#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৬]
________
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত।পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে আছেন ইনান এবং বাহরুল ইসলাম।কিছুক্ষণ আগেই তারা জগিং করতে পার্কে এসেছে।গতকাল আর বাড়ি ফেরেনি ইনান।বেশ রাত হওয়ায় বাহরুল ইসলাম তাকে নিজের সাথে নিয়ে যান।
– এবার আমি যাই মামু।কাল রাতে বাড়ি ফিরিনি মা জানলে নির্ঘাত আবার কোন কান্ড বাঁধাবেন।
– নাস্তা না করে যেতে পারবি না।তোর মামি গরম গরম পরোটা ভাজবে বলেছে আমি তোকে না নিয়ে গেলে ভীষণ রাগ করবে।
– কিন্তু..
– চুপ করতো বেশি বকিস না।চল আরেক দৌড় দিয়ে আসি।নাসরিন কিছু বললে আমাকে ফোন করবি আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো।
_
সূর্যের আলোতে ঝলমলে রোদ্দুর আছড়ে পড়ছে বাগানের দিকে।ইনান ধীর গতিতে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে।যদিও বাগানটার এখন আর তেমন যত্ম করা হয় না।তাই অধিকাংশ গাছ পঁচে মরে আছে।ইনান বাগানের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সদ্য ফোঁটা একটি লাল টকটকে গোলাপ দেখতে পায়।গোলাপ হাতে নিয়ে তির্যক দৃষ্টিতে তাকায় তার বারান্দার দিকে।নিশ্চই এই ফুল ইতিকার খোপায় গুজে দিলে সব রাগ, জেদ পানিতে পরিণত হবে।
পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ইনান।অপর দিকে বাগানের বিপরীত পাশে বাড়ির কাজের মেয়ে রূপসী দাঁড়িয়ে ছিল। ইনান কে বাড়িতে ডুকতে দেখে মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির দারোয়ানকে সর্তক সুরে বলে,
– আইজগা শেষ গো শেষ।আইজগা এই বাইতে একবছর আগে যে তুফান হইছিল আইগজা আবার হেই তুফান হইবো।ইতিকা ভাবী নাই গো নাই এটা হুনলে ইনান ভাইয়ের অবস্থাডা কি হইবো! বুঝবার পারছেন ভাই?
.
বাড়ির পরিবেশ একদম নিরিবিলি ইনান তার বেড রুম,বারান্দা,ছাদ,সবটা ঘুরে অবশেষে রান্না ঘরে পা বাড়ায়।
– মা কেমন আছো?
– ভালো।
ইনান রান্না ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।ইতিকাকে না দেখতে পেয়ে কিঞ্চিৎ কপালে ভাজ পড়ে।
– মা ইতিবউ কোথায়?
– জানি না।
– জানি না মানে?সারাদিন সে তোমার সাথেই থাকে আর তুমি বলছো তুমি জানো না।আমার সাথে কি ফাইজলামি করছো?
কথাটা ইনান একটু জোরেই বললো।
– দেখ তোর সাথে আমার মা-ছেলের সম্পর্ক।অবশ্য এই যে তুই আমার নাড়ি ছেড়া ধন এইটুকুই এর বেশি কিছু না।তুই তোর মর্জি মতো চলিস।আমি আমার মতো। তোর সাথে ফাইজলামি করার ইচ্ছে কিংবা সময় আমার নেই।
– কথা এত প্যাচানোর মানে কী?যা বলবে সোজাসাপটা বলবে।
নাসরিন ঘুরে দাঁড়ায়।কান্নার ফলে দু’চোখ আরক্ত হয়ে আছে।চোখ ফুলে গেছে খানিকটা।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইনানের চোখে চোখ রেখে বলে,
– ইতিকা চলে গেছে কাল রাতেই।
– চলে গেছে মানে কী?
ইনানের কাটক্ষের স্বর।
– কাল সে বলেছিল, এমন বন্দী জীবন তার ভালো লাগছেনা।তাকে এবার অন্তত মুক্ত দেওয়া হোক।
– কাল কী এমন হয়েছিল যার কারনে ইতিকা চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে?
– তুই তার কথা অবমূল্যায়ন করলি কেন?মেয়েটা রাতে অনেক কান্নাকাটি করেছে।আমি তাকে সোজাসুজি বলেছি তাকে এই বাড়িতে যখন আমি এনেছি তখন মুক্তটাও আমি করে দিলাম।তার যদি ইচ্ছে হয় তবে থাকুক এই বাড়িতে ইচ্ছে না হলে চলে যেতে পারে।তারপর সে চলে যায়।চাইলে বাড়ির সিসি ক্যামেরা চেক করতে পারিস।
– মা!
ইনান ধমকে উঠলে রাগটা হঠাৎ করেই মাথায় চড়ে বসেছে।কাকে রেখে কাকে গনধোলায় দেবে বুঝতে পারছে না সে।মিসেস নাসরিন চুপচাপ হাতের কাজ সারছেন।যেন ইনানের দিকে মন দেওয়া সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ।
– মা তুমি জানো ওয়াসিম বাইরে ওত পেতে আছে।একবার যদি ইতিকাকে পায় তবে, তবে….ওহ গড আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।
নাসরিন এবারো প্রত্যুত্তর করলো না।তিনি তার কাজেই ব্যস্ত।ইনান দ্রুত বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে।মেঝেতে পড়ে আছে একটু আগে ছিড়ে নেওয়া সেই ফুলটা।মিসেস নাসরিন মেঝেতে ফুলটা দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
– চাইলে তোর জীবনটাও এমন রঙিন,ফোঁটা ফুলের মতো পবিত্র করতে পারতি কিন্তু তুই বখে গেছিস।
.
