#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সূচনা_পর্ব
কারোর মরণা’স্ত্রে নিজের বাগদত্তার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে কল্পনাতীত ছিলো শান্তর। ইরশাদের মুখে কথাটা শুনতেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গেল। ক্ষণ সময় মৌনতাই ছিল তার সঙ্গী। স্যারের সাড়াশব্দ না পেয়ে ইরশাদ ভাবল ফোনটি বুঝি কেটে গেছে। সে নিশ্চিত হতে একবার নিজের মোবাইলের দিকে তাকালো। লাইনটা কাটে নি। সে ধীর স্বরে শুধালো,
“স্যার শুনছেন?”
“তুমি কি শিওর ইরশাদ?”
শান্তর কণ্ঠ থমথমে, শীতল, স্থির। নবনীতা নামক নারীটি স্যারের জীবনসঙ্গিনী হতে চলেছেন। হয়তো সামনের মাসেই তাদের বিবাহ। শান্তর নবনীতার প্রতি আলাদা রকমের টান রয়েছে। ইরশাদ প্রথম দিন থেকেই সেটা খেয়াল করেছে। টানটা বেশ প্রগাঢ় না হলেও সেই টানটা স্বাভাবিকের চেয়ে দৃঢ়। তাই ইরশাদ অতি সতর্কতার সহিত বলল,
“জি স্যার, আমি শিওর। আমার হাতেই রিপোর্টটা”
“রেখে দাও। ওইটার এখন প্রয়োজন নেই”
“কিন্তু স্যার…”
“কেস ক্লোজ ইরশাদ, এ নিয়ে কথা বাড়িও না”
ইরশাদের কথাটার মাঝে চরম নিষ্ঠুরতার সাথেই বাধ সাধলো শান্ত। তার কন্ঠের কাঠিন্য বাড়লো। দৃঢ় কণ্ঠে হুকুমের স্পষ্ট প্রকাশ। ইরশাদ বিস্মিত স্বরে বলল,
“স্যার, আপনি কি ডিআইজি স্যারকে রিপোর্ট জমা দিয়ে ফেলেছেন?”
“হ্যা, স্যার সাইন করে দিবেন। তাই এখন থেকে আমরা নিয়ন, দোলা কিংবা সময় কাউকে নিয়েই কথা বলবো না”
“আমরা কোনো ভুল করছি না তো স্যার? এমনটা তো নয় একটি নির্দোষ ছেলের উপর দোষ চাপানো হচ্ছে”
বেশ ক্ষিপ্ত স্বরেই কথাটা বলল ইরশাদ। ইরশাদ ছেলেটি চট করেই নিয়ন্ত্রণ হারায় না। সে রাগে না, প্রচন্ড গোবেচারা ধরণের সে। শান্ত প্রায়শই তার খিল্লি উড়ায় কিন্তু তার মাঝে খুব একটা অভিপ্রকাশ লক্ষ করা যায় না। এই প্রথম সে হুকুম পালনে নারাজ, তার অভিব্যক্তি প্রকাশের তৎপরতা দেখে স্তিমিত স্বরে শান্ত বলল,
“তুমি কি নবনীতাকে খু/নী হিসেবে ভেবেই নিয়েছো?”
“না ভাবার তো কারণ নেই”
“আছে, একটি নিরস্ত্র মেয়ে রাতের বেলায় একটি ছেলের বাসায় যেয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে হ/ত্যা করবে এটা কি সত্যি বাস্তব?”
“যদি আমরা কোনো তদন্ত ই না করি তবে বাস্তবতার পরিক্ষিত হবে কি করে?”
“সঠিক প্রশ্ন। তুমি সত্যি অনেক বুদ্ধিমান। দশে দশ পেয়েছো। বেশ, তুমি তোমার তদন্ত চালিয়ে যাও, আমি বাধা দিবো না। কিন্তু আমাকে কিছু জানাবে না। আমার জন্য কেস ক্লোজ”
“আপনার এত দায়সারাভাব কি নিজের বাগদত্তার কারণে? তাই নিজের দায়িত্বকেও হেলা করছেন?”
