আমি তারে দেখেছি পর্ব -০২

#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#২য়_পর্ব

“আমি আজ তোমায় কোনো প্রশ্ন করবো না নবনীতা। তুমি নিজ থেকে যা বলবে আমি শুনব। আমি সব শুনবো। তোমার স্বপ্ন, তোমার বাস্তব”

বেশ গাঢ় স্বরে কথাটা বলল শান্ত। তার কথায় কাঠিন্যের ছোঁয়া নেই। মুখের নির্লিপ্ততা কথাটির সাথে বেমানান। ফলে নবনীতার কোমল হৃদয়টা হুহু করে উঠলো। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কেউ ফাসাতে চায়। কে কেনো জানি না। শুধু এতোটুকু জানি, সময়ের খু/নের সময় আমি সেখানেই ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু খু/ন করি নি”
“আমি জানি”

শান্তর স্তিমিত বাক্যে তার চোখে চোখ রাখে নবনীতা। শান্তর দীঘির স্রোতহীন পানির ন্যায় অটল চাহনীর দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নবনীতা। তার মনে হাজারো প্রশ্ন, শুধু ঠোঁটের কাছে এসেই যেগুলো থমকে যাচ্ছে। শান্তর চোখের ভাষা বড্ড অপরিচিত। মদনকুমার তর্কালংকারকে এতোদিন কেবল ঠাট্টা, ফাজলামির চাঁদরেই দেখেছে। তার চোখে ছিলো দুষ্টুমির ছোঁয়া, সবকিছুতে তার দায়সারা একটা ভাব। কিন্তু আজ তেমনটা নেই। অনিমিখ তার দৃষ্টি, শান্ত, স্থির, অবিচল। অথচ নবনীতার কথায় তার খুব বিস্মিত হবার কথা, প্রশ্নের বানে ঝাঝড়া করে দেবার কথা নবনীতাকে। অথচ তেমন কিছুই হল না। নবনীতা কাঁপা স্বরে বলল,
“আপনি জানেন?”
“সময়কে মৃ’ত্যুর দ্বারে পৌছে দেওয়া সেই ছু’রিতে তোমার ছাঁপ পাওয়া গেছে। আমার ধারণা খু’নী দ্বিধারহস্য তৈরি করতে এমনটা করেছে। দেখো নিয়নের হ’ত্যা সে প্রথমে আত্মহ’ত্যা দেখাতে চাইলো, দোলারটাও। তারপর সেই সব খু’নের দোষ ইচ্ছে করেই দিল সময়ের ঘাড়ে। এত জটিলতা যার মনে সে অন্তত পক্ষে নিজেকে শেষ করবে না। আর মজার ব্যাপার কি জানো সময় বাঁ-হাতি, তাই নিজের বাঁ-হাত নিজে কাঁ/টা তার পক্ষে অসম্ভব। খু/নী একটু বোকা, সে অহেতুক রহস্য বানাতে যেয়ে নিজেই ফেসে যাচ্ছে, এজন্যই তোমার আঙ্গুলের ছাঁপটা ওখানে রেখে এসেছে। যেন সন্দেহের বান তোমার দিকে ঘুরে”

স্মিতস্বরে কথাগুলো বলল শান্ত। কিন্তু কথাগুলো নবনীতার উচাটন কমাতে পারলো না। নবনীতা মলিন স্বরে বলল,
“আমি সত্যি সেখানে ছিলাম, শান্ত”
“ছিলে মানে?”
“আমি সময়ের খু/ন হতে দেখেছি স্বপ্নে। শুধু তাই নয় আমি যখন চোখ মেলি আমার জামায়, রক্ত লাগানো ছিলো। মনে আছে আমি আপনার সাথে স্পটে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে লুকিয়ে আমি রক্তের স্যাম্পল নিয়েছি”
“আর সেটা তোমার জামার রক্তের সাথে মিলে গেছে?”

নবনীতা মাথা নাড়ল। শান্তর কপালে এবার ভাঁজ পড়ল। চিন্তার উদাসীন মেঘেরা জড়ো হল মস্তিষ্কে। সে সময়ের বাসার বাহিরের সিসি ক্যামেরা চেক করতে চেয়েছিলো, কিন্তু আফসোস সেটা নষ্ট ছিলো। কেউ আগ থেকেই সেটা নষ্ট করে রেখেছে। সুতরাং খু’নের দিন কে ভেতরে ঢুকেছে বা বের হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। তাই নবনীতা সেই রাতে যে সময়ের বাড়িতে ছিলো কি না সেটার কোনো প্রমাণ শান্তর কাছে নেই। সে ভেবেছিলো নয়তো নবনীতাকে ফাঁসানোর হয়তো তার ফিঙ্গার প্রিন্ট কেউ প্লেস করেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট সাজানো কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এখন তো তার ধারণাগুলো কেমন জট পাকাচ্ছে। শান্ত বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“এমন কি তোমার সব স্বপ্নের ক্ষেত্রেই হয়? মানে সব স্বপ্ন ই বাস্তবে রুপ নেয়?”
“আমার স্বপ্ন সত্যি হয়, কিন্তু আমি স্বপ্ন থেকে বেড়িয়ে আসার পরও স্বপ্নের রেশ থেকে যায় না। কিন্তু এই প্রথম ই এমন হল। যেন স্বপ্ন নয় আমি বাস্তবেই সেই জায়গায় ছিলাম। আমি স্বচক্ষে দেখছি সবটা। অথচ যখন চোখ খুলেছি তখন নিজেকে আমার রুমেই পেয়েছি। আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। ধোঁয়াশা লাগছে সবটা। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার বুঝি ভ্রম হচ্ছে, কিন্তু না যখন ব্লাড টেস্ট করলাম আর স্যাম্পল মিলে গেলো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেলো”

নবনীতা নতমুখে বসে রয়েছে, তার কন্ঠ কাঁপছে রীতিমত। শান্তর চাহনী স্থির, তার চোখের ভাষাটা নির্লিপ্ত। কি ভেবে কিছুটা এগিয়ে এসে বসলো। রুক্ষ্ণ হাত আলতো করে রাখলো নবনীতার কোমল হাতের উপর। খুব স্বাভাবিক ভাবে শুধালো,
“আচ্ছা, তুমি প্রথম কখন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছো বলো তো”

নবনীতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো শান্তর দিকে। শান্তর চোখের মাঝে তীর্থের কাকের মত ভরসার ছায়া খুঁজল। এই কথাগুলো কেউ বিশ্বাস করে না। মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেয়। নিজের বাবা-মাও হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছেন তার কথাগুলো। তাহলে এই স্বল্প পরিচিত মানুষটি কেন বা তাকে বিশ্বাস করবে! তবুও কাঙ্গাল, বুভুক্ষু হৃদয় খড়কুটো হাতরায়। একটি বিশ্বাসের হাত, যে দরাজ কন্ঠে বলবে,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি”—- নবনীতা সেই প্রত্যাশায় ই কাতর নয়নে তাকিয়ে শান্তর পানে। শান্ত মৃদু হাসলো। শ্যাম মুখে হাসিটা বড্ডবেশি অমায়িক লাগলো যেন। শান্ত হাসি অক্ষত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি শ্যামলী, তুমি যা বলবে আমি বিশ্বাস করবো। যুক্তি দাঁড় করাবো না, কথা দিলাম”

শান্তর কথাটা হাসফাঁসের গ্রীষ্মের দক্ষিণা হাওয়ার মত লাগলো। নবনীতা এক এক করে সবটা খুলে বললো। প্রথম কবে সে অনুভব করে তার স্বপ্ন সত্যি হয়, দাদাজানের মৃত্যু, তার স্বপ্নের মাঝে পরিবর্তন, সবকিছু এক এক করে খুলে বললো শান্তকে। শান্ত পালটা কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু চুপ করে সবটা শুনলো। তার মুখোভাবে নির্লিপ্ততা, যেন গল্পগুলো খুব ই স্বাভাবিক। অথচ একটু শীতল মস্তিষ্কে চিন্তা করলে ষোড়শীর কাছে ব্যাপারগুলো বড্ড ভয়ংকর। গল্পের এক পর্যায়ে এসে ক্ষান্ত দিল নবনীতা। চুপ করে গেলো। চুপটির নাম “তুষার”। শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই তুষার নামটিতে আসলেই তুমি থেমে যাও কেন শ্যামলী। আমি তোমার জীবনের উপন্যাসটি পড়ছি, এখানে অন্তত লুকোচুরি করো না”
“এই অধ্যায়টি আপনার ভালো লাগবে না”
“সেটা আমাকেই বুঝতে দাও না হয়”

নবনীতা ঠোঁট কামড়ালো। তার মাঝে দ্বিধাদন্দ। কিছুটা অস্বস্তি। তবুও সব অস্বস্তির কুয়াশা চিরে ধীর স্বরে বলল,
“তুষার আমার এক পাক্ষিক আবেগ ছিলো”
“কেবল আবেগ?”
“হ্যা, আবেগ ই। কারণ আবেগের রেশ ই ক্ষণস্থায়ী হয়”
“তাহলে বলছো, ওই ছোকরার প্রতি তোমার অনুভূতিগুলো এখন ঝাপসা হয়ে গেছে? সেই প্রগাঢ় মায়াটি তুমি কাটিয়ে ফেলেছো?”

নবনীতা চুপ করে রইলো। সে তুষারের মায়া এখনো কাটিয়ে উঠে নি। প্রায় দু বছর কেটে যাবার পর ও সেই মায়া কাটে নি। এখনও নামটি তাকে কষ্ট দেয়, এখনো নামটি শুনলেই উচাটনের জোয়ার হৃদয়কে ভাসিয়ে দেয়। এখনো তার চোখ ছলছল করে, তিক্ত ব্যাথায় কাতর হয় অন্তস্থল। এখনো, এখনো। তবুও কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল,
“এখন আর মায়া নেই”
“তা সেই মানুষটি কোথায়?”
“মা’রা গিয়েছে”
“মা’রা গিয়েছে?”
“হ্যা, যদিও আপনি কাউকে শুধালে তারা বলবে সে নিখোঁজ। কিন্তু আমি দেখেছি তার মৃত্যু”
“স্বপ্নে?”
“হ্যা, সে আত্ম/হ/ত্যা করেছে। একটি মানুষ হুট করেই নিখোঁজ হতে পারে বলুন? পারে না। যেখানে আগেরদিন ও আমার সাথে কথা বলেছে সে। আমাকে বলেছিলো, “আমাদের দেখা হবে না আর, ভালো থেকো”। তার পরদিন থেকেই সে নিখোঁজ”
“তুমি তাকে পালটা প্রশ্ন করো নি?”
“মুখ ছিলো না কিছু বলার। কি বলতাম? কিভাবে সান্ত্বনা দিতাম? সবাই মিলে যে ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুও পায়ে পিষে ফেলেছিলো”

শান্তর কপালে আবারো ভাঁজ পড়লো। বিস্মিত স্বরে বলল,
“কেনো? কি হয়েছিলো ওর সাথে?”
“তুষার খুব সাধারণ একটি ছেলে ছিলো জানেন? খুব কম কথা বলতো, ভিড় এড়িয়ে চলতো। সবার চোখ এড়িয়ে নিজের একটি ছোট দুনিইয়া ছিলো যেন তার। এটাই অনেকের চক্ষুশুল হলো। বিনাকারণে তাকে টার্গেট করা হলো। আমাদের ক্লাসের বড় লোকের বকে যাওয়া ছেলেপেলেগুলো তুষারের উদাসীনতা সহ্য হল না যেন। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কেনো কাউকে পাত্তা দিবে না। কেন তাদের জি হুজুর হ্যা হুজুর করবে না। ফলে তারা নানাভাবে ওকে উত্যোক্ত করত। এই ভাগে প্রথম ছিল আমাদের নিয়ন, শ্রীবাস, রাকা। তাদের ধারণা ছিলো সবাই তাদের চাকর। সবার উপর নিজেদের আধিপত্য। তুষার তাদের এই আধিপত্য অস্বীকার করাতেই ক্ষোভের দাবানল বিস্ফোরিত হল। তুষারকে ওরা জালিয়াতির অভিযোগে ফাঁসালো। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ওর ব্যাগে নকল পাওয়া গেল। বিনা কারণে ওকে রাস্টিকেট করা হল। তারপর ছড়ানো হলো সে মেয়েদের আপত্তিকর ছবি বানায়। ফলে সবার চোখে তার সম্মান ধুলো হয়ে গেল। ছেলেটির শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ফেলল ওরা। তাই বাঁচার চাহিদাটুকু শেষ হওয়া ভুল কিছু নয়। এই যে আজ তার সকল অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ হল, কিন্তু সে তো নেই”
“তুমি জানতে তুষার নির্দোষ?”

নবনীতা মাথা নাড়ালো। চাঁপা স্বরে বলল,
“অনেকেই জানতাম, আমরা তুষারকে নির্দোষ ও প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগ পেলাম কোথায়?”

শান্ত কিছু একটা ভেবে বলল,
“ভাগ্যের কাছে সবাই পুতুল। তাই আফসোস ই শেষ ঠিকানা। ভুলে যাও। আমার মনে হয় আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত। বাকি গল্পগুলো কাল শুনবো না হয়। আর তুমি ভয় পেও না। কেউ তোমাকে ফাঁসাতে চাইলেও পারবে না। কারণ কেস ক্লোজ। একটা চিন্তার বিষয় রয়েছে, নীলয়ের ব্যাগের মাস্কটা। ওটা নিয়ে পরে চিন্তা করে দেখবো। এখন বাড়ি যাবো”

শান্তর কথায় মাথা দোলালো নবনীতা। উঠে দাঁড়ালেই পায়ের ব্যাথাটা নিজের উপস্থিতির জানান দিলো। শান্ত নিজ হাতে হেলমেট পড়িয়ে নিল নবনীতাকে। বাহুটা আলতো করে ধরে নিয়ে গেল মোটর সাইকেলের কাছে। তখন ই মোবাইলটি ভাইব্রেট করলো। শান্ত মোবাইলের লক খুলতেই একটি মেইলের নোটিফিকেশন পেলো। মেইলটি একটি ভিডিও। ইমেইল আইডিটি খুব এলোমেলো, [email protected]। ভিডিও ওপেন করতেই চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো শান্তর। এটা কি করে সম্ভব………………

চলবে

[আমার একলা আকাশ তোমায় জুড়ে আগামীকাল পাবেন]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here