#আমারে_দিলোনা_ভুলিতে৷
#পর্ব_২।
#লেখা_আরজুমান_তাশা।
“নিবেদিতা গভীর ঘুমে আছন্ন।সে ঘুমের মাঝে নিবেদিতা কেমন একটা ছটফট করছে৷এদিকে পুরো শরীর ঘেমে একাকার৷ হঠাৎ এলার্মের কড়া শব্দে নিবেদিতা ধপ করে উঠে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে৷ মাথা উপর করে সিলিংফ্যানের দিকে তাকায়। ফ্যান চলছে তার আপন গতিতে। হাত দিয়ে ঘাড় আর মুখের ঘাম মুছে নিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে শুকনো ঢুক গিলে৷গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে পাশে রাখা ডেক্সের উপর থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে থাকে৷ পানি পান করা শেষ করে চোখ বন্ধ করে গাঢ় একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে৷এরপর ঘড়ির দিকে তাকালে দেখে ভোর পাঁচটা বাজে। সময় দেখে আগপিছ আর কিছু না ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়৷ তারপর বেড়িয়ে পরে জগিংয়ের উদ্দেশ্যে৷ এটা নিবেদিতার রেগুলার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নিবেদিতা দৌড়াচ্ছে খুব জোরে। ওর দৌড়ানো দেখে মনে হচ্ছে সে কেউ একজন থেকে পালাচ্ছে৷ চোখের সামনে কিছু স্মৃতি ভাসমান হবে ভাসছে। নিবেদিতা সেসব ইগনোর করতে চাইছে কিন্তু পেরে উঠছেনা। বরং সেসব স্মৃতি আরো প্রানবন্ত হয়ে নিবেদিতাকে ঘিরে ধরছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠে নিবেদিতা একসময় দাঁড়িয়ে যায়।হাটুতে দুইহাত দিয়ে ভর দিয়ে রুকুতে যাওয়ার মতো হয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঝাড়া দিয়ে বেমানান স্মৃতিগুলোকে আর প্রানবন্ত হতে দিলোনা। চোখ খোলে মেরুদণ্ড বরাবর হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাড়ের ঘাম মুছে নিয়ে পানি পান করে নেয়। তারপর মাথায় জ্যাকেটের হুডি টেনে দিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে হাটতে থাকে৷
” আজ অনেক তোরজোর চলছে।কেউ ফ্রিতে বসে নেই৷ সবাই কাজে ব্যস্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আজ একটা ভাষণ সভা রয়েছে। তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী’র সিকিউরিটি নিয়ে সবাই এলার্ট।তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একভাগ সেনাবাহিনীর আন্ডারে।আরেক ভাগ র্যাবের আন্ডারে।আর অন্য ভাগ পুলিশের আন্ডারে।
” চার দিকে কড়া নজর রাখছে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। কারোর একটা মিস্টেক করার সুযোগ নাই৷ কেউ যদি মিস্টেক করেও বসে তবে তার রক্ষে নেই।অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে।দলে দলে মানুষ ছুটে এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী’র বক্তৃতা শোনার জন্য৷ নিবেদিতা কন্ট্রোল রুমে থেকে একে একে সব সৈন্যকে এলার্ট করে দিচ্ছে। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসার সময় হয়ে গিয়েছে। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে। পাঁচবছর আগের নিবেদিতা’র সাথে বর্তমানের নিবেদিতার অনেক তফাৎ।নিবেদিতার গায়ে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম৷চুলগুলো খোপা করা৷ হাতে একটা ঘড়ি৷ আগের নিবেদিতা ছিলো প্রানচঞ্চল লাইফের কোন কিছু নিয়ে সে সিরিয়াস ছিলোনা৷সবসময় মজা মাস্তিতে সময় পাড় করতো৷ কিন্তু বর্তমানে নিবেদিতা পুরো প্রফেশনাল৷এখন তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে যেনো সিরিয়াসনেস। গাম্ভীর্য নিবেদিতার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷বিনা কারণে কেউ তার সাথে কোন ধরনের শব্দ করতে পারেনা। মনিটরের সামনে যারা বসা তাদেরকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে বলে, যাতে কোথাও কোন ভুল না থাকে। নিবেদিতা তার কাজ করছিলো তখন একজন সেনা কর্মকর্তা এসে নিবেদিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আশিক রিপোর্টিং ম্যাম।
কথাটা শুনে নিবেদিতা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়৷ একজন সেনা কর্মকর্তা স্ট্রেইট হয়ে শিনা টানটান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে নিবেদিতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,
” ইয়েস।
“আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে৷
” তুমি যাও। আমি আসছি।
আশিক চলে যেতে নিবেদিতা আরেকবার সিসি ক্যামেরার দিকে নজর বুলিয়ে বাহিরে বের হয়ে আসে। কন্ট্রোল রুম থেকে বের হয়ে সামনে তাকাতে নিবেদিতা সেখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়৷মুহূর্তে পুরো শরীর জুড়ে একটা কাঁপন বয়ে যায়। নিবেদিতা বাকরুদ্ধ হয়ে সেখানে ঠাঁই মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে। মানুষটা একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে। মুখে ঘনগোঁফ।চোখে চশমা। পরনে সিভিল ড্রেস। নিবেদিতা একপাশ দেখে অনুমান লাগিয়ে দিয়েছে।আর সেটাই সত্য হয়েছে যখন মানুষটা নিবেদিতার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। নিবেদিতার মনে হলো সে বিদ্যুতের ঝটকা খেয়েছে৷ পা অবশ হয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়৷ সামনে আর কেউ না,উল্লাস দাঁড়িয়ে আছে৷ সে উল্লাস, যাকে সে পাঁচ বছর ধরে চোখে দেখেনি৷পাঁচ বছর আগে একদম হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারেনি৷ নিবেদিতা অনুভব করে তার বুকে একটা ব্যথা হচ্ছে। চিন চিন ধরনের।
উল্লাস চোখের চশমা খোলে নিবেদিতার কাছে এসে দাঁড়ায়৷ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“হ্যালো, নিবেদিতা৷
নিবেদিতা এতক্ষণ যেনো একটা কল্পনায় বাস করছিলো। উল্লাসের গলার স্বর শুনে নিবেদিতার হুশ হয়৷ অপ্রস্তুত হয়ে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেয়৷নিবেদিতা অবিশ্বাস্য ভাবে ঘোর লাগা চোখে উল্লাসের মুখপানে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বলে,
” হ্যালো!
উল্লাস নিবেদিতার মুখের দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে নিবেদিতাকে পর্যবেক্ষণ করে৷ নিবেদিতাকে অনেকটা প্রাণহীন মনে হচ্ছে৷ দুইজন চুপচাপ দুজনকে দেখতে থাকে। তখন তাদের মাঝে উপস্থিত হয় মেজর জেনারেল জয়নাল। সে এসে দুজনের ইন্ট্রডিউস করে দিতে চাইলে উল্লাস বলে,
” তার প্রয়োজন বলে, স্যার তার প্রয়োজন নেই৷ আই নো হার।
কথাটা শুনতে নিবেদিতা জলদি উল্লাসের থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। উল্লাসের কথা শুনে মেজর জয়নাল নিবেদিতা বলে,
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিশেষ রিকুয়েষ্টে মেজর উল্লাস এখানে এটেন্টড করেছে৷এখানের সব কিছুর দায়িত্ব তার উপর। তুমি তাকে তার কাজে সাহায্য করবে।
কথাটা শোনা মাত্র নিবেদিতা শিনা টান করে স্ট্রেইট হয়ে দাঁড়িয়ে তার দুহাত পিছনে রেখে বলে,
” ইয়েস স্যার।
মেজর জয়নাল হাসিমুখে উল্লাসের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,
“নিবেদিতা আপনাকে সব বুঝিয়ে দিবে। হেভ এ গুড ডে ক্যাপ্টেন।
উল্লাস জবাবে হেসে বলে,
” সেম টু ইউ৷
মেজর জয়নাল চলে গেলে নিবেদিতা বলে,
“প্লিজ, কাম স্যার৷
উল্লাস একবার নিবেদিতার মুখের দিকে তাকায়। একটু আগে নিবেদিতাকে মেঘের মতো মনে হয়েছিলো। যেন একটু ছুঁয়ে দিলে মেঘ জল হয়ে ঝরে পরবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিবেদিতাকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা মূর্তি। উল্লাস সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে চশমা পড়ে নিয়ে সামনে হাটা শুরু করে। আর তার কয়েক কদম পিছনে নিবেদিতা৷ দুইজন কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করতে কন্ট্রোল রুমে থাকা সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে উল্লাসকে স্যালুট করে৷ উল্লাস অল্প হেসে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে নেয়। তারপর একে একে সব কিছু জেনে নেয়৷ তারা তারা দুজন বের হয়ে গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায়। দুইপাশে সেনাবাহিনীর অনেক সৈন্য৷ এই মাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এসে পৌছেছেন। সাংবাদিক, জনগণের ভীড়ে রমরমা অবস্থা৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গাড়ি থেকে নামতে তাকে ফুলের তোরা দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়৷ আর উপস্থিত সকল সৈন্য একসাথে স্যালুট করে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী উল্লাস আর নিবেদিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। উল্লাসকে দেখে হেসে উল্লাসের কাধে হাত রেখে বলে,
“তোমায় দেখে অনেক খুশি হলাম।
উল্লাস স্ট্রেইট হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” থ্যাংক ইউ স্যার৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী র সাথে উল্লাস আর নিবেদিতা হাটতে থাকে৷ উল্লাস একবার নিবেদিতার মুখের দিকে তাকায়। নিবেদিতার চেহারায় গাম্ভীর্যের চাপ৷ পুরো মুখে গম্ভীরতা ছাড়া আর কিছু নেই। উল্লাস পুরোটা সময় ধরে নিবেদিতাকে পর্যবেক্ষণ করে। এক সেকেন্ডের জন্যেও নিবেদিতাকে হাসতে দেখেনি৷ এটা যেন পুরো একটা রোবট দেখেছে উল্লাস।
“নিবেদিতা তার ডিফেন্সের কাপড়ে হস্পিটালে এসে পৌছেছে৷ হস্পিটালের অনেক লোকজন নিবেদিতার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে৷ এসবে নিবেদিতার কোন আগ্রহ নেয়। সে সোজা একটা চেম্বারে গিয়ে ঢুকে।চেম্বারটা চন্দ্রার৷ চন্দ্রা ডিফেন্সের ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি ডাক্তারী পড়াশোনাও করেছে৷ ডিফেন্সের ট্রেনিং নিলেও প্রফেশনাল হিসেবে বেছে নিয়ে ডাক্তারী৷ চন্দ্রা একজন সাইকোলজিজ৷ নিবেদিতাকে দেখে চন্দ্রা হন্তদন্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে নিবেদিতার কাছে এসে দাঁড়ায়। নিবেদিতা বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ চন্দ্রা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? আর ইউ ওকে?
নিবেদিতা কিছু না বলে চন্দ্রার চেম্বারে থাকা সোফায় গিয়ে বসে পড়ে৷ নিবেদিতার সাথে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরে চন্দ্রা যথেষ্ট শান্ত হয়ে নিবেদিতার পাশে গিয়ে বসে৷ নিবেদিতা দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে৷ চন্দ্রা নিবেদিতার পিঠে হাত রাখে৷ চন্দ্রার স্পর্শ পেয়ে নিবেদিতা মাথা তুলে চন্দ্রার দিকে চেয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বলে,
“উল্লাস স্যার ফিরে এসেছে৷
কথাটা,শুনা মাত্র চন্দ্রা শকড হয়ে যায়। সে বুঝতেই পারলোনা কখন তার হাত নিবেদিতার পিঠ থেকে সরে গিয়েছে। চন্দ্রা হা করে নিবেদিতার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। চন্দ্রা অবিশ্বাস্য গলায় বলে,
” আর ইউ সিউর!
নিবেদিতা কয়েকসেকেন্ডে চন্দ্রার মুখের দিকে চেয়ে থেকে মাথা নিচু করে মেঝের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখে৷ নিবেদিতা সত্য বলছে বুঝতে পেরে চন্দ্রা বলে,
“ডিটেইলসে বল।
নিবেদিতা তখন সব খুলে বলে৷ নিবেদিতার মুখে সব শুনে চন্দ্রা শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
” উনি এতোদিন কোথায় ছিলো তা কি জানতে পেরেছিস?
নিবেদিতা ছোট করে হু বলে জবাব দেয়৷ চন্দ্রা কিউরিওসিটি থেকে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায়?
নিবেদিতা মুখ তুলে চন্দ্রার মুখের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলে,
” ইন্ডিয়ায়।
চন্দ্রা জবাব শুনে হা করে নিবেদিতার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আর নিবেদিতা চন্দ্রার মুখের দিকে৷
(#চলবে….)