নিকষকালো রাতের আধাঁরে ডুবে আছে শহরখানি।বারো তলার বিল্ডিংএর ছাদে বসে শ্যাম্পেইন এর বোতলে চুমুক দিচ্ছে ইনান।অলীদ তার পাশে বসে আছে থুতনিতে হাত দিয়ে।
– আর কত গিলবি?এবার তো থাম।নিচে চল ঘুম আসছে আমার।
অলীদের কথায় ঘুরে তাকায় ইনান।তার পাশে শ্যাম্পেইনের বোতটা ছুড়ে মারে রাগ নিয়ে।সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে ভেঙ্গে যায় বোতলটি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে অলীদ।
– আব্বে শা’লা কি করছিস?মারবি নাকি আমায়?
– তোর ঘুম আসছে?অদ্ভুত তোর ঘুম আসছে?আমি গত তিনদিন নির্ঘুমে আছি।এখনো আমার ঘুম আসছে না।আমার ইতিবউ কোথায়?তার হদিস এখনো পেলাম না আমি।
– নিশ্চই ওয়াসিম নিয়ে গেছে তাকে।এর বাইরে আর কোন অপশন নেই।কেননা ওয়াসিম ছেলেটাও গত তিনদিন থেকে নিখোঁজ।আর ভাবী এই শহরটা চেনে না একমাত্র ওয়াসিম ছাড়া তাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও খুঁজে পেলাম না অদ্ভুত।
– ওয়াসিমের সঙ্গে যদি কোন কিছু সত্যি সত্যি হয় সে যদি ওয়াসিমের সঙ্গেই যায় তবে কসম কলিজা টেনে ছি’ড়ে ফেলবো।বেয়াদপ মেয়ে সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি আমাকে বয়কট করে এক্স নিয়ে ভেগে গেছে।
ইনান মাতাল ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে আরেকটা শ্যাম্পেইনের বোতল ছুড়ে ফেলে।
অলীদ জানে ইতিকা কোথায় আছে তাই নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে সে।এতদিন ইনানের পাগলের মতো অবস্থা দেখে বেশ মজা নিয়েছে অলীদ।অন্তত এই ছেলেকে কবজা করতে ইতিকার পালিয়ে যাওয়াটাই মূখ্যম ছিল।ইনানকে রাগাতে মুখ খুললো অলীদ,
– তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?তোর জন্য মেয়ের অভাব হবে না অন্তত আরেকটা বিয়ে করতে পারবি যে গেছে যেতে দে ইতিকাকে মুছে ফেল মন থেকে।
অন্ধকারে ঝাপসা চোখে অলীদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে ইনান।অবশ্য কয়েক মিনিটে খুঁজেও পায়।তৎক্ষণাৎ ক্ষুদার্থ বাঘের ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ে অলীদের উপর।হঠাৎ আক্রমণে মেঝেতে গিয়ে ঠেকে দুজনে।অলীদের মেরুদণ্ড যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।অসহ্য ব্যথায় আর্তনাদ করার আগেই ইনান তার গাল চেপে ধরে,
– সাহস কম না তোর।আমার বউ আমি ছাড়বো মানে কী?এমনি এমনি বিয়ে করিনি।তাকে চাই বলে করেছি।
– আরে ছ..ছাড় শা*লা।যদি এতই দরদ থাকতো তবে সেদিন ইতিকার কথা রাখলি না কেন?বাড়ির বাইরে গেলি কেনো তার উপর মিথ্যা বলেছিস তুই মিটিং এ আছিস।কিন্তু তুই গোপন আস্তানায় ছিলি।
অলীদের কথায় হাতের বাধঁন আলগা হয়ে যায় ইনানের।
– ইতিকা যানলো কী করে আমি মিটিং এ যাইনি।গোপন আস্তানায় গেছি?
অলীদ এবার থতমত খেয়ে যায়।কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা সে।অপরদিকে মাতাল ইনান ধীরে ধীরে নুইয়ে যাচ্ছে শরীরের শক্তি তার ধীরে ধীরে ইতি টানছে।
আজ সজ্ঞানে থাকলে সত্যিটা জানলে অলীদের গর্দান নিতেও দু’বার ভাবতো না ইনান।তা ভেবে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে অলীদ।
_
ভার্সিটিতে সুফিয়ার সাথে একটু কথা বলার জন্য দীর্ঘক্ষন অপেক্ষায় আছে অলীদ।আজ তাদের এক্সামের শেষ দিন।এবারের এক্সামটা আর দেওয়া হলো না ইনান এবং অলীদের।তবে সুফিয়ার বাবা এক্সামের দরুনে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।যদিও সর্বাবস্থায় তাকে নজরদারীতে রাখা হচ্ছে।
সুফিয়াকে আসতে দেখে এগিয়ে গেলো অলীদ।
– হেই এক্সাম কেমন হলো সুফু?
– কচুপোড়া এক্সাম দিয়েছি।কোন কিছু কমন পড়েনি।সামনের ছেলেটার কাছ থেকে সব দেখে লিখেছি এককথায় ফুল-কপি।
– বাহ বাহ, এইতো আর্দশ স্টুডেন্ট।তোরা মাইয়ারা এটাই ভালো পারিস।এক্সাম হলে আমাদের মতো অবলা ছেলেদের একটু মিষ্টি কথা বলে পটিয়ে সুন্দর ভাবে পুরো খাতাটা কপি মারতে পারিস।
অলীদের কথায় তেতে উঠলো সুফিয়া।
– ঠাটিয়ে দুই চড় দেবো।তোর মতো নাকি রে আমি?আমি ভালো স্টুডেন্ট বাট এক্সামের আগে পড়তে পারিনি তাই এই দশা।
সুফিয়ার কথার মাঝে এগিয়ে এলো সুফিয়ার গাড়ীর ড্রাইভার।
– আপা দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি চলুন।স্যার আবার রেগে যাবেন।
সুফিয়া কিছু বলার আগেই অলীদ আপাদমস্তক ছেলেটাকে দেখে নিলো।দেখেই বোঝা যাচ্ছে অবিবাহিত ছেলে।অলীদ সুফিয়ার হাত টেনে পিছিয়ে নিয়ে ছেলেটার সামনে নিজে এগিয়ে আসে।
– আপনার স্যার কোথায়?
