আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১৬

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৬

“এই ব্রিজটাতেই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো!”
ঠোঁটে হাসি টেনে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কথাখানা বলে ওঠে নাফিয়া।তার পাশেই কদমে কদম মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে সম্মতি দেয় আফিম। ব্রীজের পাশ ঘেঁষে নিরব,নিস্তব্ধ পরিবেশে হাঁটছে দু’জন মানব-মানবী।নীচে জলরাশী আর আকাশে মস্ত বড় চাঁদ,আছে মেঘেদেরও উপস্থিতি।বয়ে চলছে মৃদু বাতাসেরা।উড়ছে কিশোরীর কোমর অব্দি এলোমেলো খোলা লম্বা চুল।তা নজর কাড়ছে আফিমের।সৌন্দর্য এমনই একটা জিনিস যা যেকেউকে আকর্ষিত করতে সক্ষম।আর লোকমুখে শোনা যায় পুরুষেরা নাকি সৌন্দর্যের পূজারী।কিন্তু সত্য টা হচ্ছে,প্রতিটি মানুষই সৌন্দর্যের পূজারী।সৌন্দর্য সবাই পছন্দ করে।এখন প্রশ্ন জাগে সৌন্দর্য টা আসলে কি?সৌন্দর্য বিষয়টা আপেক্ষিক।আবার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম।যেমন কারো চোখে লম্বা কেশী নারী সুন্দর আবার কারো কাছে ছোট চুলই সুন্দর।কারো কাছে লম্বা পুরুষ সুন্দর আবার কারো কাছে উচ্চতা কমওয়ালা পুরুষই সুন্দর।কেউ কেউ ফর্সা বর্ণে মুগ্ধতা খুঁজে পায়।আবার কেউ কেউ শ্যামবর্ণায় মায়া খুঁজে পায়।আবার কেউ কেউ কৃষ্ণ বর্ণে টান খুঁজে পায়।মূলকথা,পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই সুন্দর কিন্তু সবাই সবার চোখে সুন্দর না।যার চোখ যেটায় মুগ্ধতা খুঁজে পায় তার চোখে সেটিই সুন্দর।
আফিমের চোখে তার পাশে ধীর কদমে হাঁটতে থাকা এই কিশোরীই সুন্দর।হয়তো সে এই কিশোরীর গুনে মুগ্ধ দেখেই কিশোরীর অতি সাধারণ রূপও তার কাছে অসাধারণ সুন্দর মনে হয়।পূর্ণিমা চাঁদের আলোতে নাফিয়ার চুলগুলোকে এভাবে উড়তে দেখাটা যেনো পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের মাঝে একটি।চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে আফিমের।অপলক তাকিয়ে আছে সে এ দৃশ্য পানে।
নাফিয়ার ব্যস্ত আনমনে হেঁটে চলায়।মনে অনেক অনেক কথা জমেছে তার।না বললে যেনো পেট ফেটে মরেই যাবে সে।তাইজন্যে হাঁটার মাঝেই আফিমের দিকে তাকিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
“আফিম,আমাদের প্রথম দেখার পর আজ ১ মাস ২৯ তম দিনে আপনাকে কেনো আবারও এই ব্রীজে আমাকে নিয়ে আসার বায়না ধরেছিলাম জানেন?”
নাফিয়ার প্রশ্ন কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই ধ্যান ভাঙে আফিমের।মেয়েটির চুল হতে দৃষ্টি সরিয়ে তার চোখ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আফিম।স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কেনো?
-কারণ আজ ভরা পূর্ণিমা,আকাশে অল্প-স্বল্প মেঘেদের উপস্থিতি আর এই সুন্দর পরিবেশে আপনাকে নিজের সমন্ধে অনেক কিছু জানানোর ইচ্ছা হচ্ছিল।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-ইচ্ছে হচ্ছিল!এখন আর ইচ্ছে টা নেই?
-আছে তো,শুনবেন?
মেয়েটির করা প্রশ্নে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়েই চোখের ইশারায় সম্মতি দেয় আফিম।
আফিমের অনুমতি পেয়ে ঠোঁটের হাসিটা দীর্ঘ করে নাফিয়া।হাঁটা থামিয়ে ব্রীজের কিনারায় গিয়ে দাড়িয়ে পরে সে।দৃষ্টি আবদ্ধ করে নেয় উন্মুক্ত আকাশ পানে।একটা লম্বা শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে বলতে আরম্ভ করে,
-মাম্মি বলে আমি নাকি মেঘবালিকা।মানে মেঘের কন্যা।কেনো এমনটা বলে জানেন?কারণ আমি যেদিন ধরনীর বুকে আসি অর্থাৎ যেদিন আমার জন্ম হয়েছিলো সেদিন নাকি সারাদিন বৃষ্টি ছিলো।মানে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো আরকি।আর যখন ভূমিষ্ট হই তখন নাকি বৃষ্টির বেগ ছিলো প্রবল,মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠছিলো পৃথিবী।মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়েই মৃত্যুবরণ করেন।মাম্মি বলে সেদিন মা মরা এক দুঃখীনির জন্ম হয়েছিলো বলেই প্রকৃতি বৃষ্টির মাধ্যমে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেছিলো।কিন্তু আমি মনে করি না যে আমি দুঃখী।কারণ আমি মা হারিয়েছিলাম বটে কিন্তু আল্লাহ আমাকে মাম্মি রূপে একজন মা দান করেছিলেন।মাম্মি আসলে আমার খালামনি হোন কিন্তু আমার জন্য তিনিই আমার মা।কারণ সেই জন্মের প্রথম দিন থেকে মাম্মিই আমার মা হওয়ার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন।আমার বয়স ৬ বছর হওয়া অব্দি আমার বাবা বেঁচে ছিলেন।তিনি মা মারা যাবার পরও আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।মাম্মি বলে বাবা নাকি মাকে খুব ভালোবাসতেন।সেজন্যেই দ্বিতীয় কারো কথা আর ভাবতে পারননি নিজের জীবনে।আমি জন্মের পর থেকেই মাম্মি আর খালুর সাথে থাকতাম।বাবা ও দাদা নিজেদের বাসায় একসাথে থাকতেন।আর প্রতিদিন নাকি বাবা এসে আমাকে দেখে যেতেন।আমার ভালো মতো কোনো স্মৃতিই মনে নেই তখনের।খুব ছোট ছিলাম তো তাই।কিন্তু মাম্মি বলে ৬ বছরে এমন নাকি একটা দিনও যায়নি যেদিন বাবা আমাকে দেখতে মাম্মির বাসায় আসেন্নি।বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমার সব খচর তিনিই বহন করতেন।আল্লাহর রহমতে টাকার অভাব ছিলো না আমার বাবার।তারপর যখন আমার বয়স ৬ তখন একদিন বাবা ও দাদা একসাথে কোথায়ও যাচ্ছিলেন আর রাস্তাতেই এক দূর্ঘটনার স্বীকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।তাকায় না আফিমের দিকে।কিন্তু না তাকিয়েও সে বুঝতে পারছে আফিম মনোযোগী শ্রোতা।শুনছে তাকে, আগ্রহ নিয়েই শুনছে।একটু ঢোক গিলে নাফিয়া আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-বাবা যেদিন মারা যান সেদিনও নাকি বৃষ্টি হয়েছিলো খুব।একদম আমার মায়ের মৃত্যুর দিনে যেমন প্রবল বৃষ্টি ছিলো ঠিক তেমনই বাবার মৃত্যুর দিনেও।যখন বাবা মারা যান তখন থেকেই একটু একটু করে বুঝতে শিখতে আরম্ভ করি আমি।বাস্তবতার কিছু কিছু কুৎসিত রূপের সাথেও পরিচিত হতে আরম্ভ করি। ‘বাবা’ শব্দটার আরেক নাম হয়তো ‘নিরাপত্তা’।বাবা হারানোর পরই নিজের নিরাপত্তা হারিয়েছিলাম,আফিম।বাবার যা সম্পত্তি ছিলো তা সব আমার পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু চাচারা কিভাবে যেনো সব আত্মসাৎ করে নেন।হয়তো আইনী ভাবে সব এখনো আমার আছে মানে কেস-মামলায় জড়ালে আমি পেতে পারি আমার বাবার সম্পদ।কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই আর ইচ্ছে থাকলেও তো আমার কিছু করার থাকতো না।আর খালু আবার পুলিশ-কেস এসব জিনিস ভয় পান তাই এসব দিকে তিনিও জড়াননি।আর এসবের জন্য বাবা মারা যাবার পর আমার সব খরচের বোঝা গিয়ে পড়লো খালুর কাঁধে।শুরু হলো মাম্মির সংসারে ঝামেলা।খালু আমার খরচ বহন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।মাম্মিকে চাপ দিতেন যেনো মাম্মি আমাকে মামার বাসায় দিয়ে আসে।কিন্তু মামাও আমার দ্বায়িত্ব নিতে চাইতেন না।সে নাকি তার নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতেন সেখানে আমাকে আর কি করে পালবেন! খালুর হাজারো গালমন্দ শুনেও মাম্মি আমাকে তার বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।নিজের স্বামীর সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে আমার পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি।আমার পড়ার খরচ বা যেকোনো আবদার মেটাতে অনেক সময় খালুর পকেট,মানিব্যাগ দিয়ে টাকাও চুরি করেছিলেন মাম্মি।ক’একবার ধরাও খেয়েছেন।লোকটা মাম্মির গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করেনি।আর আমার মাম্মিটা আমার জন্য ঐ লোকটার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও চুপচাপ সয়ে গিয়েছিলেন।

কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।একফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরে মেয়েটার গাল বেয়ে।ঠিক এমন মুহূর্তেই আকাশে মেঘেদের সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করে।অর্থাৎ আবহাওয়া ধীরে ধীরে খারাপের দিকে আগাচ্ছে।হয়তো আবারও বৃষ্টির আগমন ঘটবে!মেঘবালিকার কষ্ট যেনো সহ্য হয় না ঐ দূর আকাশের।তাইতো মেঘবালিকার মনে দুঃখদের আনাগোনা দেখা দিলেই ঐ দূর আকাশে জড়সড় হয় শতশত মেঘেরা।গর্জে উঠে বর্ষিত হয় ধরণীর বুকে।

আফিম অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে নিজের বক্ষমাঝারে।এমনটি নয় যে সে এসব সমন্ধে অবগত ছিলো না।জানে সে,সবটাই জানে নিজের প্রেয়সীর সমন্ধে।কিন্তু তার সামনে তার মায়াবীনির দুঃখ বিলাস পীড়া দিচ্ছে তাকে।ইচ্ছে করছে মেয়েটার অতীতের ক্ষতগুলো মুছে দিয়ে সেথায় সুখ লিখে দিতে।কিন্তু আফসোস,সৃষ্টিকর্তা সে ক্ষমতা তার সৃষ্টি কুলের কেউকে দেননি।

নাফিয়া ক’সেকেন্ড বিরতি নিয়ে আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-আমার সাথে দূরব্যবহার করা,থাকা-খাওয়ার খোঁটা দেওয়া,খরচ দিতে না চাওয়া,মাম্মির সাথে ঝগড়া করা,মাম্মির গায়ে হাত তোলা সব কিছু তাও মেনে নেওয়ার মতো ছিলো।কিন্তু এসবের পর একদিন লোকটা নিজের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেললো।লোকটা লোকটা লোকটা আ আ আমার শরীর…..

নাফিয়া আর কিছু বলার আগেই তার হাত ধরে এক হেঁচকা টানে তাকে নিজে বুকে নিয়ে এলো আফিম।চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ছেলেটার।রাগে কপালের রগগুলোও দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে তার।শক্ত করে নিজের প্রেয়সীকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন কন্ঠে আফিম বলে ওঠলো,
-চুপ!
এর থেকে বেশি শোনার ক্ষমতা আফিমের নেই।শুনলে হয়তো ঐ দানব টা আর এই পৃথিবীর বুকে একদিনো বেঁচে থাকতে পারবে না।অবশ্য নিজের হাতদুটো তো ১ মাস ২৭ দিন আগেই হারিয়েছে,এখন হয়তো নিজের জানটাও হারাবে।

চলবে।

[কেমন হয়েছে তা জানাতে ভুলবেন না যেনো প্রিয় পাঠক মহল❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here