আমারে দিলোনা ভুলিতে পর্ব ৩

#আমারে_দিলোনা_ভুলিতে।

#৩য়_পর্ব।

#লেখা_আরজুমান_তাশা।

“উল্লাস তার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে। প্রায় অনেক্ষণ ধরে শাওয়ার নিতে থাকে। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে মাথা মুছতে মুছতে মোবাইল হাতে নিয়ে কল লিস্টে গিয়ে উশান নামে ক্লিক করে৷ দুইবার রিং হতে কল রিসিভ হয়ে যায়৷ওপাশ থেকে হ্যালো বলতে উল্লাস সোজাসাপটা বলে,
” তুই ফ্রি আছিস?

ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
“হ্যাঁ৷
” তাহলে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়৷
“ওকে।
” বাই।

উল্লাস কল কেটে দিয়ে একটা টিশার্ট পরিধান করে নেয়৷ তারপর কিচেন গিয়ে নিজের জন্য চা বানিয়ে নেয়৷ প্রায় আধাঘন্টা পর উশান এসে হাজির হয়৷ উল্লাসকে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকতে দেখে উশান প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস?

উশানের কথা শুনে উল্লাস সোজা হয়ে বসে হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে ক্লান্ত গলায় বলে,
“হ্যাঁ ঠিক আছি৷ শুধু হাল্কা মাথা ব্যথা।

উশান সোফায় বসে চোখমুখ শক্ত করে বলে,
“হেয়ালি না করে সোজাসাপ্টা বল।

উল্লাস উদাস হয়ে সোফায় হেলান দেয়। দৃষ্টি তার উপরের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে উদাস গলায় বলে,
” নিবেদিতার কথা মনে আছে?

উশান মুখে সফটড্রিংক্স ঢালতে নিচ্ছিলো। নিবেদিতা নামটা শুনে থ মেরে উল্লাসের দিকে তাকিয়ে। তারপর মনে করার চেষ্টা করে বলে,
” পাঁচবছর আগে ট্রেনিং দিতে গিয়ে যার প্রেমে পরছিলি সে?

উল্লাস উশানের দিকে ঝুকে ভারাক্রান্ত গলায় বলে,
“হ্যাঁ৷

উশান এবার মুখে ড্রিংকস ঢেলে বলে,
” হ্যাঁ মনে আছে। তো কি হয়েছে?
“ওর সাথে কাকতালীয় ভাবে আমার আজ মিট হয়ে গিয়েছে।

কথাশুনা মাত্র উশান বিষম খেয়ে বসে৷ ড্রিংকস নাকে ছড়ে যায়। কাশতে কাশতে বলে,
” কিভাবে?

উল্লাস ঈষৎ হেসে বলে,
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রোগ্রামে।
উশান টিস্যু দিয়ে তার নাক মুখ মুছতে মুছতে বলে,
” ও সেখানে কি করছে?
উশানের কথায় উল্লাস বিরক্ত হয়ে বলে,
“গাধার মতন কথা বলিস না।

উশান নিজের বোকামি বুঝতে পেরে বলে,
” ওহ সরি।

উল্লাস কিছুটা দম নিয়ে বলে,
“জানিস আগের নিবেদিতার সাথে আজকের দেখার নিবেদিতার কোন মিল আমি খুঁজে পেলাম না।

উশান আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
” কেমন?

“অনেক বদলে গিয়েছে সে।ওর বিহেভ বদলেছে। এটিটিউড বদলেছে। ওর লুক বদলেছে৷ আগের সে বাচ্চামোর ছিটেফোঁটা নেই৷ আজ সারাদিন থাকে দেখে মনে হচ্ছিলো ও একটা আস্ত রোবট। কোন প্রাণ নেই তার মাঝে৷ আগে বন্ধুদের আড্ডার মাঝে থাকতো৷ সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকতো৷ কিন্তু এখন হাসির বালাই নেয় তার মাঝে৷ মাঝে মধ্যে শুধু ফর্মালিটির জন্য সে হেসেছে। সে হাসিতে ছিলোনা কোন সতেজতা। আর আমাকে দেখে কোন প্রকার কোন রিয়েক্ট সে করেনি৷ মনে হচ্ছিলো সে আমায় প্রথমবার দেখেছে৷

উল্লাসের কথা শুনে উশান সন্দেহ চোখে উল্লাসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” সত্যি করে বলতো,কাকতালীয় ভাবে তোদের দেখা হয়েছে নাকি তুই নিজ ইচ্ছায় দেখা করতে গিয়েছিস?

উশানের কথায় উল্লাস কিছুক্ষণ উশানের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। উশানের কাছে ধরা পরে গিয়েছে বুঝতে পেরে উল্লাস হার মেনে নিয়ে বলে,
“ওকে ফাইন।আমি নিজ ইচ্ছায় নিবেদিতার সাথে দেখা করতে গিয়েছি৷ বিকজ আই লাভ হার৷ এন্ড আই অলসো মিস হার।

উল্লাসের কথায় উশান আয়েশ করে বসে পিঞ্চ মেরে বলে,
” আমার সামনে বসে ভালোবাসার বুলি উড়াইলে হবে? যাকে ভালোবাসিস তাকে তো বলছিস না৷

উল্লাস ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আটকে যায়৷

উল্লাসের সমস্যা বুঝতে পেরে উশান বলে,
” ভালোবাসার ক্ষেত্রে বয়স মেটার করেনা৷ আর তোর যে লুক তাতে তো বয়স বুঝায় যায়না৷ তাছাড়া তোর আর নিবেদিতার বয়সের ব্যবধান আর কতই বা? তুই শুধু শুধু তিল কে তাল বানাচ্ছিস……

উল্লাস দুইহাত দিয়ে মুখ ঘষে ভারী গলায় বলে,
“সবকিছু এখন বদলে গিয়েছে। আগের মতো কিছু নেই৷ হয়তো নিবেদিতার যে অনুভূতি আমার প্রতি ছিলো সেটাও৷ আর আমি ওই মুহূর্তে কোন কিছু তিল কে তাল বানায়নি। আমি শুধু নিবেদিত এড়িয়ে চলেছি৷ ওর তখন যে বয়সটা ছিলো তখন কোনটা ভালোলাগা আর কোনটা ভালোবাসা তা বুঝার ছিলোনা৷ তাই আমি সবসময় বুঝেও না বুঝার মতো করে ওকে এড়িয়ে চলেছি। কিন্তু নিবেদিতা এড়িয়ে চলতে চলতে আমি ও’কে ভালোবেসে ফেলেছি৷

উশান চুপচাপ তার বন্ধুর কষ্টটা অনুভব করছে৷যারা ভালোবাসায় ব্যর্থ হয় তাদের সান্ত্বনাতে কোন কাজ হয়না। উল্টো উশানের কাছে মনে হয় কাঁটা গায়ে নুনেরছিটে মারা হচ্ছে৷ তাই উশান চুপ থেকে উল্লাসকে পর্যবেক্ষণ করছে৷

” হুইসেলের শব্দ বেজে উঠতে সব স্টুডেন্টরা আয়েশের ঘুমের বিছানা ছেড়ে উঠে বসে৷ চটজলদি রেডি হয়ে মাঠে উপস্থিত হয়৷ সারিবদ্ধ হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে৷ উল্লাস সবার সাথে নিজের ইন্ট্রডিউস করিয়ে নেয়৷ নিবেদিতা সবে ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে। মাঠে স্টুডেন্টের সাথে উল্লাসকে দেখে একজন সৈন্যকে ডেকে নিবেদিতা প্রশ্ন করে,
“উনি….!
পুরো কথা শেষ করতে পারলোনা। তার আগে সেনা বলে,
” নতুন ট্রেনার। আজ থেকে উনি ট্রেইন করবেন।

নিবেদিতা আর কিছু না বলে একবার উল্লাসের দিকে চেয়ে নিজের কাজে চলে যায়৷ নিবেদিতা প্রবেশ করতে উল্লাস নিবেদিতাকে লক্ষ্য করেছে৷ নিবেদিতার প্রফেশনাল নিয়ে সিরিয়াস দেখে উল্লাস জানপরানই অবাক৷ নিবেদিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে উল্লাস স্টুডেন্টের মাঝ থেকে একজনকে ডেকে প্রশ্ন করে,
” তোমাদের নিবেদিতা ম্যাম কেমন? তোমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করেন?

ছেলেটা হতাশ গলায় বলে,
“ম্যাম অনেক স্ট্রিট৷ ম্যামকে এখানে সবাই মানে৷ যারা রুলস ফলো করেনা তাদের অনেক পানিশ করে৷আর যারা বিনা কারণে ঝগড়া করে তাদেরকেও খুব কড়া পানিশমেন্ট করা হয়৷ এখানের প্রতিটা স্টুডেন্ট ম্যাম কে যমের মতো ভয় পায়৷

” ওকে যাও৷ লাইনে গিয়ে দাঁড়াও৷

নিবেদিতা করিডোরে দাঁড়িয়ে থেকে উল্লাসকে দেখছে। উল্লাস প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সিরিয়াস৷ এখনো সে সিরিয়াসনেস কাজ করছে। উল্লাসকে দেখে নিবেদিতার প্রশিক্ষণের সময়টা মনে পরছে৷ উল্লাসকে প্রথম দেখাতে নিবেদিতার ভালো লেগে যায়। প্রথম দেখাতে ভালোবাসা৷ নিবেদিতা ছিলো অনেকটা উড়ন্ত পাখির মতো৷ আর অনেকটা জেদিও বটে। নিবেদিতার একটা সমস্যা ছিলো,তার ঘাড়ের রগ টা অনেকটা ত্যাড়া টাইপের৷ ঝগড়ায় কেউ পেরে উঠেছে কিনা সন্দেহ আছে৷ একদিন অন্য ক্যাম্পের কিছু ছেলে নিবেদিতার সাথে মিসবিহেভ করে। নিবেদিতা এবং তার সাথের কয়েকজনকে কটাক্ষ করে কথা বলে৷ যদিও প্রথম দিকে সেসব ইগনোর করে৷ কিন্তু যখন বাজে ভাবে টাচ করার চেষ্টা করে তখন নিবেদিতা রক্ত মাথায় চড়ে বসে। ব্যস, হাতের পাশে একটা সিলভারের বালতি ছিলো সেটা তুলে একটা ছেলের মাথায় আঘাত করে বসে। তার সাথে যারা ছিলো সেসব ছেলে যখন এগিয়ে আসে নিবেদিতা হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে। নিবেদিতার দেখাদেখিতে বাকি যাদেরকে টিজ করা হচ্ছিলো তারাও ছেলেদের পেটাতে থাকে৷ ক্যাম্পের ভিতর একটা গন্ডগোল লেগে যায়৷ আর সেখানে উপস্থিত হয় উল্লাস সহ আরো কয়েকজন সিনিয়র অফিসার৷ যখন উল্লাস আসে তখন দেখে যাদের মধ্যে গন্ডগোল লেগেছে তাদের সবাই কাদাতে মাখো মাখো৷ উল্লাস সব দেখে রাগে হুংকার দিয়ে থামতে বলে৷ সবাই থেমে গেলেও নিবেদিতা থামার নাম নেয়নি৷ তার রাগটা কমছিলোনা। নিবেদিতা থামছেনা দেখে উল্লাস নিজে গিয়ে নিবেদিতাকে আকড়ে ধরে। কৌশলে নিবেদিতার হাতে এবং পায়ের কনুইতে আঘাত করে নিবেদিতাকে বসিয়ে দেয়৷ উল্লাস পিছন দিক থেকে নিবেদিতা ঘাড় চেপে ধরে বলে। নিবেদিতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে চাইলে উল্লাস হুংকার দিয়ে বলে,
“আই সে স্টপ।
নিবেদিতা দমে যায়৷ কিন্তু তখন রাগে ফুস ফুস করছিলো সে৷

যাদের সাথে সমস্যা হয় তাদের সবাইকে ডাকা হয়। নিবেদিতাকে প্রশ্ন করা হয়,এমন করার কারণ? তখন নিবেদিতা বলে,
” আমরা ডিফেন্সে এসে ভর্তি হয় আমাদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য৷ নিজের দেশকে নিজের দেশের মানুষকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য৷ আমরা নিজেদেরকে তৈরি করি যাতে আমাদের দেশ সমাজ দেখে ক্রাইম দূর করতে পারি৷ কিন্তু সে ক্রাইম যদি এখানেই হয়ে থাকে তবে কি করা উচিত?

“উল্লাস বলে,
” হুয়াট ডু ইউ মিন?

জবাবে নিবেদিতা কাটকাট গলায় বলে,
“যারা ডিফেন্সে জব করে তাদের প্রধান ধর্ম হচ্ছে দেশ রক্ষা করা। ইভটিজিং অনেক ভয়াবহ একটা ব্যধি। এটি নিরাময় করতে আইন করা হয়েছে। কিন্তু যদি এখানেই মেয়েদের সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্ট করা হয় তবে কি করা উচিত৷ ওরা তো এখানে থেকে মেয়েদের সাথে খারাপ, নোংরা আচরণ করছে৷তাহলে ভবিষ্যতে তারা যখন হাতে পাওয়ার পাবে তখন তারা কোন পর্যায়ে যাবে? আমি শুধু নিজেকে রক্ষা করেছি৷ আর তাদের বুঝিয়েছি আমরা মেয়ে বলে আমাদের যেনো খেলনা মনে না করে৷ আমরাও নিজেদের রক্ষা করতে পারি। আর আমাদের দিকে খারাপ নজরে থাকালে তার মুখ্যম জবাব ও দিতে পারি।

তখন বিচারকের একজন বলে,
” তোমরা তো কমপ্লেইন ও করতে পারতে৷
নিবেদিতার সোজা জবাব,
“তখন যেটা,ঠিক মনে হয়েছে আমি সেটা করেছি৷আমি বা বাকি মেয়েরা সেখান থেকে চুপচাপ চলে আসতাম তবে তারা সাহস পেয়ে যেতো।আর তারা কখনো আমাদের কমপ্লেইন করার সুযোগ দিতোনা। একটা প্রবাদ আছে স্যার, মানুষ শক্তের ভক্ত নরমের যম৷

বিচার কার্য করার জন্য যারা বসেছে তারা সবাই রিয়েলাইজ করে নিবেদিতা আর বাকি মেয়েদের কোন দোষ নেই। দোষ ছেলেগুলোর। আর তাদের রেডমার্ক দিয়ে তাদের সেনা ক্যাম্প থেকে বিতারিত করা হয়৷ আর বাকি মেয়েদের কিছু না বললেও নিবেদিতাকে পানিশমেন্ট দেওয়া হয়। সিনিয়র অফিসারের কথা না শুনার জন্য৷ নিবেদিতা কিছু বলেনা৷ চুপচাপ সাজা স্বীকার করে নেয়৷ আর উল্লাস ওই মুহূর্তে বুঝে যায় নিবেদিতা ভীষণ রকমের জেদি আর একরোখা স্বভাবের৷

(#চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here