– অফিসে আছেন।আমাকে বললো আপাকে নিয়ে যেতে।
– বাড়ি ফিরবে কখন তোমার স্যার?
– মিটিং আছে বেশ রাত করেই ফিরবেন।
– তোমার বউ আছে নাকি গার্লফ্রেন্ড?
এবার অলীদের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় ছেলেটি।চোখ ছোট করে সুফিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবারো অলীদের দিকে তাকায়।
– গার্লফ্রেন্ড আছে।
– বাহ বাহ বেশ ভালো।তোমার স্যারের ম্যাডামকে ফোন করে আমি বলে দেবো ওনার মেয়ে আমার সাথে আছে।আর স্যারকে তুমি ফোন করে বলবে সুফিয়া আপাকে তুমি বাড়ি পৌছে দিয়েছো বুঝতে পারেছো?
– কিন্তু….
– কোন কিন্তু নয় এই এক হাজার টাকা রাখো। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আজ ঘুরতে যাও।আর যা শিখিয়ে দিয়েছি সবটা বলবে।এবার ফুটো এখান থেকে।
ছেলেটি বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।অপরদিকে সুফিয়া আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে অলীদের দিকে।
– তুই ছেলেটাকে এক হাজার টাকা দিয়ে দিলি!তোর কী টাকা বেড়ে গেছে নাকি?
– না আমার টাকা বাড়বে কেন?আমার আবার অত টাকা পয়সা নেই।এক হাজার টাকার নোটটা তোর ছিল।
– মানে?
অলীদ সুফিয়ার দিকে পার্সটা ছুড়ে দেয়।
– নে তোর পার্স।তোর ব্যাগ থেকে নিয়েছি আর টাকা’টাও তোর ছিল।
সুফিয়া পার্সটা হাতে নিয়ে অলীদের পিঠে কিল বসায়।
_
লেকের পাড়ে বাদামের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত অলীদ।বেশ যত্ন নিয়ে বাদামের খোসা ছাড়ায়ে সুফিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে।যেন এটাই তার বর্তমানে একমাত্র কাজ আর কাজটি সঠিক ভাবে পালন না হলে বিশেষ কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।সুফিয়া অলীদের হাত থেকে বাদাম নিয়ে ভ্রু-যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
– ঘটনা কী?আজ এত আদর আদর ভাব।
-“আমি আমার হবু বউকে আদর যত্ন করছি তাতে তোর কী?এবার অফ যা।”
কথাটি মনে মনে বলে ঠোঁট টিপে হাসে অলীদ।এই কথা তার সামনা সামনি বলার সাহস নেই তার।
– অলীদ উত্তর দিচ্ছিস না কেন?আর হাসছিস কেন?
– না এমনি অনেকদিন পর আড্ডা দিচ্ছি তাই আর কি।
– ইনান কোথায় রে?
– সে আছে ইতিকাকে খোঁজার জন্য এদিক থেকে সেদিক পাগলের মতো ঘুরছে।শুনেছি আজ ওয়াসিমের সম্পর্কে হালকা পাতলা তথ্য পেয়েছে।ওয়াসিম যে সিলেট আছে সেটা আজ জানলো ইনান।তবে তার সাথে কী ইতিকা আছে কী না তা জানতে পারেনি।
‘ওয়াসিমের’ নামটা শুনতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো সুফিয়ার।তবুও নিজেকে আবার সংযত করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
– আচ্ছা আমরা কী ইনানের ভালো করছি নাকি মন্দ?ছেলেটা যে রাতদিন এক করে মেয়েটাকে খুঁজছে আর আমরাই যে ইতিকার ব্রেনওয়াশ করে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি বিষয়টা যদি সে জানে তবে….বুঝতে পারছিস তুই?
– ভুলেও এই কথা মুখ থেকে বার করবি না সুফু।ইনান চিলের চোখ নিয়ে ঘোরে বলা তো যায়না আমাদেরো সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেবে।
– হ্যা ঠিক।
– শোন ইতিভাবী বাড়ি থেকে সেদিন রাতেই বেরিয়ে যায়।আমি ভেবেই নিয়েছিলাম সে হয়তো ফ্লাটে আসবে।আমি গাড়ি নিয়ে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমি ভেবে রেখেছি দেখা তো হবেই তখন এক ব্যবস্থা করবো কিন্তু তিনি উলটো পথে হেঁটে গেলেন।আগে ওয়াসিমের সাথে যোগাযোগ করে তার বাড়িতে পৌঁছে যায়।সেদিন রাতে দুজনে গ্রামে চলে যায়।আর ইতিভাবী ওয়াসিমের কাছে সাতদিন সময় চেয়েছে গ্রামে থাকার।আর তত দিন গা ঢাকা দেবেন তিনি।ওয়াসিম তো খুশিতে গদগদ হয়ে কাজের সূত্রে সিলেট চলে গেছে।সাতদিন পর ইতিকা ওয়াসিমের সঙ্গে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে।কিন্তু বোকা ওয়াসিমতো জানে না তার বাবা ‘সাহাব উদ্দিন’কে আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আর তাই তিনি কৌশলে তাকে সিলেট পাঠিয়ে দেয়।আর ইনান যদি ইতিভাবীর শর্তে রাজি থাকে তবেই সে ফিরবে।যদি ইনান নিজের মামুর কথায় এবারো টক্কর দেয় তবে আমাদের আর কিছু করার নেই আমরা ইতিকাকে আড়াল করে দেবো।ইব্রাহিম আঙ্কেল বলেছেন তার বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয় দেবেন।
– আমি জানি, তুই,আঙ্কেল, আন্টি সবাই ইতিকার বিষয়ে জানি যদি খবরটা ইনান পায় তবে কী হবে?