“ঠিক বলেছো। আমি চাই না কেসটার কোনো তদন্ত হোক। আমি নবনীতাকে বিয়ে করে সুখী জীবন কাটাতে চাই, হ্যাপি ফ্যামিলি। আমি তো কোথায় হানিমুনে যাব সেটাও ভেবে নিয়েছি। শুধু শ্বশুরটার মাজা ভাঙ্গা। ওইটা ঠিক হলেই বিয়ের মহাকার্য সম্পাদিত হবে। ভালো হবে না?”
খট করে ফোন কেটে দিল ইরশাদ। ইরশাদকে এখন চরম মাপের বে’য়া’দ’ব বলে আখ্যায়িত করতে ইচ্ছে করছে শান্তর। কথাটা তার এখনও শেষ হয় নি। অথচ বিনা জবাবেই বে’য়া’দ’ব ছেলেটা ফোন কেটে দিয়েছে। শান্তর হৃদয় বড় মাপের তাই সে কিছু বলবে না। শান্তর মুখখানা স্বাভাবিকরুপ নিল। তার মাঝে খুব একটা পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হল সে আগ থেকেই এমন কিছু একটা আন্দাজ করেছিল, শুধু ইরশাদের নিশ্চিত করায় কিছুটা ভড়কেছিল। এখন আবার সব স্বাভাবিক। তাইতো, ফুরফুরে চিত্তে ফোন লাগালো নবনীতার নাম্বারে। মেয়েটি হয়তো এখন পার্কে বসে আছে। তাকে সময় দিয়েছিলো সাড়ে সাতটার সময় কিন্তু এখন সোয়া আটটা বাজে। মেয়েটি এখনও পার্কেই আছে? জানা দরকার। অপেক্ষা এমন একটি তিক্ত অনুভূতি যা কেউ অনুভব করতে চায় না। কিন্তু মানুষ অপেক্ষা করাতে পছন্দ করে। কেউ নিজের সময় কিছুকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে তাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনবে এটা যেকোনো মানুষের কাছেই বেশ আনন্দদায়ক অভিপ্রায়। শান্ত ও ব্যতিক্রম নয়, সে খুব করে চায় নবনীতা যেন পার্কেই অপেক্ষা করে। সে খুব করে চায় নবনীতা যেন তার অপেক্ষা পার্কের লৌহগেটের দিকে এক আকাশসম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সে খুব করে চায় যেন নবনীতা ফোন ধরা মাত্রই মেকি রাগের ঘনঘটা দেখিয়ে বলবে,
“আপনি কি আসবেন নাকি আমি চলে যাব?”
কিন্তু তার অভিলাষার সিড়িটা বেশিদুর আগালো না। নবনীতা ফোনটি ধরলো ঠিকই, কিন্তু কাঁপা স্বরে বলল,
“আমি তারে দেখেছি, মাস্কধারী মানুষটি আমার সামনে। আপনি আসুন, তাড়াতাড়ি আসুন”
নবনীতার কথায় ভীষণভাবে চমকালো। অস্থির স্বরে বলল,
“তুমি কোথায়? আর কে মাস্কধারী মানুষ?”
