#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৩০
এক দমকা হাওয়া।হটাৎ এক ঝরে সব উলোটপালোট।আকাশ জুড়ে কালো মেঘেদের উপস্থিতি।না নেই কোনো সূর্যের কিরণ,নেই কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলোর উপস্থিতি।সাড়ে বারো বছর বয়সী কিশোরের মনের আকাশ দুঃখ নামক কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরোপুরি।তার দুঃখে নিমজ্জিত হৃদয় এ মুহূর্তে একটি মানুষেরই সাক্ষাৎ চাইছে ভীষণভাবে।সে মানুষটি হচ্ছে তার মায়ের বান্ধবী ও তাদের প্রতিবেশী।যার নাম ‘নুরানি’।
মায়ের মৃত্যুর পরপরই আফিমকে ছাড়তে হয়েছে নিজের বাড়ি,নিজের স্কুল, নিজের সহপাঠীদের সঙ্গ ও নিজের শহরও।কারণ মা মরা এই কিশোরের দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে তার চাচার কাঁধে।এখন নিজের সব কিছু ফেলে সে আশ্রিতা নিজের চাচার বাসায়।নিজের শহর ছাড়া নিয়ে খুব একটা অভিযোগ নেই আফিমের কিন্তু মা ব্যাতীত যার কাছ থেকে সে মায়ের গন্ধ পেতো সেই মানুষটার থেকেও দূরে আসতে হয়েছে বলে কষ্ট অনুভূত হচ্ছে তার।মায়ের অনুপস্থিতিতে কেবল ঐ মানুষটার সাক্ষাৎই যেনো আফিমের হৃদয়ে একটু স্বস্তি এনে দিতে পারবে।
চাচার বাসায় আসার পর থেকে একবারো নিজ কক্ষ হতে বের হয়নি আফিম কিন্তু আজ আর আটকাতে পারলো না সে নিজেকে।ধীর কদম ফেলে এগিয়ে গেলো চাচার কক্ষের দিকে।
অতঃপর আফিম কক্ষে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে চাচার সামনে গিয়ে বসলো।পত্রিকা হতে চোখ উঠিয়ে নিজের ভাতিজার দিকে তাকালেন চাচা।দেখা পেলেন এক ফ্যাকাশে মুখশ্রীর।ক’দিনেই কেমন শুকিয়ে গিয়েছে ছেলেটা,ফোলা চোখদুটো, শুকনো ঠোঁট এসবে মায়া হলো চাচার।তিনি পত্রিকা ফেলে আফিমকে জিজ্ঞেস করলেন,
-বল বাবা কিছু বলবি?
-আমাকে একটু আমার বাড়িতে নিয়ে যাবা চাচ্চু? আমি নুরি আন্টির সাথে দেখা করবো।
-নুরি আন্টি কে?
-আমাদের প্রতিবেশী আর আম্মুর খুব কাছের বান্ধবী।
-তোকে যেদিন নিয়ে এলাম সেদিন তো নুরি নামে কেউ ছিলো না ওখানে।
-নুরি আন্টির বোনকে আল্লাহ বাবু দিবেন।তাই তিনি তার বোনের কাছে গিয়েছেন।আম্মুর এক্সিডেন্ট, আমার এখানে আসা কোনো কিছুই জানেন না আন্টি।
-তুই কেনো দেখা করতে চাইছিস?
উত্তরে চুপ হয়ে যায় আফিম।মনের টান শব্দে কি করে ব্যক্ত করবে সে?তবুও নিন্ম স্বরে টলমল চোখ নিয়ে বলে উঠলো,
-আন্টির কাছ থেকে মা মা গন্ধ আসে।
উত্তরে চুপ হয়ে গেলেন চাচা।কপালে চিন্তের ছাপ ফেলে বলে উঠলেন,
-কত দূরের রাস্তা।যাইতে কত সময় লাগবে জানিসই তো।আর আজকাল কাজের চাপে আমি এতো ব্যস্ত কিভাবে যে সময় বের করে তোরে নিয়া যাই!