– আরেকটা অশান্তি শুরু হবে।তবে যা হচ্ছে হতে দে।
__
প্রভাতের আলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।দিঘির সচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে রমণী।দু’চোখে তার উদাসীনতা।কোন কিছুর পাওয়ার অভিলাষ যে তাকে মুষড়ে দিচ্ছে ভেতরটায় তা প্রকাশ করতে পারছে না সে।বিস্তীর্ণ দিঘিটায় ফুটে আছে কচুরিপানার ফুল।দিঘির শেষ প্রান্তে আকাশ চিড়ে বেরিয়ে আসছে উত্তপ্ত রক্তিম লালের দিনমণি’টা।সেদিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রমণী।দিঘির জলে দু’পা নাড়িয়ে তৃপ্ত হচ্ছে বারংবার।মাথায় ঘোমটা টা সরিয়ে কোমড় সমান ঢেউ খেলানো চুলগুলো একপাশে আছড়ে রাখে।এই সময় এইদিকটায় কেউ আসে না বললেই চলে।গ্রামের বাড়িটায় উঠান শেষে একটি বড় পরিস্কার পুকুর আছে সেই পুকুরটাই ব্যবহার করে সবাই।অপরদিকে এই দিঘিটি ইতিকার ফুফির ঘর থেকে কিছুটা দূরেই।দিঘির পাড়ে বেশ কয়েকটা পাটাতন রয়েছে যার কারনে ইতিকার বসতে বেশ সুবিধাই হয়।
ওয়াসিমের কাছ থেকে সাতদিনের সময় নিয়েছে ইতিকা।যার মধ্যে পাঁচদিন পূর্ণ।আজ ষষ্ঠ দিন শুরু।অপরদিকে ইনান প্রায় চারবার এসেছে এই বাড়িতে প্রতি বারি ইতিকা পালিয়ে ছিল রান্না ঘরের ভাঙ্গা আলমারিটার পেছনে।সে ইনানের কাছে কিছুতেই ধরা দেবে না।
তবে ইনানকে যে তার চাই, খুব করে চাই।দিঘির জলে হাত ভেজালো ইতিকা।উদাস কন্ঠে একটি গান আওড়ালো।
“প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ।”
অকস্মাৎ ইতিকা অনুভব করে তার উন্মুক্ত পিঠে কেউ ঠোঁটের স্পর্শ করেছে।উত্তেজিত হয়ে কিছু বলার আগেই ব্যাক্তিটি পেছন থেকে তার দু’বাহু চেপে ধরে।এবং গভীর ভাবে অধর ছোঁয়াতে থাকে।মেয়েটি উপায়ান্তর
না পেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে স্বচ্ছ দঘির জলে।বেশ দূরে না যাওয়ায় মাটির স্পর্শ পায় সে।তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে কপালের দিকে আছড়ে পড়া চুলগুলো পেঁছনে ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে তাকায়।সামনের মানবটিকে দেখে বাক্য হীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে।
.
গত কয়েকদিন যখন নিজের বউকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মতো অবস্থা তখন নিরুপায় হয়ে আবারো গ্রামে ফিরে আসে ইনান।এবার বাড়িতে সোজাসুজি প্রবেশ না করে।পেছনের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে।হঠাৎ চোখে পড়ে দিঘির পাটাতনে বসে আছে একটি মেয়ে।তাকিয়ে আয়ে আছে অনাবিল দিঘির জলে।দূর থেকেই ইনান চেনে নেয় এটাই তার ইতিবউ।বেশ কিছুক্ষণ ইতিকার পাশে শব্দহীন বসে ছিল সে।যখনি ইতিকা গান আওড়ালো নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না।উন্মুক্ত পিঠে মাথা নুইয়ে অধর স্পশে ব্যস্ত সে।
– আপনি?
ইতিকার প্রশ্নে উত্তর দিলো না ইনান।হলুদ বর্ণের সূর্যটা ধীরে ধীরে আলো ছড়িয়েছে ব্যাপক।হলুদ,কমলার মিশ্রিত আলো ইতিকার চুলে, গালে ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন আদুরে ভাবে।
– দেখলেন ইতিবউ চলে গিয়ে কী লাভ হলো, সেই তো আমি আপনার সামনে হাজির।
ইতিকা এখনো নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেনি।অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বিধস্ত পুরুষটার দিকে।
– উঠে আসুন।আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।
– আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাবো না।আমি আমার ভিটেমাটিতে পড়ে থাকবো।
– সিরিয়াসলি আপনার ভিটেমাটি?আপনার ফুফা-ফুপিকে এক ইশারা করলে এক্ষুনি বের করে দেবে।তার থেকে ভালো উঠে আসুন।সম্মানের সাথে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।
– সম্মান তো একবার ভাঙ্গেননি বার বার ভেঙ্গেছেন।আপনাকে শর্ত দিয়েছি বাইরে এইভাবে চলাফেরা বন্ধ করুন।বাবার ব্যবসায় হাত লাগান।অযথা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন।
– এত কথা শুনতে চাই না ইতিবউ চলুন আমার সাথে।যা করেছেন তার জন্য আপনাকে মাফ করেছি এটাই অনেক।
– যাবো না আমি। আপনার যেদিকে ইচ্ছে আপনি চলে যান।আর আমায় শান্তিতে বাচঁতে দিন।
– শান্তি?আমায় ছাড়া না আপনার শান্তি হবে আর না আমার শান্তি হবে।উঠে আসুন।
– উঠবো না।
– আমি কি ঝাপ দেবো?আমি কিন্তু সাঁতার জানি জানি।
ইতিকা উঠলো না সে এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।ইনান ইতিকার কান্ড বুঝতে পেরে পাটাতনে বসে যায়।অপরদিকে ইতিকা ঠোঁট বাকিয়ে সাঁতার কেটে একটু মাঝামাঝিতে চলে যায়।ডুব সাঁতারে পানি থেকে লাফিয়ে উঠতেই ইতিকার দিকে তাকিয়ে ইনান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।এ যেন জলপরী।সর্বাঙ্গ দেহে জলে টইটুম্বুর।নাক ঠোঁট চুইয়ে চুইয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে দিঘির জলে।ইতিকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে সূর্যের দিকে তাকায়।কিছুটা এগিয়ে এসে কচুরিপানার ফুল ছিড়ে কানে গুজে নেয়।ইনান তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আমার সর্বাঙ্গসুন্দরী বউ।এত স্নিগ্ধ এতটা কোমলমতী তোমায় আগে লাগেনি।আজ তো আমার দিঘির অগাধ জলের উপর ঈর্ষা হচ্ছে।আমার কোমলমতীকে ছোঁয়ার ভাগ্য তার হয়েছে।অথচ আমি কে?আমাকে রাখে দূরে আড়ালে তার ভালোবাসার আবডালে।
ইতিকা ঘুরে তাকিয়ে ইনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– ফিরে যান।আমি ফিরবো না আপনার সঙ্গে।
– আমার কী একটাই অপরাধ?আমি মামুর সঙ্গ দিচ্ছি বলে?
– যদি বলি হ্যা তাই!আপনি আপনার মামুর সঙ্গতা ছেড়ে দিন।আমি কিন্তু আত্মীয়তা ছাড়তে বলেনি স্রেফ সঙ্গতা,রাজনীতি, মারামারি গুলো ছাড়তে বলেছি।
ইনান উঠে দাঁড়ায়।হঠাৎ তার রাগ মাথা চড়া দিয়ে বেড়েছে।তাকে যেতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে ইতিকা।হাতে এক কোষ জল নিয়ে ছুড়ে দেয় ইনানের দিকে।জলের স্পর্শে ঘুরে তাকায় ইনান।ইতিকা কোমড়ে হাত গুজে বলে,
– অন্তত একটা কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি।আমি যা বলি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা ওয়াসিম ছাড়া এই ভুবনে কেউ করেনি।ছেলেটা মন্দ হলেও আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
ইতিকা ঘুরে দাঁড়ায়, হলুদ সূর্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে চোখ কুচকে।অপরদিকে ইনানের কাছে ইতিকার কথাগুলো ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো।রাগে হন্তদন্ত হয়ে মাঝ পথে থেমে যায় ইনান।পকেটে বেশ শব্দ করে ভাইব্রেট হচ্ছে ফোন।নাসরিনের নাম্বার দেখে দ্রুত ফোন রিসিভ করে সে।
– হ্যা মা বলো।
– তুই কোথায়? এদিকে যে কান্ডো ঘটে গেছে।
– কি হয়েছে?
– তোর মামু আংটি নিয়ে বেশ কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে।আজ নাকি তোর আর রুমুর এনগেজমেন্ট হবে।ইতিকা যেহেতু চলেই গেছে তবে আর দেরি নয় ‘রুমু’র সাথেই তোর বিয়ে দিতে চায় ভাইজান।তোর বাপ রেগে বোম হয়ে আছে। আমার শেষ কথার এক কথা মা হয়ে ছেলের খারাপ চাইবো না।ইতিকা ছাড়া এই বাড়িতে অন্য কেউ বউ হয়ে এলে তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করতে দুইবার ভাববো না।আমি আমার ভাইকে বিশ্বাস করি না এটা মাথায় রাখিস।
নাসরিন খট করে ফোনটা কেটে দিলেন।একের পর এক ঝামেলা তাকে বিষিয়ে তুলছে।ইতিকাকে ছাড়া সে থাকতে পারবেনা অপর দিকে আজ একা বাড়ি ফিরলে ঝামেলায় পড়বে।কী করবে সে?তার মায়ের বলা শেষ কথাটা ভাবিয়ে তুলছে তাকে।
ইনান অলীদের নাম্বারে কল করে কিছুটা স্থির কন্ঠে বলে,
– আমি ইতিবউকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার এখন কী করা উচিত?
– বলদের মতো কথা বলিস কেন?এইসব ভংচং ছাড় ইতিভাবীকে নিয়ে থাক।দেখবি সুখে থাকবি।
ইনান ফোন অফ করে আবারো দিঘির পাড়ে যায়।ইতিকা অন্যদিকে মুখ করে কচুরিপানার ফুল ছিড়তে ব্যস্ত।
– ইতিবউ আমি যদি আপনার সব কথা মেনে নি তবে কি ফিরে আসবেন?
– অবশ্যই।
– তবে বেশ কবুল!আপনার সব শর্ত কবুল!