নবনীতা উত্তর দেবার আগেই খট করে ফোনটি কেটে গেল। তারপর বারবার নাম্বারটিতে ফোন করলেও তা বন্ধ ই আসল। ফলে শান্ত স্থির চিত্ত মুহূর্তেই অস্থির হয়ে গেল। এক মুহূর্ত সে অপেক্ষা করল না সে। দ্রুত গতিতে প্রস্থান করল স্থান। গন্তব্য নবনীতা____
******
অপলক ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে নবনীতা। নিলয়ের মুখশ্রীতে বিস্ময়। তার হাতে একটি কালো মাস্ক। মাস্কটির উপর বাঘ এর একটি কারুকাজ করা। কিন্তু এই মাস্কটি তার নয়। তার ব্যাগে কি করে এল তার জানা নেই। কিন্তু নবনীতার তীক্ষ নয়নে স্পষ্ট অবিশ্বাস। আজ নিজের দুই যুগের বন্ধুত্বকে সে অবিশ্বাস করছে নবনীতা। নিলয় তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে সে পিছিয়ে যায় দু কদম। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের দৃষ্টিতে ভয়। যেন প্রাণের সংকট। নীলয় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, আকুতির স্বরে বলল,
“বিশ্বাস কর নীতু এই মাস্ক আমার না”
“আমার কাছে আসবি না।“
নবনীতার আচারণে বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে পৌছালো নীলয়। একটু এগিয়ে এসে কাতর স্বরে বলল,
“তুই এমন অস্বাভাবিক আচারণ কেন করছিস নীতু। আমার ই ভয় করছে”
“বলেছি না কাছে আসবি না। আমি স্বাভাবিক ই আছি। অস্বাভাবিক তো তুই। এই মাস্কটা তোর নাহলে এখানে কেন এটা?”
“আমি নিজেও জানি না নীতু। এই মাস্ক আমার না। আর একটা মাস্কের জন্য এত ভয় পাচ্ছিস তুই? আমাকে এমন ভাবে দেখছিস যেন আমি কোনো ক্রি’মি’না’ল”
নবনীতা আর স্থির রইল না। কাঁপা স্বরে বলল,
“হ্যা, তুই ক্রি’মি’না’ল। তুই ই খু/ন করেছিস দোলা, নিয়ন আর সময়কে। নিয়নকে তো তুই সহ্য করতে পারতি না। সেই বদলাই নিয়েছিস তুই”
“কি যা তা বলছি”
“আমি তোকে দেখেছি। সত্যি করে বল আমাকে কেন ফাসাচ্ছিস তুই?”
নবনীতার দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নীলয়। তার দৃষ্টিতে বিমূঢ়তা। মস্তিষ্ক বাস্তবের ঘটনাগুলো মানতে পারছে না। নিজের প্রিয় মানুষটিকে এমন অস্বাভাবিক আচারণ করতে শেষবার দেখেছিল তুষারের নিখোঁজের দিন। সেদিন ও এমন পাগলের মত আচারণ করছিলো নবনীতা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল চিরচেনা শান্ত, চুপচাপ মেয়েটি। উন্মাদের মত চিৎকার করছিল সে। কিন্তু সেই নবনীতাকে একদিন বাদেই গায়েব করে ফেলেছিল বাস্তববাদী নবনীতা। কিন্তু আজ এত বছর পর সেই নবনীতাকে আবারো চোখের সম্মুখে দেখছে নীলয়। নিজেকে খুব কষ্টে শান্ত করল নীলয়। বন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা এগিয়ে এলো। নীলয়ের আগানো দেখে ঘাবড়ে গেল নবনীতা, এলোমেলো পায়ে পেছাতে লাগলো। পেছাতে গিয়ে পার্কের ময়দানের অবহেলিত ইটের টুকরোতে পা বিঁধে পড়ে গেল সে। সাথে সাথেই হাটুতে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হল। নীলয় এক মুহূর্ত প্রতীক্ষা না করেই ছুটে গেলো নবনীতার সাথে। তাকে সামলানোর চেষ্টা করলো। নীলয় ছুঁতে আসলেই হাত পা ছুড়তে লাগলো নবনীতা। ভীত, সন্ত্রস্ত মেয়েটি যেন নিজেকে বাঁচাবার প্রচেষ্টা চালালো। ফলে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেল যেন। পার্ক তখন জনশূন্য প্রায়। ফলে নবনীতা ব্যথিত আর্তনাদ খুব একটা দূরে যাচ্ছে না। অবশ্য নবনীতা বেশ জোরে চিৎকার ও করছে না। সে শুধু নীলয় থেকে পালাতে চায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই পার্কে উপস্থিত হল শান্ত। দূর থেকে দৃশ্যটিকে দেখে মনে হল নীলয় যেন নবনীতার সাথে জো’র’জ’ব’র’দস্তি করছে। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করেই নবনীতাকে নীলয় থেকে ছাড়ালো সে। ধাক্কার প্রবল জোরে বেশ দূরে ছিটকে গেল নীলয়। ক্লান্ত, বিভ্রান্ত নবনীতাকে ভয়ার্ত সরু দেহ কাঁপছে। শান্ত তাকে স্পর্শ করতে সব ভুলে সে শান্তকে জড়িয়ে ধরল। আকুল স্বরে বলল,
“আপনি এসেছেন”
নবনীতার কণ্ঠে স্বস্তির স্পষ্ট প্রকাশ। শান্তর বলিষ্ঠ বুকে ভীত মুখখানা লুকিয়ে রাখলো সে। তার শরীর ঘেমে গেছে ধস্তাধস্তিতে। শান্তর কঠিন দৃষ্টি পড়ল নীলয়ের দিকে। নীলয় অপরাধী কণ্ঠে বলল,
“আপনি ভুল বুঝছেন। আমি কিছুই করি নি”
“সেটা আমি কাল বুঝে নিব”
বলেই পাজাকোলে তুলে নিল নবনীতা। নবনীতাকে এখন শান্ত করা প্রয়োজন। ব্যাপারটি বেশ অবাক লাগছে শান্তর। শান্ত, ধীর, পরিপাটি মেয়েটিকে এমন ভীত, কাবু, নিয়ন্ত্রণহীনরুপে দেখবে কখনো ভাবে নি। কি হয়েছে সেটা জানা খুব ই জরুরি। তার পূর্বে নবনীতাকে শান্ত করা প্রয়োজন। তাই বিলম্ব না করে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল শান্ত।
*********
যাত্রীছাউনিতে পা দুলিয়ে বসে আছে নবনীতা। আকাশে তখন কৃষ্ণাভ মেঘের বিস্তরণ। চাঁদটা সেই মেঘের ভিড়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। ল্যাম্পপোষ্টের বাল্বটা থেমে থেমে জ্বলছে আর নিভছে। সেই আলোর মাঝেই দেখা যাচ্ছে শান্তকে। কঠিন শ্যাম মুখ, হাতে একটি বেনসন। অবিমিশ্র বাতাসটিকে কলুষিত করছে নিকোটিনের ছাই ধোঁয়া, সেই সাথে পুড়ছে খয়েরি ঠোঁট জোড়া। নবনীতা এখন অনেকটাই শান্ত। তার ভয়টা ক্ষীন। শান্ত একটিবারও তাকে কারণ শুধায় নি। শুধু শুধিয়েছে,
“এখন কেমন লাগছে?”
কিছুটা সময় নীরবতায় কাটানোর পর নবনীতা ধীর গলায় বলল,
“আপনি কি একটু পাশে এসে বসবেন?”
হাতে থাকা বেনসনটা বিনাদ্বিধায় ফেলে দিল শান্ত। তার রক্তিম লাভা বুজালো পা দিয়ে। তারপর দায়সারা ভাবে পাশে বসল। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“বল”
“আপনার কি জানার কিছুই নেই?”
“আমি আজ তোমায় কোনো প্রশ্ন করবো না নবনীতা। তুমি নিজ থেকে যা বলবে আমি শুনব। আমি সব শুনবো। তোমার স্বপ্ন, তোমার বাস্তব”
বেশ গাঢ় স্বরে কথাটা বলল শান্ত। তার কথায় কাঠিন্যের ছোঁয়া নেই। মুখের নির্লিপ্ততা কথাটির সাথে বেমানান। ফলে নবনীতার কোমল হৃদয়টা হুহু করে উঠলো। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কেউ ফাসাতে চায়। কে কেনো জানি না। শুধু এতোটুকু জানি, সময়ের খু/নের সময় আমি সেখানেই ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু খু/ন করি নি”
“আমি জানি”………
চলবে
[প্রথম পরিচ্ছেদের অন্তিম থেকে সূচনা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের, কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি