আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১৪ ও শেষ

#আগুন_ঝরার_দিনে

#শেষ_পর্ব

বাচ্চা একটি মেয়ের হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। বাইরে প্রচন্ড রৌদ। এই রৌদের মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি পথচারীদের কাছে গোলাপগুলো বিক্রি করার প্রাণপন চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই সময় আসলে কারো মধ্যে ফুল কেনার তাড়া থাকার কথা নয়। এখন বাজে সকাল দশটা। সবার এখন অফিসে কিংবা নিজ নিজ কাজে পৌঁছানোর তাড়া রয়েছে। কার এখন সময় আছে ফুল কেনার। রুহী এতক্ষন একটা ছিমছাম রেঁস্তোরার ভেতর থেকে মেয়েটাকে দেখছিল। একটু পর রুহী রেঁস্তোরা থেকে বের হলো। বাচ্চা মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগছে। ফুলগুলো সে নিজেই নাহয় কিনে নিবে মেয়েটির কাছ থেকে। রুহী ফুলগুলো কিনে নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরল। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে তবুও মানুষটার কোনো দেখা নেই। অথচ এই মানুষটি তাকে গত কাল রাতে ফোন করে এখানে আসতে বলেছেন।

রুহী তার হাতে ধরা ফুলের তোড়াটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ফুলের তোড়াটা এখানে রাখার কোনো মানে হয় না। একটু পর যে আসবে সে হয়ত ভেবে বসবে তোড়াটি রুহী তার জন্য কিনেছে। রুহী ভাবলো ফুলের তোড়াটি সে কোথাও সরিয়ে ফেলবে। তবে রুহী ফুলগুলো সরিয়ে ফেলার আগেই আশফাক স্যার তার সামনে চলে এলো। রুহী এক গুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে আশফাক স্যারের মুখোমুখি বসে রইল।

অনেকক্ষন কেউ কোনো কথা বলল না। রুহী কয়েক বার উসখুস করল। একটা সময় ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ কফির অর্ডার করল। তবুও আশফাক স্যার চুপচাপ একই ভাবে বসে রইলো। এই ক’দিনে সে অনেক খানি শুকিয়ে গেছে যার কারনে তার লম্বা শরীরটাকে আরো লম্বা লাগছে। কিছুটা সময় পার হবার পর রুহী নরম গলায় বলল, কেমন আছেন?

রুহীর মনে হলো আশফাক স্যার যেন কিছুটা বাধ্য হয়ে তার কথার উত্তর দিল। খুব সংক্ষেপে বলল, ভালো।

রুহী আবার বলল, আপনি আমায় ডেকেছিলেন। কিছু বলবেন?

অনেকক্ষন কোনো কথা নেই। রুহীর কোনো কথা যেন মানুষটির কানে যেয়ে পৌঁছেনি। রুহী খুব অবাক হলো। এই ক’দিনে মানুষটা অনেকখানি বদলে গেছে। শরীরে, চেহারায় হয়ত মনেও।

রুহীর ভাবনার মাঝে আশফাক স্যার বলে উঠল, আমি কাল চলে যাচ্ছি রুহী।

রুহী একটু হেসে বলল, আপনি তো অনেক আগেই চলে গিয়েছেন। এ আর নতুন কী!

– কাল আমি একেবারেই চলে যাচ্ছি।

রুহী একটুও অবাক না হয়ে বলল, আপনার কাছে যেমন আমার বিয়ে ভেঙে যাবার খবরটা কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে গেছে ঠিক তেমন আপনার একেবারে চলে যাবার খবরটাও আমার কাছে কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে গেছে।

মানুষটা কাতর কন্ঠে বলল, কেন তুমি এমন করলে রুহী! সজলের সাথে বিয়েটা তুমি কেন এভাবে ভেঙে দিলে?

রুহী খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল, দেখুন সজলকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগত না। সে ভীষণ ভাবে শরীর সর্বস্ব একজন মানুষ। কিন্তু এটা হয়ত সজলের সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দেয়ার মূল কারন নয়। ভালোবাসা বা কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরীর ব্যাপারটা থাকবে সেটা আর নতুন কী!

– তবে? কেন এমন করলে রুহী? কেন তুমি আমাকে এভাবে অপরাধী বানালে?

রুহী একটু অবাক হয়ে বলল, আপনাকে অপরাধী বানাইনি তো! সজলের সাথে আমি সম্পর্কটা ভেঙেছি কারন আমার মনে হয়েছে সজলকে আমি ঠকিয়েছি। সজলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবার পর আপনার সাথে আমার একটা সম্পর্ক হয়েছিল। যদিও আপনার সাথে সম্পর্কটা আমার ভেঙে গেছে এবং সজল এই ব্যাপারে কিছুই জানত না তবুও আমার মনে হয়েছে সজলকে বিয়ে করলে আমার সারাজীবন ওর সাথে চোরের মত সংসার করতে হত। সবসময় সজলের কাছে ধরা পড়ে যাবার একটা ভয় আমাকে কুরে কুরে খেত। সেটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই ভাবলাম এভাবে ছোট হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য বেশী সম্মানের।

– আমার উপর তোমার অনেক রাগ, তাই না?

– রাগ হবে কেন। তাছাড়া রাগ হলে তো নিজের উপর রাগ হওয়া উচিৎ, তাই না? কারন আমি সব জানতাম। আপনি তো আমার কাছে কিছু লুকোননি। বারবার আমাকে বলেছেন, আপনার পক্ষে নিজ সন্তান, স্ত্রীকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়।

আশফাক স্যার কিছু বলল না। রুহী যে কথাগুলো বলল সেই কথাগুলো হয়ত ঠিক। তবুও সে খুব ভালো মত জানে, রুহীর এই কথাগুলোর মধ্যে চরম একটা ফাঁক রয়েছে। তাদের সম্পর্কটা নিয়ে দীপার সব কিছু জানার পরেও হয়ত এই ফাঁকটা অনেকভাবে পূরণ করা যেত। অন্তত সেই সময় রুহীর পাশে দাঁড়ানো যেত। কিন্তু সে তা করেনি। নিজের গোছানো সংসারটাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না এই অজুহাতে সে রুহীর কাছ থেকে কাপুরুষের মত পালিয়ে বেরিয়েছে। অশান্তি এড়ানোর জন্য দীপার কথা মত ক্যাম্পাস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছে। পরবর্তীতে আরো দুই মাস সেই ছুটি এক্সটেনশন করিয়েছে। আবার দীপার চাপেই এখন দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে।

রুহী আবার বলল, আপনার উপর যেমন আমার কোনো রাগ নেই ঠিক তেমন আমার নিজের উপরেও আমার কোনো রাগ নেই। সজলের সাথে বিয়েটা ভেঙে দেয়ার পর নিজেকে বারবার বুঝিয়েছি, একটা ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে যেমন ভুল করেছিলাম ঠিক তেমন একটা ভুল সম্পর্ককে ভেঙে দিয়েও সঠিক কাজটা করেছি। আপনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর আমি যদি বাবা মার কথা মত সজলকে বিয়ে করতাম তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি আমার নিজের এই সিদ্ধান্তের কারনে একসময় আমার নিজের উপর ভীষণ রাগ হত। বিশ্বাস করুন, আমি এই মুহুর্তে ভীষণ ভারমুক্ত একটা জীবন যাপন করছি। বাবা-মা হয়ত আমার উপর এখন অভিমান করে রয়েছেন তবে আমি জানি সময়ের সাথে সাথে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আশফাক স্যার অসহায় গলায় বলল, তোমার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না রুহী। আমাদের আর কোনোদিন একসাথে বসে পুরোনো সেই দিনগুলোর মত চাঁদ দেখা হবে না, বর্ষা নিয়ে গল্প হবে না, গরম চায়ের কাপে ডুবিয়ে গরম গরম ডালপুরি খাওয়া হবে না। অন্তত একই শহরে থাকলে দেখা হবার একটা সুযোগ হয়ত থাকত। হয়ত কোনো রেঁস্তোরা, হয়ত কোনো শপিং মলে কিংবা কোনো রাস্তায় দুজন মুখোমুখি হয়ে যেতাম। হয়ত কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলতাম না, তবুও চোখের উপর হয়ত চোখ পড়ত সেটাই বা কম কী!

রুহী একটু হেসে বলল, আমি জানি না আপনি ঠিক কী কারনে আমার সাথে আজ দেখা করতে এসেছেন। আমার ধারনা কাল আপনাদের ফ্লাইট বলে দীপা ম্যাম গোছগাছ নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আপনিও হয়ত কোনো কাজের অজুহাত দেখিয়ে বের হয়েছেন। আমার সাথে দেখা করার জন্য আজকের দিনটা আপনার কাছে ভীষন নিরাপদ ঠিক যেমন নিরাপদ ছিল আপনার কাছে আমাদের নাম না জানা সেই সম্পর্কটি। তাই আপনি খুব ভালো মত জেনে রাখুন, আপনি এই শহরে থাকলে এমনকি আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হলেও আমার আর কিছু যেত আসতো না। যেখানে ভালোবাসাটায় মরে গেছে সেখানে এই ধরণের আবেগের কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।

– এখন আমার উপর সব দোষ চাপিয়ে দিতে চাইছো রুহী। প্রমাণ করতে চাইছো আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি। তোমার আর আমার এই সম্পর্কের সব দায় আমার ছিল। তোমার কিছুই ছিল না।

রুহী একটু হেসে বলল, আমি কিছুই প্রমান করতে চাইছি না। শুধু বলতে চাইছি আমি আপনার জীবনে শুধু মাত্র একটা “সেফ গেম” ছিলাম অনেকটা ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে সেই ভিডিও গেম খেলার মত। যা নিয়ে খেলতে খুব মজা তবে যেই না বাবা মা জানলো ওমনি লক্ষ্মী ছেলের মত সব খেলা ভুলে একেবারে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। রুহী একটু চুপ করে থেকে আবারো বলল, তবে বিশ্বাস করুন আপনি যা করেছেন খুব ঠিক করেছেন। ভাগ্যিস আমার সাথে আপনি এতদিন যোগাযোগ করেননি। তা না হলে আমি হয়ত খুব বড় একটা ভুল করে বসতাম।

এরপর আর কথা চলে না। আশফাক স্যার চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। যাবার মুহুর্তে রুহীর হাতে ধরা ফুলগুলোকে দেখিয়ে বলল, ফুলগুলো কার জন্য। নিশ্চয় আমার জন্য নয়।

রুহী শক্ত গলায় বলল, ঠিক ধরেছেন। ফুলগুলো আপনার জন্য নয়। আমার নিজের জন্য।

আশফাক স্যার একটু আগে চলে গেছেন। রুহী একই ভাবে রেঁস্তোরায় বসে রইল। আজ তার জীবনে নতুন একটা দিনের সূচনা হলো। ভুল শোধরানোর সুযোগ সবাই পায় না। প্রকৃতি সবার উপর এত খানি সদয় আচরন করে না। রুহী দৃপ্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে অনেক পথ বাকি। সে খুব ভালোমতই জানে সামনের পথগুলোও নিশ্চয় মসৃণ হবে না। তবে কাঁটাযুক্ত বন্ধুর পথে কীভাবে চলতে হয় সেই শিক্ষা রুহী এই ক’দিনে খুব ভালোমতই পেয়েছে। আসলে জীবনে কোনো কিছুই বৃথা যায় না। আশফাক স্যারের সাথে তার সম্পর্কটাও তাই বৃথা যায়নি। এই সম্পর্কটা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। রুহী আপন মনে হেসে ফেলল। এই হাসিটা অতীতের সব ভুলগুলো মুছে ফেলার আনন্দে নাকি অতীতের করা ভুলগুলোর কারনে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কোমল কোনো অনুভুতির জন্য তা অবশ্য বোঝা গেল না!

“সমাপ্ত”

“আগুন ঝরার দিনে”র পাশে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কেমন লাগলো প্লিজ মন্তব্য করে জানাবেন।আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here