#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪]
– বিয়ের কারনটা এখনো আমাদের তুই ব্যাখ্যা করিস’নি ইনান।এবার তুই সোজাসাপটা বলবি এই বিয়েটা করার কারন কি?
ওয়াইনের বোতলটা বেশ শব্দ করেই টেবিলের উপর রাখলো ইনান।সুফিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তার ইচ্ছে নেই তাই আবারো চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছ।
– প্লিজ এইভাবে চুপ থাকিস না।তুই এমন কেন করলি?এত বেপরোয়া কেন তুই?আঙ্কেল আন্টিকে জানিয়ে হলেও বিয়েটা করতে পারতি।
ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।বরং অলীদ সুফিয়ার পাশে বসে আফসোস ভঙ্গিতে বলে,
– আগামীতে কিছু একটা হবে।
– কী হবে?
– যুদ্ধ!এই যুদ্ধে তুই আমি দুজনেই ফেঁসে যাবো আর ওই কুত্তা ইনান তো ডাইরেক মারা পড়বে।
– মানে কি?
– ইতিকা মেয়েটি আমাদের টপ শত্রু ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ড।
অলীদের কথা শুনে সারা শরীরে ঝলকানি দিয়ে উঠে সুফিয়ার।দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গোপনে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে থাকে।
– এটা কিভাবে সম্ভব।এই মেয়ে প্রেম করছে?আর মেয়েটার বয়স মাত্র ১৬।আমার জানা মতে ক্লাস নাইনে পড়ছে।
সুফিয়ার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ইনান।হাতের সিগারেট ছুড়ে ফেলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলতে থাকে,
– মেয়েটা তোর থেকেও দু’গুন বেশি সেয়ানা।ওয়াসিমের কাছে আসতে পারে, হাতে হাত রেখে চলতে পারে আর আমি বিয়ে করায় গায়ে কলঙ্ক লেপ্টে গেছে?
– বিয়ে করা আর গার্লফ্রেন্ড হওয়া দুইটা কি এক?তোর উপর আমার বিশ্বাস নেই কখন কি করে ফেলবি।
সুফিয়ার কথায় এবার বেশ রেগে গেলো ইনান।টেবিলের উপর শব্দ করে হাত রেখে বলে,
– শেট আপ,আমার বউয়ের কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ আমি জানি।তাই তোদের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে আসবো না।আরেকটা কথা ইতিকার বয়স ১৬ নয়, ১৭ বছর ১০ মাস।আর ১৬ বছর যে জন্ম নিবন্ধনটা আছে ওটাতে বয়সের হেরফের করা আছে।তার মায়ের মৃত্যুর কারনে পড়াশোনার বাধাগ্রস্ত হয়।কিছু দিন পরেই ইতিকার আঠারো বছর পূর্ণ হবে এখন আশা করি এই বিষয় নিয়ে তোদের মাথা ব্যথা নেই তোদের।
ইনান আবারো চেয়ারে বসে ওয়াইনের বোতলে চুমুক লাগায়।মাথায় ঝিম ধরে গেছে।সুফিয়া অলীদকে শান্ত থাকতে ইশারা করে।বেশ কিছুক্ষণ তাদের মাঝে নিরবতায় কেটে যায়।
– সবটা বুঝলাম কিন্তু এত মেয়ের মাঝে ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ডকে বউ বানানোর বিষটি বুঝলাম না।
– সব কথা বোঝার দরকার নেই তোদের।
..
ফ্লাটের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভয়েরা আকড়ে ধরলো অলীদকে।চারিদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন।এই ফ্লাটে গত এক বছর যাবৎ আছে সে কোনদিন এত অন্ধকার করে রাখেনি ইনান তবে আজ ঘরের লাইটগুলো বন্ধ কেন?তাছাড়া ইতিকা কোথায়?
ইতিকার কথা মাথায় আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অলীদ।
– ভাবী কই?আর ঘর এত অন্ধকার কেন?
– রুমে আছে।
– কিন্তু তুই মেইন সুইচ বন্ধ করে গেলি কেন?এত বিতিকিচ্ছি তুই কি করে করিস বলতে পারবি?
