজা করছ?’
‘মজা করব কেন?’
‘তুমি ভাবছ, তুমি চাইলেই আমি তোমাকে নিয়ে যাব?’
‘একশ এক বার।’
‘একবারও না।’ অপূর্ব ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ায়, ‘এই একটা মাস বাবারা আমাদের সাথে থাকবেন। এরপর দু’জনই লন্ডনে চলে যাবেন। ততদিন পর্যন্ত উনাদের একা ফেলে কোথাও যেতে চাই না।’
‘তাহলে এরপর যাবেন?’
‘নেভার।’ অপূর্ব দরজা খুলে বেরুতে গেলে আকাশী পিছনে গিয়ে বলল, ‘আমি যদি ওঁদের পারমিশন নিই?’
‘চায়টা কি বলো?’
আকাশী সিরিয়াস হয়, ‘আগে আমার পড়াশোনা ব্যতীত টিউশনি থাকত, যার কারণে কখনও লোনলি বা বোরিং ফিল করতাম না। এখন পড়াশোনা, কাজকাম, টিউশানি কিছুই না থাকায় আমি অস্থিরতা বোধ করছি।’
অপূর্ব দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘ওকে দ্যান।’ ওয়ালেট বের করে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বলল, ‘মেয়েরা শপিং বেশি পছন্দ করে। তুমি সম্ভবত জায়গাটা চেনো। যাই ইচ্ছা হয় করোগে।’
আকাশী তার সঙ্গ না চাইলেও এরকম কিছু চায় না, ‘না, শপিংয়ের প্রয়োজন নেই। মেঘলা যথেষ্ট শপিং বিয়ের আগে আপনার তরফ থেকে করে দিয়েছে। আমার কাছে আর্জেন্টলি কোনো ব্যস্ততা চাই।’
অপূর্ব বিরক্ত হলো। কিন্তু ভেতরে আকাশীর জন্য সমবেদনাও আছে। সে আরেকটা কার্ড বের করে তাকে দেয়, ‘আমার এই বন্ধু ফরাইন ডিজাইনার ম্যাকনীলের হয়ে এখানে কাজ করে। কোর্সও করায়। তুমি ওর হেল্প নিতে পার।’
আকাশী পুরোপুরি আত্মহারা হয়ে যায়। খুশিটা তার মুখেই প্রকাশ পাচ্ছে। অপূর্ব সিনেমায় দেখে এসেছে, এই ধরনের কোনো সিচুয়েশনে মেয়েরা হিরোদের খুশিতে জড়িয়ে ধরে। আকাশীর ভঙ্গি দেখে লাগছে, সে হয়তো তাই করবে। অপূর্ব সেকেন্ড কয়েক শুধু পরীক্ষা করার জন্যই দাঁড়াল। সে দেখল আকাশী লাফাতে লাফাতে দৌড়ে গিয়ে ফোন তোলে নেয়। অপূর্ব মনে মনেই হাসে আকাশীর বাল্যকালের একটা রূপ দেখে যখন সে বইয়ের নিচে ড্রয়িং এর খাতা লুকিয়ে রেখে আঁকাজোকা করত।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here