#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৫
আফিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে নাফিয়া।ছেলেটার কষ্টগুলো যেনো নিজের মাঝে শুষে নেওয়ার তীব্র চেষ্টায় আছে সে।এদিকে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের পুরুষটার মুখখানা মৃদু লালচে হয়ে আছে।হয়তো অতিরিক্ত রাগ বা কষ্টের প্রভাবে।চোখের কোণে সামান্য এক বিন্দু পানির উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।সেই সাথে ঠোঁটে ফুটে আছে সামান্য হাসির রেখা।নিজের মায়াবীনিকে শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে সে নিজেও।সময়টা যেনো এখানেই থেমে গিয়েছে দু’জনার।হৃৎস্পন্দন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।অনেকটা সময় এভাবেই অতিবাহিত হবার পর আফিমের কাছ থেকে কিছুটা সরে আসে নাফিয়া।নিজের ডান হাত রাখে আফিমের বক্ষ মাঝে,কিছুটা বাম দিকে ঠিক যেখানে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন স্পষ্ট অনুভূত হয়।নিজের বাম হাত দ্বারা আলতো করে আফিমের গাল স্পর্শ করে সে।নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-দুঃখ কমেছে?
মেয়েটার নয়ন পানে তাকিয়ে রয় আফিম।এই ডাগর ডাগর চোখজোড়ায় কত চিন্তে ফুটে আছে তার জন্যে, দৃশ্যমান হয়ে আছে এই নয়নজোড়ায় তার জন্যে যত্নে রাখা সুগভীর প্রেমানুভূতি।আফিম আলতো করে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নাফিয়ার গাল।কপালে কপাল ঠেকায় সে।এসিড যেমন ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে প্রশমিত হয়ে যায় ঠিক তেমনই এই মায়াবীনির প্রথম স্পর্শই আফিমের যন্ত্রণাগুলোকে প্রশমিত করে দিয়েছিলো।এখন আর বক্ষমাঝারে যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে না তার।বরং মেয়েটার জড়িয়ে ধরাতে বুকের এক কোনে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছে আফিম।তবে মেয়েটার আদর কুড়ানোর সুযোগ টা হাত ছাড়া করতে ইচ্ছুক নয় সে।তাই মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-উহু।
-দুঃখ একটুও কমেনি?
-উহু।
-আরো আদর করতে হবে?
-হু।
আফিমের উত্তর মিলতেই আর বিলম্ব করে না নাফিয়া।ঠোঁট এগিয়ে চুমু এঁকে দেয় ছেলেটার কপালের মাঝ বরাবর।কপালে আদর দিয়ে ঠোঁট নামিয়ে গালেও চুমু এঁকে দেয় সে।দু’গালে চুমু দিয়ে নিম্ন স্বরেই জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কমেছে?
-উহু।
আফিমের না বোধক উত্তর পেয়ে আবারও আদরে মনোনিবেশ করে নাফিয়া।ছেলেটার নাকের মাঝ বরাবর চুমু বসায় সে।ঠোঁট নামিয়ে আফিমের থুতনিতেও চুমু এঁকে দেয়।অতঃপর ঠোঁট কানের কাছে নিয়ে গিয়ে সেথায়ও ঠোঁট ছোঁয়ায় মেয়েটা।সাথে সাথে নাফিয়ার কোমর আঁকড়ে ধরে আফিম।নাফিয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সে।চোখবুঁজে নিজের প্রেয়সীর গলায় মুখ ডুবায় ছেলেটা।এ মুহূর্তে বাহ্যিক পৃথিবীর কোনো হুস নেই তার।ডুবেছে সে নিজের মায়াবীনির অনন্ত নেশায়।
গলায় আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।চোখজোড়া বুজে নেয় নিজের।শিহরিত হয়ে আঁকড়ে ধরে আফিমের কাঁধ। নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করে ওঠে,
-এবার কমেছে?
একই প্রশ্নের এবারও একই উত্তর আফিমের।
-উহু।
আফিমের উত্তরে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।এবার সে বুঝতে সক্ষম হয় আফিম তার আদর নিতে মিথ্যে বলছে।বুঝতে পেরেও আর বাঁধা দোওয়ার ইচ্ছে হয় না নাফিয়ার।বরং এই মানুষটাকে সারাজীবন নিজের আবেগ-অনুভূতিমাখানো স্পর্শে, আদরের চাদরে মুড়িয়ে রাখার তীব্র ইচ্ছা অনুভব করে সে নিজের মাঝে।
মেয়েটার গলায় একের পর এক ঠোঁটের স্পর্শ আঁকতে ব্যস্ত আফিম।এ স্পর্শ ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে।গলা থেকে ক্রমশ উপরে উঠতে উঠতে মেয়েটার থুতনিতে এসে থেমেছে আফিমের ওষ্ঠদ্বয়ের এই সম্মোহনী স্পর্শ।থুতনি হতে ঠোঁট উঠিয়ে সামান্য দূরে সরে সে তাকায় নাফিয়ার ঠোঁটের দিকে।নেশাগ্রস্থের ন্যায় নিজের দৃষ্টি আবদ্ধ করে নেয় মেয়েটার ওষ্ঠদ্বয়ে।ঠোঁটে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই সে মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,
-Can i kiss, Miss. Sheikh?
!!
কুসুমকে কোলে নিয়ে নিজের ক্যাবিনে ঢোকে রিয়াদ।একটি চেয়ারে মেয়েটিকে বসিয়ে দেয় সে।চোখ-মুখে ফুটে আছে তার চরম বিরক্তি।এ দিকে কুসুমের সম্পূর্ণ মনোযোগ তার পায়ে কেন্দ্রীভূত।পরে যাওয়ার ফলে পায়ে অনেকটা ব্যথা পেয়েছে।কোমরেও যে ব্যথা পেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।মেয়েটা ব্যস্ত তার ব্যথা নিয়ে।দু’হাতে পা ধরে পা মালিশ করে চলছে সে।মালিশ করার মাঝেই কুসুম শুনতে পায় কোনো একজনের গম্ভীর কন্ঠস্বর।কেউ একজন তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেছে,
-চোখ কি বাসায় রেখে এসেছেন মিস.কুসুম?হাঁটার সময় যে সাবধানে হাঁটতেও জানে না তাকে কি কোনোভাবে বিশ্বাস করা উচিৎ? কোন বিশ্বাসে আপনাকে দায়িত্ব দিবো?
-যে বিশ্বাসে আপনি নিজে দায়িত্ব নেন স্যার।
-মানে?
-আমাদের দু’জনার মাঝে কেউ একজনও যদি সাবধান হতো বা খেয়াল করে চলতো তাহলে এই কান্ড টা ঘটতো না।সুতরাং আপনি যা আমিও তাই।
কুসুমের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে রিয়াদের। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে ওঠে,
-দু’দিনের চাকরিরত মেয়ে আমার সাথে নিজের তুলনা করছেন?সাহস কি করে হয় নিজেকে আমার সাথে তুলনা করার?
ভয় পাবার মতো মেয়ে কুসুম নয়।তাই রিয়াদের রাগ দেখে বিশেষ কিছু অনুভব হলো না তার।বরং বিরক্ত ঠেকলো।সে চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
-স্যার,আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি।একজন মানুষ হিসেবে আপনার উচিৎ আমার হেল্প করা।
কুসুমের কথায় তার পায়ের দিকে তাকায় রিয়াদ।আসলেই কিছুটা ফুলে উঠেছে পায়ের জায়গাটা।আর কথা বাড়ায় না রিয়াদ।সে জানে দোষ তারও ছিলো।সে নিজেই বেখেয়ালিতে চলছিলো।তাই সোজা গিয়ে নিজের ড্রয়ার হতে ব্যথা নিরাময়ের স্প্রে বের করে তা নিয়ে এগিয়ে যায় কুসুমের কাছে।কুসুমের সামনে বরাবর দাঁড়িয়ে একটু ঝুকে পুরো পায়ের পাতা,গোড়ালি সম্পূর্ণ জায়গায় স্প্রে করে দেয় রিয়াদ।স্প্রে করা শেষ হতেই কুসুমের কাছ থেকে সরে গিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পরে সে।
এদিকে অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে কুসুম তার দিকে।এভাবে কেউ কারো সাহায্য করে?না ভালো করে দেখলো ব্যথা কোথায় পেয়েছে, না একটু সুন্দর করে ধরে আস্তে ধীরে স্প্রে করলো!ব্যাস ঝরের গতিতে এসে এলোপাতাড়ি স্প্রে মেরে চলে গেলো।এ কাজে কোথাও এক বিন্দু পরিমাণ যত্ন ছিলো না আর না ছিলো সহমর্মিতা।
!!
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই অতীতের স্মৃতিরা চোখের সামনে ভেসে উঠতে আরম্ভ করে আরহান সাহেবের।মনে পরে নিজের জীবনযুদ্ধে কতশত বার পরাজিত হয়েছিলেন তিনি।কতবার জীবন তাকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিয়েছিলো!কতবার জীবন তাকে নির্দয় হতে বাধ্য করেছিলো!
এসব পুরোনো স্মৃতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখজোড়া বুজে নেন আরহান সাহেব।ওমনি চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরে এক ফোঁটা অশ্রু কণা।দেশের মাটিতে পা রাখার পর হতে তিনি তীব্র ভাবে অনুভব করছেন নিজের স্ত্রীর অনুপস্থিতি।ভুলে যাননি তিনি তার স্ত্রীর সাথে করা নিজের অন্যায়ের কথা।এখনো মনে পরে তার সেদিনটির কথা।তখন মাত্র ক’মাস হয়েছে তিনি বিদেশের মাটিতে পা রেখেছেন।এক অনিশ্চিত জীবন পাড় করছিলেন তিনি সেসময়।নিজের বেকারত্বের বোঝা নিজের কাঁধ হতে সরাতেই প্রধানত তিনি বিদেশে আসার সীদ্ধান্ত নেন।অতঃপর অনেক কষ্টে এক নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় বিদেশে আসার সুযোগও হয় তার।এখানে আসতেই বুঝতে পারেন প্রবাসীদের জীবন কতটা কষ্টের।থাকার জায়গা ছিলো না, খাওয়ার টাকা ছিলো না।কতরাত রাস্তায় পাড় করেছেন তার হিসেব নেই,কতবেলা না খেয়ে পাড় করেছেন তারও হিসেব নেই।অপরিচিত দেশ, অপরিচিত সব মানুষের মাঝে নিজেকে কতটা অসহায় অনুভব করতেন তা ব্যাখ্যা করবার মতো ভাষাও জানা নেই আরহান সাহেবের।যেখানে যে কাজ পেতেন তাই-ই করতেন।সম্মানের কথাও চিন্তা করেননি।এভাবে বহু কষ্ট সহ্য করেও ওখানে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তিনি।সময়ের সাথে সাথে সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন।ক’মাসে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালী যুবকদের সাথে পরিচয় হয় আরহান সাহেবের।তাদের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।বাঙালী এই ৫-৬ জন নিলে সীদ্ধান্ত নেয় সবাই মিলে ব্যবসা শুরু করবে।এতে যুক্ত ছিলেন আরহান সাহেবও।ব্যবসা ছিলো ফুডকোর্টের।সবাই মিলে যে যত টাকা পেরেছেন দিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন।ভাসমান ফুডকোর্টের এ ব্যবসা টা এতোটা লাভজনক হবে তা ভাবনাতিত ছিলো সবার।অল্প সময়ের মাঝেই মোটা অংকের লাভের মুখ দেখলো তারা।
এভাবে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল আরহান সাহেবের।ধীরে ধীরে প্রবাসে অভ্যস্ত হচ্ছিলেন তিনি এবং ব্যবসার ফলে একটু টাকারও মুখ দেখছিলেন।স্বপ্ন বুনছিলেন নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।কিন্তু ঠিক এমন সময়ই ভাগ্য আবারও তার পরিক্ষা নেয়।বাংলাদেশ থেকে আসা নিজের ভাইয়ের ফোন কল তার সবকিছু উলোটপালোট করে দেয়।ভাগ্য আবারও সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলে দেয় তাকে।নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জায়গায় সব অন্ধকার দেখতে আরম্ভ করেন তিনি।
চলবে।
[