আগুন ঝরার দিনে পর্ব -০৩

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_৩

চারটা দশ বাজে। রুহি ভয়ে ভয়ে টিচার্স রুমের দিকে এগুলো। আশফাক স্যার তাকে বিকেল চারটার মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন লিখিত ভাবে জমা দিতে বলেছিলেন। পরপর দুটো ক্লাস থাকার কারনে রুহির দশ মিনিট দেরী হয়ে গেল। সে টিচার্স রুমে উঁকি দিল। টিচার্স রুমে অনেকে স্যার ম্যাডামরাই আছেন তবে রুহি কোথাও আশফাক স্যারকে দেখতে পেল না। রুহি বেশ কিছুক্ষণ টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। সে অবাক হয়ে দেখল, টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। এই ভালোলাগাটা একটু অন্যরকম। এই ভালোলাগা হচ্ছে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষার, অজানা কোনো রহস্যকে ভেদ করার অপেক্ষার! রুহি এই প্রথম খুব ভালো মত জানল, কিছু কিছু অপেক্ষাও মধুর হয়।

– তুমি কি কারো জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছো?

রুহি দেখল, কেয়া ম্যাডাম কখন যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রুহি একটু ইতস্তত করে বলল, ম্যাডাম আশফাক স্যার আমাকে আসতে বলেছিলেন।

কেয়া ম্যাডাম ভ্রু কুঁচকে বললেন, সে তো এখানে নেই। একটু আগেই বেরিয়ে গেল।

– স্যার চলে গিয়েছেন বুঝি?

– তাই তো মনে হলো। কিছুক্ষণ আগে আশফাকের মিসেস এসেছিল তাদের ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে। তাদের একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান আছে সেখানেই গিয়েছে সম্ভবত। তুমি বরং কাল এসো।

রুহি মন খারাপ করে টিচার্স রুমের সামনে থেকে চলে এলো। হুট করেই তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই কান্নার উৎস সম্পর্কে তার কোনো ধারনা নেই। এর মাঝে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই
বোধহয় মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। রুহি পুরো ক্যাম্পাসে তার কাছের বন্ধুদের কাউকে খুঁজে পেল না। সবাই বোধহয় রুহিকে ছাড়া যে যার মত বেরিয়ে গেছে। রুহির আবারো খুব কান্না পেল। আজকের দিনটা তার জন্য আসলেই খুব খারাপ। রুহি বাড়ি ফেরার জন্য একটা উবার কল করল এবং অবাক হয়ে দেখল, আজ উবারেও কোনো গাড়ি এভেইলেবল নেই। রুহি হতাশ হয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। রাস্তায় দুই একটা
সি এন জি দেখা যাচ্ছে বটে তবে সেগুলো যাত্রী দিয়ে পরিপূর্ণ। রুহি চুপচাপ রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ইতিমধ্যে দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার লোকজন সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এদিক, সেদিক দৌড়াচ্ছে। রুহির জেদ চেপে গেল। সে রাস্তার পাশে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আরো জোরে বৃষ্টি আসলে আসুক! আজ সে কাকভেজা হয়ে ভিজলেও ভিজুক! যা ইচ্ছে হোক। আজ তার মন খারাপ হবার দিন। আজ কোনো কিছুতেই তার যায় আসে না। এক আকাশ বৃষ্টিতে ভিজলেও না!

……………..

আশফাক ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সারে তিনটা বাজে। চারটা বাজতে আরো ত্রিশ মিনিট বাকি। আশফাক নিজের উপর খুব বিরক্ত হলো। সে খুব ভালো মত জানে চারটা বাজলেও তার কোনো যায় আসে না। তার কাছে সারে তিনটাও যা, চারটাও তা। তবুও আশফাকের ভেতরে অদ্ভুৎ রকমের একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আশফাকের এসব অস্থিরতার মাঝেই ঠিক তিনটা পয়তাল্লিশ মিনিটে দীপা এলো তাদের ছেলেটাকে নিয়ে। বলা যায় তাদের মা ছেলের আশফাকের ক্যাম্পাসে প্রথম বারের মত ছোট খাটো একটা সারপ্রাইজ ভিজিট। দীপাদের দেখে আশফাকের একই সাথে খুব ভালো লাগলো, আবার মন খারাপও হলো। আশফাক নিজের মন খারাপ লাগাটুকুকে এক পাশে সরিয়ে রেখে হাসিমুখে দীপার দিকে এগুলো।

দীপার চাচাতো বোনের আজ হলুদ সন্ধ্যা। এই অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল পাঁচটা থেকে। দীপা আজ তাই কোনো রিস্ক নেয়নি। সে আশফাককে খুব ভালো মত চেনে। দীপা তাকে বগলদাবা করে নিয়ে না গেলে সে তার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় যাবে না। না যাবার কোনো না কোনো অজুহাত সে ঠিকই বের করবে। তাই দীপা একেবারে তৈরি হয়ে আশফাকের ক্যাম্পাসে এসেছে। আশফাক অনুষ্ঠানে যা পরবে সেই সব কাপড় চোপড় পর্যন্ত সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

আশফাক দেখল হলুদ শাড়ি আর খোপায় বেলী ফুলের মালায় দীপাকে খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। অনেকদিন পর দীপাকে দেখে তার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। তবে এটাও সত্য যে, হৃদয়ের কোনো এক কোনায় যেন এক জোড়া বড় বড় চোখ আশফাককে বড় বেশী অস্বস্তি দিচ্ছে। আশফাক তার অস্বস্তিটুকু একপাশে সরিয়ে রেখে দীপাদের দিকে মোনোযোগ দিল। আরো মিনিট দশেক টিচার্স রুমে কাটিয়ে সে দীপাদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল।

বিকেলটা খুব ভালো মতই শুরু হয়েছিল। তবে দীপাদের নিয়ে গাড়িতে ওঠার পরেই বিপত্তি ঘটলো। দীপার সাথে আশফাকের গাড়িতে ছোটখাটো একটা ঝগড়া বেধে গেল। ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটলো খুব ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে। গাড়িতে ওঠার পর দীপা আশফাকের জন্য যে পাঞ্জাবীটা নিয়ে এসেছিল সেটা দেখে আশফাকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দীপা তার জন্য ক্যাটকেটে টিয়া রংয়ের একটা পাঞ্জাবী নিয়ে এসেছে।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, তোমার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় আমি এই রংয়ের পাঞ্জাবী পরব?

দীপা নির্বিকার গলায় বলল, হুম পরবে। আজ ছেলেরা সবাই এই রংয়ের পাঞ্জাবী পরবে।

– আমি পরব না দীপা। দরকার হলে তোমার বোনের অনুষ্ঠানে আমি যাব না, তবুও এই রংয়ের পাঞ্জাবী আমি পরব না।

দীপা গম্ভীর গলায় বলল, বেশ তাহলে তুমি এক্ষুনি গাড়ী থেকে নেমে যাও। কারন অনুষ্ঠানে গেলে তোমাকে এটাই পরতে হবে।

– কী পাগলামি শুরু করলে বলো তো! ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে শুধু শুধু এমন পাগলামি কেন করো তুমি?

– কোনো পাগলামি আমি করছি না। যা বলছি তোমাকে তাই করতে হবে। তুমি হয় এক্ষুনি গাড়ী থেকে নেমে যাবে নয়ত এই পাঞ্জাবী পরে আজকের সন্ধ্যা তোমায় কাটাতে হবে।

আশফাকের কেমন যেন জেদ চেপে গেল। সে থমথমে গলায় বলল, বেশ আমি তাহলে নেমে যাচ্ছি। আমার পক্ষে এই পাঞ্জাবী পরা সম্ভব নয়।

আশফাককে হতভম্ব করে দিয়ে দীপা তাকে সত্যি সত্যি গাড়ী থেকে নামিয়ে দিলো। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই বোধহয় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। তবে দীপার নজরে এসব কিছুই এলো না। দীপা আশফাককে রাস্তার মাঝে নামিয়ে দিয়ে নির্বিকার ভাবে গাড়ী নিয়ে চলে গেল। আশফাক ঘড়িতে দেখল চারটা ত্রিশ বাজে। এই সময় বাড়ি ফেরার কোনো মানে হয় না। রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল তাই গাড়ী খুব বেশীদূর আসে নাই। আশফাক ভাবল, ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে আজ কিছুটা সময় কাটাবে। একটা রিক্সা নিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে তার হয়ত খুব বেশী হলে মিনিট দশেক সময় লাগবে। আশফাকের রিক্সায় বসার পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টির কারনে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে তার আরো পনের মিনিট সময় লাগলো। ক্যাম্পাসের গেইট পর্যন্ত আশফাকের রিক্সাটা যখন পৌঁছালো তখন আশফাক অবাক হয়ে দেখল, তুমুল বৃষ্টির মাঝেও একটি মেয়ে ক্যাম্পাসের গেইটের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমুল বৃষ্টির তোড়ে মেয়েটি পুরোপুরি ভিজে গেছে। ভেজা কাপড় তার পুরো শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। এমনকি মেয়েটি ঠান্ডাতেও অল্প অল্প কাঁপছে। তবুও যেন তার কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নেই। আশফাক অবাক হয়ে দেখল, বৃষ্টিতে ভেজা সেই মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই মেয়েটি হলো তার হৃদয়ের কোনে জমে থাকা বড় বড় সেই চোখের মালিক! যার নাম রুহি!

“চলবে”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here