আমার শহরে রংধনু উঠেনা পর্ব ১

বিয়ের ঠিক তিন দিনের মাথায় বিশাল প্রোগ্রামে বর্ষার স্বামী যখন সব গেস্টদের সামনে তাকে কা-জের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো,ওই সময় বর্ষা এতোটাই বাকরুদ্ধ হয়ে যায় যে মুখ ফুটে একটা শব্দ অব্দি বের হচ্ছিলো না।পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল তার। পা ঝিম মেরে যায়। মাথা ভোভো করতে শুরু করে। এমন অবস্থায় প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা মুখ ফুটে কিছু বলার শক্তিও তার মধ্যে ছিল না৷ শুধু নিরব আন্দোলনে দু’ফোটা অশ্রুমালা তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে। তার স্বামীর মতো ধনী নাহলেও বাবা-মায়ের আদুরে মেয়ে সে। মা বিয়ের আগ পর্যন্ত বাসায় তাকে কোন কাজ করতে দিত না পড়াশোনায় ব্যাহত ঘটবে বলে। অথচ তাকে কিনা শ্বশুড়বাড়িতে সার্ভেন্ট বলা হলো! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!

কিছু মুহূর্ত আগে যখন বর্ষা নাস্তার প্লেট নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো। তার চোখে পড়লো তার স্বামী তারই চোখের সামনে আরেকটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখেই হাসি লেগে আছে। চারপাশে সফট রোমান্টিক হিন্দি গান বেজে চলেছে। ফারাজকে এমন অবস্থায় দেখা মাত্র বর্ষায় অন্তর অব্দি কেঁপে উঠে। সে সম্ভবত মেয়েটার হাতের অনামিকা আঙুলের ফাঁকে আংটি জাতীয় কিছু পড়িয়ে দিচ্ছিলো কারণ ওই সময়ে মেয়েটার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল আর তখন বর্ষার চোখ ভরে উঠে। বুকে যেন আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মনে দহনক্রিয়া বিয়ের রাতেই ঘটে গেছে তবুও আজ আরেকটা বার মনটা পুড়ে ছাড়খার হচ্ছে।

বর্ষা রুমে প্রবেশ করতেই ফারাজ তার দিকে একবার আড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তখন তার বুক দুমড়েমুচড়ে যায়।তাকে দেখা মাত্র ফারাজের চোখে রাগের ফুলকা ভাসতে লাগে। ফারাজ রক্তবর্ণ চোখে একবার তাকে পর্যবেক্ষণ করে বিড়বিড় করে নিজে নিজে কিছু একটা বললো। সম্ভবত বর্ষাকে গালি দিচ্ছে সে সবার সামনে চলে আসার জন্য। গতকাল রাতে ফারাজ তাকে শাসিয়ে বলেছিল আজকের প্রোগ্রামে যেন বর্ষা না আসে। বাসায় না থেকে অন্যকোথাও চলে যায়। কিন্তু বর্ষার যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই বিধায় রান্নাঘরে ছিল। অন্যান্য সার্ভেন্টদের সঙ্গে কাজে সাহায্য করছিল।

দুজনের মধ্যে দৃষ্টিবিলাশ ঘটে। একজনের চোখে ঘৃণা!এবং অপমানিত হওয়ার কষ্ট। তো অপরের জনের চোখে আনন্দ! কাউকে ছোট করার,অপমান করার পৈশাচিক আনন্দ । এবারে ফারাজ আরো এক কদম এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত শক্ত করে ধরে বলে, টিয়া আই লাভ ইউ। উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড?

টিয়া নামের মেয়েটা যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে বিষ্মিত হয়ে গেলো। বড় একটা ঢোক গিললো।

ফারাজ আবারো তাড়া দিয়ে বলে উঠে, কি হলো উত্তর দাও!

মেয়েটা হেসে বলে, অফ কর্স জান আই লাভ ইউ। তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায়?
ফারাজ তার উত্তর শুনে হালকা হাসলো। এরপর সে আরো একটু এগিয়ে এসে যখন টিয়ার কপালে চুমু খাবে ঠিক সেই মুহুর্তে বর্ষা তাদের সামনে এসে বলে, এসব কি করছেন আপনি? লজ্জা করেনা একটা পরনারীর সঙ্গে এতো খোলামেলা ভাবে মিশতে তাও আবার সবার সামনে? মানুষ পাপ লুকিয়ে করে আর আপনি জন সম্মুখে ছিঃ!