ইতিকা ঘাবড়ে গেলো।হঠাৎ ইনাকে এত নার্ভাস লাগছে কেন।ইনান ছটফট করে পানিতে নেমে যায়।ইতিকাকে ইশারা করে এগিয়ে আসত।ইতিকাও জড়বস্তুর ন্যায় মুঠো ভর্তি কচুরিপানার ফুল নিয়ে এগিয়ে এলো ইনানের কাছে।ইনান ফুলগুলো নিজ হাতে তুলে নেয়।ইতিকার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে।ফুল গুলো বাড়িয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বলে,
– হাজার’টা জড়তা ভুলে আমি আপনার কাছে, আমার জীবন সমর্পণ করিলাম ইতিবউ! #আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৭ ]
________
দ্বিপ্রহরে নীল আকাশটা হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে আছে তার সাথে ভারী বর্ষণ।আধাঁর পরিবেশে ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে মেঘের গুম গুম শব্দ।ইনান শার্টের হাতা ভাজ করে বারান্দা থেকে মাথা তুলে একবার আকাশটা দেখে নিলো।না,বৃষ্টি থামার নাম নেই।আজ যেন আকাশ উত্তাল হয়েছে ধরণি ভিজিয়ে সতেজ করার বাহানায়।সকালে ইতিকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেও ইতিকার ফুফা,ফুফি কিছুতেই বাড়ি ফিরতে দিলেন না।তারা দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে মত্ত হয়ে উঠলেন।আহার গ্রহণ শেষে শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো ইতিকা।হঠাৎ ভারী বর্ষণ শুরু।তারপরেই তারা বন্দি।
– একটা কথা ছিল!
ইতিকার ভরাট কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় ইনান।ইতিকা দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে।
– বলুন।
– ওয়াসিম কোথায় আছে কিছু জানেন কী?গত তিনদিন তার কোন খোঁজ পাচ্ছি না।
‘ওয়াসিম’ নামটা শুনতেই ইনানের সর্বাঙ্গ যেন ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।এত মায়া কেন ছেলেটার জন্য?কিসের এত আকুলতা?
– আপনার তো দেখছি সবার জন্যই মাথা ব্যাথা হয় একমাত্র আমি ছাড়া।
ইনান শান্ত সুরে কথাটা বললেও তার কন্ঠে যে কতটা রাগ মিশ্রিত ছিল তা ইতিকা ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে।
সে হালকা করে ঢোক গিলে ইনানের দিকে তাকালো।
– আসলে তার সাথেই গ্রামে এসেছি এরপর দুইদিন কথা হয়েছে গত তিনদিন কোন কথা হয়নি তাই।তাছাড়া সে আমার উপকার করেছে।আর তার খোঁজ খবর যদি আমি না রাখি বেইমানি হয়ে যাচ্ছে না বিষয়টা।
ইতিকার সহজ স্বীকারোক্তি তবে রাগ লাগলো ইনানের।দু’হাতের মুঠো করে এগিয়ে গেলো ইতিকার দিকে।ইতিকা মাথা নুইয়েই দু’কদম পিছিয়ে যায়।
তাদের অবস্থানের মাঝে আর সামান্য ব্যবধান আছে বলা চলে।ইনান বাজখাঁই গলায় কিছু বলার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় ইতিকার সমবয়সী ফুফাতো বোন মিহি।
– ইতিকা আম্মা তোকে ডাকে…
ইতিকা ইনানকে ঠেলে সরে যায়।দ্রুত মাথায় ঘোমটা টেনে বারান্দা পার করে ঘরে প্রবেশ করে।
মিহি থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে।সে বুঝতে পারেনি ইতিকা এবং ইনান দুজনে এত কাছে ছিল এইভাবে।যদি বুঝতো তবে ভুলেও এইদিকটায় পা বাড়াতো না।
– মিহি এদিকে আসো।
ইনানের ডাক শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।
– কিছু বলবেন দুলাভাই?
‘দুলাভাই’ ডাকটা শুনে মনে কেমন যেন উড়ু-উড়ু করছে ইনানের।তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া গেল।একহাত কোমড়ে দিয়ে, অন্য হাত দিয়ে সামনে থাকা চুলগুলো বেশ স্টাইল করে পেছনে সরিয়ে ঘুরে তাকালো সে।বুকের বাম পাশটায় আবেগী ভঙ্গিতে হাত দিয়ে নিজেও বিড়বিড় করে বলে, ‘দুলাভাই’।
– দুলাভাই কিছু বলবেন?
ইনান আবারো ঘুরে তাকায়।হাত ইশারায় ডাকতে থাকে মিহিকে।
– আমাকে এত ভয় পাও কেন?সবসময় দূরে দূরে থাকো।অদ্ভুত আমাকে দেখলেও ছুটে পালিয়ে যাও।
– কই, আমি আবার কখন পালালাম?
– মিথ্যা বলছো আমার সঙ্গে?
মিহি এবার থতমত খেয়ে যায়।মিনমিনিয়ে চোখ ছোট করে বলে,
– বিয়ের দিন যে ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ে এসেছেন।গাড়িতে করে রামদা,পিস্তল ভাবতেই আমার ভয় লাগে।
মিহির এমন প্রত্যুত্তরি আশা করছিল ইনান।মুখে গম্ভীর্য ভাব রেখে বলে,
– আমি ছেলেটা খারাপ নই।আর এখন আরো ভালো হয় যাবো তোমার বোনের পবিত্র ছোঁয়া পেয়েছি কীনা!আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারো।যাই হোক একটা প্রশ্ন করি তোমায়।আমার সোজাসাপটা উত্তর চাই।
– জি বলুন।
– এই কয়েকদিন আমার অনুপস্থিতিতে ইতিবউ কী আমায় মিস করেছে?তোমায় কিছু বলেছে সেই ব্যাপারে?
– রাতদিন এক করে কেঁদেছে।নির্ঘুম রজনি পার করেছে।খাওয়াদাওয়া তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল।এবার আপনি বুঝেনিন সে কী আপনাকে মিস করেছিল!