ইনান জবাব দিলো না।হঠাৎ করেই ঘর জুড়ে সব লাইট আগের মতো জ্বলে উঠলো।
বেশ রাত হয়ে গেছে এতক্ষণে হয়তো ইতিকা ঘুমিয়ে গেছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইনান বেড রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই থমকে যায়।ভেজা কাপড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মেয়েটি।দু’গাল রক্তিমভাব ছড়িয়ে আছে।আরক্তনয়নে একপলক তাকায় ইনানের দিকে।
তার দৃষ্টির ভাবগাম্ভীর্য বুঝতে পেরে গলা খেকিয়ে উঠে ইনান।
– এত নাটকের মানে কি?আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করেন’নি কেন?মানলাম আমি বকেছি তাই বলে ভেজা শরীরে…
ইনান এগিয়ে এসে ইতিকাকে ছুঁয়ে দেয়।সারা শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে আছে।
– ইতিবউ দ্রুত চেঞ্জ করে আসুন।
-…………
– আজব কথা বলছেন না কেন?
-…….
– আমি উঠতে বলেছি আপনাকে।
ইতিকা কথা শুনলো না বরং রাগ দেখিয়ে বসে রইলো।ইনান একটা সময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে পরখ করে।মেয়েটার উপর বার বার রেগে যাচ্ছে সে, কি করে সামলাবে এই রাগ।লেখনীতে পলি আনান।এদিকে নেশাটা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে,মাথা ভারী ভারী অনুভব হচ্ছে।
– লাস্ট বার বলছি আপনি ওয়াশরুমে যাবেন এবং ড্রেস চেঞ্জ করবেন।
ইতিকা গেলো না।বরং ঠায় বসে রইলো আগের মতো।রাগের মাত্রাটা যোগ হয়েছে এবার বেশামাল ভাবে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো সে।
তৎক্ষনাৎ রুম জুড়ে ছড়িয়ে যায় বিকট শব্দ।শব্দের তোড়ে অলীদ বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বসে।
ইতিকা নিরবতা ঘুচে শব্দ করে কেঁদে উঠে।মেঝেতে আয়নার টুকরো গুলো ছড়িয়ে আছে।গলগল করে রক্ত ঝরছে ইনানের ডান হাত থেকে।
– আপনি এখনো যাবেন না ইতিবউ?
ইতিকার জামকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।অপরদিকে অলীদ জোরে জোরে দরজায় করাঘাত করছে। রক্তাক্ত হাতটা চোখের সামনে এনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইনান।আফসোস সুরে ফিসফিস করে বলে,
– আমায় কি একটু শান্তি দেবেন না ইতিবউ!
.
– এই রাগ,জেদ বেহায়াপনা তোর কি কোন দিন কমবে না?বিয়ে হয়েছে এবার একটু শান্ত থাক মানুষের মত ব্যবহার কর তোর আচরণ আমার কাছে রাস্তার কু*ত্তার থেকেও খারাপ লাগে।হাতের কি জঘন্য অবস্থা করেছিস তুই।কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাবি।
অলীদ রাগ ঝারতে ঝারতে ইনানের হাতে ব্যান্ডেজ করছে।ইতিকা চুপসে দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।রুমের একপাশে কাঁচের ছড়াছড়ি।এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে।লোকটাকে তার আগে থেকেই রাগী কপট মনে হতো কিন্তু এখন একটা পাগলা,উম্মাদ মনে হচ্ছে।রাগ দেখিয়ে কেউ কাঁচে ঘুষি দেয়?এইভাবে হাতের বিশ্রী অবস্থা করে?আর প্রত্যেক বার রাগ দেখিয়েই কি মানুষটার গায়ে এত কাটা-সেলাইয়ের দাগ!মানুষটা আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু এই অদ্ভুত মানুষটা কেন তার জীবনে ইতিকা নামক সরল সোজা মেয়েটার জীবন জুড়ে নিয়েছে?
প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে ইতিকার মস্তিষ্কে বার বার হানা দিচ্ছে কিন্তু সঠিক উত্তর পাওয়া এখনো হলো না।
অলীদ ব্যান্ডেজ শেষে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে ইতিকার উপর।
– ভাবী শুনছেন?
‘ভাবী’ শব্দটা শুনেই অপ্রতিভ অবস্থায় পড়ে যায় ইতিকা।ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে অলীদের দিকে।অলীদ গলা ঝেরে আবারো দৃষ্টি রাখে ইতিকার দিকে,
– ভাবী আপনাকেই বলছি, শুনছেন আপনি?
– জ..জী বলুন।
– আপনি আজ পাশের রুমে ঘুমান।গতকাল সুফু যেখানে ঘুমিয়েছে।ইনানকে বরং আজ একা থাকতে দিন।
অলীদের কথা শেষ হতেই ইনান দুজনের উদ্দেশ্য গম্ভীর স্বরে বলে,
– অলীদ এখন রুম থেকে যা।অন্য কেউ যেন ভুলেও এই রুম থেকে যাওয়ার দুঃসাহস না করে, হিতাহিত ফল ভালো হবে না।
অলীদ উঠে দাঁড়ায় ইতিকাকে থাকতে ইশারা করে নিজে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
.
গভীর রাতে ইনান বারান্দায় বসে আছে।হিমেল হাওয়া শরীরে অন্যরকম শিহরণ জাগিয়ে তুলছে।হাতের টনটন ব্যথা তীব্র ভাবে বৃদ্ধ পেলেও সে একদম স্থির ভাবে সিগারেট ফুঁকছে।এমন কত শত জখম যে সে পেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।তার তুলনায় এই জখমটি তুচ্ছতম।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় বাইরে।ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় প্রবেশ করে বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়।বেশ খানিকটা আলো আছড়ে পড়ছে ঘুমন্ত ইতিকার মুখে।সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতে থাকে ইনান।
– ইতিবউ আগে তুমি ছিলে আমার টোপ,এরপর অদ্ভুত ভাবে সব পালটে গেলো।এখন সব কিছুর উর্ধে তুমি আমার ভালোবাসা।আর ভালোবাসার যত্ন করতে হয়, না হলে হারিয়ে যায়।আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টায় তোমায় আগলে রাখবো।
_
সকাল সকাল ফ্লাটে সুফিয়ার আগমন মোটেও সুবিধা লাগেনি অলীদের কাছে।তার দিকে তাকিয়ে বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়লো অলীদ,
– তুই এত সকাল এখানে কি করস?
– ইনান আমায় আসতে বলেছে।
– কিন্তু কেন?
– তা জানি না।
দুজনের মাঝে আবার নিরবতা।কিছুক্ষন পরেই ইনান এসে তাদের সামনে বসে এবং সুফিয়াকে ইশারা করে বলে,
– ইতিকার দায়িত্ব অর্ধেক তোর উপর ছেড়ে দিলাম।
– আমার উপর?মানে কি?
– ইতিকাকে স্কুলে ভর্তি করাবি।এই শহরে চলতে হলে,আমার সঙ্গে থাকতে হলে ঠিক যা যা অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সব তোর দায়িত্ব।ওর জন্য আলাদা ম্যাডাম ঠিক করবি পড়ানোর জন্য।
ইনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই চটপট উত্তর দিলো অলীদ।
– দোস্ত তোর সাথে থাকতে হলে মেয়েটাকে আগে যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।দুই, চারটা লাশ তার সামনে পড়লে যেন অজ্ঞান না হয় তাই কলিজা শক্ত রাখতে হবে।কিন্তু মেয়েটার কাল তোর হাত কাঁটা দেখে যে অবস্থা হয়েছে মনে তো হয়না তোর সাথে যেকোন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে সে টিকে থাকবে।
– শেট আপ!
ইনান বেশ জোরেই ধমক দেয় অলীদকে সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায় সে।
_
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে ইনান।তাদের বিবাহিত জীবনের অষ্টম দিন আজ।এই কয়েকদিন বেশ ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তার উপর।ইতিকাকে স্কুল ভর্তি নিয়ে ছিল বেশ তোষামোদ।
গতকাল থেকেই নতুন স্কুলে পড়াশোনা শুরু হবে তার।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আয়নার দিকে তাকায় ইনান।সেখানে ভেসে উঠে ভেজা চোখ দুটি নিয়ে তাকিয়ে থাকা কিশোরীর দিকে।
– ইতিবউ কাদঁছেন কেন আপনি ?
– এই কয়েকদিনে আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভালোর জন্য সব ব্যবস্থা আপনি করছেন কিন্তু আপনি কি এটা ভেবে দেখছেন না,সব কিছু ভালোর জন্য করলেও আপনি আমার ভালো থাকাটাই কেড়ে নিলেন।
ইতিকার কথায় ইনানের কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে।
– কি সমস্যা আপনার?
– আপনি ওয়াসিমকে কি করে চেনেন?
– সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।
– ওয়াসিম আমার হবু বর!
– মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলুন ইতিবউ।সে আপনার প্রাক্তন।ভুলেও স্বামি বানাতে যাবেন না।
– আপনার আগে সে আমার জীবনে এসেছে আর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আপনি মাঝে ডুকে সব ভেস্তে দিয়েছেন।
– ওহ আচ্ছা তাই নাকি?এতই টান বুঝি প্রেমিকের জন্য?তা বিয়ের সাপ্তাহ পার হয়ে গেলো আপনার প্রেমিক কোথায়?
– সে দেশের বাইরে আছে।ফ্যামিলি বিজনেসে।
– ওহ তাই নাকি? নাকি বিয়ে করে সংসার করছে?
– মানে?
ইতিকা চমকে তাকায় ইনানের দিকে।ইনান হাসতে হাসতে নিজের ফোন হাতে তুলে ইতিকার সামনে তাক করে।ইতিকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়।ওয়াসিম একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।ছবিটি দেখে দোটানায় পড়ে যায় ইতিকা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ইনান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– কার জন্য আমাকে অপমান,অবহেলা করছেন?ওয়াসিম বাগদত্তা।বিদেশে সে ফ্যামিলি বিজনেসে যায়নি বরং বিয়ে করতে গেছে।আর তুমি তো ছিলে তার ভো…. থাক আর কিছু বলবো না।মন দিয়ে পড়াশোনা করুন।
ইনান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক সেই মূহুর্তে মুখে হাত ঘুঁজে কেঁদে দেয় ইতিকা
।ইনানের কানে ইতিকার কান্নার শব্দ আসতেই আবারো দৌড়ে রুমে ফিরে আসে,
– অন্য কোন উপপতির জন্য কাদঁতে হলে রাস্তায় যান।আমার বাসায় এইসব আমি সহ্য করবো না।মাইন্ড ইট।
ইনানের কথায় কোন হেলদোল নেই ইতিকার বরং আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠে সে।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৫]
ফোলা চোখ মুখ নিয়ে সুফিয়ার দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ইতিকা।আজ তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেশ জোর তোষামোদ শুরু করে দিয়েছে সবাই।কিন্তু এই মূহুর্তে স্কুল,পড়াশোনা কিছুই মাথায় নেই তার বর্তমানে ওয়াসিমের সাথে একটি বার যোগাযোগ করার জন্য আকুল হয়ে পড়েছে সে।
– আমি আজ স্কুলে যাবো না আপু।
কথাটি ইনানের শ্রবণ হতেই পাউরুটিতে কামড় বসানোর আগেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ইতিকার দিকে,
– স্কুল যাবেন না মানে কি?
– আমার ভালো লাগছে না।
– আমি আপনাকে সেদিন বলেছিলাম অন্য কারো জন্য কাদঁতে হলে রাস্তায় যান আমার বাসায় এইসব আমি মেনে নেবো না।তারপরেও আপনি গত তিনদিন আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন।কাদঁতে কাঁদতে চোখে মুখের কি বাজে অবস্থা করেছেন ধারনা আছে আপনার?
ইনান কথাটি বলেই পাউরুটিতে কামড় বসায়।
ইতিকা না চাইতেও আবারো ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয়।না চাইতেও ইনানের কথা তার বার বার মনে পড়ছে।
.
দীর্ঘ লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে বেণি বাধিঁয়ে নিজেকে তৈরি করে নেয় ইতিকা।ইনান বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাসা থেকে বেরিয়েছে।বর্তমানে সুফিয়া আর ইতিকাও বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
স্কুল ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র চেক করে নিচে চলে যায় দুজনে।
– একটা কথা বলবো আপু?
প্রশ্নটি করেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো ইতিকা।
– বলো।
– প্রায় পনেরো দিন হলো আমি তোমাদের সাথে আছি কিন্তু কাউকেই চিনি না।সবচেয়ে বড় কথা যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে তাকেই এখনো ভালোভাবে চিনতে পারছি না আমি শুধু তার ডাক নামটাই যানি।
ইতিকার প্রশ্নে স্মিথ হাসে সুফিয়া।রাস্তার পাশ থেকে রিক্সা ডেকে ইতিকাকে চড়ে বসার জন্য ইশারা করে।
– ইনানের পুরো নাম “ইফতিহার ইনান”। পড়াশোনা অর্নাস ২য় বর্ষ।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।তার বাবা বর্তমানে ব্যবসা করছেন।
– কিন্তু তিনি তার বাবা মায়ের সঙ্গে কেন থাকেন না?আর সেদিন তার সাথে এত বাজে ভাবে কেন কথা বলেছে?
– ইনানের বাবার সঙ্গে তার বনিবনা নেই এর বিশেষ কারন তার মামার জন্য।ইনান তার মামু ভক্ত।বিষয়টি মোটেও পছন্দ করেন না আঙ্কেল। গত একবছর থেকে পরিবার বিচ্ছিন্ন ইনান।
– কিন্তু আমাকে বিয়ে করার কারনটা বুঝতে পারছিনা।
– সেটা আমিও জানি না ইতিকা।
ইতিকা আর প্রশ্ন করলো না।দীর্ঘ জ্যাম লেগে থাকা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের হিসাব কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
স্কুল শেষে ভিড়ের মাঝে কোন দিকে যাবে দিশেহারা হয়ে পড়ছে ইতিকা।স্কুলের বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে তার আজ পরিচয় বিনিময় হয়েছে।কিন্তু সবার কাছে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করেছে।
ভিড়ের মাঝে সুফিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ হাতে বেশ জোরেই টান অনুভব করে সে।ঘাবড়ে গিয়ে হাত ছাড়ানোর জন্য ঝাকরা দিতেই আরো জোরে টান লাগে তৎক্ষনাৎ ছিটকে প্রশস্ত কারো বুকে আছড়ে পড়ে ইতিকা।নিজেকে ধাতস্ত করে দ্রুত মাথা তুলে তাকাতেই ইনানকে দেখে অস্থিরতা লুপ্ত হয়।
– আপনি?আপু কোথায়?
– আপু আসবে না এখন আমার সাথেই বাড়ি চলুন।
ইতিকার হাতটা ইনান শক্ত ভাবে ধরে আছে।গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ স্থির চিত্তে তাকিয়ে থাকে ইতিকার দিকে।ইতিকা আড় চোখে বেশ কয়েকবার ইনানের দিকে তাকায়।কিন্তু বুঝতে পারছে না কি হয়েছে ছেলেটার।ইনান গাড়ি চালানো শুরু করে দেয়।ফ্লাটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে ইতিকাকে নামতে ইশারা করে।
ইতিকা তার স্কুল ব্যাগ হাতে তুলে ইনানের সঙ্গে ঘরের ভেতর যায়।ইনান একটানে ইতিকার হাত থেকে ব্যাগটা ছাড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসে। তার কান্ডে অবাক হয়ে যায় ইতিকা।
– এটা কোন ধরনের অভদ্রতা,ব্যাগ টানাটানি শুরু করেছেন কেন?
– আজ কার কার সাথে পরিচিত হয়েছো ইতিবউ?
– তা আপনাকে বলবো কেন?
ইতিকার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে ইনান।স্কুল ব্যাগ থেকে ‘একাডেমি ডাইরিটা’ হাতে তুলে জোরে জোরে পড়তে থাকে।
– নাম; ইতিকা ইয়াসমিন। শ্রেণি;নবম।রোল;৭৮।
বাহ বাহ ভালো বেশ ভালো।
ইনানের অচরণ বড্ড অদ্ভুত লাগছে ইতিকার কাছে তবুও চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সে।ইনান ব্যাগে বেশ ভালো ভাবে চেকিং করার এক পর্যায়ে, একটা চিঠি পেলো।চিঠিটা হাতে নিয়ে ইতিকার দিকে সূক্ষ্ম ভাবে তাকায় ইনান।
– এটা কি ইতিবউ?
– আমি জানি না
– আপনার ব্যাগ আর আপনি বলছেন জানেন না?
ইতিকা চুপচাপ রইলো।সে নিজেও বুঝতে পারছেনা এই চিঠি তার ব্যাগে কি করে এলো।
ইনান চিঠি খুলে বেশ জোরে জোরে পড়তে শুরু করে।
‘হেই ইতিকা,
তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।তোমার সঙ্গে যতবার কথা বলতে চেয়েছি তুমি আমায় ইগ্নোর করেছো।কিন্তু ইগ্নোর করার কারনটা কি?তুমি জানো ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট,ইন্টেলিজেন্ট ছেলে আমি।আর তুমি আমাকেই পাত্তা দিচ্ছো না।আমি চাই আমাদের একটা ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হোক।সর্বশেষ একটা কথা না বললেই নয় তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়।
ইনান চিঠিটা পড়ে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে ইতিকার উপর।ইতিকা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
– আরে বিশ্বাস করুন আমি জানি না এই চিঠি কে দিয়েছে।আমি, আমি,
– চুপ! তুমি খুব আদরে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয় আমার বউয়ের প্রশংসা আমি এক পিচ্চি ইঁচড়েপাকা ছেলের কাছ থেকে শুনবো?পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন আপনি, প্রেম করতে নয়।কোন ছেলের সাথে মেলামেশা করতে দেখলে ঠ্যাং ভেঙ্গে বাড়িতে বসিয়ে রাখবো।
– আমি ছেলেটাকে চিনি না।আর চিঠি ব্যাগে আসলো কি করে সেটাও জানি না।
– এদিকে আসেন আপনি।
– ক…কেন?
– আমি আসতে বলেছি।
ইতিকা ইনানের সামনে এসে দাঁড়ালে ইনান তাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়।মাথায় হাত বুলিহে আদুরে সুরে বলে থাকে,
– মিসেস ইফতিহার ইনান, আপনি বর্তমানে বিবাহিত ভুলে যান আপনার অতিতের কথা আর অন্য কোন প্রেমিক পুরুষ আপনার জীবনে আসতে চাইলেও মনে করবেন সেইদিনের রাতের কথা।আপনার উপর রাগ উড়াতে নিজের হাতটাকে যেভাবে জখম করেছিলাম ঠিক আবার একই কাজ করবো।আপনার কোন ভুলে আমি আপনাকে শাস্তি দেব না।শাস্তিটা আমি নিজে গ্রহণ করবো।আপনার অন্যয়ের কারনে অন্য কেউ শাস্তি পাচ্ছে,কষ্ট পাচ্ছে কখনোই তা মেনে নিতে পারবেন না আমি জানি।তাই যা বলছি ভালো ভাবে মেনে চলুন।
ইনানের কথার উলটো পিঠে আর কথা বললো না ইতিকা।সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার জীবনটা ধীরে ধীরে ইনানময় হয়ে যাচ্ছে।যেখানে তার নিজের জীবনের উপর নিজের সিদ্ধান্ত তুচ্ছ।
.
ইনানের মামা বাহরুল ইসলাম আজ বেজায় রেগে আছেন।তার মাথা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো।ইনানের অপেক্ষা করতে করতে তিনি বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়েন।শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে।
অতীতে তিনি ব্যবসায় জড়িত থাকলেও রাজনীতি প্রিয় বন্ধু সাহাবের প্ররচণায় রাজনীতিতে যুক্ত হোন।কিন্তু বাহরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা তুখোড় ভাবে বেড়ে গেলে সেই প্রিয় বন্ধুর মনেই হিংসার সঞ্চার হয়।ধীরে ধীরে একে অপরের শক্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ইনান তার বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান।কিন্তু ধীরে ধীরে ছেলেটি তার মামার সঙ্গে মেতে উঠে রাজনীতিতে।বাহরুল ইসলামের হাতের লাঠি হয়ে উঠে ইনান।তারপর থেকেই পিতামাতার সঙ্গে এতটা দূরত্ব ইনানের।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান রুমে ডুকেই হুড়মুড় করে বাহরুল ইসলামের পাশে বসে যায়।
– মামু তোমার তো বেশ বড় আঘাত লেগেছে কিন্তু তুমি আমায় জানাও নি কেন?
– এখন কি আর তোমার খোঁজ পাওয়া যায়?ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত তুমি।
– ছাড় এইসব কথা।
কোন কু*ত্তার বাচ্চা তোমার সাথে এমন করেছে আগে সেটা বলো।আমার কলিজায় হাত দিয়েছে ফল প্রচন্ড খারাপ হবে।
– তুমি কিছু করতে পারবে না।আর যা হয়েছে তার দায় তোমারো কোন অংশে কম নয়।
– মানে কি?কি বলছো তুমি মামু।যা বলছো সোজাসাপটা বলো প্যাচানো কথা আমার একদম পছন্দ নয়।
বাহরুল ইসলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইনানের দিকে।
– ‘সাহাবের’ লোক আমার গাড়িতে হামলা করেছে।
– কারনটা?
– তোমার জেদেই এমনটা হয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?
– আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি করেছি।তাতে তোমার শত্রুর এতটা জ্বলছে কেন?
– সাহাব আমার সাথে ডিল করেছে মেয়েটাকে যদি মারতে পারি তবে সব শত্রুতা চুকিয়ে দেবে কিন্তু তুমি কি করেছো?সরাসরি মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছো।এতে লাভটা কি হলো?বরং শত্রু শত্রু খেলা দিগুন বেড়ে গেছে।
– অদ্ভুত কথা বলছো তুমি মামু।শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা করে কেউ কখনো পার পেয়েছে?পায়নি।তুমিও পেতে না। ইলেকশন এলে দুজনের মাঝে আবার দাঙ্গার সৃষ্টি হতো।
– সেটা ভবিষ্যতের কথা।বিয়েটা করা উচিত হয়নি তোমার।যাই হোক এমন অনাবশ্যক একটি মেয়েকে মেরে ফেললে দেশের ক্ষতি হয়ে যেত না।
বাহরুল ইসলামের কথায় বেশ রেগেই গেলো ইনান।চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সারা রুম জুড়ে পায়চারি করতে থাকে।রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চুলগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে।
– ইতিকা অনাবশ্যক নয় মামু।সে আমার জন্য আবশ্যক।আরেকটা কথা তোমরা তোমাদের শত্রুতা নিয়ে এই শহর উলটে ফেলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না কিন্তু আমার বউয়ের দিকে যেন কোন আচঁ না আসে।
ইনানের বিরোধাভাস কথায় চমকে যায় বাহরুল।ইনানের দিকে দৃষ্টি রেখে দু’বাক্য করার সাহস পেলেন না।
– আমি আসছি, সাহাব উদ্দিনের বিষয়টি তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।নিজের যত্ন নিও।
ইনান বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।অপরদিকে বাহরুল ইসলাম তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
– তোকে তোর পরিবার থেকে আলাদা করেছি এই দিন দেখার জন্য নয়।
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