“ক্লিন সেভে কোন ছেলেকে এতো আকর্ষনীয় কিভাবে লাগে? রসগোল্লা, মিষ্টি, সন্দেশের মতো পুরো লোভনীয়৷ দেখতে জিভে জল চলে আসে৷ ”
ঝোল খাওয়ার মতো একটা শব্দ করে নিবেদিতা৷ মাতাল নিবেদিতা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় এমন কথা শুনে চন্দ্রা’র চোখ ছানাবড়া৷কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা। কোন ছেলের ব্যাপারে এমন মন্তব্য! অবিশ্বাস্য৷ নিবেদিতার জায়গায় যদি কোন ছেলে কোন মেয়েকে এমন ট্রিপিক্যাল ধরনের কথা বলতো তবে সে নির্ঘাৎ মারা খেতো৷নিবেদিতা যার উদ্দেশ্যে এমন কথা বলেছে তার নাম উল্লাস৷ মেজর উল্লাস বিন চৌধুরী৷ একজন সোলজার৷ নিবেদিতাদের ব্যাচের ট্রেইনার। প্রথম দেখা থেকে নিবি’র দুর্বলতা উল্লাসের প্রতি।কিন্তু উল্লাসের অজানা৷ উল্লাস স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড। চোখে মুখে সবসময় কাঠিন্য গোবেচারা একটা ভাব। নিবি সচারাচর বেশির ভাগ তাকে দাড়িতে দেখেছে। এই প্রথম নিউ লুকে দেখছে তাকে৷ উল্লাসের জন্য নিবি’র মনে হাহাকার চলে সবসময় ৷ কিন্তু উল্লাস বোঝেনা৷ অথচ উল্লাস নাকি চোখ দেখে মস্তিষ্ক পড়ে ফেলতে পারে। সে উল্লাস শুধু নিবি’র চোখ দেখে তার মস্তিষ্ক আর মন পড়তে পারেনা৷ তার চোখের ভাষা কি এতো কঠিন? কথাগুলো ভাবতে নিবি বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷
” চন্দ্রা নিবেদিতা শক্ত করে ধরে সামলানোর চেষ্টা করছে। একজন স্বাভাবিক মানুষের ওজনের চেয়ে একজন মাতালের ওজন যেনো দিগুণ হয়৷ চন্দ্রা’রও হিমশিম খাওয়া অবস্থা৷ চন্দ্রা আগলে ধরে বলে,
“তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস।
নিবি ভ্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে চন্দ্রার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
” ইউ আর সো কিউট লীলাবতী, থুক্কু চন্দ্রাবতী। আই লাভ ইউ সো মাচ।
“নিবেদিতার মাতাল হওয়ার কারণ উল্লাস। উল্লাস তার ব্যাচের একজনের সাথে খুব হাসিখুশি ভাবে কথা বলছে। একটু বেশি খোজমেজাজে৷ ভাগ্যক্রমে সে একজন মেয়ে। একসাথে কয়েকটা অপারেশনে গিয়েছে তারা৷ আজ অনেকদিন পর পার্টিতে তাদের দেখা। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী৷ যদি মিডিয়ায় কাজ করতো তবে ক্যাটরিনা, দীপিকাকেও সে হার মানাতো৷ আর সৌখিনতা মাশা-আল্লাহ। রুপ,স্টাইল সবকিছু দিয়ে দুইমিনিটে একটা ছেলেকে ঘায়েল করার ক্ষমতা আছে তার মাঝে৷ আর তাকে উল্লাসের একটু বেশি কাছাকাছি দেখে নিবেদিতার হিংসায় অন্তর আত্মা ফেটে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে৷ উল্লাসও এমন ভাবে হেসে হেসে কথা বলছে দিনদুনিয়া সে ভুলে গিয়েছে এমন অবস্থা৷ আর এদিকে নিবেদিতা’র রাগে, হিংসায় গা পিত্তি জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷ সে জ্বালা কমাতে উইস্কি বেছে নিয়েছে। ব্যস দেখছে, লুচির মতো ফুলছে আর এক এক করে গিলছে। খেতে খেতে সীমালঙ্ঘনই করে বসেছে৷ আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে মুখ দিয়ে উল্লাসের ব্যাপারে যা আসছে তাই বলছে৷”
“আজ ৫০তম ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হয়েছে। তাই একটা পার্টি অরগানাইজ করা হয়েছে৷ উল্লাস উইস্কির গ্লাসে চুমুক বসিয়ে তার থেকে কিছু দূরে থাকা নিবেদিতা আর চন্দ্রা’কে খেয়াল করছে৷ বিশেষ করে নিবেদিতাকে। নিবেদিতা’র পাগলামি ভালোই চোখে পরছে উল্লাসের৷ ভালো করে বুঝতে পারছে নিবেদিতার মাতাল অবস্থা৷ কেমন এলোমেলো ভাবে নাচতে শুরু করেছে৷ উল্লাস সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে৷ নিবেদিতা’কে একদম সহ্য করতে পারেনা৷ ম্যাচিউরিটির বালাই নাই তার মাঝে৷ আর সে মেয়ে ডিফেন্সের ট্রেনিং নিয়েছে৷ কেয়ারলেস এমন একজন কিভাবে সোলজার হতে পারে উল্লাসের অজানা৷ গ্লাসে শেষ চুমুক বসিয়ে গ্লাস খালি করে গ্লাসে আবার উইস্কি ভরতি করে নিয়ে তার মাঝে বরফের দুই টুকরো ঢেলে দিলো৷ গ্লাস নিয়ে পিছু ফিরতে উল্লাস ভড়কে যায়৷ ভড়কে যাওয়ার ফলে গ্লাস থেকে কিছু খানি উইস্কি উল্লাসের ব্লেজারে এসে পড়ে৷ উল্লাস চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিবেদিতা উল্লাসের একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। উল্লাস নিজেকে সামলে নিয়ে চোখমুখ শক্ত করে নিবেদিতা’র মুখের দিকে তাকায় থাকে৷ নিবেদিতা ভ্যাবলাকান্তের মতো ড্যাবড্যাব করে উল্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিবেদিতার তাকানো দেখে উল্লাস গম্ভীর গলায় বলে, কিছু বলবে? নিবেদিতা উপর নিচ মাথা দুলিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে, ইয়েস স্যার। তার এতো জোরে শব্দে উল্লাসের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো। উল্লাস হাত দিয়ে কান ঘষে বিরক্তি গলায় বলে, বলো? নিবেদিতা কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতে কেউ একজন উল্লাসকে ডেকে উঠে। উল্লাসকে ডাকার ফলে নিবেদিতা রাগান্বিত গলায় বলে, কোন বেয়াক্কলে ডাকে রে? নিবেদিতার কথায় উল্লাস অপ্রস্তুত হয়ে যায়৷ যে ডেকেছে সে একজন সিনিয়র অফিসার। নিবেদিতার মুখে এমন কথা শুনলে তিনি নির্ঘাত নিবেদিতাকে পানিশমেন্ট দিবে। উল্লাস চাপা গলায় বলে সাটাপ। এখানে দাঁড়াও আমি আসছি। নিবেদিতা স্যালুট মেরে উচ্চ গলায় বলে, ইয়েস স্যার। নিবেদিতার এমন কান্ডে উল্লাসের প্রেশার যেন হাই হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঝাড়া দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
“পনেরো মিনিট বাদে উল্লাস আগের জায়গায় ফিরে আসে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিবেদিতাকে খুঁজতে থাকে। কোথাও দেখতে না পেয়ে ভাবে হয়তো চলে গিয়েছে৷ উল্লাস নিজ কাজে মনোযোগ দেয়৷ তখন হন্তদন্ত হয়ে চন্দ্রা আসে৷ চন্দ্রা উল্লাসকে স্যার বলে ডেকে উঠে৷ তার ডাকে উল্লাস মাথা তুলে তাকায়। চন্দ্রাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে উল্লাস চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,
” কিছু হয়েছে?
চন্দ্রা ঘাবড়ানো গলায় বলে,
” নিবেদিতাকে কোথাও পাচ্ছিনা স্যার।
চন্দ্রার কথা শুনে উল্লাসের কপালের দুপাশের রগ ধপধপ করে উঠে৷ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বলে,
“কি বলছো? আশপাশে ভালো করে দেখেছো?
চন্দ্রা হাঁপানো গলায় বলে,
” জ্বী স্যার আশপাশ দেখেছি।
উল্লাসের চিন্তা গাঢ় হয়ে উঠে৷ রাগী গলায় চন্দ্রাকে ধমক দিয়ে বলে ,
” ও’কে এই অবস্থায় একা রেখে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
উল্লাসের ধমকে চন্দ্রা শিউরে উঠে।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু এসে ওকে আর পাচ্ছিনা।
চন্দ্রা এবার কেঁদেই ফেললো। চন্দ্রার কাঁন্না দেখে উল্লাস মিইয়ে যায়। শান্ত গলায় বলে,
” শান্ত হও৷ তুমি ওইদিকে যাও।আমি এইদিকে যাচ্ছি৷ আর পেলে আমায় ইনফর্ম করিও। ওকে?
“চন্দ্রা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে। তারপর দুইজন দুইদিকে চলে যায়৷ চন্দ্রা একেক এক করে সবার থেকে নিবেদিতা’র খোঁজ করতে থাকে৷ কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি। তার খোলা দিতে পারছেনা৷ চন্দ্রার অবস্থা বেগতিক। ভয়ে হাত পা কাঁপছে৷নিবেদিতার আবার কোন অঘটন ঘটলো নাতো৷ উল্লাসও তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে যেনো গায়েব হয়ে গেলো৷উল্লাসের এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে।কেন ওই অবস্থায় সে নিবেদিতা একা রেখে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো৷ ভিতরে ভয় দাঁনা বাঁধা শুরু করেছে৷ উল্লাস চিৎকার করে নিবেদিতা বলে ডেকে উঠে৷ একটা জঙ্গলের সামনে এসে দাঁড়ায় উল্লাস৷ হাঁপিয়ে উঠেছে৷ কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। একটু দম নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে নিবেদিতা বলে চিৎকার করে উঠে।
” আমি এখানে।
উল্লাসের কানে আওয়াজ আসতে উল্লাস সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আশপাশ তাকায়। কিন্তু কোথাও কারো অস্তিত্বের খুঁজ মিললোনা। উল্লাস আবারও নিবেদিতাকে ডেকে উঠে।
“আমি এদিকে স্যার। লেফট, লেফট।
চারদিকে অন্ধকার৷উল্লাস নিবেদিতার আওয়াজ অনুধাবন করে এগোতে থাকে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে। একপর্যায়ে একটা জায়গাতে এসে থেমে যায়।জঙ্গলের ওপারে খোলা মাঠা।ঘাস বেশ লম্বা লম্বা। অন্ধকারের মাঝে জোনাকি পোকার মিলন মেলা বসেছে জেনো আজ। ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে নিবেদিতার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে৷ নিবেদিতা দু’হাত মিলে ঘুরছে৷ অন্ধকারে এই পথ দিয়ে যদি কোন মানুষ যায় তবে সে নির্ঘাৎ অশরীরী ভেবে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতো৷ উল্লাস নিবেদিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ তারপর ধমকের গলায় বলে, তুমি এখানে কি করছো?
উল্লাসের কথায় নিবেদিতা উল্লাসের দিকে আঙ্গুল তাক করে ধরে উল্লাসের কথা রিপিট করে বলে,
” তুমি এখানে কি করছো?
নিবেদিতার কথায় উল্লাস গম্ভীর গলায় বলে,
“নিবেদিতা…
উল্লাসের ডাকে নিবেদিতা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে।উল্লাসের দুই কদম সামনে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মাথা চক্কর দেওয়ার ফলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। নিবেদিতা পায়ের সাথে পা লেগে পরে যেতে নিলে উল্লাস নিবেদিতাকে শক্ত করে ধরে ফেলে কিছুটা নিচের দিয়ে ঝুকে৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট দুইজনের মুখ বরাবরে পরছে৷ নিবেদিতা তার নেশা চোখে উল্লাসকে দেখতে থাকে৷উল্লাস নিবেদিতা নেশা চোখে তাকায়। এ চোখ তাকে যেনো কিছু বলতে চায়৷ কিন্তু কি সেটা সে ধরতে পারেনা৷ নিবেদিতা উল্লাসের শার্ট খামচে ধরে ঝিমিয়ে পরা গলায় বলে,
” আপনি খুব সুন্দর৷
কথাটা বলে উল্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিবেদিতা চোখ বুজে ফেলে৷ আর উল্লাস বাকরুদ্ধ হয়ে নিবেদিতার মুখপানে চেয়ে রই৷ নিবেদিতার এই একলাইন কথা উল্লাসকে জেনো অনেক কিছু বলে দিয়েছে৷ উল্লাস শুকনো ঢুগ গিলে৷ বুকের মাঝে হঠাৎ কেমন করে উঠে৷ জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকা কিছু পোকামাকড়ের অদ্ভুত শব্দ কানে আসাতে নিস্তব্ধতা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু উল্লাসের কোন ভাবান্তর নেই৷
(চলবে)
#আমারে_দিলোনা_ভুলিতে৷
#পর্ব_১।
#লেখা_আরজুমান_তাশা৷