“আকাশী”
পর্ব ৮.
আকাশী সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, জয় তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সে মোটেও অস্বস্তি বোধ করল না।
‘এভাবে কী দেখছেন?’
জয় মৃদু হেসে বলল, ‘গ্রামের ফেমাস মেয়েটিকে দেখছি।’
‘ফেমাস?’
‘তাইতো! চারিদিকেই তোমাকে নিয়ে চর্চা শুনছি। এর আগে কখনও কাউকে নিয়ে এই বাড়িতে কথা বলতে শুনিনি।’
আকাশী কিছু বলল না। সে যদি জিজ্ঞেস করে, তা মানুষ কী কী বলে? জয় যা বলবে, তন্মধ্যে তার প্রশংসার সাথে সাথে তাকে নিয়ে করা কিছু বাজে মন্তব্যও বেরিয়ে আসবে। যারা হিংসা করছে, তারা তাকে নিয়ে কত খারাপ কথাই না বলে। মেয়েটি পেকে গেছে, বেশি বুঝে, বেপরোয়া হয়ে বেপর্দা হাঁটে। আকাশী তার গন্তব্যে পৌঁছার আগে এই ধরনের খারাপ কথা শুনে নিজেকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায় না। এই লোকগুলোকে দেখাতে হবে কেন সে এসব করছে। আকাশী জানে তার পক্ষে চল্লিশ পার্সেন্ট লোক থাকলেও, পুরাদস্তুর ষাট পার্সেন্ট লোক তাকে গিলে খেতে চায়। আর এদেরই মন-মানসিকতার সে পরিবর্তন করতে চায়।
জয় বলল, ‘তাই তোমাকে ঘুরঘুর করে দেখছিলাম। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না, তোমাকে বিষণ্ণ কেন দেখাচ্ছে?’
আকাশী অন্যদিকে মুখ করে বসে রইল। কথাটা শোনার পর সে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। তার মনের ভেতর খটখট করা কথাগুলো এই মুহূর্তে বের করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জয়কে বলতে দ্বিধা হচ্ছে। অপরিচিতদের কাছে দুঃখ ভাগ করে নিতে সে শেখেনি। এমনকি আপনদেরও সে কখনও মনের কথা খুলে বলতে পারে না। হয়তো তাদের দ্বিমত পোষণ করার সম্ভাবনা থাকে নয়তো কথা শোনার আগ্রহই দেখায় না।
তার জীবনে আছেই বা কে? বিভার বয়সের বোন থাকলে মেয়েরা তাদের বন্ধু পেয়ে যায়। কিন্তু আকাশী বিভাকে কখনও বোন হিসেবেও পায়নি। আর মা সবসময় নির্লিপ্ত থাকেন। মাঝে মাঝেই তাঁকে ভালো দেখায়, তাও বিভার সামনে। বিভাকে ছাড়া আর কাউকেই তিনি ভালো আপন মনে করেন না। আর বাবা সবসময় বাড়িতে থাকেন না। তিনি দুইমাস বাসায় থাকলে একবছর বিদেশে থাকেন। অতদূরে কাজে ব্যস্ত থাকা একটি লোককে তার মনের ভেতরের খটখট আওয়াজগুলো শোনাতে ইচ্ছে হয় না।
অথচ সে বাবার মতোই হয়েছে। বাবা নিশ্চয় তার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে যুক্তিযুক্ত বলতেন। তিনি সবসময় তাকে অনুপ্রেরিত করে এসেছেন। তাঁকে ওইজন্য আকাশী অত্যধিক ভালোবাসে। আর মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকে কষ্ট দিতে চায় না। আকাশীর ক্ষেত্রে তাই হয়। সে বাবাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য তিনি ফোনকল করলে তার বকবক শোনায় না। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে অল্প কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেয়। বাকিটা সে মনের মধ্যেই তর্কাতর্কি করতে থাকে।
তাই জয়কে যতই চিনুক না কেন, ভেতরের তর্কগুলোকে বেরিয়ে আনা যায় না। হয়তো ওই কথাগুলো জয় ভাইয়ার পছন্দ হবে না। ভাইয়ার সাথে ইদানীং দেখা হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে বড়চাচুদের সাথে এসেছেন তাদের কাজেই। এর আগে তাকে আকাশী দেখেছিল পিকনিকে। সেবারও সে দুইদিনের জন্য মা-বাবার সাথে এসেছিল। দুইদিনের প্রথমদিন আকাশী ছেলেদের সাথে শর্তে খেলাটা খেলে মাঠ থেকে ফিরে এসেছিল।
বাসায় ঢুকতেই বিভা ঘাড় কিছুটা ঘুরিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যা শেষ হয়ে গেছে। অথচ দেখা নেই। রান্না কে করবে? মা নাকি?’