– আমার জন্য নাকি ওয়াসিমের জন্য কেঁদেছিল?বিশ্বাস করবো কী করে?
– বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্পূর্ণ আপনার বিষয়।আমি সত্যটাই বলেছি।এর বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই দুলাভাই।
__
টিনের চালায় ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।বিদ্যুৎ নেই বিকেলের পর থেকে।ঘরে লন্ঠনের লাল টিমটিমে আলোর পাশে বসে আছে ইনান।ইতিকার সাথে আর খুব একটা কথা হয়নি অবশ্য মেয়েটাই কেমন যেন দূরত্ব নিয়ে চলছে কিন্তু কেন বুঝতে পারছেনা সে।প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।আকাশের হাক ধীরে ধীরে ক্রমশ বেড়েই চলছে।ইতিকা রুমে ডুকলো ভেজা চুল নিয়ে।গায়ে তার এক রঙা লাল শাড়ি।শাড়িটির কিনারায় বেগুনি সুতার কাজ।লন্ঠনের টিমটিমে আলোতেও বেশ দেখতে লাগছে মেয়েটাকে।
– আপনি থাকতে পারবেন তো এই খাটে?আপনার রুমের খাটের মতো আমার খাট কিন্তু নরম নয়,বেশ শক্ত।তাছাড়া টিনের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে।স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে আপনার থাকতে নিশ্চই অসুবিধে হবে।আমি মাফ চে…..
ইতিকা কথা শেষ করার আগেই ইনান তার হাত টেনে কাছে বসিয়ে দেয়।ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে মত্ত হয়ে যায় ভেজাচুলের ঘ্রাণে।ইতিকা চোখ বাকিয়ে তাকায় ইনানের দিকে, ছেলেটা যে এখন প্রমত্ত হয়ে আছে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।
– কিছু বলছেন না যে?
– চুল ভেজা কেন?গোসল করেছো এই রাতে?
– না, না আসলে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলাম একটা কাজে; ভিজে গেছি তাই একেবারে পুকুর থেকে গোসল করে এসেছি।
– একা কেন গেলে?আমাকে নিয়ে যেতে দু’জনে একসাথে ভিজতাম।
– এটা আপনার শহর নয় রোমান্টিক মুড নিয়ে আমাকে সহ ভিজবেন এটা গ্রাম।আমরা স্বামী-স্ত্রী হলেও সবাই কুবাদ রটিয়ে দেবে।
ইনান খানিকটা সরে গেলো ইতিকার পাশ থেকে।থম মেরে বসে রইলো হারিকেনের দিকে তাকিয়ে। ইতিকা বুঝতে পারছেনা হঠাৎ কি হলো ছেলেটার।
– রেগে গেলেন কেন?আমি কি ভুল বলেছি?
– ওয়াসিমের সাথে যখন প্রেম করতে তখন কী তোমার গ্রামের মানুষ কুবাদ রটায় নি?
ইতিকা নড়ে উঠলো।প্রতিটি কথার ভাজে ভাজে ওয়াসিমের কথা না তুললে মনে হয় ই ছেলের শান্তি নেই।
– ওয়াসিমের সাথে আমার প্রেম গ্রামের সবাই জানতো।তাছাড়া আমাদের দেখা হতো খুব কম।যত বার দেখা করেছি মিহি দূর থেকেই আমাদের পাহারা দিয়েছে।আরেকটা কথা আপনার কথা বার্তার ধাঁচে অন্য কিছু প্রকাশ পাচ্ছে।আমি প্রেম করেছি এই না যে সতিত্ব বিলিন করেছি।ওয়াসিম শুধু একবার আমার হাত ছোঁয়ার অনুমতি পেয়েছে এছাড়া বেশি কিছু নয়।
কথাগুলো শেষ করে উঠে চলে গেলো ইতিকা।এখানে আর বসে থাকার মতো কোন যুক্তি পেলনা সে।
.
টিনের ফাঁক দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস ডুকছে রুমে।লন্ঠনের টিমটিমে আলোতে তাকিয়ে আছে ইতিকা।দুচোখ ঘুমহীন, মাথায় চেপে আছে হাজারটা চিন্তা।পাশে শুয়ে আছে ইনান।বৃষ্টির গতিক থেমে গেছে প্রায় অনেক্ষণ যাবৎ দূর থেকে কানে আসছে আকাশের গুমগুম শব্দ।হঠৎ দমকা বাতাস শুরু।
লন্ঠনের তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় নিভে গেছে তৎক্ষণাৎ। আকাশের ডাক হঠাৎ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।মেঘের গর্জনে যেন পুরো ঘরটাই নড়ে উঠছে।ইতিকা ভয় পেয়ে যায়।আকঁড়ে ধরে গায়ের কাঁথাটা।আকাশের প্রতিধ্বনিকে মাতিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু।গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ইতিকার।অন্ধকার রুম, তার সাথে আকাশের এমন বিভৎস ডাকে দু’আঙুল কানে গুজে দিলো।তাতেও কোন লাভ নেই আজ বজ্রপাত যেন তাকে ভয় দেখাতে প্রস্তুত।এমন ভীতকর পরিস্থিতি কান্নার মত অবস্থা ইতিকার।আজ যদি পাশে মিহি থাকতো তবে তাত হাতটা জড়িয়ে রাখতো দুজনে মিলে কথার তালে ভয়টা কাটিয়ে তুলতো।তবে এখন পাশে আছে ইনান যাকে সে চাইলেও ছুঁয়ে দিতে পারবেনা।বলতেও পারবেনা আমার ভয় লাগছে জড়িয়ে নিন আমায় আপনার বক্ষপিঞ্জরে।মানুষটা কি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে?
