আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১১

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_১১

রুহী অবাক হয়ে সুমির দিয়ে তাকিয়ে রইল যদিও সুমির মধ্যে কোনো বিকার নেই। সে একই ভাবে ভাবলেশহীন চোখে রুহীর দিকে তাকিয়ে আছে।

রুহী বলল, কে এসেছে বললি?

সুমি অবলীলায় বলল, দীপা নামের একটি মেয়ে তোর সাথে দেখা করার জন্য এসেছে।

– দীপা কে? আর তুই তাকে পেলি কোথায়?

– আমাদের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে ডেকে তোর কথা জিজ্ঞেস করল। আর তুই শুধু শুধু ভাব ধরছিস কেন দীপা নামের কাউকে তুই চিনিস না? তুই জানিস না দীপা কে?

রুহী চুপ করে রইল। আজ বোধহয় আশফাক স্যার ক্যাম্পাসে আসেননি। তিনি ক্যাম্পাসে আসলে এতক্ষণে নিশ্চয় তার সাথে একবার দেখা হত। এদিকে কাল রাতেও আশফাক স্যারের সাথে তার ফোনে কথা হয়নি। রুহী দেখেছে, কাল রাত দশটার পর থেকে আশফাক স্যার অনলাইনে ছিলেন না। রুহী আরেকবার মোবাইল চেক করলো। আশফাক স্যার এখনো অনলাইনে নেই। কাল রাত দশটা থেকে তিনি অফলাইনে। রুহী একবার ভাবলো আশফাক স্যারকে সরাসরি কল দেয়। সে সুমির দিকে আড়চোখে তাকালো। সে একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সুমির উপর একই সাথে রুহীর প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো আবার মায়াও হলো। সে খুব ভালোমত জানে, পুরো পৃথিবী তার বিপক্ষে গেলেও এই মেয়ে তাকে ছেড়ে যাবে না। রুহী আশফাক স্যারকে সরাসরি ফোন করলো। আশফাক স্যারের ফোন বন্ধ। রুহী এবার ভীষণ অসহায় বোধ করল। আশফাক স্যারের সাথে গতকাল রাত থেকে তার কোনো যোগাযোগ নেই। এদিকে স্যারের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত চলে এসেছে।

সুমি ভ্রুঁ নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কীরে তোর আশফাক স্যার ফোন ধরলেন না? এক রাতে বৌয়ের ঝাড়ি খেয়েই সব প্রেম উবে গেল?

রুহী বিরক্ত হয়ে বলল, তুই থামবি? আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত জানি না তাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কী হয়েছে? কেন হয়েছে? আর কেনই বা আশফাক স্যার ফোন বন্ধ করে ঘরে বসে আছেন?

সুমি তার গলায় একগাদা বিদ্রুপ মিশিয়ে বলল, যা না। গিয়ে জিজ্ঞেস কর। তোর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যেই তো এত দূর থেকে আশফাক স্যারের বৌ ছুটে এসেছে।

রুহী এবার হতাশ চোখে সুমির দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে সুমি ছাড়া কারো পক্ষে তার পরিস্থিতি বোঝার কথা নয়। অথচ সুমিও কেমন যেন অবুঝের মত আচরণ করছে।

সুমি বোধহয় রুহীর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। নরম গলায় বলল, টেনশন করিস না। যা, উনার সাথে কথা বল। সেই কখন থেকে তোর জন্য ক্যান্টিনে বসে আছেন। তোর ভয় নেই। কেউ কিছু জানে না। দীপা ম্যামকে ক্যান্টিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি তার সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলেছি। তাকে ক্যাম্পাসে দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাকে দেখেই আমি ধারনা করেছিলাম, তিনি তোর সাথে দেখা করার জন্য এখানে এসেছেন।

রুহী বলল, তুই আশফাক স্যারের বৌ কে চিনিস?

– হুম চিনি। আমি কেন ক্যাম্পাসের অনেকেই তাকে চেনে। মাস দুয়েক আগে তিনি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। আমার এটাই আফসোস রুহী, হাসিখুশি একটা পরিবারকে আমরা সবাই দেখলাম, সবাই সব বুঝলাম। শুধু তুই কিছু দেখলি না। তুই কিছু বুঝলি না কিংবা তুই সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলি।

সুমি ক্যান্টিন পর্যন্ত রুহীর সাথে এলো। ক্যান্টিনে ঢোকার মুহুর্তে রুহীর একটা হাত ধরে বলল, খুব স্বাভাবিকভাবেই উনি তোকে অনেক কড়া কড়া কথা শোনাবেন রুহী। তোর প্রতি তার সকল রাগ, ঘৃণা উনি হয়ত তোর মুখের উপরেই উদ্গীরণ করবেন। তোকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে রুহী। তোকে খুব ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে। তুই যদি আজ এই জায়গা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বের হয়ে আসতে পারিস আমার বিশ্বাস সব বিপদ কেটে যাবে। আবার সব আগের মত হয়ে যাবে। তোর উপরে এখন সব কিছু নির্ভর করছে রুহী। শুধুমাত্র তোর উপরেই।

