গল্প: আমার গল্পে শুধু তুমি
লেখক :হাচনাইন হোসেন সাব্বির
পর্ব:২৪ ও শেষ পর্ব
অন্তী এবার যেন সকল কূল কিনারা হারিয়ে ফেলেছে।সে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে….
এখন এক মাত্র আল্লাহয় তাকে পথা দেখাতে পারে।এক মাত্র তিনিই পারেন তূর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে……
অন্তী সকালের আলো ফোটা মাত্র তিতিরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তিয়াশের দেওয়া ঠিকানায়।
অন্তী শহরের বাহিরে এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলো কিছুদিনের জন্য।অন্তত তূর্য যতোদিন এ শহরে থাকবে ততোদিন তো সে নিজেকে সব কিছুর থেকে আড়াল করে রাখাতে চেয়েছিলো।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর আল্লাহ করে আরেক।অন্তীর ক্ষেত্রে তাই-ই হয়েছে।
অন্তী যাত্রা পথে হাজার বারের চেয়েও বেশি ফোন করে ফেলেছে তিয়াশকে কিন্তু তিয়াশ একবারের জন্যও অন্তীর ফোন রিসিভ করে নি।না কল ব্যাক করেছে।
শুধু তিয়াশ কেন অন্তী বাড়িতে ও কয়েকবার ফোন করেছিলো কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি।অন্তীর মা ও অন্তীর ফোন ধরে নি।
অন্তী তূর্য থেকো দূরে যাওয়ার জন্য শহরের বাহিরে এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো।তূর্য ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে।নিজেকে সব কিছুর থেকে আড়াল করে রাখবে।
সন্তানের দাবী নিয়ে কখনো দাড়াবে না তূর্যর সামনে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো?সে বাঁচবে তো? অন্তী সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে প্রথমে ফিরে আসে নিজের বাড়িতে।
কিন্তু বাড়ি ফিরেই সে এক রকম অবাক হয়ে যায়।তাদের বাড়িতে ইয়া বড় একটা তালা ঝুলছে।এবার অন্তীর ভেতরটা ধক করে উঠে।গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
তাহলে কি সে যা ভয় করছিলো তাই হলো??তূর্যর কি কোনো ক্ষতি হয়ে গেলো?? এমন ভয়ংকর চিন্তা ভাবনায় অন্তীর হাটু ভেঙ্গে আসে।চোখ গড়িয়ে অঝোড় ধারায় পানি পড়তে থাকে।
এদিকে মায়ের এমন অবস্থা দেখে ছোট্ট তিতির ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু অন্তী কোনো জবাবই দিচ্ছে না। কি জবাব দেবে ঐ ছোট্ট পিচ্চিকে যে সে নিজের বাবাকে একবার ও বাবা ডাকার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো!! অন্তী আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাড়িয়ে তিয়াশের দেওয়া ঠকানায় চলে যায়।
অন্তী তিয়াশের দেওয়া ঠিকানা পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যে পড়ে যায়।অন্তী সেখানে গিয়ে সদর দরজা পেড়িয়ে ভেতর পর্যন্ত যেতেই দেখতে পায় দরজার সামনে তিয়াশ দাড়িয়ে আছে।
তিয়াশকে দেখে অন্তীর গলাটা আরো শুকিয়ে যায়।তিয়াশ বেশ দুঃখী দুঃখী মুখ করে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। অন্তী তিয়াশের কাছে গিয়ে তিয়াশের হাত চেপে ধরে,,, -তিয়াশ ভাইয়া বলো না প্লিজ তূর্য ভাইশয়া কোথায়??
-সরি??
-মানে??তূর্য ভাইয়া ঠিক আছে তো??বলো না?সরি বললে কেন??
-কি হলো বলো সরি বললে কেন??তূর্য ভাইয়া কোথায়?? অন্তী এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নাকটা টেনে নেয়। তিয়াশ কিছুক্ষন অন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বারিয়ে ভেতর দিকে ইশারা করে।
অন্তী আর কোনো দিকে না তাকিয়ে তিয়াশের দেখানো পথে ভেতর দিকে ছুট লাগায়। অন্তী ভেতরে গিয়ে অবাক।চার দিক হালকা অলো অন্ধকার খেলা করছে।অন্তী চারদিক একবার চোখ বুলায়।কোনো কিছুই সে ঠাউর করতে পারছে।
রাগে দুঃখে অন্তী খুব জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে! কিছুক্ষন কান্না করতেই চোখ যায় সামনের সিড়ির দিকে।সিড়ি বেয়ে কোনো একজন ছাড়া মানব অন্তীর দিকে এগিয়ে আসছে।অন্তী সেখানেই স্থীর হয়ে দাড়িয়ে আছে।সেই ছায়া মানব এসে অন্তীকে জড়িয়ে ধরে।
অন্তী কিছুক্ষন মূর্তির মতো দাড়িয়ে থেকে দুম করে সেই ছায়া মানবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অন্তীর সমস্ত ইন্দ্রীয়তে একটি কথায় প্রতিফলিত হচ্ছেএই তো পেয়েছি তোমারে
তিয়াশ এসে হটাৎ লাইট অন করতেই অন্তী তূর্য দুজনই চমকে উঠে…. অন্তী তূর্যকে ছেড়ে দিয়ে তূর্যকে খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করে…. তূর্যর কপালে ছোট্ট একটা কাটা দাগ ছাড়া কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
অর্থাৎ তিয়াশ যেমনটা ফোনে বলেছিলো তেমন কিছুই ঘটে নি। এবার অন্তী আবেগ ছেড়ে দিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে…. তিয়াশের দিকে এগিয়ে যায় -তিয়াশ ভাইয়া তুমি কি বলেছিলে ফোনে??হুহ….!!আমাকে মিথ্যা কেন বললে??
তিয়াশ তিতিরকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোনে দাড়িয়ে হিহি করে হেসে দেয় -অন্তু তোকে ঐ সব বললাম বলেই তো তুই এলি না হলে তো!! -তুমি??তুমি এরম কেন করলে??(কান্না করতে করতে)
-আরে আরে আমি কি করলাম সব কিছু তো তোর তূর্য ভাইয়াই….আই মিন তোর বর আর…. অন্তী চোখ মুখ খিচিয়ে তূর্যর দিকে তাকাতেই পেছন থেকে অন্তীর দাদী বলে উঠে,,, -আমার বুন্ধী।বুড়ি হলে কি হবে মাথা ভর্তি বুদ্ধী ঠিকিই আছে…..
অন্তী পেছন ফিরতেই দেখে অন্তীর মা দাদী বোনেরা আর শ্বাশুড়ি সবাই সেখানে আছে। এবার অন্তী একটু অবাক হয় নার্সিং হোমে সবাই।তারপর তিয়াশ এই ব্যাপারটা ও পরিষ্কার করে দেয় এটা কোনো নার্সিং হোম না এটা তাদের নতুন বাড়ি।
অনেক মান অভিমান রাগা রাগির মাঝে অন্তী তূর্য দুজনই দুজনের ভুল বুঝতে পারে।অন্যায় যে শুধু এক জনের ছিলো এমনটা না দুজনেই সমাম তালে নিজেদের ইগোকে বাধিয়ে রেখেছিলো।
রাত এগারো টা বেজে চল্লিশ মিনিট.. তূয বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।আর এদিকে অন্তী তিতিরকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্তীর ঘুম একটু আলগা হতেই চোখ যায় বিছানার পাশটা ফাঁকা।যদিও আজ তূর্য অন্তীর এক সাথে থাকার কথা কিন্তু তূর্য নেই।
অন্তী তিতিরকে রেখে একটু উঠে দাড়াতেই দেখে তূর্য বারান্দায় দাড়িয়ে স্মোক করছিলো অন্তী তূর্যর দিকে তাকিয়ে তূর্যকে বলে উঠে -আমার মতো আমাদের মেয়েরও কিন্তু স্মোক অ্যাল্যার্জি আছে….
-ওহ্ সরি!আমি আসলে….কিন্তু তুই আই মিন তু….তুমি এখানে কি করছিলে?তুমি না ঘুমাই গিয়েছিলা??
-ওওও তুমি কি এখানেই থাকবা নাকি?
-না তো!!আমি যাচ্ছি আসলে…..
-আসলে….
-আই লাভ ইউ….
-হুহ??(অন্তী অবাক হয়ে)
-এতোগুলো বছর তোকে ভালোবেসেছি…তোর কাছে আছে তবে কখনো তোকে বলা হয়নি!!
অন্তী অবাক হয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে আছে…. তূর্য অন্তীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।অন্তীও হাত বাড়িয়ে দিতেই তূর্য অন্তীকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় -আমাকে ক্ষমা করে দিস।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে। তোদের তবে আর কোনো দিন তোদেরকে কাঁদতে দিবো না কথা দিলাম….!!
অন্তী তূর্যকে জড়িয়ে ধরে…..
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন।সব কিছু স্বাভাবিক হলেও তিতির অস্বাভাবিক।তূর্যর সাথে প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও এখন দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেছে।আজকাল তিতির তূর্যকে ছাড়া না খেতে চায় না ঘুমাতে।অন্তী পড়ে গেছে মহা বিপদে।
মাঝ রাতে দুই বাবা মেয়ে মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে আইসক্রীম খাওয়া আবার সুযোগ বুঝে স্কুল ফাকিয়ে দিয়ে লং ড্রইভে যাওয়া কোনো কিছুই বাদ দিচ্ছে না তিতির তূর্য।তবে মাঝে মাঝে তিতির রেগে গেলে তূর্যকে পঁচা আঙ্কেল ডেকে ফেলে।এতে অবশ্য তিতির মজা পেলেও তূর্য খুব কষ্ট পায়।তবে কিছু করার নেই।
বর্তমানে তিতিরকে পায় কে…
তার যেকোনো আবদার রক্ষা করার জন্য তার পাপা চলে এসেছে।এখন আর কেউ তার দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বলবে না…তোর পাপা নেই…,তুই তো কখনো তোর পাপাকে দেখিসই নি!! তূর্যও এখন তিতির আর অন্তীকে জীবনের সব চেয়ে আনন্দময় সময় উপহার দিতে চায়।
আজকাল তিতিরের নতুন বায়না শুরু হয়ে গেছে…. তার না কি একটা ভাই লাগবে….তাও আবার দুদিনের মধ্যেই!!
ভাবা যায় এইসব!!
অন্তীর মাঝে মাঝে খুব হাসি পায় বাবা মেয়ের কান্ড দেখে… সেদিন তূর্য অন্তীর হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলেছিলো… তোমার এই সে বেস্ট প্রেমিক হতে পারে নি হয়তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড ও হতে পারি নি….তবে এখন বেস্ট হাসবেন্ডহবো আর সাথে বেস্ট বাবা ও হবো!আমার তিতিরের বাবা
সেদিন তূর্য আবার কেঁদেছিলো তিতিরকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলো!!
হয়তো সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে….সব না পাওয়া গুলোও পাওয়া হয়ে যাবে তবে যে সময়টা হারিয়ে যায় তা তো আর কখনো ফিরে আসে না!!
সমাপ্ত…..