আকস্মিক অন্ধকার রুমটা বিদ্যুৎ চমকানিতে আলোকিত হয়ে যায়।আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে বজ্রপাত তৎক্ষণাৎ যেন কেঁপে উঠে ধরণি।ইতিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়।সহসা পেছন থেকে কেউ তার ঘাড়ে বেশ জোরেই দেয় টান দেয়।কিছু বুঝে উঠার আগেই ইনানের বক্ষপিঞ্জিরায় আড়াল হয়ে যায় সে।
– ভয় পাবেন অথচ মুখ ফুটে বলবেন না।বললে কি জাত চলে যাবে?
ইতিকা কথার উলটো পিঠে আর কথা খুঁজে পেল না।কিছু বলতে যাবে তার আগেই কপালে অনুভব করে উষ্ণ ছোঁয়ার ইনান বেশ গভীর ভাবে তার কপালে অধর ছুঁয়ে দিয়েছে।
– যখনি ভয় পাবে?একা একা লাগবে,নিঃসঙ্গতায় ভুগবে,আর কাদঁতে ইচ্ছে হবে, চলে এসো এই রগচটা মানুষটার বক্ষঃস্থলে যে তোমায় সঙ্গ দিতে সর্বদা প্রস্তুত।
ইতিকা মাথা তুলে তাকাতে চাইলো ইনানের দিকে।কিন্তু অন্ধকার ঘরটায় রগচটা ব্যাক্তিটার মুখ দেখতে পেলো না।ক্রমশ বাড়তে থাকে বিদ্যুৎ ঝলকানি ইতিকাও গুটিয়ে যায় ইনানে বক্ষঃস্থলে।ভয়টা যেন নিমিষে পতিত হয়েছে তার মন থেকে।
____
বসার ঘরে বেশ চিন্তিত মুখ নিয়ে সিগারেট টানতে ব্যস্ত বাহরুল ইসলাম।তার সামনে বসে আছে ইফতিহার ইনান।
– তুমি তাহলে ওই মেয়েটার জন্য নিজের মামুর প্রস্তাব নাকচ করলে বাহ এই ছিল এতদিনে কোলে পিঠে মানুষ করার ফল।
– রুমুকে আমি নিজের বোনের চোখে দেখি মামু তার সাথে বিয়ের প্রসঙ্গ এলো কি করে?
– আমি তো আর তোমায় নিজের ছেলে ভাবি নি।আমি নিজের বাড়ির জামাই করার আশায় ছিলাম।
ইনান ফস করে শ্বাস ছাড়লো।মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে সহসা কথার পিঠ ঘুরিয়ে দিলো।
– আরেকটা কথা ছিল মামু।আমি তোমার কাজটা ছেড়ে দিচ্ছি।রাজনীতির পথে আর হাটছি না।ভাবছি এবার নিজেই কিছু একটা করবো।
ইনানের কথা শুনে বাহরুল ইসলামের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়েছে।
– কি বলছো এইসব?ভবিষ্যত পদ তোমাকে দেবো বলে ঠিক করে রেখেছি আর তুমি!
– একদম ঠিক বলছি আমি।দুঃখিত মামু অন্য কাউকে আমার স্থানে বসিয়ে নাও।আমার থেকেও যোগ্য মানুষ পাবে তুমি।
বাহরুল ইসলাম কিছু একটা ভাবলেন।চোখে মুখে তার অদ্ভুত হাসির ঝলক দেখা মিললো।
– বেশ তবে তুমি তোমার মতো চলো আমি তোমার স্থানে ‘ওয়াসিম’কে মনোনীত করলাম।
বাহরুল ইসলামের এমন একটি কথা কিছুতেই আশা করেনি ইনান।হঠাৎ রাগটা যেন মাথা চড়ে বসেছে।
– ওয়াসিম!শক্রুকে আজকাল দলে ঢোকানোর জন্য এত দিশেহারা হয়ে গেলে কেন তুমি?বুঝতে পারছিনা আমি তোমার মতিগতি।
– আপন যখন পর হয় তখন বন্ধু শত্রু হলে কী সমস্যা?আমি তো কোন খুঁত খুঁজে পাইনি।
ইনান আর এক মূহুর্তেও দাড়ালো না।বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো বসার ঘর থেকে। সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবটা।
_
অলীদের পাশে বসে তিরতির করে কাঁপছে ইতিকা।হাতে তার অলীদের ফোন।ফোনের বিপরীত থেকে শোনা যাচ্ছে কর্কশ কন্ঠের ওয়াসিমের কথা যে কী না এক নাগাড়ে বকে যাচ্ছে ইতিকাকে।
– এবার থামো ওয়াসিম।তোমার যুক্তিহীন তর্ক বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ হজম করছি।
– আমার কথা তোমার কাছে যুক্তিহীন?সাতদিন সময় চেয়েছো তুমি আমি দিয়েছিলাম আর ছয় দিনের দিন সুর সুর করে চলে আসলে ইনানের হাত ধরে বাহ বাহ।এই ছিলো তোমার মনে!
– যা হয়েছে ভুলে যাও আমি আমার রাস্তায় তুমি তোমার।
– এত সহজ নয়।এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো।
– যা ইচ্ছে হয় দেখো আমি আমার রাস্তা বেছে নিয়েছি আর এটাই শেষ কথা।
ইতিকা কথাটা বলে ডান হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়।হঠাৎ দরজার সামনে থেকে কানে আসে চেনা পরিচিত কারো কন্ঠ।যা শুনে অলীদ এবং ইতিকা দুজনেই চমকে যায়,
– কার সাথে কথা বলছেন ইতিবউ?
#