এর আগে অসংখ্য বার চিরচেনা এই ক্যান্টিনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত রুহী পার হয়েছে। এই ক্যান্টিনকে জড়িয়ে রুহীর অসংখ্য মধুর স্মৃতি রয়েছে। তবে আজ এই ক্যান্টিন তার জন্য কী রকম ভয়াবহ স্মৃতি তৈরি করে রেখেছে কে জানে? রুহীর যেন এইটুকু পথ পারি দিতে সহস্র বছর সময় লাগল। পা দুটো যেন অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে। পাখির পালকের মত হালকা এই শরীরটাও আজ পাথরের মত ভারী! রুহী কোনোমতে নিজের শরীরটাকে টেনে কাঙ্ক্ষিত টেবিলটার সামনে দাঁড়ালো। সে দেখলো, দীপার সামনে একটা চায়ের কাপ অবহেলায় পড়ে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চায়ের কাপটায় তার ঠোঁটের ছোঁয়া পর্যন্ত পড়েনি। গরম চায়ের উপর ইতিমধ্যেই ঘন সর পড়ে রয়েছে।

রুহীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপা কঠিন গলায় বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। অনেকক্ষন বসিয়ে রেখেছ তুমি আমাকে। একসময় মনে হলো, তুমি আর আসবে না। আমার কথা শুনে বোধহয় পালিয়ে গেছো।

দীপার কথা শুনে রুহী সরাসরি তার দিকে তাকালো। দীপার ঠোঁটের কোনে বিদ্রূপের হাসি। দীপার এই হাসিটুকু রুহীর ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো। অবাক হলেও সত্য, আজ দীপা যে টেবিলটাই বসেছে আশফাক স্যার এই টেবিলে প্রায়ই বসে চা খান। রুহীর খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, দীপা কি কাজটা ইচ্ছে করে করেছে? নাকি দীপার এই টেবিলে বসাটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়?

দীপা আবারো বলল, বসো। তোমার সাথে আমার কথা এত অল্প নয় যে তোমার দাঁড়িয়ে থেকেই সব কথা শোনা হয়ে যাবে।

অগ্যতা রুহী বসল। রুহী কে বসতে দেখে দীপা কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এই যে তোমরা সব কিছু জেনে শুনে একজন বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ো, এটা আসলে কী ভেবে পড়ো? নিশ্চয় পুরুষটির শুধু রূপ দেখে নয়, তার ক্যারিয়ার দেখে, ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে, তাই নয় কী?

এর আগে এত অসহায় বোধ রুহী কখনো করেনি। সে কাতর গলায় বলল, আমাকে এসব প্রশ্ন কেন করছেন আপনি?

– তুমি জানো না আমি কেন করছি?

রুহী কাতর গলায় বলল, আপনি প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আপনার সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমার খুব কস্ট হচ্ছে।

দীপা গলা নামিয়ে বলল, এই কথাটা আমার বরের সাথে প্রেম করার আগে তোমার ভাবা উচিৎ ছিল। তাছাড়া তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আমার নেই। আমি তোমাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। এই মুহুর্ত থেকে তুমি আর কখনো আশফাকের সাথে কথা বলবে না, কোনো রকম যোগাযোগ করবে না। আর যদি করো, আমার সম্পর্কে তোমার নিশ্চয় নূন্যতম ধারনা আছে। নিজের প্রতি অন্যায় মেনে নেয়ার মত মেয়ে আমি নই।

রুহী থেমে থেমে বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার ক্ষতি হোক, আপনার প্রতি অন্যায় হোক এমন কোনো কিছু আমি কখনো ভাবিনি।

– তুমি হয়ত জানো না রুহী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় অন্যায়গুলো, বড় বড় পাপগুলো এভাবে না বুঝে করা হয়। কোনো অন্যায়কারী বলবে না যে, সে সব বুঝে শুনে অন্যায় করেছে।

রুহী নরম গলায় বলল, আপনি একটু শান্ত হন প্লিজ। আপনি হয়ত জানেন না আর ক’দিন পর আমার বিয়ে।

দীপা বলল, জানি। তোমার বান্ধবী সুমি আমাকে জানিয়েছে। সে অনুরোধ করেছে, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে। তবে আমি তোমাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি রুহী। তোমাকে দেখে আমার শুধু একটা কথায় বারবার মনে হচ্ছে, একটা মেয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের পুরো জীবন নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে পারে! আমার খুব ইচ্ছে করছে, যে ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে হবে তাকে সব জানিয়ে দিই। অন্তত সে জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বাঁচুক। তবে এই কাজটা আমি করব না। তোমার বিয়ের পর আশফাকের জীবন থেকে তুমি এমনিতেই সরে যাবে এমন ভাবনা থেকে আমি তোমার হবু স্বামীকে কিছু জানাচ্ছি না তা কিন্তু নয়। তোমাকে আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি। ধরে নাও, এই মুহুর্তে তোমার বন্ধুর কথাটা আমি রাখছি।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল। একটু পর দীপা বোধহয় কোনো জবাবের আশায় রুহীর দিকে তাকালো। তবে রুহী কোনো জবাব দিল না। সে একই ভাবে মাথা নীচু করে বসে রইল।

চলবে”

আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here