আজম প্রতিবারের মতো প্রতিবাদ করলেন, ‘মেয়ে শুধু আমার একটাই নাকি? মা’কে কষ্ট না দিতে চাইলে তুই রান্না করতে পারতি না?’
বিভা জবাব দেওয়ার আগেই লক্ষ করল, বাড়ির সামনে অনেকগুলো ছেলে জড় হয়েছে। তাছাড়া বাহিরে বেশ শোরগোল আর হইচই। সে হতভম্ব হয়ে বেরুনোর সময় আকাশী বলল, ‘আজ কারো কাছেই রাঁধতে হবে না। এই ছেলেগুলো রান্না করবে।’
রোকসানাও বেরিয়ে এলেন। ছেলেরা তাদের দোষ লুকাতেই বলল, আজ এখানেই পিকনিক করব।
রোকসানা বললেন, ‘এ আবার কেমন পিকনিক?’
‘আমরা রান্না করার পর সবাই একযোগে খাব।’
শর্তে এটা না থাকলেও প্রস্তাবটা আকাশীর পছন্দ হয়েছে। সে বলল, ‘তবে বাড়ির কয়েকজনের সাথে ছোটখাটো একটা পিকনিক হয়ে যাক।’
ছেলেরা তাতে সায় দেয়। তারা ভাবল, রান্না তো জানে না, মানসম্মানের প্রশ্ন যখন, তখন এতে করে অন্তত সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। ওদের হইচই-এ কয়েকটা বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে আসে। ছেলেগুলোর সমবয়সী ছেলেরা খুব কম করে সামান্য আয়োজনের জন্য চাঁদা তুলল। আকাশীদের ঘরের চুলোটা তার কিছুদিন আগে থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আজাদ গ্যাসের চুলা এনেছেন বিদেশ থেকে। অগত্যা ছেলেদের অন্য জায়গা থেকে স্টোভের বন্দোবস্ত করতে হয়েছে।
এরূপ আচমকা ছোটখাটো পিকনিকের আয়োজন শুরু হওয়ায় সবার মধ্যে একটা আমেজ ছড়িয়ে পড়েছিল। ছেলেরা বিরিয়ানির আয়োজন করতে লাগল। তাদের অবস্থা বুঝে আকাশী বলল, বিরিয়ানির সাথে কেবল একটা ডিম আর স্যালাড হলেই চলবে। তাদের আনাড়িপনা বুঝে আকাশী কথাটি বলেছিল। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছেলেগুলোর মাধ্যমে রান্না করানো ছিল না। সে তাদের বুঝাতে চেয়েছিল, মেয়েদের কাজ সহজ নয় আর তারা ছেলেদের চেয়েও অধিক পরিশ্রমী। মেয়েদের ঘরকুনো বলাও ঠিক নয়।
আকাশী কম কিছু দাবী করার সত্ত্বেও নিজেই ছেলেদের কাজ করিয়ে দিচ্ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিখিয়েও দিচ্ছিল। তাকে দেখে অন্য মেয়েরাও তাদের সাহায্যে লেগে পড়ে। বিভাকে সেই প্রথম রাতের বেলায় বাইরের কোনো আয়োজনে শরিক হতে দেখা যায়। এই জায়গায় এসে আকাশী আর বিভার মাঝের ঈর্ষার দেয়ালটা কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
বিভার ভাব দেখে বুঝায়, এতদিন তার আর আকাশীর মাঝে ভালো কোনো সম্পর্ক না থাকলেও খারাপ কোনো সম্পর্ক ছিল না। আর এই প্রথম বাড়িতে এমন কোনো হুটহাট মজাদার একটি আয়োজন হওয়ায় বিভার ভেতরের ক্লেশগুলো কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়েছে। সেও আকাশী, ফারাবি, তাসফিয়াসহ তার সমবয়সী মেয়েদের সাথে মিশে গেছে।
রান্না শেষ হলে ফারাবিকে নিয়ে আকাশী প্রতিটি ঘরের বাচ্চাদের আর বড় ছেলেমেয়েদের ডাকতে যায়। যদিও অনেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেলেছে, তবু তাদের আকাশীরা সামান্য করে চেকে দেখতে এবং তাদের আনন্দে শরিক হতে আহবান জানায়। সবশেষে আকাশী ছোটচাচুদের বাড়ির সামনে এসে হতবাক হয়ে যায়। এই বাড়িতে সামনে তালা লাগানো নেই। আকাশী গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। এক জোয়ান ছেলে দরজা খুলে। সে আকাশীকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল, ‘কে তুমি? কী চায়?’
আকাশী গলা খাঁকার দিয়ে বলল, ‘এখান থেকে অপূর্ব ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পর ভেবেছি কেউই আসবে না। আপনি তাদের আত্মীয়?’
ছেলেটি জবাব না দিয়ে আকাশীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘তুমি আকাশী না?’
‘জ্বি’, আকাশী হতবুদ্ধি হয়ে বলল, ‘আমাকে কী করে চেনেন?’
‘তোমাকে না চেনার কোনো কারণ নেই। তুমি অনেক পরিবর্তিত হলেও কিছুটা আগের মতোই আছ। বেশ লম্বা আর সুন্দর হয়েছ তুমি।’ বলে ছেলেটা মুখে ভদ্র একটা হাসি বজায় রাখল।
আকাশী চেয়েছিল অন্য কিছু জানতে। কিন্তু ছেলেটি এর পরিবর্তে প্রশংসা করায় ভালো লাগল না।
আকাশী বলল, ‘আমাদের এখানে ছোটখাটো একটা পিকনিক হচ্ছে। বিরিয়ানি চলছে। ডাকতে এসেছি। কেউ যদি আগ্রহ নিয়ে আমাদের আনন্দে যোগদান করে তবে আমরা খুশি হব।’
‘ওহ্, বাসায় তো মা-বাবা ছাড়া কেউই নেই। আমি যেতে পারব?’
হ্যাঁ বলতে গিয়েও আকাশীর মুখে বাধল। ভ্রূ কুঁচকে সে তার দিকে চাইল।
ছেলেটি তা বুঝতে পেরে বলল, ‘ফ্রক থেকে শাড়িতে তোমার ট্রান্সফার হওয়ার সত্ত্বেও তোমায় চেনে ফেললাম। আর তুমি আমাকে চিনলে না? আরে আমি জয়। জয়নাল। অপূর্বের বড় ভাই? মানে তোমার বড়চাচুর ছেলে। কী, চিনতে পারোনি?’
আকাশী একটু সরল কণ্ঠে বলল, ‘ওহ্, ইচ্ছে হলে আসবেন।’ আকাশী ব্যস্ত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
রাত দশটার পরও এই বাড়ির সামনে বাতি জ্বলতে থাকে। আকাশীরা ধোঁয়া উঠা বড় বড় পাতিল থেকে বিরিয়ানি পরিবেশন করছে। বিভা সেই প্লেটে ডিম দেওয়ার কাজ করছে। ফারাবি স্যালাড দিচ্ছিল। কিছু ছেলে সেই প্লেট পরিবেশন করছে। একদিকে মাদুরে হাতেগোনা মেয়েরা বাচ্চাকাচ্চার সাথে বসেছে। তাদের সামনাসামনির মাদুরে ছেলেরা তুমুল হাসি-মজা করছে।
আকাশী অদ্ভুত চোখে চেয়ে দেখল, জয় ভাই হা করে সবকিছু চেয়ে রয়েছে, যেন তিনি আদিম যুগে চলে এসেছেন। যখন জয়কে থালা দেওয়া হয়, তখন সে ঝুঁকে কোনোভাবেই সুবিধা করে খেতে পারছে না। তখন আকাশী নিজেকেই বকল, এমন এক শহুরে মানুষকে খেতে আসতে বলা মোটেও উচিত হয়নি। তারা হয়তো কখনও মাটিতে বসে ভাত খায়নি। এমন মানুষদের ওপরে থাকাই ঢের ভালো। অন্তত নিচের মানুষকে বিরক্ত করতে আসবে না।
সে পরক্ষণে দেখল, জয় ভাই কোনো ফরমায়েশ না করে এডজাস্ট করার চেষ্টা করছে। এটি আবার আকাশীর ভালো লাগল। তবে হয়তো এই পরিবেশ জয় মানিয়ে নিতে পারছে না। কিন্তু পরক্ষণে সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাওয়ার পর্ব শেষে সবার জন্যই পেপসি আনায়। সেই পর্ব শেষে আকাশী বলেছিল, থ্যাংকস।
‘থ্যাংকস কেন?’