হতাশ গলায় কথাগুলো বললেন চাচা।চাচার দিকে এক নজর তাকালো আফিম।মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-সমস্যা নেই চাচ্চু।আগে কাজ তারপর সব।
কথাটা বলে আর বসে না আফিম।নিজ কক্ষে চলে আসে সে।ছোটবেলা দিয়েই ব্যক্তিত্ববান ছেলে সে।যেখানে চাচা তার দিক টা একবারো ভাবলো না সেখানে তার আর অনুরোধ করা টা মানায় না।একটা বাচ্চা যার জীবন একটা দূর্ঘটনার কবলে পরে সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, যার মনের অবস্থা সমন্ধে অবগত প্রতিটা মানুষ।এমতাবস্থায় বাচ্চাটার একটা ছোট আবদার চাচা হয়ে কি করে পারলেন তিনি কাজের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখান করতে?সামান্য মায়া থাকলেও মানুষ এমনটা করে বলে মনে করে না আফিম।এ ঘটনায় সে বুঝে নিলো এখন সে যাদের কাছে আছে তাদের কাছে তার অনুভূতির মূল্য নেই।তার কষ্ট এখানের কেউকে স্পর্শ করে না,কেউ ব্যথিত হয় না,কারো আসলে কিছু আসে-যায় না।আফিম অনুভব করলো সে একা,ভীষণ একা।এ ঘটনার পর থেকে ছেলেটা নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলো।পুরোপুরি কথা বলা বন্ধ করে দিলো।পড়ালেখা,খাওয়া-দাওয়াসহ সব কিছুতে তার তৈরি হলো অনিহা।
আফিমের এসব ব্যবহারের খবর পৌঁছালো আরহান সাহেবের কাছে।তখন তার রমরমা ব্যবসা।দু’হাত ভরে আসছে টাকা।সময় হলো না তার নিজের ছেলের সাথে কথা বলে তার মন বুঝার চেষ্টা করার।কারণ আফিম নিজের অভিমানের জন্য তার সাথে কথা বলতে চাইতো না আর তার সময়ও ছিলো না যে সে সময় নিয়ে আফিমের অভিমান ভাঙাবে।বড় ভাইর কাছ থেকে ছেলের খবর শুনা আর টাকা পাঠানো অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিলো তার দায়িত্ব।
এরই মাঝে হটাৎ একদিন বাংলাদেশের কারো একজনের কল আসে আরহান সাহেবের ফোনে।জানতে পারে তার খুবই ভালো সম্পর্কের এক ভাইয়ের মৃত্যুর খবর।লোকটি মারা যাবার পর তার পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।সাহায্যের প্রয়োজন ভীষণ কিন্তু কোনোভাবে কোনো সাহায্য পাচ্ছে না তারা।আরহান সাহেবের মনে পরে এই মৃত ব্যাক্তিটি এক সময় বড় অংকের টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করেছিলো।ভীষণ বড় মনের ও ভালো মনের মানুষ ছিলেন লোকটি।সবটা বিবেচনা করে মনে দয়া জন্মায় আরহান সাহেবের।কিভাবে সাহায্য করবে ভাবতেই তার মাথায় আসে আফিমের কথা।ভাবে একজন বন্ধু বা সাথী বা সহচরী পেলে হয়তো ছেলেটা স্বাভাবিক হবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।প্রস্তাব পাঠালেন তিনি সেই মৃত ব্যক্তির স্ত্রী অর্থাৎ রিয়াদের মায়ের কাছে।প্রস্তাব ছিলো রিয়াদ সব সময় আফিমের সাথে তার ছায়া হয়ে থাকবে, আফিমের প্রতি খেয়াল রাখবে এবং এর বিনিময়ে তিনি রিয়াদের সকল দায়িত্ব নেবেন ও সেই সাথে কিছু টাকা রিয়াদের পরিবারকে দিবেন।
বিপদের মুহুর্তে আরহান সাহেবের প্রস্তাব প্রত্যাখান করার সাহস হলো না রিয়াদের মায়ের।রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
রিয়াদ ছোটবেলায় মিশুক ও বাঁচাল প্রকৃতির থাকায় প্রথম গিয়েই আফিমের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো।যদিও প্রথম দিকে সে ভেবেছিলো যে সে ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে এজন্য কান্নাকাটি বা কিছুই করেনি।কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারে যে তাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানেই থাকতে হবে তখন অবশ্য খুব বেশি কষ্ট হয়নি তার কারণ ততদিনে আফিমের সাথে এক অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে।আর আফিম! সে প্রথম প্রথম রিয়াদের সাথে কথা না বললেও পরে রিয়াদের দুষ্টুমি,ননস্টপ কথা বলা আর বিনা বিরতিতে আফিমকে জ্বালাতে থাকার স্বভাবের জন্যে সে নিজেও রিয়াদকে আপন ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছিলো।
রিয়াদ আসার পর থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে আরম্ভ করে আফিম।আগের মতো আবারও পড়াশোনায় মনোযোগী হয় সে।নিজেকে গড়ে তোলার জিদ তৈরি হয় তার মাঝে।নিজের জন্য নিজেই যথেষ্ট হওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়ে সে।
এরপর জীবনে নিজেকে গড়তে গিয়ে কত হোঁচট খায়,পরে যায় আবার নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ায়।স্রষ্টার প্রতি খুব বিশ্বাস ছিলো আফিমের।তাই তো সে মানতো আল্লাহর রহমত থাকলে কোনো বাঁধাতে আটকাবে না সে।খুব বেশি কিছু না শুধু সব হারাম থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে সে আর নিজের সততা বজায় রেখেছে।ব্যাস,এরপর শুধু সাহস দেখিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সে।থামেনি কোথাও আর থামতে হয়ও নাই।তার নিজের মনোবল তো ছিলোই সেই সাথে তার সাথে ছিলো তাকে উৎসাহিত করার মতো একজন বন্ধু রিয়াদ।
____অতীত হতে ফিরে আসে আফিম।অনুভব করে তার আঁখিজোড়া সামান্য সিক্ত হয়ে আছে।হাত উঠায় তা মুছে নেওয়ার জন্যে।কিন্তু তার আগেই চোখের কোণে কারো ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে আফিম।এ স্পর্শ যেনো সোজা গিয়ে তার হৃৎপিণ্ড স্পর্শ করে ছড়িয়ে পরলো পুরো শরীর জুড়ে।তবুও চোখ বুঁজেই রাখলো সে।বা’চোখের কোণে চুমু আঁকার পর ডান চোখেও চুমু এঁকে দেয় নাফিয়া।অতঃপর কপালে চুমু খেয়ে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আফিমের গাল।নাকে নাক ঘষে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-এতো চাপা স্বভাবের কেনো আপনি আফিম?আমার কোলে শুয়ে নিরবে,নিঃশব্দে দুঃখবিলাস করে চলছেন আর ভেবেছেন আমি বুঝবো না?হার্ট টু হার্ট কানেকশন বোঝেন?
প্রশ্ন খানা করে নাফিয়া নিজের ডান হাত টি রাখে আফিমের বক্ষ মাঝে।বলে ওঠে,
-এই যে এইখান থেকে…..
এটুকু বলে আফিমের একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে নিজের স্পন্দিত হওয়া হৃৎপিণ্ড টির উপর সামান্য স্পর্শ করিয়ে বলে ওঠে,
-এই পর্যন্ত এক অদৃশ্য সংযোগকে বলে হার্ট টু হার্ট কানেকশন।যাদের মাঝে এই সংযোগ টা থাকে তারা হাজার চেষ্টা করেও একে-অপরের থেকে নিজেদের মনের অবস্থা লুকোতে পারে না।বুঝেছেন?
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৩১
মধ্য রাত!
আয় ও ব্যয়ের হিসেব টেনে একটি গ্রাফ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে আছে রিয়াদ।এমন সময় ফোনে একটি ম্যাসেজ আসার শব্দ কানে আসে রিয়াদের।ব্রু কুঁচকে তাকায় সে ফোনের দিকে।এতো রাতে তাকে টেক্সট করার মতো কেউ তো নেই তার ফ্রেন্ডলিস্টে তবে কে টেক্সট করলো!কৌতূহলের বসে ফোন হাতে নেয় সে।চোখে পরে কৃষ্ণচূড়া নামক আইডি হতে আসা একখানা ম্যাসেজ।
“আসসালামু আলাইকুম,জানি এতো রাতে ম্যসেজ দেওয়াটা অভদ্রতা।তারজন্যে দুঃখিত।আসলে আমাদের জেনারেশনের মানুষদের অবসর সময়টা হচ্ছে ‘রাত’।বলতে গেলে ৯৮% মানুষরা রাতে ঘুম বাদ দিয়ে ফেসবুকিং করে কারণ দিনে অফিসের কাজের চাপে অবসর সময় মেলে না।এটি বিবেচনা করে এখন ম্যাসেজ দিলাম।”
ম্যাসেজ খানা দেখে বিরক্ত হলেও মেয়েটির গুছিয়ে কথা বলা ও ভদ্রতা দেখানোটা ভালো লাগলো রিয়াদের।তাই সে অন্য অপ্রয়োজনীয় ম্যাসেজের মতো এটি স্প্যাম লিস্টে না রেখে রিপ্লাই দিলো,
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমরা কি পরিচিত?
রিয়াদ ম্যাসেজ খানা দিতেই সাথে সাথে ওপাশ থেকে ম্যাসেজ এলো,
-হ্যাঁ।
ম্যাসেজটি পেতেই কপালে চিন্তের ছাপ পরে রিয়াদের।সে চেনে মেয়েটিকে?কিন্তু কিভাবে?কে হতে পারে এই আইডির মালকিন?নিজের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো সে।সাথে সাথে মেয়েটির আইডিতে ঢুকলো।দেখলো কয়েকটি বুকগ্রাফির ছবি পোস্ট করা আছে আর সেই সাথে আরো ১-২ টি ছবি আছে যাতে তার চেহারা দৃশ্যমান নয়।মেয়েটির গায়ের রঙ কালো বিধায় রিয়াদের মাথায় একবার কুসুমের চিন্তে এলো।কিন্তু পরক্ষণেই আরো কয়েকজনের কথা মনে পড়লো তার যাদের সাথে ভার্সিটি লাইফে পরিচয় ছিলো রিয়াদের। তবে কি তাদের মাঝেই কেউ একজন এই মেয়ে?
উত্তর মিললো না।আইডি হতে রিয়াদ ফিরলো মেয়েটির ইনবক্সে।প্রশ্ন করলো,
-আমি ঠিক চিনতে পারছি না আপনাকে।আপনার পরিচয়?
-দিবো না তো।পারলে চিনে নেন।
-দেখুন আমার সময় স্বল্পতা আছে।আপনার পেছনে অপচয় করার মতো সময় নেই আমার।পরিচয় দিন নাহয় ব্লক করে দিবো।
-উম,আপনার যে কৌতূহলী স্বভাব তাতে আমার পরিচয় না জেনে আমাকে ব্লক করলে আপনার খাওয়া-দাওয়া,ঘুম সব উড়ে যাবে।সো আই নো আপনি আমাকে ব্লক করবেন না আর না আমি পরিচয় দিবো।
বিরক্তি শীর্ষে পৌঁছিয়েছে রিয়াদের।সেই সাথে কিছুটা অবাকও হয়েছে সে।এটি ভেবে যে,এই মেয়ে তার স্বভাব সমন্ধে কি করে জানে?
বিরক্তিতে ইচ্ছে তো করছে ব্লক করতে কিন্তু মেয়েটির পরিচয় না জানলে কৌতূহল মিটবে না তার তাই ব্লক করলো না সে।ম্যাসেজটা দেখে রেখে দিলো,রিপ্লাই আর করলো না।ভাবলো,পরে একদিন সময় করে ভাববে এ বিষয়ে।
!!
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে আফিম ও নাফিয়া।সবেই নাফিয়াকে কলেজে ভর্তি করে এখন নিজের বাড়ি ফিরার উদ্দেশ্যে ড্রাইভ করছে আফিম।আর নাফিয়া নিরবে জানালা হতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আফিম আড়চোখে এক-দু’বার দেখে নিলো নাফিয়াকে।নাফিয়ার এরূপ নিরবতা স্বাভাবিক ঠেকছে না তার।মেয়েটার মন বুঝার চেষ্টা করছে সে।এরই মাঝে হুট করে আফিমের দিকে তাকালো নাফিয়া।শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-মাম্মি কেমন আছে আফিম?
নাফিয়ার এমন প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলো আফিম। তাই জন্যেই মেয়েটির নিরবতা অস্বাভাবিক ঠেকছিলো তার।কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন শুনে আফিম বলে উঠলো,
-হটাৎ এমন প্রশ্ন?
-কলেজে ভর্তি করার জন্য আমার যেসব ইনফরমেশন লেগেছে তা কোত্থেকে পেলেন আপনি?অবশ্যই মাম্মির কাছ থেকে?তারমানে মাম্মি জানে আমি আপনার সাথে আছি,সেফ আছি,ভালো আছি সেজন্যে তিনি নিশ্চিন্ত।কিন্তু এর মানে এও দাঁড়ায় যে খালুও আপনার সমন্ধে জানে।খালু জানে মানে খালুর সেই বিদেশি ক্ষমতাবান বন্ধুও জানে আমি আপনার কাছে আছি।এর অর্থ আমরা সেফ না আফিম।আমার সাথে সাথে তারা আপনারও ক্ষতি করতে চাইবে কারণ তাদের উদ্দেশ্য সফলের রাস্তায় আপনি প্রতিবন্ধক।আপনি শুধু শুধু আমার জন্য নিজের শত্রুর সংখ্যা বাড়ালেন!
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসলো আফিম।বলে উঠলো,
-বাহ, তোমাকে যত বলদ ভাবছিলাম তুমি ততও বলদ নও!
আফিমের কথায় তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নাফিয়া।বলে ওঠে,
-আপনি আমাকে বলদ বললেন?
উত্তরে কিছু বললো না আফিম।তার নিরবতা আর ঠোঁটের হাসিটাই উত্তর দিয়ে দিলো।মৃদু রাগ জমলো কিশোরীর।গাল ফুলিয়ে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো সে।কিন্তু ক’সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই মনে একটি প্রশ্ন জাগলো তার।আফিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-আচ্ছা, আপনি আর কি কি লুকচ্ছেন আফিম?
নাফিয়ার দিকে এক পলক তাকায় আফিম।পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে বলে ওঠে,
-সময় বলে দিবে।
উত্তরখানা পছন্দ হয়না নাফিয়ার।এই মানুষটার এই একটা গুনই নাফিয়ার ভীষণ অপছন্দনীয়।তা হলো চাপা স্বভাব।
পূর্বের ন্যায় আবারও গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বসে পরে সে।এমন সময়েই গাড়ির ব্রেক কষে আফিম।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে নাফিয়া।তবুও নড়ে না সে।পূর্বের ন্যায় একই ভঙ্গিতে বসে রয়।এ দেখে মৃদু হাসি ফোটে আফিমের ঠোঁটে।বাচ্চামিগুলো মন্দ লাগে না তো।সে নাফিয়ার সিট বেল্ট খুলে দিয়ে এক হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে নিয়ে আসে।চমকে আফিমের চোখে চোখ রাখে নাফিয়া।মেয়েটার মুখে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে গুছিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয় আফিম।উভয়ের নিঃশ্বাস উভয়ই অনুভব করতে পারছে তারা।নাফিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে কপালে চুমু এঁকে দেয় আফিম।বলে ওঠে,
-সাহিত্যিকেরা বলে নারী যখন আদর চায় তখন বিনা কারণে তারা রাগ দেখায়।আদর চাচ্ছো?
কথাখানা বলেই চোখ মারে আফিম।নাফিয়া চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তাই? কোন সাহিত্যিক বলছে এটা?
-দ্যাট’স নন অফ আওয়ার বিজনেস মিস.শেখ।
কথাটি বলতে বলতে নাফিয়ার আরো কাছে আসে আফিম।কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে নেয় নিজের।
মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে নাফিয়ার।ঠোঁট চেপে হেসে অনতিবিলম্বে আফিমের নাকে কামড় বসিয়ে দেয় সে।জোরে এক কামড় বসিয়ে সরে আসে আফিমের থেকে।ছেলেটা খিঁচে চোখ বুজে রেখেছে।নাকে দাঁতের দাগ বসে গিয়েছে।সেই সাথে জায়গাটা একটু লাল বর্ণও ধারণ করেছে।
আফিমকে দেখে নিয়ে হেসে ওঠে নাফিয়া।বলে ওঠে,
-এই হলো আমাকে রাগানোর শাস্তি হুহ্!
নাফিয়ার কথায় তার দিকে বাঁকা হেসে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-আচ্ছা তাই?
কথাখানা বলে নাফিয়ার দিকে খানিকটা এগিয়ে যায় আফিম।মেয়েটির চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-ইউ হ্যাভ টু পে ইট লেটার মিস. শেখ।
!!
ছেলের অপেক্ষায় বসে আছেন আরহান সাহেব।এ অপেক্ষা যেনো শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না।মনে শঙ্কা জাগছে আফিম কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাকে দেখে সেটি নিয়ে।ছেলেটা কি নিজের অভিমান পুষে রেখেছে নাকি সময় যেমন সব ক্ষত পূরণ করে দেয় তেমনই শেষ করে দিয়েছে এ অভিমানটাও।মন অস্থির হয়ে আছে আরহান সাহেবের।কেমন সব নেতিবাচক চিন্তেরা মনে উদিত হয়ে চলছে তার।আর কত দীর্ঘ হবে এ অপেক্ষার প্রহর?
আরহান সাহেবের এরূপ চিন্তের মাঝেই বেজে ওঠে বাড়ির কলিং বেল।বেড়ে যায় তার বুকের ধুকপুকানি।সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি।এগিয়ে যান বাড়ির সদর দরজার দিকে।
গৃহপরিচারিকাদের মাঝে একজন গিয়ে স্বাগত জানিয়েছে আফিম ও নাফিয়াকে।গৃহে এক পা রাখতেই আফিমের চোখ পরে তার পিতার দিকে।সারাটা রাত নিজেকে এ মুহুর্তের জন্যেই তো প্রস্তুত করে এনেছে সে।চোখ বুঁজে নিজেকে স্বাভাবিক করলো আফিম।এবার চোখ খুলে আরহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-আসসালামু আলাইকুম বাবা।ভালো আছেন?
উত্তর মিললো না এ প্রশ্নের।আরহান সাহেব অপলক তাকিয়ে আছেন নিজের পুত্রের দিকে।তিনি যখন দেশ ছেড়েছিলেন তখন আফিমের সবে ১২ পূর্ণ হয়েছিলো।আর এখন সে যাকে দেখছে সে ২৮ বছর বয়সী এক যুবক।আফিমের চেহারা পানে তাকিয়ে বারংবার আরহান সাহেবের চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ১২ বছর বয়সী কিশোর আফিমের মুখখানা।অশ্রু আটকাতে ব্যর্থ হলেন আরহান সাহেব।এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আফিমকে।সাথে সাথে হাত মুঠোবন্দি করে নিলো আফিম।রাগ লাগছে তার আরহান সাহেবের আবেগ দেখে।এতোই যখন ভালোবাসা ছিলো তাহলে প্রয়োজনের সময় কেনো অনুপস্থিত ছিলেন?
নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে আফিম।ছেলের থেকে সরে এসে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আরহান সাহেব বলে ওঠে,
-কেমন আছিস বাবা?কত বড় গেছে আমার ছেলে!!
উত্তরে আফিম কিছু বলে না।শুধু জোরপূর্বক নিজের ঠোঁটে হাসি টেনে রেখেছে সে।
এবার আফিম হতে চোখ সরে নাফিয়ার দিকে চোখ যায় আরহান সাহেবের।ওমনি ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পরে তার।নাফিয়ার সাথে তার চোখাচোখি হতেই নাফিয়া ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
নাফিয়ার সালামে ঠোঁটে আলতো হাসি টানেন আরহান সাহেব।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-কে ও?
চলবে।
চলবে।
[