#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৫
মন খারাপের সময়গুলো দীর্ঘ হয় খুব।তাই তো দীর্ঘ এক দিন পাড় করছে নাফিয়া।সময় যেনো যাচ্ছেই না আজ।কোনো কাজে মন নেই তার।অন্য মনস্ক হয়েই গ্রিন টি বানাচ্ছে সে।এরই মাঝে হটাৎ করে কোনো একজনের হাতের মুঠোয় বন্দী হয় তার ডান হাতটি।ফলে ধ্যান ভাঙে তার।অবাক নয়নে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফিম।দু’জনের চোখাচোখি হতেই আফিম বলে ওঠে,
-কাপে গমর পানি না ঢেলে নিজের হাতের উপরই ঢালতে যাচ্ছিলে।মন কোথায়?
আফিমের কথায় হুঁশ হয় নাফিয়ার।কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নেয় সে।অতঃপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,
-আমার একটু সাহায্য লাগবে আফিম।করবেন?
হটাৎ নাফিয়ার এমন প্রশ্নের পেছনের কারণটা বোধগম্য হয় না আফিমের।’মেয়েটার সাহায্যের প্রয়োজন মনে হলো কেনো?’মনে এ প্রশ্ন উদয় হতেই আফিম জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি সাহায্য?
আফিমের প্রশ্ন শুনে ক’সেকেন্ড সময় নেয় নাফিয়া।অতঃপর নিচু স্বরেই বলে ওঠে,
-শীগ্রই আমার এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট বের হবে।আর তারপরই শুরু হবে কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি।ভর্তি হতে তো টাকা লাগবে।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।একটু সময় নিয়ে বলে ওঠে,
-আমি কিছু একটা করতে চাই,আফিম।টাকা কামাতে চাই।
নাফিয়ার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে আফিম।স্বাভাবিকভাবেই বলে ওঠে,
-তুমি যেহেতু আমার আন্ডারে কাজ করছো সেহেতু তোমার সব দ্বায়িত্ব তো আমি নিচ্ছি।কলেজেও আমিই ভর্তি করিয়ে দিবো সময় হলে।
নাফিয়া বিনয়ী হেসে আফিমের কথার বিরোধিতা করে বলে ওঠে,
-আমি চাইছি না আমার পড়াশোনার দ্বায়িত্বটাও আপনি নেন।
কথাটা বলে থামে নাফিয়া।তাকায় আফিমের দিকে।ছেলেটার চোখে ভেসে ওঠা প্রশ্ন বুঝতে বিলম্ব হয় না তার।একটি ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাফিয়া বলতে আরম্ভ করে,
-আমার পুরো একটা পৃথিবী হলো আমার মাম্মি।জানেন আফিম,এই মানুষটা আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।আর এই মানুষটারই স্বপ্ন আমি খুব শিক্ষিত হবো।মানে উচ্চ শিক্ষিত।তার এ স্বপ্নের পেছনের কারণ টা কি জানেন?কারণ সে চায় আমি যেনো একটা স্বাধীন জীবন পাই।যে জীবনে আমার সম্মান থাকবে,আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে,মানুষের কাছে আমার মতামতের মূল্য থাকবে,সবার কাছে আমার গ্রহণ যোগ্যতা থাকবে,আমাকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।তার এই স্বপ্ন খুব যত্নে নিজের হৃদয়ে পুষে নিয়ে বেরাচ্ছি আমি।আর আমি চাই না এ স্বপ্ন পূরণের পথে কারো দয়ার ছাপ পরুক বা এও বলতে পারেন যে আমি চাইনা আমার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রেও অন্য কারো সাহায্য নিতে।আমার মাম্মির স্বপ্ন আমি নিজের যোগ্যতায় পূরণ করতে চাই আফিম।
কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।মনে মনে ভীষণ গর্ববোধ করছে আফিম নিজের মায়াবীনির প্রতি।বয়সে ছোট হলেও মেয়েটার মাঝে কতোটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে!নিজে কিছু করে দেখানোর স্পৃহা রয়েছে।রয়েছে এক বুক সাহস আর নিজের মাম্মির স্বপ্ন পূরণের দৃঢ় ইচ্ছা।আরও একবার মুগ্ধ হয় আফিম।
নিজের কথাগুলো শেষ করবার পর চোখ তুলে আফিমের চোখের দিকে তাকায় নাফিয়া।ঠোঁটে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-আপনি অনেক অনেক সাহায্য না চাইতেই করছেন আমায়,আফিম।আপনার কাছে আজ অব্দি একটি বারও নিজের প্রয়োজনের কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার।না চাইতেই নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন, ৩ বেলার খাবার দিচ্ছেন,নতুন আলমারি ভরা কাপড় কিনে দিয়েছেন,আমার সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখার জন্য একজন ফিমেল হেল্পার নিযুক্ত করে রেখেছেন।আর কতো?আর কতো করবেন এক অপরিচিতার জন্যে?
এ কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।মনে মনেই বলে ওঠে,
“নামহীন,অপ্রকাশিত ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছেন আমায়।মাত্র ক’টা দিনেই আমার জীবনে সব রঙ ভরে দিয়েছেন।অজানা সব সুখের সন্ধান দিয়েছেন।এতো এতো কিছুর ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আমার নেই,আফিম।আর ঋণী হতে চাই না।”
নাফিয়ার কথাগুলোর উত্তরে আফিম মনে মনেই বলে ওঠে,
“অপরিচিতা নও তুমি।তুমি তো একান্তই আমার মায়াবীনি।যেগুলোকে তুমি দয়া ভাবছো তা হক তোমার।কারণ আমার সবকিছুরই অর্ধেক অংশের অধিকারীনি তুমি,আমার অর্ধাঙ্গীনি।”
দু’জনেই তাদের হৃদয়ের কথা হৃদয়েই গোপন করে রাখে।যেনো প্রকাশ করা বারণ।নাফিয়ার কথাগুলোর উত্তরে আফিম ভাবুক কন্ঠে বলে ওঠে,
-You are right Miss. Sheikh. আমি আর কতো করবো!তোমারও উচিৎ কিছু করা।
কথাটি বলে নাফিয়ার দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে আফিম।নাফিয়া আফিমের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ে।সে আবার কি করবে!আর কথাখানা শেষ করে আফিমের তার দিকে এভাবে এগিয়ে আসা টা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না নাফিয়ার।সে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয় আফিমের দিকে।আফিম নাফিয়ার কাছে এসে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নাফিয়ার কোমর।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-না মানে আমি এত্তো কিছু করি তোমার জন্য সো তোমার উচিৎ আমাকে ভালো কিছু গিফট করা।
আফিমের কথার উত্তরে নাফিয়ার বোকার মতো বলে ওঠে,
-টাকা তো নেই এখন আমার কাছে।
উত্তরে আফিম তার দুষ্টু হাসিটি বজায়ে রেখেই বলে ওঠে,
-টাকা ছাড়াও আরো অনেকভাবে গিফট দেওয়া যায়,মিস.শেখ।
-যেমন?
-যেমন তুমি চাইলে আমার ঠোঁটে চুমু দিতে পারো, বডি ম্যাসাজ করে দিতে পারো আরো অনেক কিছু চাইলেই করতে পারো।
কথাগুলো বলা শেষে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে আফিম।অবাক হওয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে নাফিয়া।কিসব ছিঃ মার্কা কথা বলছে ছেলেটা!চোখমুখ কুঁচকে আফিমকে ঠেলে দূরে সরিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-ছিঃ!দিন দিন নির্লজ্জ হচ্ছেন আফিম।
নাফিয়ার কান্ডে ঠোঁট চেপে আলতো হাসে আফিম।মনে মনে বলে ওঠে,
“নির্লজ্জতার তো এখনো কিছু দেখোই নাই মিসেস. লজ্জাবতী”
!!
রেজাল্টের চিন্তা,টাকার চিন্তা,নতুন কলেজের চিন্তা সব মিলিয়ে মনে শান্তি পাচ্ছে না নাফিয়া।এতোদিন যেনো কোনো এক রঙিন দুনিয়ায় বসবাস ছিলো তার।নতুন সব অনুভূতিতে ঘেরা নতুন এক প্রশান্তিতে ডুবে ছিলো সে।ভুলে বসেছিলো বাস্তবতা কখনোই এতো সুন্দর হয় না।তাকে পরিশ্রম করতে হবে।অনেক অনেক পরিশ্রম!যাতে সে নিজের যোগ্যতায় নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপ দিতে পারে।
আজ সকালে যখন ঐ মহিলা ও বাচ্চাটিকে দেখেছিলো সে তখন থেকেই হৃদয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করছে সে।তখন থেকেই সেই রঙিন দুনিয়া থেকে বেরিয়ে বাস্তবতায় ফিরেছে নাফিয়া।ভাবছে নিজের পরবর্তী সব পদক্ষেপগুলোকে নিয়ে।কিভাবে একটু একটু করে এগিয়ে যাবে নিজের স্বপ্ন ছুঁতে সেই পরিকল্পনা করে যাচ্ছে সে।
নিজের প্রয়োজনের কথা আফিমকে তো বলেছে সে কিন্তু ছেলেটা কি করে সহায়তা করবে তাকে?এখনো এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্টই বের হয়নি তার।এতো কম পড়াশোনায় কোনো চাকরি পাওয়া আদৌতেও কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব নয়।আর চাকরি পেলেও তাতে কি আর সম্মান মিলবে?
আফিমের ক্যাবিনে থাকা সাদা সোফাটিতে বসে ব্যস্ত নগরী পানে চেয়ে থেকে এসব চিন্তেতেই বিভোর হয়ে আছে নাফিয়া।হটাৎ ক্যাবিনে কারো আগমনে ধ্যান ভাঙে তার।
“May i come in,sir?”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্নখানা করে ওঠে রিয়াদ।গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইল হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলোতে ব্যস্ত ছিলো আফিম।রিয়াদের প্রশ্নে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে তার।ফাইল হতে দৃষ্টি সরিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে,
“Come”
অনুমতি পেয়ে কক্ষে প্রবেশ করে রিয়াদ।ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-স্যার চারজন বাচ্চা পেয়েছি।তারা ক্লাস ২ তে পড়ে।আর তাদের বাবা-মা তাদের জন্য বাসায় পড়ানোর টিচার খুঁজছিলো তাই তাদের প্যারেন্টসদের সাথে কথা বলে আমি সব ঠিক করে এসেছি।আপনি অনুমতি দিলে তারা এ মাস থেকেই পড়া শুরু করবে।
রিয়াদের কথা শুনে ভীষণ রকমের অবাক হয় নাফিয়া।আফিমের মতো এতো ব্যস্ত মানুষ যার কিনা এতো বড় বিজনেস সে কেনো টিউশনি করাতে যাবে!মনে এ প্রশ্ন উদয় হওয়ার ক’সেকেন্ডের মাঝেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।কৃতজ্ঞতায় ভরা দুনয়নে তাকায় আফিমের দিকে।
ছেলেটা রিয়াদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।আর নাফিয়া ব্যস্ত এই মানুষটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকাতে।
চলবে।
[