‘আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে অসন্তুষ্টিতে ফেলে দিয়েছি। যেই দেখলাম, খাওয়া শেষে সবার জন্য নিজে গিয়ে পেপসি এনে সবাইকে খুশি করলেন, আমি কিছুটা অবাক হলাম। আর ওদের মুখে হাসি আনার জন্য পেপসি আনার জন্য থ্যাংকস দেওয়া উচিত ভাবলাম।’
‘আরে থ্যাংকস তো তাকে বলা উচিত, যে এসবের পরিকল্পনা করেছে। আমি মনে করেছিলাম, আমাদের গ্রাম্য পরিবেশটা আজীবনই মূর্খ থাকবে। মেয়েদের তারা বাসায় বন্দি রেখে লালন করে, যাতে একটা ছেলের ভোগের জন্য তৈরি করতে পারে। মূর্খ পরিবারে জন্মানো মেয়েরা হয় মূর্খ, যার কারণে স্বামীদের কাছে মর্যাদা পায় না। এমন ঘটনা অহরহ ঘটত, যখন আমি ছোটবেলায় এখান থেকে যাচ্ছিলাম। এখন এই পরিবর্তন দেখে ভালোই লাগছে। এইযে, ছেলেরা মেয়েদের ছাড়া অচল, তা অন্তত এখানে আসা কিছু ছেলে তো উপলব্ধি করতে পেরেছে!’
আকাশী মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনে রইল। পরদিন আবারও তাদের দেখা হয়। আকাশী সন্ধ্যার ঠাণ্ডা পরিবেশটা উপভোগ করতে বেরিয়েছিল। তখনই জয়ের সাথে দেখা। জয় তার ওই নিঃসঙ্গ সময়ে সাথে দিয়ে তার সাথে হাঁটতে থাকে। আকাশীর এতে দ্বিমত ছিল না। লোকটির সম্বন্ধে তার আগের দিন যে ধারণাটা তৈরী হয়েছিল, তা তাকে দ্বিমত পোষণ করতে দেয়নি।
তারা কথা বলতে বলতে সুদূর দূরের পিছঢালা রাস্তায় এসে পড়ে। রাস্তার দু’পাশে কিছু দূরত্ব পরপর গাছ আছে। রাস্তার একপাশে একটি খামার আছে। সেদিকটায় দেখতে বোধ হয়, রাত এখন নিশুতি হয়েছে। ওখানে আছে ছায়া আঁধারের খেলা। ওই খামারের আশেপাশে অনেক গাছপালা, যেন ওই খামারটিকে ঘিরে রেখেছে। তার সামনে ছোট একটি পুকুর। পুকুরের আশেপাশে লম্বা বেশকিছু তালগাছ। ভৌতিক একটি জায়গা যেন রাস্তার ওইপাশে। আকাশীরা তালগাছের নিচে পৌঁছালে জয় বলল, ‘জানো, আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম, এটি সত্যিই ভৌতিক একটি জায়গা।’
বলে সে আড়চোখে আকাশীর দিকে তাকায়। আকাশী মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমাকে ভয় দেখানোর কথা ভেবেছেন নাকি?’
জয় ধরা পড়ে গেল। তবু বলল, ‘জানো, এখানের তালগাছের ওপরের যে ছায়াতলটা দেখছ, সেখানে অদ্ভুত কিছু থাকত। আর ওখান থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ আসত। রক্ত হিম করার মতো নাকি। ভাগ্যিস আমরা সন্ধ্যায় এই জায়গা অতিক্রম করছি। রাত হলে নির্ঘাত আমাদের বাড়িতে দু’জনের চল্লিশা হতো।’
‘গুজব।’
‘আরে, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে শোনা। ওদের নাকি চেনা যায় না। তালগাছগুলোর নিচ দিয়ে যারা অতিক্রম করে তারা ওপরের দিকে তাকালেই নাকি তাদের ওপর কী একটা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের রক্ত চুষে নেয়।’
‘ওহ্’, আকাশী টেনে টেনে বলল, ‘তাই নাকি? তাহলে সেই মানুষগুলোর তো মরে যাওয়ার কথা। এই মৃত ভুক্তভোগী মানুষ কাহিনিগুলো কাকে শোনাতে গেল? কীভাবে শোনাতে গেল?’ বলেই আকাশী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
আকাশী তাকে নিয়ে মজা করেছে জেনেও জয় তার মুখে সুপরিচিত ভদ্র হাসিটা বজায় রাখল আর হাঁটতে হাঁটতে পা দিয়ে একটা ছোট পাথরকে টুকু দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।
আকাশী একসময় চুপ হয়ে গিয়ে বলল, ‘সরি।’
‘কেন?’