বর্ষার কথায় উপস্থিত সবার মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। তবে ফারাজ বেশ বিরক্ত হয়। সে একটা হাই তুলে বলে, তোমার এতো সমস্যা হলে চোখ বন্ধ করে থাকো মেয়ে। এতো পকপক করার দরকার নেই৷

— সবসময়ই চোখ বুজে থাকো যায় না।

ফারাজ বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করে বলে, তাহলে মুখ বুজে সহ্য করো।

ওই সময় ফারাজের এক বন্ধু বলে উঠে, দোস এই মেয়েটা কে রে? তোদের বাসায় আগে তো কোনদিন দেখি নি। তোর কাজিনদের তো চিনি। কে মেয়েটা?

এই প্রশ্নের উত্তরে ফারাজ বেশ উৎসাহের সাথে বলে, আমাদের বাসার নতুন সার্ভেন্ট। আব্বা গ্রাম থেকে নিয়ে আসছে। বাসায় রান্না-বান্নার কাজ করবে।ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখবে। বেতন মাসে বারো হাজার।

কথাটা বর্ষার কানে যেতেই তার চোখ ফেটে কান্নারা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো।মনে হচ্ছে কেউ তার হৃদয়ে পাথর নিক্ষেপে করে ক্রমশ আঘাত হানছে।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো পবিত্র সম্পর্ককে ফারাজ কি করে পারলো এভাবে ছোট করতে? নিজের বউকে কিভাবে সবার সামনে অকপট ভাবে কাজের মেয়ে বলে পরিচয় দেয়৷আবার বেতনের কথা বলে তার মূল্য নির্ধারণ করে! বর্ষার এই মূহুর্তে এ বাসা থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে৷ কিন্তু সে নিরুপায়। অদৃশ্য শিকলে তার হাত-পা বাঁধা পড়ে গেছে যেন৷ ঢাকা শহরে একেবারে নতুন। কিছু-ই চেনে না। পালিয়ে গিয়ে যাবে কই?এতো সাহস তো তার মধ্যে নেই যে ফারাজের মুখে থাপ্পড় মেরে বেরিয়ে যাবে৷ এতো স্পর্ধা বা সাহস কোনটাই তার মধ্যে নেই৷সে ছোটবেলা থেকেই ভীতু আর নরম প্রকৃতির।

ফারাজের বন্ধু বলে উঠে, দেখে তো সার্ভেন্ট মনে হচ্ছে না। ভালো জামা-কাপড় পড়ে আছে ভালো ঘরের মেয়েই লাগছে….

— আমাদের বাসায় সার্ভেন্টদের পরিবারের সদস্যদের মতো ট্রিট করা হয়।

বর্ষা হতবিহ্বল চাউনিতে ফারাজের দিকে তাকালো। মাত্র তিন দিন আগে তাদের ছোট করে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। আর এই তিনের মধ্যে সে এই বাড়ির বউ থেকে কাজের মেয়েতে পরিনত হলো? বাহ কি চমৎকার নীতি। আগেই বলে দিত যে বাড়ির বউ না কাজের মেয়ে চাই রান্না-বান্নার জন্য। তাহলে বিয়ের শাড়িটা কিনে দিয়ে অযথা পয়সা খরচ হতো না।

ফারাজ তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই যে মেয়ে আমার জন্য এক কাপ কফি আনো তো। মাথা ধরেছে।

বর্ষা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এক পাও নড়লো না।শুধু আদেশকারীর দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ফারাজ সবার সামনে তাকে ধমকে বলে উঠে, মন কোথায় তোমার? কফি আনতে বলেছি না? যাও কফি বানিয়ে আনো। গো।

ফারাজের ধমকে মৃদ্যু কেঁপে উঠে সে। ততোক্ষনে ঘটনার আকষ্মিকতার রেশ কেটে গেছে তার। সে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। আজকে ফারাজের ব্যবহারে তার মোটেও অবাক হওয়া উচিত হয়নি। সে তো বিয়ের পরের দিনই বলে দিয়েছে যে এই বিয়ে মানে না।এমন কি তাদের বাসর রাতও হয়নি। বাসর রাতে ফারাজ লাপাত্তা ছিল। সে রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

বর্ষা রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিয়েই ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি জন্য? তার স্বামী তাকে মেনে নিচ্ছে না এইজন্য নাকি তাকে সার্ভেন্ট হিসেবে দেখছে সেজন্য? উত্তরটা বর্ষার জানা নেই।কিন্তু সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, আজকের দিনের ঘটনার জন্য হলেও তাকে ফারাজের উপর প্রতিশোধ নিতে হবে। কাউকে ছোট করা বিবেকের আদালতে সবচেয়ে বড় অপরাধ!

সে চুলায় পানি গরম করতে দিয়ে চোখের পানি ওড়না দিয়ে মুছে ফেলে। ওই সময় রান্নাঘরের দিকে একজন গেস্ট এসে বলে, এই যে বুয়া এক গ্লাস পানি দাও তো।

বর্ষা কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়ালো। তার কি করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছে।আগত মেহমানের কথায় সে ভীষণ কষ্ট পেল।

কখনো কখনো মানুষ নিষ্ঠুরতম কথা বলে। প্রচুর নিষ্ঠুরতা করে।

আচ্ছা বুয়া না বলে যদি ভাবী বলে সম্মোধন করত তবে কি বর্ষা খুশি হত? কে জানে? সে গ্লাস এগিয়ে দিল।

এরপর কফি বানিয়ে ফারাজের কাছে গেলো। ফারাজ আর বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলার আয়োজন করছে।তাকে দেখা মাত্র সে বাঁকা হাসল এবং কাপটা হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এক চুমুক দিলো। কফির কাপে চুমুক দেওয়া মাত্র সে মুখ-চোখ কুচকে ফেলে। তারপর রাগী চোখে বর্ষার পানে তাকিয়ে কফির কাপটা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বলে, সামান্য কফিটাও বানাতে পারো না?এতো মিষ্টি কেন? গ্রামের ক্ষ্যাত মেয়ে কফি খাওনি কোনদিন?

বর্ষা শান্ত গলায় উত্তর দেয়, না খাই নি।

ফারাজের তখন মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, চোখের সামন থেকে দূর হও।

বর্ষা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলো। নড়াচড়া থামিয়ে দিয়েছে যেন। ফারাজ উঠে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, যাও রুমে যাও। এদিকে আর আসবা না।

বর্ষার মধ্যে কোন ভাবান্তর ফুটে উঠলো না। সে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকে। উপায় না পেয়ে তার হাতে চেপে ধরে ফারাজ প্রায় এক প্রকার জোর করে তাকে পাশের রুমে নিয়ে গেলো এবং দরজা আটকে দিলো বাহির থেকে। বর্ষা এতোক্ষণ নির্বিকার থাকলেও দরজা লক করে দেওয়া মাত্র, দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠে, দরজা খুলে দিন ফারাজ। ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

ফারাজ ওপাশে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে বলে, পার্টি শেষ হওয়ার আগ অব্দি লক খোলা হবে না। মানা করা সত্ত্বেও কথা শুনো না কেন?

ফারাজ বর্ষাকে রুমে আটকে রেখে ড্রয়িং রুমে ফিরে আসতেই তার এক ফ্রেন্ড বলে উঠে, কি রে দোস্ত?তোর কয়জন লাগে? হু?সুন্দরী কাজের মেয়ে দেখা মাত্র হাত ধরাধরি শুরু। দেখিস আবার কন্সিভ যেন না করে। হাহাহা।

–মুখ সামলে কথা বল। বলার আগে কাকে কি বলছিস ভেবে নিবি।

তার বন্ধু হাসা থামিয়ে বলে, মামা শান্ত হ। জাস্ট কিডিং।

ফারাজ রক্তবর্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ওকে কাজের মেয়ে বলে ডাকবি না।

— আজব তো! কাজের মেয়েকে কাজের মেয়ে বলে ডাকব না?

— না।

চলবে।

#আমার_শহরে_রংধনু_উঠেনা
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–1

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here