#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_৪
আশফাক অনেক খানি দোটানার মধ্যে পড়ে গেল। তার বিবেক বলছে, এই বৃষ্টির মধ্যে ক্যাম্পাসের মেইন দরজায় যে-ই দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন তার কোনো যায় আসে না। তার এক্ষুনি, এই মুহুর্তে রিক্সা নিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যাওয়া উচিৎ। তবে হৃদয় বলছে অন্য কথা। তার হৃদয় বলছে, তার এই মুহুর্তে রিক্সা থেকে নেমে যাওয়া উচিৎ। যে মেয়েটি এভাবে কাক ভেজা হয়ে ভিজছে সেই মেয়েটি তার অতি পরিচিত। মেয়েটিকে তার এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। মেয়েটির তাকে এখন প্রয়োজন। আশফাকের বিবেক, বুদ্ধি তার হৃদয়ের কাছে হার মানল। আশফাক বৃষ্টির মাঝেই রিক্সা থেকে নেমে পড়ল।
রিক্সাচালক অবাক বলল, এহানে নামেন ক্যান? চলেন আপনারে ভেতরে রাইখ্যা আসি।
আশফাক বলল, দরকার নেই। তুমি আমাকে এখানে নামিয়ে দাও।
রিক্সাচালক বেশ অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। এই লোক পুরো রাস্তায় যেন না ভিজে এই নিয়ে সদা সতর্ক ছিল অথচ এখানে এসে কী এমন হলো যে এত বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়তে হলো! রিক্সাচালক হতাশ হয়ে ভাবল, মানুষ আসলে বড়োই আজব কিসিমের প্রাণী! তার চেয়েও বড়ো আজব হলো মানুষের মন!
আশফাক যতক্ষনে রুহির কাছে পৌঁছালো ততক্ষনে সে নিজেও ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এদিকে রুহি তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আশফাক রুহির কাছে যেয়ে বলল, তুমি এইখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
রুহি কোনো জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে সে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আশফাকের মনে হলো, রুহি বোধহয় তাকে চিনতে পারেনি। পরোক্ষনেই তার ভুল ভাঙল। রুহি তাকে নরম গলায় বলল, আপনার জন্য।
এবার আশফকের অবাক হবার পালা। সে হতভম্ব হয়ে বলল, আমার জন্য?
– হুম, আপনার জন্য।
– কেন বলো তো?
– আজ আপনি আমায় বিকেল চারটার সময় আপনার কাছে আসতে বলেছিলেন।
আশফাকের অনেকক্ষন সময় লাগল রুহির কথাটুকু বুঝতে। আজ সে রুহির কাছে বিকেল চারটার মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন লিখিত ভাবে জমা দিতে বলেছিল বটে তাই বলে কোনো ভাবেই এই সময় এবং এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নয়। রুহি কাগজটা কালকেও তার কাছে জমা দিতে পারত। তাছাড়া বিকেল চারটা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। আশফাক অবাক হয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা যদি আজ রাগ করে তাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে না দিত তবে এতক্ষনে সে হয়ত দীপার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় থাকত। স্বাভাবিক সময় হলে, আশফাকের কোনোভাবেই এখন ক্যাম্পাসে ফিরে আসার কথা নয়। চারপাশে এত বৃষ্টি, ঝড়ো হিমেল বাতাস আর তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আশফাকের মন কেমন করে উঠলো। এই মুহুর্তে যে কাজটি করা তার জন্য সবচেয়ে বেশী অনুচিৎ ছিল সেই কাজটি সে নির্দ্বিধায় করল।
রুহির একটা হাত ধরে কোমল গলায় বলল, এমন পাগলামী কেন করছ তুমি? আমার সাথে কাল দেখা করলেও চলত তোমার। এই ভাবে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় কি?
আশফাক অবাক হয়ে দেখল রুহি তার কথা শুনে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। তার দুই চোখ জুড়ে টলমল করছে অশ্রু, যদিও বৃষ্টির পানিতে অশ্রুগুলো সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যাচ্ছে তবুও রুহির কান্নাটুকু আশফাকের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো। আশফাক রুহির হাতটুকু একই ভাবে ধরে রইল। এর মাঝে বৃষ্টি থেমে এলো। সন্ধ্যাও নেমে এলো। কেউ জানলো না তবে দুই জন মানব মানবী জানল বৃষ্টি হয়ত থেমে গেছে, ঝড়ো বাতাসগুলোও স্থির হয়ে গেছে, তবে নতুন একটা অস্থির ঝড় বয়ে চলেছে, দুই জন অসম বয়সী মানব মানবীর হৃদয়ে!
………………….
রুহির প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আজ বিকেলের বৃষ্টিতে সে বড়ো বেশী ভেজা ভিজেছে। তবে শরীরের এই জ্বরটুকু তার ভালো লাগছে। একটু আগে মা জোর করে তাকে একবাটি চিকেন স্যুপ খাইয়েছেন। যাবার আগে দুটো নাপা দিতেও তিনি ভোলেননি। নাপা খেয়ে রুহির জ্বর একটু কমেছে বটে তবে তার পুরো শরীর জুড়ে বিরাজ করছে অদ্ভুৎ এক আলস্যতা। এই আলস্যতাটুকু অবশ্য রুহী খুব উপভোগ করছে। আজ আশফাক স্যার তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন। তারা দুজন এতটা পথ একসাথে একটা সিএনজি করে এসেছে। আশফাক স্যার পুরোটা পথ তার বৌ বাচ্চার গল্প করেছেন। রুহি বুঝতে পারছিল, তিনি ইচ্ছে করেই কাজটা করছেন। ইচ্ছে করেই রুহিকে জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ যার দিকে রুহির তাকানো বারণ। রুহির হঠাৎ করেই মনে হলো, নাকি আশফাক স্যার আসলে রুহিকে বলা কথাগুলো নিজেকেই বলছিলেন? রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু আগে মনটা অসম্ভব যে ভালোলাগাটায় ভরেছিল এখন আর তা নেই। রুহি নিজের অজান্তেই দুইদিকে মাথা নাড়ালো। মরীচিকার পেছনে ছুটে আসলে কোনো লাভ নেই। মরীচিকা সব সময় দূর থেকে দেখা যায় কিংবা বলা যায় দূর থেকেই মরীচিকা দেখতে ভালো। কাছে গেলে মরীচিকার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। রুহি ফোনটা হাতে নিল। অনেক দিন পর সে খুব আগ্রহ নিয়ে সজলকে ফোন করল।
……………..
আশফাকের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটার মত বেজে গেল। সে বাসায় পৌছে দেখল দীপাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আশফাক সরাসরি তাদের শোবার ঘরে ঢুকল। ছেলেটা বিছানার এক পাশে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সাধারনত তার আর দীপার মাঝেই বাচ্চাটা ঘুমায়। কোনো কোনো বিশেষ দিনে ছেলেটাকে বিছানার একপাশে রাখা হয়। আশফাকের মন হলো আজ বোধহয় সেই বিশেষ দিন। দীপা ইচ্ছা করেই এই কাজটা করেছে। হয়ত আজ বিকেলের সেই ব্যবহারের জন্য দীপা মনে মনে অনুতপ্ত। আশফাক বুঝতে পারল না, তার খুশী হওয়া উচিৎ নাকি মন ভার করে রাখা উচিৎ? আশফাকের ভাবনার মাঝেই দীপা ঘরে ঢুকল। তার চোখে স্পষ্ট আহবান। এই আহবান উপেক্ষা করার সাধ্য কোনো পুরুষ মানুষের নেই। তাছাড়া দীপার আহবান উপেক্ষা করার কোনো স্পষ্ট কারন কিংবা যুক্তি কোনোটায় আশফাকের কাছে নেই। সে সব ভুলে দীপার মাঝে ডুবে গেল।
“চলবে”
“