‘অত হাসা হয়তো উচিত হয়নি। তবে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।’ আকাশীরা ওই রাস্তা দিয়ে প্রাইমারি স্কুলের প্রাঙ্গণ ঘুরল। আকাশী বলল, ‘এখন রাত হয়ে আসছে। আমার রান্না করার টাইম হয়েছে।’
‘ওহ্ আচ্ছা। চলো।’ জয়ের গলার স্বরটা একটু বিষাদময় লাগল।
আকাশী পরোয়া না করে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল। চাঁদটাকে বাড়ির ওপাশে দেখা যাচ্ছে। চাঁদনী আলোর তেজ তেমন একটা নেই। অন্তত জয়ের চেহারা ভালো করে চেনা যাবে এমন আলো নেই। আকাশী সামনে হাঁটছিল। একবার পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, তাড়াতাড়ি হাঁটুন না।’
‘আমি কেন তাড়াতাড়ি হাঁটব?’
‘ওহ্ সরি।’
‘সরি কেন?’
‘আপনি তো আমার সাথে আসেননি যে, আমার সাথেই যাবেন। খেয়াল করিনি, আপনি আলাদাও যেতে পারেন।’
‘আমি তোমার সাথেই ঘুরতে এসেছি, তোমার সাথেই যাব। প্রতিটা কিছুতে সরি বলা লাগে নাকি?’
আকাশী জবাব দিলো না।
জয় পেছন থেকেই বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না। কাল যে চলে যেতে হবে। এখানে যে সময়গুলো কাটালাম, স্পেশালি..’ জয় কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে বলল, ‘তুমি হাঁটো, আমি পেছনে আছি। ভয় পেও না।’
আকশী ভয় পাচ্ছে না। তবু প্রতিবাদ করল না। কিছু মানুষ ভুল বুঝলে বুঝুক। রাতটা ঘনিয়ে আসছে। সামনের পথটা আরেকটু অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। সামনে তালগাছ। আকাশী দ্রুতপদে এই নিস্তব্ধ প্রকৃতির সৌন্দর্যের সবকিছু চেয়ে চেয়ে হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে জয়েরও হাঁটার আওয়াজ বারবার কানে আসছে।
তালগাছের নিচে আসার পর কী ভেবে যেন আকাশী উপরে তাকালো। তালগাছের ওপরের পাতার নিচের অংশটা কেমন যেন ঘন কালচে! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই এক ভয়ংকর গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেল। আওয়াজটা যেন আলাদা এক জগতের। পৈশাচিক একটা ভাব বিরাজ করছে তাতে।
তৎক্ষণাৎ আকাশীর ভেতরের হৃদস্পন্দনের বেগ দ্বিগুণ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডেই তার মধ্যে আতঙ্ক ছেয়ে গেল। সামনে আরও চারপাঁচটি তালগাছ। আকাশী ভয়ে দৌড়ে পেছনে গেল। জয়ও আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আকাশী গিয়ে তার হাতটা খামচে ধরল। সে কাঁপতে লাগল। আওয়াজটা একটু আগে মিলিয়ে গিয়েছিল।
আকাশী ঠোঁট কামড়ে রেখে ভীত চোখে ওই তালগাছগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। সে মাত্র একটা তালগাছ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু আরও অনেক তালগাছ। কিভাবে সে বাড়ি পৌঁছাবে? গলা শুকিয়ে আসছে। আকাশী ওখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর খেয়াল করল, সে জয়ের হাত সম্পূর্ণই জড়িয়ে ধরেছে। আকাশী বুঝল, জয় অপলক তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার